চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: পাহাড়ের বুকে শাটলের সুর

কিশোর কল্লোল
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৫৭

শাটল ট্রেন। ছবি: সংগৃহীত
পাহাড়ের বুকে দাঁড়িয়ে শিক্ষার আলো বিলিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সঙ্গে আছে শাটল ট্রেনের রোমাঞ্চ। এ যেন এক জাদুর ক্যাম্পাস, যেখানে ভোরের আলো ফোটে শাটলের হুইসলে, আবার বন্ধুদের আড্ডা জমে ওঠে টিলার নিচের টঙে বসে চায়ে চুমুক দেওয়া কাপে। জেনে নিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কিছু তথ্য।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিই সৌন্দর্যের লীলাভূমি। কী নেই ক্যাম্পাসে? পাহাড় আছে, সবুজের মায়া আছে, শাটল ট্রেনের ভালোবাসা আছে। খুব সকালে পাখির কিচিরমিচির ডাকে ঘুম ভাঙে ক্যাম্পাসের। আবার সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে নীরবতা নেমে আসে। প্রকৃতির খুব কাছে হওয়ায় শিশিরে ভিজতে ভিজতে ঘুমিয়ে পড়ে চট্টগ্রাম ক্যাম্পাস।
শহরের কোলাহল আর যান্ত্রিকতা থেকে প্রকৃতির কোলে গড়ে উঠেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সবুজ গাছগাছালির মধ্যে দেখা মেলে হরেক রঙের নানা রকম পাখির। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাটা পাহাড়, বাণিজ্য অনুষদের পেছন, ফরেস্ট্রি এলাকাসহ সবুজ পাহাড়ের কোলে প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকা ছোট আকারের লালচে বাদামি রঙের মায়া হরিণের দেখা মেলে কেবল এই ক্যাম্পাসে। অজগর কিংবা বিচিত্র দুর্লভ প্রাণীর জীবন্ত জাদুঘর চবি ক্যাম্পাস। ঝুলন্ত সেতু, ঝর্ণাধারা, উদ্ভিদ উদ্যান কিংবা সুবিশাল মাঠ সবই আছে এখানে। এখানেই শেষ নয়, চট্টগ্রাম ক্যাম্পাসে পাওয়া অপরূপ সৌন্দর্য চালন্দা গিরিপথ।
শাটল ট্রেন
চবি একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে এখনো শাটল ট্রেন চলাচল করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ বলা হয় এই শাটল ট্রেনকে। এই শাটলেই প্রতিদিন হাজারো প্রাণের মেলা বসে। গল্প আড্ডা আর গানে মুখরিত হয়ে ওঠে শাটলের একেকটি বগি। সেখানে গান করে অনেকেই হয়েছেন বিখ্যাত গায়ক। তাই চবিকে গানবাজদের তীর্থস্থানও বলা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষে এখানকার শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি মিস করে এই শাটলের আড্ডা ও গান।
অসাধারণ ফ্যাকাল্টি
বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিশ্বতত্ত্ববিদ সর্বজন শ্রদ্ধেয় ড. জামাল নজরুল ইসলাম, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা চবিতে শিক্ষকতা করেছেন। এখানে শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের রয়েছে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এখানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ছাড়াও এমফিল, পিএইচডি, এমডি, এমপিএইচের মতো উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণের সুযোগ আছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর
১৯৭৩ সালের ১৪ জুন প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের একমাত্র একাডেমিক জাদুঘর চালু হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। মূলত মানব ইতিহাস, শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষা, গবেষণা কার্যক্রমে শিক্ষার্থী ও গবেষকদের সহায়তা করা, প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস ও প্রাচীন শিল্পকলার নিদর্শন সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন এবং এসব বিষয়ে মৌলিক গবেষণার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে এই জাদুঘর চালু হয়। এটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ভবনের পশ্চিম পাশে অবস্থিত। এটি চট্টগ্রামের একমাত্র শিল্প জাদুঘর এবং দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যেও একমাত্র জাদুঘর হিসেবে বিবেচিত। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের পাঠক্রমের সহায়ক হিসেবে আছে ‘প্রাণিবিদ্যা জাদুঘর’। আবার বিশ্ববিদ্যালয়েরই সামুদ্রিক বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে গড়ে তোলা হয়েছে ‘সমুদ্রসম্পদ জাদুঘর’, যেখানে ৫৫০টির মতো সামুদ্রিক প্রাণী সংরক্ষণ করা হয়েছে।
৪০ হাজার জার্নাল-সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ। এটি দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই গ্রন্থাগারে বইয়ের বর্তমান সংগ্রহ সংখ্যা প্রায় তিন লাখ ৫০ হাজার। সংগ্রহের তালিকায় আছে বিরল বই, জার্নাল, অডিও-ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট, পাণ্ডুলিপি ও অন্ধদের জন্য ব্রেইল বই। গ্রন্থাগারটিকে বর্তমানে অটোমেশনের আওতায় আনা হয়েছে।
স্মৃতিস্তম্ভ ও ভাস্কর্য
বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবিড় সম্পর্ক আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথেই রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ ও বীরত্বের স্মৃতিতে নির্মিত ‘স্মরণ স্মৃতিস্তম্ভ’। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন বীরের নাম ও ছবি আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা অনুষদের সামনে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে ‘বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ’। এটি বুদ্ধিজীবী চত্বর নামে পরিচিত। বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভের বিপরীত পাশে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অবস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের সামনে আছে ‘স্বাধীনতা স্মৃতি ম্যুরাল’।
প্রকৃতির বুকে হল
পাহাড়ঘেরা প্রকৃতির কোলে চবি ক্যাম্পাসে রয়েছে ১২টি আবাসিক হল। যার মধ্যে আটটি ছাত্র ও চারটি ছাত্রী হল। প্রতিটি হলের নির্মাণশৈলী যেমন আলাদা, তেমনি কোনোটা পাহাড়ের কুলঘেঁষে, আবার কোনোটা পাহাড় ও নয়নাভিরাম সবুজে ঘেরা যেন এক স্বপ্নপুরী। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে পাহাড়ে পাখির কলতান, জোনাকির মৃদু আলো আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক পুরো ক্যাম্পাসকে করে তোলে আরো আকর্ষণীয়।
মধুর আড্ডা
চবির বিভিন্ন অনুষদ ও হলগুলোর পাশে রয়েছে সারি সারি অনেক দোকান। এসব দোকানকে ঝুপড়ি বা টং নামে ডাকা হয়। চবি শিক্ষার্থীদের আড্ডার অন্যতম জায়গা এই ঝুপড়িগুলো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সুস্বাদু আর রুচিশীল খাবারগুলোর উৎস হলো এসব ঝুপড়ি। এখানে হরেক রকম ভর্তা ও নানা মজাদার খাবারের দেখা মেলে। সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার, গরম ভাত কিংবা ভর্তার জন্য অপেক্ষমাণ শত শত শিক্ষার্থীর পদচারণে মুখর থাকে ঝুপড়িগুলো।