Logo
×

Follow Us

শিক্ষা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে পড়ার একশ’ বছর

Icon

এ আর সুমন

প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০২০, ১২:৩২

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে পড়ার একশ’ বছর

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ভ্যাকসিন আবিষ্কারে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা প্রতিষ্ঠানের নাম অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের সফল ট্রায়ালও চালিয়েছেন। পুরো বিশ্ব আপাতত অক্সফোর্ডের দিকেই বেশি তাকিয়ে আছেন। একইসময়ে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্যানিটাইজার বানাতে সক্ষম হয়েছে। স্যানিটাইজার তৈরির পর সংবাদ হলো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় হলো! প্রশ্ন উঠতে পারে, কোথায় স্যানিটাইজার আর কোথায় করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন! তবে সে দোষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে লাভ নেই।

রাষ্ট্রীয়ভাবেই সেই ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। সেজন্যই হয়তো স্যানিটাইজার পেয়েই আজ খুশি থাকতে হচ্ছে আমাদের। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক পালাবদলে এ বিশ্ববিদ্যালয় রেখেছে বিশেষ ভূমিকা। গত ১ জুলাই এ ভূখ-ের সবচেয়ে প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী উচ্চশিক্ষার বাতিঘর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পা রাখল একশ’র কোটায়। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি কিংবা বিকাশে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

ইতিহাসবিদরা বলে থাকেন, ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এর একটি রাজনৈতিক দিক ছিল। ‘বঙ্গভঙ্গ’ বাতিল করার রাজকীয় ক্ষতিপূরণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় বলে অনেকে মনে করেন। ১৯২১ সালে রাজসিক কর্মযজ্ঞে উপাচার্য হিসেবে ব্রিটেন থেকে নিয়ে আসা হয় শিক্ষাবিদ পি জে হার্টজকে। পরিকল্পনা ছিল ঢাকা হবে পূর্ব বাংলার বুদ্ধিবৃত্তিক রাজধানী আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে শক্তিশালী স্কুল অব হিস্টরি, প্রাকটিক্যাল স্কুল অব সোশ্যাল ইকোনমিকস।

এরপর নানা বিপত্তি থাকা সত্ত্বেও উপমহাদেশের প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৯৩০ সালের মধ্যেই এশিয়ার দশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটিতে পরিণত হয়। তখন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টি ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাতি লাভ করে। এরপর টালমাটাল সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সম্মুখ নেতৃত্ব দিয়েছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রুখেছে, ভাষার দাবি আদায় করেছে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় রেখেছে অনন্য ভূমিকা। এরপর স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন-সংগ্রাম বাঁক বদলের ভূমিকা রেখেছে। এমন গৌরবময় ইতিহাস পৃথিবীর আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে কী?

বলা হচ্ছে সাফল্যের একশ’ বছর। জানতে চেয়েছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য কোথায় কোথায়। সাম্প্রতিক দেশকালের কাছে তার ব্যাখ্যা দিয়ে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সাফল্য আছে, তা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বাইরে। প্রশাসনের আধিপত্যের বাইরে অনেক শিক্ষককে আমরা পাই। পঞ্চাশের দশকে পেয়েছি, ষাটের দশকে পেয়েছি। তখন ওই শিক্ষকরা আইয়ুব খান, মোনায়েম খানদের বিরোধিতা করে কাজ করেছেন, জ্ঞানচর্চা করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন। তারাই কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব রক্ষা করেছেন।

স্বাধীনতার পর এ ধারার শিক্ষকরাই প্রশাসনিক কিংবা সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে জ্ঞানচর্চা করেন, মুক্ত চিন্তা করেন, প্রতিবাদ করেন। এ ধরনের শিক্ষক-শিক্ষার্থী এখনো আছেন। এটিই হলো গৌরবের ধারা। তারা খুব চাপের মধ্যে থাকেন। সম্ভাবনাটা ওই জায়গাতেই দেখি যে এত চাপ, প্রতিকূল পরিবেশ এবং আধিপত্য সন্ত্রাসের মধ্যেও একটি ভিন্নধারা আমরা শিক্ষকদের মধ্যেও পাই, শিক্ষার্থীদের মধ্যেও পাই। প্রতিবাদের যে ইতিহাস বা সংস্কৃতি সেটি কম হলেও এখনো আছে। যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে গর্ব করতেই হয়, এটিই তার প্রধান কারণ। অপরদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ধারাটি হলো-  শিক্ষা-গবেষণাবিরোধী ধারা। যা যে কোনো দেশ বা জাতির জন্য একটি লজ্জার বিষয়।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সাফল্যগুলো আছে, তা এই জনগোষ্ঠী এবং রাষ্ট্রের বিকাশের সঙ্গে যুক্ত। দুটি বিষয় এখানে ঘটেনি, এক. পরিকল্পিতভাবে কী করা হবে, সেটির বাস্তবায়ন এখানে হয়নি। সাফল্য এসেছে জনগোষ্ঠীর রাজনীতি এবং অপরাপর কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে। দুই. এই সাফল্যের মধ্যে একাডেমির ভাগ প্রায় নেই, খুবই কম। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- একটি বিশ্ববিদ্যালয় আগামীর দিনগুলোতে, আগামী দশ বা বিশ বছর কীভাবে চলবে, কোথায় যাবে সেটির ভালো পরিকল্পনা করা। এ পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কখনো ছিল না বা এখনো পৌঁছাতে পারেনি।’ 

ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার সমাজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল। সেই অধ্যাদেশের মূল বিষয় ছিল, বিশ্ববিদ্যালয় হবে স্বায়ত্তশাসিত এবং সেখানে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ থাকবে। প্রশ্ন হলো, এখন কী সেই স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ আছে, স্বায়ত্তশাসনই বা কতটুকু আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের?

