Logo
×

Follow Us

শিক্ষা

স্কুল-কলেজে রোগ বাঁধাচ্ছে মেয়েরা

Icon

কে এম ওবায়দুল্লাহ

প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২০, ০৯:৫৬

 স্কুল-কলেজে রোগ বাঁধাচ্ছে মেয়েরা

কলেজ জীবনের প্রথম দিনটা কখনোই ভুলবেন না শাহিনা আক্তার। কী অস্বস্তির মধ্যেই না সেদিন পড়েছিলেন। শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি এখন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। 

ওই দিনের ঘটনা স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘ক্লাসের ফাঁকে বাথরুমে গিয়ে মারাত্মক বিপাকে পড়েছিলাম। নোংরা আর স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। দেখেই মনে হচ্ছিল নিয়মিত পরিষ্কার হয় না। দুর্গন্ধে বমি আসছিল। বিদ্যুতের বাল্ব শেষ কবে লাগানো হয়েছে কেউ বলতে পারবে না। সকেটটি ভেঙে বিদ্যুতের তার এমনভাবে ঝুলে ছিল, একটু অসাবধান হলেই যে কোনো মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা। খুব জরুরি হওয়ায় ভাঙা দরজাটা কোনো রকমে টেনেটুনে লাগাতেই টয়লেটের ভেতরটায় নেমে আসে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছিল না তখন। এর মধ্যেই দ্রুত বাথরুম সেরে বের হতেই দেখি বেশ কয়েকজন ছাত্র ঢুকছে। পরক্ষণেই বুঝতে পারি এটি কমন বাথরুম। মেয়েদের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই।’ 

এত বছর পরও পরিবর্তন হয়নি সেই চিত্রের। দেশের বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্যানিটেশন ব্যবস্থা প্রায় একই। এতে করে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছে শিক্ষার্থীরা। মেয়েদের সমস্যা হয় সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে ঋতুকালীন সময়ে তারা স্কুলে যেতে চায় না কোনো ব্যবস্থা না থাকায়। 

বাংলাদেশে নারী শিক্ষার হার দিন দিন বাড়ছে। ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী নারীর সাক্ষরতার হার ৭১.২ শতাংশ। তবে উচ্চমাধ্যমিক ও তার পরের পর্যায়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া মেয়েদের হার অনেক কম। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা পর্যাপ্ত না হলে এ হার আরো কমতে পারে। এর মধ্যে টয়লেট অন্যতম। 

সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের এক প্রতিবেদনেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বেহাল স্বাস্থ্যসেবার চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ছাত্রীদের জন্য পৃথক টয়লেট রয়েছে মাত্র ৩২.৬ শতাংশ স্কুলে। অর্থাৎ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর প্রায় ৬৭ শতাংশ ছাত্রীই এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এর মধ্যে আবার ১৮ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোনো টয়লেটই নেই। 

স্থানীয় সরকার বিভাগের পলিসি সাপোর্ট ইউনিটের উদ্যোগে ন্যাশনাল হাইজিন বেসলাইন সার্ভে করেছিল আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি)। স্বাস্থ্যবিধি চর্চার বিষয়ে ধারণা পেতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে করা এ জরিপে সহযোগিতায় ছিল ওয়াটার এইড বাংলাদেশ। 

এতে দেখা যায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গড়ে ১৮৭ শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে একটি টয়লেট, যেখানে সরকারি মানদণ্ডে প্রতি ৫০ ছাত্রীর জন্য পৃথক টয়লেট ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে। আবার স্কুলগুলোর ৫৫ শতাংশ টয়লেট তালাবদ্ধ থাকে। খোলা থাকাগুলোর মধ্যে মাত্র ২৪ শতাংশ ব্যবহারের উপযোগী। এছাড়া ছাত্রীদের জন্য আলাদা টয়লেট আছে কেবল ১১ শতাংশ স্কুলে। আর ঋতুকালীন ব্যবস্থাপনা রয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ স্কুলে। তাই ৮৬ শতাংশ ছাত্রী এ সময় বিদ্যালয়ে আসতে চায় না। 

এসব চিত্র দেখে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা করতে বলে সরকার। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নত করতে ২০১৫ সালে একটি পরিপত্রও জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, ছাত্রীদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা, ঢাকনাযুক্ত প্লাস্টিকের পাত্র রাখা, ঋতুকালীন বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য একজন শিক্ষিকাকে দায়িত্ব দেয়া, প্রয়োজনে টাকার বিনিময়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখতে হবে। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা মানছে না। 

