Logo
×

Follow Us

শিক্ষা

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খাবার

বেড়েছে দাম কমেছে মান

Icon

এম ডি হোসাইন

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১৪:৪৩

বেড়েছে দাম কমেছে মান

শিক্ষার্থীদের পাল্টে গেছে দৈনন্দিন জীবনের রুটিন। ফাইল ছবি

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপে রাজধানীর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিন-ডাইনিংয়ে বেড়েছে খাবারের দাম, অন্যদিকে সমানতালে কমেছে মান। গত এক বছরের তুলনায় খাবারের দাম বেড়েছে দুই থেকে তিন গুণ। স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ফি বৃদ্ধির সঙ্গে খাবার দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রতিমাসে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হচ্ছে অভিভাবকদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাল্টে গেছে দৈনন্দিন জীবনের রুটিন। 

জানা যায়, রাজধানীর মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল ও কলেজ, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে আগে যে শিঙাড়া বিক্রি হতো ৫ টাকায় এখন সেটির দাম ১০ টাকা, ১২ থেকে ১৫ টাকার রোল বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকায়। একইভাবে চিকেন, পিৎজা, ফ্রায়েড রাইসসহ প্রায় সব খাবারের দাম আগের তুলনায় কয়েক গুণ বেড়েছে। রাজধানীর মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের এক অভিভাবক আশরাফুল ইসলাম বলেন, আমার ছেলেকে আগে স্কুলে নাশতার জন্য ১৫ থেকে ২০ টাকা দিতাম। এখন ৫০ টাকা দিয়েও সে দুপুরে ভালো কিছু খেতে পারে না। ক্যান্টিনের সব খাবারের দাম বেড়ে গেছে। মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল ও কলেজের অভিভাবক আরিফ হোসেন বলেন, আমার মেয়ে আগে স্কুলের ক্যান্টিনে দুপুরের খাবার খেত। এখন খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রতিদিন বাসা থেকে টিফিন দেওয়া হয়। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব স্কুলের একাধিক শিক্ষক বলেন, স্কুলের ক্যান্টিনে খাবারের দাম আগের তুলনায় কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে বাইরের দোকানের তুলনায় কম। এ ছাড়া স্কুলের ক্যান্টিনে শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত খাবারের ব্যবস্থা আছে। 

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সামনেই কফি হাট, যা ‘ডিইউ কফি হাট’ নামে পরিচিত। অনুষদ ভবনের সামনে সৌন্দর্যবর্ধনের পর সেখানে ফুড কোর্টটি বসানো হয়। এতে শিক্ষার্থীদের আশা ছিল, স্বল্প দামে মানসম্মত খাবার খেতে পারবেন তারা। তবে হয়েছে উল্টো। অথচ শিক্ষার্থীদের কথা ভেবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতিক্রমে ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কফি হাট। কিন্তু চড়া দামের কারণে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই খেতে পারেন না সেখানে। উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থী এবং বহিরাগতরা এর মূল ক্রেতা। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, কফি হাটে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাধ্যের মধ্যে খাবার নেই। দাম বেশি হওয়ার পাশাপাশি মান নিয়েও প্রশ্ন তাদের। পাশাপাশি ময়লা ফেলায় জায়গাটি আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।

কফি হাটের খাবার ও মূল্য তালিকা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, সেখানে দেশীয় প্রচলিত তেমন কোনো খাবার নেই। তালিকা অনুযায়ী, ফ্রায়েড রাইসের সঙ্গে চিকেন মাসালা ও ভেজিটেবলের দাম ১১০ টাকা, ফ্রায়েড রাইসের সঙ্গে থাই চিকেন ফ্রাই ও ভেজিটেবলের দাম ১২৫, ফ্রায়েড রাইসের সঙ্গে চিকেন ফ্রাই এবং ভেজিটেবল ১২৫, ফ্রায়েড রাইসের সঙ্গে চিকেন ও চিকেন ফ্রাই ২১০, বার্গার ও কোল্ড কফি ১৫০ টাকা, চিকেন বার্গার ও ড্রিংকস ১৪৫, বিফ বার্গারের সঙ্গে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও ড্রিংকস ১৫৫, দুই পিস ফ্রায়েড চিকেনের সঙ্গে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও ড্রিংকসের দাম ২০০ টাকা। কফি হাটের প্রায় প্রতিটি পদের খাবারের দাম ১২০ থেকে ২০০ টাকা। শুধু স্যান্ডউইচের দাম ৪০-৫০ টাকা। তবে তা সব সময় পাওয়া যায় না। এর আগে তুলনামূলক কম দামে খিচুড়ি পাওয়া গেলেও এখন আর তা রাখা হয় না। 

একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ক্যান্টিন, ডাইনিংয়েও বেড়েছে খাবারের দাম। ঢাবি শিক্ষার্থী ফাহিম হোসেন বলেন, কফি হাটে যেসব খাবার পাওয়া যায়, তা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। মান বিবেচনায় খাবারের দাম বেশি। শিক্ষার্থীদের পক্ষে এখানে খাওয়া কষ্টকর। আশেপাশে কোনো ক্যান্টিন না থাকায় দুপুরে খেতে ছুটতে হয় চারুকলায় বা হলে। কখনো কখনো ক্লাসের মাঝে অত সময় পাওয়া যায় না। কাছাকাছি খাবার না পাওয়ায় অনেকে না খেয়েও থাকে। 

