উচ্চশিক্ষা নিতে অস্ট্রেলিয়া যেতে চাইলে

মীর ইফতেখার উদ্দিন ফাহাদ
প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:২৫

মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি। ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বের ১৩তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ অস্ট্রেলিয়া। পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার-গঠনে উন্নয়নশীল দেশের ছাত্রছাত্রীদের জন্য অস্ট্রেলিয়া নিঃসন্দেহে একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য। জেনে নেওয়া যাক অস্ট্রেলিয়াতে উচ্চশিক্ষায় আবেদন প্রক্রিয়া, স্টুডেন্ট ভিসা, অধ্যয়ন খরচ এবং স্কলারশিপসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে।
অস্ট্রেলিয়া উচ্চশিক্ষার জন্য সেরা কেন
কিউএস ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ে ২০২৫ সালের জন্য শীর্ষ ১০ শিক্ষার্থীবান্ধব নগরীর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ও সিডনির অবস্থান যথাক্রমে- পঞ্চম ও ষষ্ঠ। তা ছাড়া এ দুটি শহরসহ আরও বেশ কয়েকটি শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিবছরই থাকে কিউএস র্যাঙ্কিংয়ে। ২০২৪ সালে প্রথম অর্ধশতকের মধ্যে থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্ন (১৩), ইউনিভার্সিটি অব সিডনি (১৮), ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস (১৯), অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (৩০), মোনাশ ইউনিভার্সিটি (৩৭) ও ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ড (৪০)।
সেরা বিষয়গুলো
অ্যাকাউন্টিং, অ্যাকচুয়ারিয়াল সায়েন্স, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি, সাইকোলজি, ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, আর্কিটেকচার, ইঞ্জিনিয়ারিং, হেলথ সায়েন্স অ্যান্ড নার্সিং ও বিজনেস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট।
আবেদনের উপায়
বছরজুড়ে সাধারণত তিনটি মৌসুমে ভর্তির জন্য আবেদন গ্রহণ করে থাকে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। মৌসুমগুলো ফেব্রুয়ারি, জুলাই ও নভেম্বর ইন্টেক হিসেবে পরিচিত। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কোর্সে ভর্তির সুযোগ থাকে ফেব্রুয়ারি ইন্টেকে। ভর্তি কার্যক্রম চলে ফেব্রুয়ারি বা মার্চ থেকে শুরু করে মে মাসের শেষ বা জুনের শুরু পর্যন্ত। আবেদন গ্রহণ করা হয় আগের বছরের অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসে। ইন্টার্নশিপ বা কর্মসংস্থান পাওয়ার ক্ষেত্রে এই মৌসুমটিই সর্বাধিক উপযুক্ত। জুলাই ইন্টেকের আবেদন নেওয়া হয় এপ্রিল থেকে মে পর্যন্ত। অতঃপর ভর্তি শুরু হয় জুলাইয়ের শেষ বা আগস্টের শুরুর দিকে। তারপর নভেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে ছাত্রছাত্রী ভর্তি। সর্বশেষ নভেম্বর ইন্টেকে আবেদনের সময় সেপ্টেম্বর মাস। ভর্তি প্রক্রিয়া চলমান থাকে নভেম্বরের শেষ থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত।
এই আবেদনের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে নিজস্ব অনলাইন পোর্টাল। মৌসুমগুলোকে কেন্দ্র করে এই ওয়েবসাইটগুলোতে ভর্তির যাবতীয় শর্ত, কোর্সের পর্যাপ্ততা ও আবেদনের সময়সীমা হালনাগাদ করা হয়। তাই অনলাইন আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ অন্যান্য বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা জানতে প্ল্যাটফর্মগুলোতে চোখ রাখা উচিত।
ভর্তির আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট এবং সার্টিফিকেট- স্নাতকের ক্ষেত্রে উচ্চ মাধ্যমিকের নথি, স্নাতকোত্তরের জন্য স্নাতকের নথি এবং পিএইচডির জন্য স্নাতকোত্তরের শংসাপত্র, সিভি বা পোর্টফলিও। স্টেটমেন্ট অব পার্পাস (এসওপি) বা পার্সোনাল স্টেটমেন্ট, লেটার অব রিকমেন্ডেশন (এলওআর), রিসার্চ প্রপোজাল (ডক্টরাল প্রোগ্রামের জন্য), পেশাগত অভিজ্ঞতাপত্র (এমবিএ প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে), বৈধ পাসপোর্ট, সাম্প্রতিক তোলা ছবি, অধ্যয়ন ফি প্রদানের জন্য আর্থিক সামর্থ্যরে প্রমাণ- কমপক্ষে কোর্সের প্রথম ১২ মাসের ফি, কোর্স ১২ মাস বা তার কম হলে সম্পূর্ণ ফি পরিশোধ করতে হবে। স্বাস্থ্য বীমাস্বরূপ ওভারসিজ স্টুডেন্ট হেলথ কভার (ওএসএইচসি) ।