এজন্য অবশ্য স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটি, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভাব রয়েছে বলে জানায় স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ড্রপ। 

প্রতিষ্ঠানটির প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর ডা. তারেক আলম বলেন, ‘স্কুলের কাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু ওয়াশ খাতের (স্যানিটেশন ও হাইজিন) উন্নয়নে রয়েছে চরম অবহেলা। নতুন স্কুল ভবনে টয়লেট থাকলেও তা পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য নেই লোকবল। নিজস্ব বাজেটেও এ খাতে বরাদ্দ খুবই নগণ্য। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজমেন্ট কমিটি, শিক্ষক, অভিভাবকদের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সবার অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। আর সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর মনিটরিংয়ের পাশাপাশি বাজেটও বাড়াতে হবে।’ 

বিষয়টি স্বীকার করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘টেকসই উন্নয়নের জন্য স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়ন করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে নোংরা টয়লেট বড় বাধা। সেটা কাটিয়ে উঠতে অবশ্য পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিয়েছি। ২০২৩ সালের মধ্যে সব প্রাথমিক স্কুলে ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট নির্মাণ করা হবে। এরই মধ্যে ৫০ শতাংশ স্কুলে সে কাজ শেষ হয়েছে।’

গোপন সমস্যায় বঞ্চিত উপবৃত্তি

দেশে প্রায় ২ কোটি ছাত্রী, এর মধ্যে মাত্র ২০ ভাগ স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার করতে পারছে। আর ৮০ ভাগ মেয়েই বঞ্চিত হচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঋতুকালীন গড়ে ১০ শতাংশ স্কুলছাত্রী স্যানিটারি প্যাড কিংবা স্বাস্থ্যসম্মত উপকরণ ব্যবহারের সুযোগ পায়। অন্যরা পুরনো কাপড় বা অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করে, যা অনেক ক্ষেত্রেই অনিরাপদ। 

আবার এ সময় টয়লেট অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে বেশির ভাগ মেয়ে মাসের ৪ থেকে ৫ দিন ক্লাসে অনুপস্থিত থাকে। এতে করে ক্লাসের পাঠ থেকে তাদের পিছিয়ে পড়তে হয়। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনীয় উপস্থিতি না থাকায় অনেক ছাত্রী উপবৃত্তি থেকেও বঞ্চিত হয়। 

লজ্জার কথা!

ন্যাশনাল হাইজিন ব্যাস লাইন সার্ভে ও ইউনিসেফের তথ্যানুসারে, নোংরা থাকায় বাংলাদেশের বেশিরভাগ স্কুলের টয়লেট ব্যবহারের অনুপযুক্ত। অথচ বছরের পর বছর এ অবস্থা চলার পরও সবাই নিশ্চুপ। এ নিয়ে অভিভাবক, শিক্ষকসহ জনপ্রতিনিধি ও নীতিনির্ধারক মহলও নির্বিকার। 

কারণ অনেকের কাছে টয়লেট ব্যবহার বা টয়লেটের পরিচ্ছন্নতা নিয়ে কথা বলা মানে ‘নোংরামি’, যা সবার সামনে তুলে ধরাকে ‘লজ্জার বিষয়’ বলে মনে করা হয়।

তারা উদাসীন

স্যানিটেশন উন্নয়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি হলেও কোথাও কোথাও রয়ে গেছে সমন্বয়হীনতা। ফলে অগ্রগতির সুফল তো মিলছেই না, উল্টো শুদ্ধাচারের অভাবে পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে। কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও এখন উন্নত টয়লেটের ব্যবস্থা হয়েছে। তবে সেটার রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতও যে নিয়মিত করতে হবে- এ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা উদাসীন। 

স্যানিটেশনের বিষয়ে শিক্ষকরা সচেতন হলেও তারা এখনো জানেন না, এ ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা কী। অন্যদিকে, স্কুলের ফান্ডে অর্থ থাকা সত্ত্বেও ব্যবস্থাপনা কমিটি বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। কোনো রকমে স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করেই দায় সারতে চান তারা। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর টয়লেট নিয়ে তখন ভোগান্তি পোহাতে হয় শিক্ষার্থীদের। 

