সিস্টার জেফ: সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার বাতিঘর

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৩, ১৭:৩১
পাকিস্তানের শিক্ষক সিস্টার জেফ। ছবি- সংগৃহীত
২০২৩ সালের বিশ্বসেরা শিক্ষক হিসেবে এমন একজন ব্যক্তির নাম ঘোষণা করা হয়েছে যিনি পড়া কম পারায় ছোটবেলায় স্কুলে শিক্ষকের হাতে নিয়মিত মার খেতেন। তিনি পাকিস্তানের শিক্ষক সিস্টার জেফ। বিশ্বের প্রায় সাত হাজার শিক্ষকের মধ্য থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে তাকে।
গত ৮ নভেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থিত জাতিসংঘের ইউনেস্কো সদর দপ্তরে বিশ্বসেরা শিক্ষক হিসেবে জেফের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। আট বছর ধরে প্রতিবছর এই পুরস্কারটি দিয়ে আসছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ভার্কি ফাউন্ডেশন। এই পুরস্কারের অর্থমূল্য ১০ লাখ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা বর্তমানে ১১ কোটি ২ লাখ টাকা।
সিস্টার জেফের জন্ম পাকিস্তানের গুজরানওয়ালায়। পড়া কম পারায় ছোটবেলায় স্কুলে শিক্ষকের হাতে নিয়মিত মার খেতেন তিনি। লাঞ্ছনাও সইতে হয়েছে সহপাঠীদের সামনে। এসবের পরে মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাড়ির উঠোনেই শুরু করেন নিজে নিজে পড়াশোনা। সঙ্গে স্থানীয় শিশুদের টিউশন দিতেন। অল্প বয়সেই বিনা মূল্যে শিক্ষাদানের জন্য স্কুল খোলেন। শিক্ষার্থী জোগাড়ের জন্য এ বাড়ি-ও বাড়ি ঘুরতে হয়েছে তাকে। তিনি বলেন, যদিও তার স্কুলে মৌলিক সুযোগ-সুবিধার অভাব ছিল, কিন্তু এখানে শিক্ষার্থীদের জন্য সম্মান, সমতা, ভালোবাসা ও আবেগ ছিল। এই আবেগই ভবিষ্যতে ইতিহাস তৈরি করেছে। ২৬ বছর পর বাড়ির উঠোনে শুরু হওয়া ওই স্কুলই বিশ্বসেরা শিক্ষকের পুরস্কার এনে দিল জেফকে।
আট ঘণ্টা কাজ করে নিজের স্কুলে দিতেন চার ঘণ্টা
সিস্টার জেফের জীবনকাহিনি করুণ। কঠোর পরিশ্রমের ফলেই এমন জায়গায় তিনি এসে দাঁড়িয়েছেন। প্রাইভেটে ছাত্রী হিসেবে পড়েছেন। দিনে আট ঘণ্টা কাজ করতেন। নিজের স্কুলে চার ঘণ্টা পড়াতেন। নিজের পড়াশোনার জন্য সময় বেছে নিতেন রাতে। পড়তেন চার ঘণ্টা। জ্ঞান ও কথা বলার দক্ষতা বাড়াতে তিনি নিয়মিত খবরের কাগজ পড়তেন এবং ইংরেজি খবর শুনতেন। সে সময় তিনিই তার পরিবারে বা পাড়ায় একমাত্র শিক্ষিত ছিলেন। ২৬ বছর ধরে করছেন শিক্ষকতা। এখন একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন।
নারীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য ২০০৬ সালে বন্দুকধারীরা সিস্টার জেফের বাড়িতে আক্রমণ করেছিল। এর ফলে পরিবারের সঙ্গে গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল তাকে। ছয় মাস পর পরিবারসহ ফেরেন গ্রামে। সিদ্ধান্ত নেন শিক্ষার্থীদের ফেলে আর কখনো কোথায় যাবেন না। ২০১০ সালে তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তার প্রথম স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তখন তার স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা শতাধিক।
নিজে ইন্টারনেট থেকে শিখে, শিখিয়েছেন শিক্ষার্থীদের
সিস্টার জেফ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইন্টারনেট থেকে শিখছেন, যা শিখছেন তা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জ্ঞান ভাগ করে নিচ্ছেন। কোনো আনুষ্ঠানিক আইটি প্রশিক্ষণ ছাড়াই তিনি গুগলকে তার শিক্ষক বানিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে তিনি লিন সিমস গ্লোবাল প্রাইজ জেতেন। পুরস্কারের অর্থে ছোট জমি কিনেছিলেন। এ জায়গায় তিনি সকালে নারীদের বিনা মূল্যে কাজ শেখানো শুরু করেন। আর সন্ধ্যায় তার শিক্ষার্থীদের পড়াতেন।
