
গত তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্থগিত হয়েছে এইচএসসিসহ অনেক পরীক্ষা। এসএসসির ফল প্রকাশ হলেও করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে এইচএসসিতে ভর্তি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে করোনাভাইরাস মহামারিতে পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকট হচ্ছে সেশনজটের আশঙ্কা। পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। সংকট সমাধানে অনলাইন ক্লাসের ব্যাপ্তি বাড়ানোর পরিকল্পনা ঘোষণা দেয়া হলেও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তা বাস্তবায়ন করতে পারছে না। করোনাভাইরাসের ছোবলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে দেশের শিক্ষা খাত। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষা খাতে করোনাভাইরাসের প্রভাব পুনরুদ্ধারের জন্য কমপক্ষে দুই-তিন বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। জিডিপির অনুপাত হিসাবে শিক্ষায় সরকারের ব্যয় গত বেশ কয়েক বছর ধরে প্রায় ২ শতাংশই থেকে গেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য অনেক দেশের তুলনায় কম। সেটি এখন বাড়াতে হবে। পরিকল্পিতভাবে শিক্ষা খাতের ব্যয় নির্ধারণ করতে হবে। মহামারির কারণে অনেক শিক্ষার্থী স্কুল থেকে ঝরে পড়বে এবং এতে বাল্যবিয়ে, অকাল গর্ভধারণ ও শিশু শ্রম বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গণসাক্ষরতা অভিযানের পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে শিক্ষা খাতের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই। এবারের বাজেটও একটি গতানুগতিক শিক্ষা বাজেট। ফলে এই বরাদ্দের মাধ্যমে কভিড-১৯ এর জন্য পড়াশোনার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না।’
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ জানান, ‘শিক্ষা খাতে করোনাভাইরাসের প্রভাব পুনরুদ্ধারের জন্য কমপক্ষে দুই-তিন বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। বাজেটে করোনাভাইরাস সংকট থেকে উপজেলাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা পুনরুদ্ধারে সরকারের পাঁচ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ থাকা উচিত। বিশেষ বরাদ্দ ছাড়া শিক্ষা খাতের এই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব নয়।
গত ৩ জুন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশন (সিএএমপিই) প্রকাশিত এক জরিপে ১২৬ জন এনজিও ও শিক্ষক প্রতিনিধিরা তাদের মতামত জানান। করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি ও ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাস দেন তারা।
জরিপে অংশ নেয়াদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ মনে করেন, স্কুলে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে; ৭২ শতাংশ জানান, অপুষ্টির কারণে শিশুদের শিক্ষায় প্রভাব পড়বে; ৭১ শতাংশ মনে করেন, শিশুশ্রম বাড়বে ও ৫৮ শতাংশ বলেছেন, বাল্যবিয়ে বাড়বে।
এই পরিস্থিতির বিপরীতে শিক্ষা ব্যবস্থায় সাফল্য অব্যাহত রাখতে ও যেকোনো ধরনের ‘বিপর্যয়’ রোধে শিক্ষা খাতে তারা মোট বাজেটের অন্তত ১৫ শতাংশ বরাদ্দের আহ্বান জানান। এরপরও শিক্ষা খাতের এই সংকট মোকাবেলায় সরকারের বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত শনাক্ত হয়। এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গত ১৬ মার্চ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। এর ফলে পিছিয়ে যায় এইচএসসি পরীক্ষাও। ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকায় পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দেখা দিচ্ছে সেশনজটের আশঙ্কা।
শিক্ষা কার্যক্রম যাতে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন না হয়, সে আশঙ্কা থেকে প্রথমে মাধ্যমিক স্কুলের জন্য সংসদ টিভিতে ক্লাস পরিচালনা শুরু করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর। এরপর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের উদ্যোগে শুরু হয় প্রাথমিকের ক্লাস। কয়েক মাস ধরে চলছে এ শিক্ষা কার্যক্রম।
জানা গেছে, দীর্ঘমেয়াদি সংকটের কথা মাথায় রেখেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনলাইনে ক্লাস পরিচালনার তাগাদা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল। তবে ইউজিসির আহ্বানের পরও অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় তার অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে পারছে না সফলভাবে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কোনোমতে জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালাচ্ছে। আবার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে একটি বা দুটি বিভাগে সপ্তাহে একটি, দুটি ক্লাস হচ্ছে।
তুলনামূলকভাবে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ডিজিটালাইজ না হওয়া ও শিক্ষার্থীরা গ্রামের বাড়ি চলে যাওয়ায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ কাজে সফল হতে পারছে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চলমান সেমিস্টার গত এপ্রিলে শেষ হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সেমিস্টার কোর্স অনলাইনে পাঠদানের মাধ্যমে সম্পন্ন করেছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এ সেমিস্টারের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি।
জানা গেছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের কীভাবে পরের সেমিস্টারে উত্তীর্ণ দেখানো যায়, তা নিয়ে সম্প্রতি একটি ভার্চুয়াল বৈঠক করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, ইউজিসি চেয়ারম্যান ড. কাজী শহীদুল্লাহসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা এতে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
এ ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা। তাই সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার পরই স্কুল-কলেজে যাবে ছাত্র-ছাত্রীরা। যে সংকট শুরু হয়েছে, তাতে আমরা বলতে পারছি না যে, কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। তা জানলে সে হিসেবে ব্যবস্থা নিতাম। অনিশ্চয়তা থাকায় শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠানো যাচ্ছে না। যদি করোনাভাইরাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয় তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি আরো বাড়বে। যেভাবে সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশন ও অনলাইনে ক্লাস কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে এটি চলমান থাকবে। অনলাইনে ক্লাসের পরিসীমা আরো বিস্তৃত করা হবে।’
জানা যায়, করোনাভাইরাসের প্রভাবে শুধু শিক্ষার্থী নয় শিক্ষকরাও বিপাকে পড়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা নামমাত্র কিছু বেতন পেয়ে থাকেন। কোথাও কোথাও তাও পান না। বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের টিউশন ফিও বন্ধ। কারিগরি শিক্ষার প্রসারে দেশে বেসরকারি উদ্যোগে ৫৫৩টি বেসরকারি পলিটেকনিক গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠান শুধু শিক্ষার্থীদের বেতনের ওপর নির্ভরশীল। প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার সংস্থান হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলম সাজু বলেন, ‘করোনাভাইরাসের প্রকোপ আরো দীর্ঘায়িত হলে পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করবে। দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার প্রায় ৯৭ শতাংশ বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত হয়। শিক্ষা খাত বাঁচাতে সংশ্লিষ্ট স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিনিধি ও শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা যেতে পারে। সরকার ঘোষিত প্রণোদনার অংশ থেকে শিক্ষার জন্য একটি বিশেষ ফান্ড গঠন করা প্রয়োজন। একইসাথে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা সরকারের কাছে প্রণোদনাও চেয়েছেন।’
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য শিক্ষা খাতে ৬৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন। তিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ২৪ হাজার ৯৩৭ কোটি, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় ৩৩ হাজার ১১৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য আট হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন।
শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ মোট ব্যয়ের ১১.৬৯ শতাংশ ও জিডিপির ২.০৯ শতাংশ। চলতি বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ৬১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ ও জিডিপির ২.১ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় জানান, করোনাভাইরাস সংকটের কারণে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর সাধারণ শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে। কোনো নির্দিষ্ট নির্দেশিকা উল্লেখ না করে তিনি বলেন, ‘আগামী অর্থবছরে শিক্ষা খাতে এই ক্ষতি পুষিয়ে তোলা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য বাজেটে আমরা প্রয়োজনীয় সম্পদের জোগান রাখছি।’