এর বাইরেও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অতিরিক্ত নথি চাওয়া হতে পারে। কোনো কাগজ বাংলায় হলে তা অবশ্যই ইংরেজিতে অনুবাদ করে মূল কপিসহ অনুদিত কপি স্ক্যান করতে হবে। এখানে অনুবাদককে অবশ্যই জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হতে হবে।
ভাষার দক্ষতা প্রমাণ
ইংরেজি ভাষা দক্ষতার প্রমাণপত্র : ন্যূনতম যোগ্যতাস্বরূপ আইইএলটিএস স্কোর ৬, টোফেল আইবিটিতে ৬৪, কেম্ব্রিজ ইংলিশ- অ্যাডভান্সড-এ ১৬৯, বা পিয়ারসন টেস্ট অব ইংলিশ (পিটিই) একাডেমিক-এ ৫০।
স্টুডেন্ট ভিসার জন্য আবেদন
স্নাতক বা স্নাতকোত্তরের মতো দীর্ঘমেয়াদি কোর্সগুলোতে অধ্যয়নের অনুমতি দেয় অস্ট্রেলিয়ার সাবক্লাস ৫০০ স্টুডেন্ট ভিসা। এখানে সর্বোচ্চ ৫ বছর পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা নিজেদের পছন্দসই বিষয়ে পড়াশোনা করতে পারে। এই ভিসার আবেদনের জন্য অফলাইন ও অনলাইন দুই মাধ্যমই রয়েছে। তবে সবচেয়ে নিরবচ্ছিন্ন উপায় হচ্ছে অনলাইন আবেদন। এই মাধ্যমে মূলত পাসপোর্টে কোনো সিল দেওয়া হয় না। ভিসাকে পাসপোর্টের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় ডিজিটালভাবে।
আবেদনের পুরো প্রক্রিয়া অনলাইনে সম্পন্ন করার জন্য দুটো প্ল্যাটফর্ম আছে। অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্র বিভাগের ওয়েবসাইটের অন্তর্ভুক্ত ইমি পোর্টাল (https://online.immi.gov.au/lusc/register) এবং ভিএফএস (ভিসা ফ্যাসিলিটেশন সার্ভিসেস) গ্লোবাল প্ল্যাটফর্ম (https://visa.vfsglobal.com/bgd/en/aus/register)
এগুলোর যে কোনো একটিতে অ্যাকাউন্ট খোলার মাধ্যমে আবেদন প্রক্রিয়া শুরু করা যায়। তবে বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের জন্য অবশ্যই ভিএফএস সাইটের মাধ্যমে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়। উভয় ক্ষেত্রেই আবেদনের জরুরি কাগজপত্র আপলোডসহ আবেদনের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়।
স্টুডেন্ট ভিসা ফি এবং প্রক্রিয়াকরণের সময়
ভিসার প্রায় ৯০ শতাংশ প্রস্তুত হতে সাধারণত ৪ মাস সময় লেগে যায়। সাবক্লাস ৫০০ স্টুডেন্ট ভিসা ফি ১ হাজার ৬০০ ডলার কিংবা ১ লাখ ৩০ হাজার ৯৬০ টাকা। এটি ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে অনলাইনে পরিশোধ করতে হবে। বায়োমেট্রিক নিবন্ধন ফি ২ হাজার ১৫৫ টাকা সরাসরি ভিএফএস সেন্টারে নগদে জমা দিতে হবে।
পড়াশোনা ও জীবনযাত্রার সম্ভাব্য খরচ
উচ্চ অধ্যয়ন ফির দেশগুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া অন্যতম। এখানে স্নাতক ডিগ্রির জন্য বাজেট রাখতে হবে ২০ থেকে ৪৫ হাজার ডলার, যা প্রায় ১৬ লাখ ৩৭ হাজার ৬ থেকে ৩৬ লাখ ৮৩ হাজার ২৬৩ টাকা। ২২ থেকে ৫০ হাজার ডলারের (১৮ লাখ ৭০৬ থেকে ৪০ লাখ ৯২ হাজার ৫১৪ টাকা) ব্যয়ভার রয়েছে স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামগুলোতে। আর ডক্টরাল ডিগ্রিতে খরচ হয় প্রায় ১৮ থেকে ৪২ হাজার ডলার (১৪ লাখ ৭৩ হাজার ৩০৫ থেকে ৩৪ লাখ ৩৭ হাজার ৭১২ টাকা)।
জীবনযাত্রার খরচের দিক থেকেও অস্ট্রেলিয়া যথেষ্ট ব্যয়বহুল। আবাসনে সবচেয়ে কমের মধ্যেই ক্যাম্পাস ডরমিটরির ভাড়া ৮০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ ডলার। মাসে খাবার ও মুদির জন্য বাজেট রাখতে হবে ৬৫ থেকে ১০৩ ডলার বা ৫ হাজার ৩২০ থেকে ৮ হাজার ৪৩১ টাকা। যাতায়াত বাবদ খরচ ৩ থেকে ৪০০ ডলার (২৪ হাজার ৫৫৫ থেকে ৩২ হাজার ৭৪০ টাকা)। বিদ্যুৎ, গ্যাস, মোবাইল, ইন্টারনেটসহ ইউটিলিটি বাজেট ২৭০ থেকে ৪৯০ ডলার (২২ হাজার ১০০ থেকে ৪০ হাজার ১০৭ টাকা)।
স্কলারশিপের সুবিধা
মেলবোর্ন ইন্টারন্যাশনাল আন্ডার গ্র্যাজুয়েট স্কলারশিপ স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। এখানে প্রথম বছরের জন্য ১০ হাজার ডলার (৮ লাখ ১৮ হাজার ৫০৩ টাকা) অধ্যয়ন ফি ছাড় পাওয়া যায়। মোনাশ ইন্টারন্যাশনাল লিডারশিপ স্কলারশিপ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর অধ্যয়নরতদের জন্য। এখানে প্রোগ্রামের একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্রেডিট পয়েন্ট নির্ধারিত থাকে, যেটি পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত শতভাগ আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। ইউটিএস ভাইস-চ্যান্সেলরের ইন্টারন্যাশনাল স্কলারশিপ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নের ৫০ শতাংশ ব্যয়ভার গ্রহণ করে থাকে। গ্লোবাল একাডেমিক এক্সিলেন্স স্কলারশিপে (ইন্টারন্যাশনাল) প্রতিটি অনুষদে অসামান্য একাডেমিক ফল অর্জনকারীদের অধ্যয়ন খরচ থেকে ৫০ শতাংশ মওকুফ করা হয়।