এ বিষয়ে রেস্তোরাঁ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আসিফ আহমেদ মিরাজ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে ১ লাখ টাকা ভাড়া দিতে হয়। পাশাপাশি রাঁধুনিসহ ১৫ জন কর্মচারী রয়েছে, যাদের পারিশ্রমিক প্রতি মাসে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এ ছাড়া গ্যাস বিল ৮০ হাজার, পানি বিল ১ হাজার এবং ময়লা বিল ৮০০ টাকার সঙ্গে বিদ্যুৎ বিলও আছে। এ সবকিছু মিলিয়ে কম দামে খাবার বিক্রি করা যায় না। এ ছাড়া দামি সামগ্রী খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।

ঢাবির ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মধুর ক্যান্টিন। বর্তমানে এটি রেস্তোরাঁ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই ক্যান্টিনের বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিলসহ সব ধরনের খরচ বহন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তা ছাড়াও দিতে হয় না কোনো ধরনের মাসিক ভাড়া। তবু শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এখানে খাবারের মান নিম্নমানের হলেও দাম অত্যধিক চড়া। এ ছাড়াও সেখানকার কর্মচারীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে। ক্যান্টিন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা অরুণ দে জানান, বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে এর প্রভাব পড়েছে ক্যান্টিনের খাবারের মূল্যে। বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল না দিয়েও মধুর ক্যান্টিনে খাবারের তালিকা অনুযায়ী শিঙাড়া ১০ টাকা, সবজি রোল ১৫ টাকা, সমুচা ১০ টাকা, স্যান্ডউইচ ৬৫ টাকা, শর্মা ৮৫ টাকা, পুডিং ৩৫ টাকা, পাটিসাপ্টা ২৫ টাকা, ব্রেড বাটার ৪০ টাকা, রং চা ১০ টাকা, ছানা ছোট ২ টুকরা ৩৫ টাকা, ছোট ৫ পিস মিষ্টি ৫০ টাকা প্লেট এবং কেক ১৫ টাকা দাম রাখা হয়।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মাকসুদুর রহমান জানান, আমি খাবারের দাম এবং ব্যবহারের ব্যাপারে অবগত ছিলাম না। যতদ্রুত সম্ভব বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করব।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ছাত্রী হলের শিক্ষার্থী কণা। কয়েক মাস আগেও পর্যাপ্ত পরিমাণ মাছ, মাংস, ডিম খেতে পারতেন। কিন্তু বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে পাল্টে গেছে তার দৈনন্দিন জীবনের রুটিন। লাগাম টানতে হয়েছে খাবার ব্যবস্থায়। মাছ, মাংস, ডিমের পরিবর্তে দুই বেলা সবজি খেয়েই কাটছে তার অধিকাংশ দিন। ছাত্রী হলের ক্যান্টিনে প্লেটপ্রতি ভাত ১০ টাকা, পাতলা ডাল ২ টাকা, ভর্তা-শাক ১০ টাকা, রুই, কাতলা, সরপুঁটি, পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া ও কইমাছ (প্রতি পিস) ৩৫ টাকা, ছোট মাছ ও চিংড়ি ৩৫ টাকা, দেশি মুরগি (এক পিস মাংস) ৪০ টাকা, ব্রয়লার (এক পিস মাংস) ৩৫ টাকা, মুরগি খিঁচুড়ি ৫০ টাকা, তেহারি ৭০ টাকা (ছোট এক পিস মুরগির মাংসসহ), মুড়িঘণ্ট ৩০ টাকা, শাকের সঙ্গে মাছের মাথা ভুনা ২০ টাকা, ডিম অমলেট (প্রতি পিস) ১৮ টাকা।

ভাত, ডাল ও ভর্তার দাম অপরিবর্তিত রেখে সব খাবারের দাম ৫ টাকা করে বাড়ানো হলেও মান ও পরিমাণ দুটিই কমানো হয়েছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়েও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। বাধ্য হয়ে অনেকে হলের বাইরে চড়া দামে খাবার খায়। ক্যান্টিন পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘বাজারে সবকিছুর দাম এখন চড়া, ফলে ব্যবস্থাপনা খরচও অনেক বেড়ে গেছে। অন্যদিকে লাভের পরিমাণ কমেছে। ভর্তুকি ছাড়া খাবারের মূল্য আর কমানো সম্ভব না।’ 

হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. দীপিকা রানী সরকার বলেন, ‘হলের অধিকাংশ মেয়ে এখন রান্না করে খায়, অনেক সিট এখনো খালি আছে। ফলে অল্পসংখ্যক মেয়েই হলের ক্যান্টিনে খাবার খায়। এতে ক্যান্টিন পরিচালকদের ব্যবসা কমে গেছে। ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে তারা কিছুটা দাম না বাড়ালে তাদের ব্যবসা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব না। ভর্তুকি দিয়ে খাবারের মূল্য কিছুটা কমিয়ে আনার কথা ভাবছে প্রশাসন।’

একইভাবে খাবারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা কলেজ, বেগম বদরুনন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এখন রান্না করে খায়। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, করোনা মহামারির পর থেকেই শেকৃবির হলগুলোতে খাবারের দাম বাড়ানো হচ্ছে। ১০-১৫ টাকা করে বেড়েছে প্রতি হলে। তবে রমজান মাসে এ দাম আরও বাড়তে পারে। অতিরিক্ত দামের ফলে শিক্ষার্থীরা রুমে রান্না করে খাওয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছেন। ফলে তাদের নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান সময়। একই সঙ্গে অপচয় হচ্ছে বিদ্যুৎও।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