শিক্ষার্থীদের নকল বেড়েছে, সহযোগিতায় একশ্রেণির শিক্ষক

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১৪:৩৬
ছবি: সংগৃহীত
চলতি বছরের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের নকল বেড়েছে আগের তুলনায় অনেক বেশি। এক্ষেত্রে সহযোগিতা করছেন এক শ্রেণির শিক্ষক। গতকাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত চারটি পরীক্ষাতেই বই খুলে লেখা, বাইরে থেকে দেওয়াল টপকে কেন্দ্রের ভেতরে নকল সরবরাহ, শিক্ষকের সামনে দেখাদেখি ও আলোচনা করে উত্তরপত্রে লেখার বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। ইতিমধ্যে ভাইরাল হয়েছে শিক্ষকের সামনে বই খুলে পরীক্ষা দেওয়ার ভিডিও। দেওয়াল টপকে পরীক্ষার হলে নকল সরবরাহের ছবিও ছড়িয়ে পড়েছে ইন্টারনেটে।
হাতে লিখে প্রশ্নোত্তর সরবরাহের দায়ে একজন শিক্ষকের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। উত্তর বলে দেওয়ায় হল সুপার আটক হয়েছেন। প্রশাসন কঠোর হয়েও নকলের লাগাম টানতে পারছে না। উপরন্তু মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্নফাঁস। প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে পরীক্ষাকেন্দ্র সচিব এক অধ্যক্ষকে আটক করা হয়েছে। পরীক্ষার্থীর হাতে পাওয়া গেছে মোবাইল ফোন। প্রক্সি দিতে এসে গ্রেফতার হয়েছেন এক জন। চারটি পরীক্ষায় ২৭৪ শিক্ষার্থী বহিষ্কার এবং ২১ শিক্ষককে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে নকল করার প্রবণতা অনেক সময়ই দেখা যায়। সাধারণত চিরকুটে করা এসব নকল তারা পকেটে বা শরীরের কোথাও লুকিয়ে রাখেন। যুগ যুগ ধরে হাতের তালু, বাহু, জামার উলটো পিঠ, চেয়ার-টেবিল বা দেওয়াল ছাপিয়ে হাল আমলে নকলের এই দৌরাত্ম্য ঠেকেছে মোবাইল ফোন-স্মার্ট গ্যাজেট পর্যন্ত।
তবে এবার শিক্ষকদের সহযোগিতায় অসদুপায় বেড়েছে। সমাজতত্ত্ববিদরা নকল বৃদ্ধির পেছনে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের দিকে আঙুল তুলেছেন। তারা বলেন, সমাজে সর্বস্তরে দুর্নীতি বাড়ছে, অসাধুতা ‘স্বাভাবিকতা’য় পরিণত হচ্ছে। এমতাবস্থায় পরীক্ষার্থীদেরও এর দ্বারা প্রভাবিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। নকল করা বৃদ্ধির যাবতীয় দায় পরীক্ষার্থীদের অসৎ মানসিকতার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার আগে তাই আয়নায় নিজেদের দেখে নেওয়া ভালো।
ফেনীতে দাখিল পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীকে হাতে লিখে প্রশ্নোত্তর সরবরাহের দায়ে মো. ইউনুস নামের এক শিক্ষককে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গত ১০ এপ্রিল ফেনী আলিয়া কামিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। ফেনী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সুলতানা নাসরিন কান্তা এ দণ্ডাদেশ দেন। সাজাপ্রাপ্ত মো. ইউনুস ফেনী সদর উপজেলার মটুয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।
এছাড়া, চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলায় এসএসসি পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর বলে দেওয়ার অভিযোগে এক হল সুপারকে হাতেনাতে আটক করা হয়েছে। একই ঘটনায় পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে দায়িত্বরত তিন শিক্ষককে প্রত্যাহার করা হয়েছে। উপজেলার নিজমেহার মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গণিত পরীক্ষা চলাকালে এ ঘটনা ঘটে। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিরুপম মজুমদার জানান, ঐ কেন্দ্রে গণিত পরীক্ষা চলাকালে হল সুপার ও দেবকরা মারগুবা ড. শহীদুল্লাহ মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. আজমুল হক ১২ নম্বর হলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মৌখিকভাবে এমসিকিউ উত্তর বলে দেন। ঐ সময় কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে তাকে হাতেনাতে আটক করা হয়।
প্রশ্নফাঁসে কেন্দ্র সচিবসহ আটক ৬, ট্যাগ কর্মকর্তাকে অব্যাহতি: এসএসসি পরীক্ষার হল থেকে প্রশ্নপত্র বের করে ফটোকপি করার জন্য দোকানে নেওয়ার সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে একটি চক্র। এরপর কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে অতিরিক্ত প্রশ্নপত্রের মধ্য থেকেও দুটি প্রশ্ন কম পাওয়া যায়। এই দুই ঘটনায় কেন্দ্র সচিব, ট্যাগ কর্মকর্তা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও তাদের বহিরাগত সহযোগীসহ মোট ১০ জনকে সাজা দেওয়া হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর ফাজিল মাদ্রাসায় দাখিলের গণিত পরীক্ষা চলাকালে এসব ঘটনা ঘটেছে বলে নিশ্চিত করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. পপি খাতুন। আটকরা হলেন—ভূঞাপুর ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও কেন্দ্র সচিব মো. আব্দুস ছোবাহান, বিয়ারা দাখিল মাদ্রাসার পরীক্ষার্থী শাহ আলম ও তার সহযোগী রায়হান আলী, মিজানুর রহমান, লুত্ফর রহমান, সুমন মিয়া। এছাড়া দায়িত্বে অবহেলার দায়ে কেন্দ্রের ট্যাগ অফিসার ও উপজেলা পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ম্যানেজার মো. মনিরুজ্জামানকে অব্যাহতি এবং কক্ষ পরিদর্শকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে জিগাতলা দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক জহুরুল ইসলাম, কোনাবাড়ী দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক আব্দুল হাই এবং নিকলা দড়িপাড়া দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক মোতালেব হোসেনকে।
ছাদ বেয়ে হলে নকল দিতে এসে কারাগারে তরুণ: কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে চলমান এসএসসি পরীক্ষায় ছাদ বেয়ে নকল সরবরাহের দায়ে ইমরান হোসেন (১৯) নামের এক যুবককে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে পেরিয়া ইউনিয়নের ডা. যোবায়েদা হান্নান হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র থেকে তাকে আটক করা হয়। পরে বিকালে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাফিদ খান এ দণ্ডাদেশ দেন।
শিক্ষকের সামনেই বই খুলে উত্তর লেখার ভিডিও ভাইরাল : অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে গত ১০ এপ্রিল এবারের এসএসসি শুরুর দিনই বাংলা প্রথম পত্রে ২২ জন পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। টাঙ্গাইলের কালীহাতি উপজেলার নারান্দিয়ায় তোফাজ্জল হোসেন তুহিন কারিগরি স্কুল কেন্দ্রে একটি কক্ষের অনেক শিক্ষার্থীকে শিক্ষকের সামনেই বই খুলে উত্তর লেখার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ঐ ভিডিও প্রকাশের পর আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে দেশ জুড়ে। এছাড়া কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলার থানাহাট এ ইউ পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে দেওয়াল টপকে পরীক্ষার হলে নকল সরবরাহের ছবিও ছড়িয়ে পড়েছে ইন্টারনেটে।