বরাদ্দ দিয়েও গবেষণা করাতে পারছে না পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়

প্রতীক সিফাত
প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৩, ১১:২৮

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। ফাইল ছবি
গবেষণার জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদের সঙ্গে ২০০৬ সালে একটি চুক্তি করেছিলেন ধানমন্ডির রোকেয়া আক্তার। কথা ছিল ১৮ মাসের মধ্যে গবেষণাপত্র জমা দেবেন। কিন্তু ১৭ বছর অতিবাহিত হলেও তার কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি ফেরত দিচ্ছেন না দুই কিস্তিতে নেওয়া ৩৫ হাজার টাকাও। সেই টাকা ফেরত আনতে একের পর এক চিঠি দিয়ে যাচ্ছে পরিষদ। আইনি ব্যবস্থার সতর্কতাও কাজে আসছে না। একই কাজ করেছেন নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার জামাল উদ্দিন সরকার নামে এক পিএইচডি গবেষক। ২০১৪ সালে তার সঙ্গে ২৮ মাসের চুক্তি করা হয়েছিল। মেয়াদ শেষ হওয়ার ছয় বছর অতিক্রম হলেও তিনি তার গবেষণাপত্র জমা দেননি। ফেরত দিচ্ছেন না চুক্তির আংশিক বরাদ্দ ২৫ হাজার টাকা। গত ডিসেম্বর এবং চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ১৫ দিনের মধ্যে টাকা ফেরত দেওয়ার সতর্কবার্তা দিয়ে চিঠিও পাঠানো হলে তার কোনো সাড়া মেলেনি।
দেশের আর্থ—সামাজিক উন্নয়নে নিত্য—নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নীতি প্রণয়ন এবং প্রয়োজনীয় গবেষণায় মুখ্য ভূমিকায় থাকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। তাই প্রতিবছর পরিকল্পনা তৈরিতে বিভিন্ন সামাজিক খাতভিত্তিক চাহিদা নিরূপণ এবং বিদ্যমান পরিস্থিতি পর্যালোচনায় গবেষণা করতে বিভিন্ন গবেষককে ২ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত তারা অর্থ সহায়তা দেয়। তবে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করলেও মন্ত্রণালয়টির সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ এখনো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। চাহিদার তুলনায় কম বরাদ্দ। আবার সে অর্থও ঠিকঠাক কাজে লাগছে না। টাকা দিয়েও গবেষণাপত্র না পেয়ে আবার সেই অর্থ উদ্ধারে ছুটতে হচ্ছে গবেষকদের পিছু পিছু। ২০২২—২৩ অর্থবছরে অবশ্য আর্থিক সংকটে গবেষণা বরাদ্দ ছিল না। যদিও আগের বছরের বরাদ্দই সম্পূর্ণ ব্যয় করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। তিন ধাপের বাছাই কমিটি পার করে অর্থ বরাদ্দ দিয়েও গত আট মাসে প্রায় ১০টি চুক্তি বাতিল করতে হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, ১৯৮৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পরিষদ থেকে মোট ৬৩৮টি গবেষণা কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। অর্থাৎ বছরে গবেষণা হয়েছে মাত্র ১৮টি। যদিও প্রতিবছর গড়ে আবেদন পড়ে ২৫০টির মতো। সেখান থেকে ৭০—৮০টি আবেদন অনুমোদন পায়। গত অর্থবছরে মোট ২৫৯টি আবেদন জমা পড়লেও টিকেছে কেবল ৫৬টি। এর মধ্যে আবার ৩০টি চুক্তি সম্পন্ন হয়েছিল। এ বছর গবেষণায় ২ কোটি ৪০ লাখ এবং প্রশিক্ষণে ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অনুমোদনের পর অর্থ পেয়েও সময়মতো গবেষণা শেষ করেন না গবেষকরা। এমনকি ১৯৯০ দশকের চুক্তিও এখনো ঝুলছে। অনেকে আবার অর্থ নিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দিচ্ছেন। কাজ না করে চুক্তির মেয়াদ শেষ বা বাতিল হলেও ফেরত দিচ্ছেন না সরকারি টাকা।
চুক্তি বাতিলের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে গবেষণার জন্য চুক্তি হয় কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক তৌফিক আহাম্মদের সঙ্গে। ৩৬ মাসের গবেষণার মেয়াদ ২০২২ সালে শেষ হলেও ই—মেইল এবং ডাকযোগে চিঠি দিলেও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তাই গত ১৮ ডিসেম্বর চুক্তিটি বাতিল করা হয়েছে। একইভাবে বিআইডিএসের প্রধান হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা সোয়া লাখ টাকায় গবেষণা করার জন্য ২০১৭ সালে চুক্তি করেন। তবে ১২ মাসের মেয়াদ থাকলেও ৬০ মাসেও গবেষণাপত্র কিংবা কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি এ কর্মকর্তার। তাই গত ডিসেম্বরে চুক্তিটি বাতিল করা হয়েছে।