পড়াশোনা শেষে এদের অনেকেই এখন তার সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক হিসেবে কাজ করছে। তার অনেক শিক্ষার্থী জীবনে সফলতা পেয়েছেন। অনেকে অপরাধবিজ্ঞান, বিবিএ, মানবসম্পদ, মার্কেটিং, ফিন্যান্স এবং গণযোগাযোগে মাস্টার্স করছেন। এই ২৬ বছরে সিস্টার জেফ শতাধিক শিশুকে শিক্ষা দিয়েছেন। বর্তমানে ২১৫ সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে বিনা মূল্যে শিক্ষা দিচ্ছেন তিনি। তার প্রতিষ্ঠান জেডডব্লিউইই ফাউন্ডেশনে (সেফানিয়া ফ্রি এডুকেশন অ্যান্ড উইমেনস এমপাওয়ারমেন্ট ফাউন্ডেশন) ২৬ কর্মচারী রয়েছেন। সেফানিয়া ফ্রি এডুকেশন অ্যান্ড উইমেনস এমপাওয়ারমেন্ট ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য শিক্ষা ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমে নারীর মর্যাদা বাড়ানো। এই ২৬ কর্মচারীর সবাই তার প্রাক্তন শিক্ষার্থী।
‘যত দিন বেঁচে আছি, শিশুদের শিক্ষিত করার কাজ করে যাব’
পুরস্কার হিসেবে পাওয়া ১১ কোটি টাকা নিজের স্কুলের পেছনে ব্যয় করারই পরিকল্পনা করেছেন জেফ। চার হেক্টর জমির ওপর নতুন ভবন নির্মাণ করবেন তিনি। সমাজের দরিদ্র শ্রেণির শিশুরা সেখানে কোনো বৈষম্য ছাড়াই পড়াশোনা করবে। এ ছাড়া এতিম শিশুদের জন্য একটি আশ্রয়কেন্দ্রও নির্মাণ করা হবে। তাদের পড়ানোর জন্য বিশ্বের সব জায়গা থেকেই শিক্ষকদের আমন্ত্রণ জানানো হবে।
সিস্টার জেফ তার জীবনকে শিক্ষার জন্য উৎসর্গ করেছেন। তিনি সব সময় বলেন, যত দিন আমি বেঁচে আছি, বিশ্বের শিশুদের শিক্ষিত করার জন্য কাজ করে যাব।
একজন নারী শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, পরিবেশগত নেত্রী, শিশু অধিকার কর্মী, লেখক, আন্তর্জাতিক বক্তা এবং আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি বৃদ্ধিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতা হিসেবে সমাদৃত সিস্টার জেফ। তিনি জেডডব্লিউইই এবং জেফ সানডে স্কুল মিনিস্ট্রির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসনও।
সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য তার কাজ এবং উৎসর্গের জন্য তিনি পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনালের ইটারনাল লাইফ মিনিস্ট্রি কর্তৃক অসামান্য পারফরম্যান্স পুরস্কার এবং বায়োনিয়ার্স চেঞ্জ মেকারস অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছেন। চ্যানেল নিউজ এশিয়া সিঙ্গাপুর তার জীবন এবং কাজের ওপর ফ্লাইট অব দ্য ফ্যালকনস চলচ্চিত্র বানিয়েছেন। ছবিটি ২০১৬ সালে নিউইয়র্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল থেকে স্বর্ণপদক জিতেছিল।
২০২১ সালে কার-ই-খাইর পাকিস্তান থেকে তাকে মানবতার বই হিসেবে একটি স্বর্ণপদক এবং পাকিস্তানের ভিক্টরি চার্চ থেকে একটি অসামান্য পারফরম্যান্স পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী নানা পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
বিশ্বসেরা শিক্ষকের পুরস্কারের জন্য জেফকে অভিনন্দন জানিয়ে ভার্কি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সানি ভার্কি বলেছেন, সিস্টার জেফ, আপনার অবিশ্বাস্য গল্পটি দেখায় যে আজ এবং আগামীকালের বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে শিক্ষা।