নামিদের ঘাড়েও দুর্নাম

শুধু গ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চলেই নয়, রাজধানীর অনেক নামি-দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও স্যানিটেশনের সমস্যা রয়েছে। এসব স্কুলে উন্নত টয়লেট থাকলেও মূলত নিয়মিত যত্ন ও দেখভালের অভাবে তা আর ব্যবহারযোগ্য থাকে না। তখন শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই এগুলোর ব্যবহার এড়িয়ে চলে। 

আবার কিছু প্রতিষ্ঠানের ভবন তিন-চার তলাবিশিষ্ট হলেও প্রতি তলায় টয়লেট নেই। এক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীকে অন্য তলায় গিয়ে বাথরুম সারতে হয়। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদেরও এমনটা করতে হয়। অথচ ভবন নির্মাণের সময়ই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর জন্য প্রতি তলাতে টয়লেট নির্মাণ বাধ্যতামূলক।

টয়লেটে ঠেকে বাল্যবিয়ে

স্কুলে টয়লেট থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেই গোপনীয়তা রক্ষার সুযোগ। অথচ মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা থাকলে লেখাপড়া শেষ করার হার, বিশেষ করে শিক্ষা সমাপনীর হার ও বিয়ের বয়স বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল আনে। 

ব্র্যাকের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, আলাদা টয়লেট থাকায় ক্লাসে মেয়েদের উপস্থিতি ১০ শতাংশ এবং ঋতুকালীন সেগুলো ব্যবহারের সুযোগ থাকলে উপস্থিতি বাড়ে ২০ শতাংশ। এর ফলে মেয়েদের বাল্যবিয়ের হারও কমে যায়। 

আলো জ্বালালেও ভবিষ্যৎ অন্ধকার

ইডেন কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের ছাত্রী মোনালিসা চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের ডিপার্টমেন্টের টয়লেট প্রচুর নোংরা আর দুর্গন্ধপূর্ণ। কলগুলো ভাঙা থাকায় সব সময় পানি ঝরে। টয়লেটের সামনের জায়গাও কাদা-পানি দিয়ে মাখামাখি হয়ে থাকে সব সময়। এ অবস্থা দেখে অনেকদিন সামনে গিয়েও ফিরে এসেছি। তাই এখন কলেজ গেলে পানি খাই না। সকালেও কম পানি খেয়ে যাই।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অস্বাস্থ্যকর টয়লেটের কারণে দেশের দুই কোটি শিশু টাইফয়েড, জন্ডিস, কলেরা বা ডায়রিয়ার মতো মারাত্মক রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। স্কুলের ছেলেরা নোংরা টয়লেট কোনোমতে ব্যবহার করতে পারলেও বিপাকে পড়ে মেয়েরা। তখন তাদের প্রস্রাব চেপে রাখতে হয়। এতে করে ইউরিনারি ট্র্যাক ইনফেকশন বা ইউটিআই হতে পারে, যাকে বলে মূত্রনালির সংক্রমণ। পরবর্তী সময়ে এটা অন্য সমস্যা তৈরি করে। যেমন- বারবার যদি কারো ইউটিআই হয়, তাহলে এটি নারীর প্রজনন ক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

এ বিষয়ে জামালপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক মাহবুব হাসান বাপ্পী বলেন, ‘আমাদের কাছে প্রচুর রোগী আসে, যারা স্কুল-কলেজের ছাত্রী। পর্যাপ্ত পানি পান না করা ও দীর্ঘ সময় প্রস্রাব চেপে রাখার কারণে মূলত তারা ইউরিন ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়। ফলে জ্বর, পেটব্যথা ইত্যাদি সমস্যা তাদের লেগেই থাকে। অনেকের শরীরে পানিশূন্যতাও দেখা দেয়।’ 

তিনি বলেন, ‘প্রস্রাবে ইউরিয়া ও অ্যামিনো এসিডের মতো টক্সিন জাতীয় পদার্থ থাকে। ফলে বেশিক্ষণ চেপে রাখলে বিষাক্ত পদার্থ কিডনিতে পৌঁছে পাথর তৈরি করতে পারে। শহুরে নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যেই ইদানীং এ রোগে আক্রান্তের হার বাড়ছে। আবার পিরিয়ডকালীন প্রয়োজনে টয়লেট ব্যবহার না করলে মূত্রথলির পাশাপাশি জরায়ুর ইনফেশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