শুধু ব্যক্তিগত না প্রাতিষ্ঠানিক চুক্তিও বাতিল হচ্ছে। ঠিকানা অনুযায়ী অফিস নেই এবং প্রয়োজনীয় লোকবল ছাড়াই করোনার প্রভাব এবং করণীয় নিয়ে গবেষণার জন্য নির্বাচিত হয় সোশ্যাল অ্যাসিসট্যান্ট ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট নামের একটি সংস্থা। কিন্তু বারবার গবেষক পরিবর্তন এবং সঠিক তথ্য না দেওয়ায় তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে পরিষদ। এ ক্যাটাগরিতে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়ে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে টাকা ফেরত নিতে অবশ্য সফল হচ্ছে পরিষদ। বন ভবনে কর্মরত আমিনুল ইসলাম ২০২১ সালে প্রথম কিস্তি বাবদ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ পেয়েছিলেন। কিন্তু সময়মতো গবেষণা শেষ না করায় বছরের শুরুতে চুক্তিটি বাতিল করা হয়। পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে তিনি টাকা ফেরত দেওয়ায় তাকে গবেষণার দায়ভার থেকে অবমুক্তি দেওয়া হয়।
বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা পরিষদ সূত্র জানায়, ১৯৯০ সালের চুক্তির ফাইল অনুযায়ীও তারা চিঠি দিয়ে যাচ্ছেন। একজন তো টাকা নিয়ে মারাও গেছেন। চুক্তি বাতিলের কারণ হিসেবে সঠিক লোক বাছাই এবং পরিষদ থেকে নিয়মিত যোগাযোগের ঘাটতি ছিল বলে মনে করছে সূত্রটি। আবার চিঠিগুলো সংশ্লিষ্ট লোকজন পাচ্ছে কিনা তা নিয়েও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তবে দায়িত্ব হিসেবে পরিষদ থেকে নিয়মিত চিঠি দেওয়ার কাজটি করে যাচ্ছেন তারা। আর আগে অনেক মানুষকে বরাদ্দ দেওয়া হতো। এখন নীতিমালা পরিবর্তন করে সংখ্যা কমিয়ে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। বছরে ৫ কোটি টাকার চাহিদা থাকলেও আড়াই কোটি টাকার মতো বরাদ্দ পাওয়া যায় বলেও জানান সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদের কর্মকর্তারা।
চুক্তি বাতিলের কারণ নিয়ে কথা বলতে পরিষদ প্রধানের দায়িত্বে থাকা যুগ্মসচিব নাদিয়া শারমীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অসুস্থ থাকায় কথা বলতে রাজি হননি। প্রশিক্ষণের ছুটিতে থাকায় কথা বলেননি উপসচিব কামরুজজামানও। পরিষদের বাজেট কর্মকর্তা ধূসর প্রকৃতি গাইন জানান, গত বছর কৃচ্ছ্রসাধনের অংশ হিসেবে গবেষণায় বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। কিন্তু অর্থ ব্যয় না হলে বছর শেষে টাকা ফেরত দিয়ে দেওয়া হয়। এ বছর এখনো বরাদ্দ বণ্টন বা গবেষণার জন্য আবেদন আহ্বান করা হয়নি।
চুক্তি বাতিলের কারণ নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব সত্যজিত কর্মকারের মন্তব্য জানতে একাধিকবার ফোন করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। খুদেবার্তা পাঠিয়েও তার সাড়া মেলেনি।
গবেষণার জন্য চুক্তি করেও কাজ না করা এবং টাকা ফেরত না দেওয়াকে খুবই দুঃখজনক বলে জানান পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্যমান্য গবেষকরা টাকা নিয়ে সময়মতো রিপোর্ট দিচ্ছেন না, টাকাও ফেরত দিচ্ছেন না। এটা সামাজিক অবক্ষয়ের একটি চিত্র। গবেষণাকে উৎসাহিত করতে জনগণের কোটি কোটি টাকা তাদেরকে দেওয়া হচ্ছে। এখন এটা নিয়ে তাদেরকে বলাটাও বিব্রতকর। আমরা শুদ্ধি আন্দোলনের কথা বলি, গণতন্ত্রায়ণের কথা বলি। কিন্তু নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ছাড়া এগুলো কীভাবে সম্ভব হবে? আমরা সাধারণত আশা করি তারা মূল্যবোধের চর্চা করবে কিন্তু এখন এ অবস্থা। সু—শিক্ষিত এ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে গেলেও আবার অনেকে নিষেধ করবেন।’