এ প্রসঙ্গে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় সবসময় একটি সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয় সমাজের জ্ঞান সৃষ্টির কেন্দ্র। নতুন প্রজন্ম তৈরি করা, সেই প্রজন্মের সঙ্গে নিত্য নতুন জ্ঞান, গবেষণার সংযোগ স্থাপনের জন্যই তো দরকার বিশ্ববিদ্যালয়। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তখনই সফল হতে পারে, যখন সেখানে জ্ঞান উৎপাদন হয়, চর্চা হয়, গবেষণা-শিক্ষা প্রাধান্য পায়। আমাদের দেশে সমস্যাটা হলো- বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকার যে চোখে দেখে, সেখানে জ্ঞানচর্চা বা গবেষণার গুরুত্ব নেই। সেখানে গুরুত্ব পায় একটি অধীনস্ত এবং অনুগত জনগোষ্ঠী তৈরি করা। আর অনুগত জনগোষ্ঠী তৈরি করতে গেলে সেখানে শিক্ষকদের মেরুদ-হীন করতে হয়, শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি অনুগত গোষ্ঠী তৈরি করতে হয়। যে কোনো ভিন্ন চিন্তা বা নতুন চিন্তাকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে সন্ত্রাসের আশ্রয় নিতে হয়। এগুলোর মধ্য থেকেই জন্ম নেয় দুর্নীতি, ভুল নিয়োগ- যাদের শিক্ষক হওয়ার কথা না, তারা শিক্ষক হয়। এর কারণে সমাজের প্রত্যাশা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক দূরে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের একটি বড় অংশ আছেন, যাদের মেধা ও যোগ্যতা আন্তর্জাতিক মানের; কিন্তু এখানে গবেষণায় গুরুত্ব ও যথেষ্ট বরাদ্দ না থাকা এবং সন্ত্রাসী ও অনুগত বাহিনীর আধিপত্যের ফলে শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশই তৈরি হয়নি। প্রশাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, সরকার প্রশাসনকে বাছাই করে এমন সব লোকদের দিয়ে, যারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে সক্ষম নয় কিংবা যারা দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করবে। এর ফলে ওই প্রতিষ্ঠানে কিভাবে মুক্ত চিন্তা হবে, কিভাবে শিক্ষা-গবেষণা হবে, কিভাবে নতুন চিন্তার যোগ হবে! এই সমস্যা সব বিশ্ববিদ্যালয়েই আছে; কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি আরও বেশি বেদনাদায়ক। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে প্রত্যাশা সবচেয়ে বেশি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন আন্তর্জাতিক মানের হয়ে উঠতে পারেনি- এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘এ কথা বলার আগে খেয়াল রাখতে হবে আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ বা সরকার এটি কখনো চেয়েছে কিনা! এর সঙ্গে বাজেটের বিষয় যুক্ত, পরিকল্পনা এবং আকাক্সক্ষার বিষয়টি যুক্ত। আসলে বিশ্ববিদ্যালয়কে মুখে মুখে শ্রদ্ধা-সম্মান ছাড়া কার্যত এ ব্যাপারে কখনো কোনো উদ্যোগ নেয়নি আমাদের সমাজ বা প্রভাবশালী গোষ্ঠী বা রাষ্ট্র। এর প্রমাণ হলো- গবেষণা কার্যক্রম। সারাবিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেভাবে কাজ হয়, তার কোনো ধরনের কাঠামো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। গবেষণায় ঢুকতে হলে কাঠামোগত পরিবর্তন করতে হবে। সেই পরিবর্তনের দিকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কখনো আকাক্সক্ষা দেখায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় না, বিশ্ববিদ্যালয় পারে না- এসব একদম বানোয়াট কথা। ওই ধরনের ব্যাপারের মধ্যে আমরা আসলে কখনোই যাইনি।’ 

তিনি আরও যোগ করেন, ‘অক্সফোর্ডে যে গবেষণা হচ্ছে, তা যদি কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রত্যাশা করেন, তা হবে ইতর সামাজিক প্রত্যাশা। যেভাবে অক্সফোর্ড কাজ করে, যেভাবে গবেষণা প্রকল্প নেয়, রাষ্ট্রের সঙ্গে বা কোম্পানির সঙ্গে কাজ করে, বা বাজেট পায়; সেইসঙ্গে পিএইচডি গবেষণা, মাস্টার্সে গবেষণা, শিক্ষকদের প্রকল্পে গবেষণা- এই লম্বা প্রক্রিয়া নিয়ে আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র বা পুঁজিপতিরা কখনো ভাবেনি। কখনো খবর নেয়নি। এখন হঠাৎ করেই একটি আকাক্সক্ষা জেগেছে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিছু করবে। এর মানে- তারা গবেষণা বলতে কিছু জানে না।’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস অব্যাহত সংগ্রামের ইতিহাস। লড়তে হয়েছে তাকে দুই ফ্রন্টে- একটি জ্ঞানের, অন্যটি সামাজিকতার। তবে এ কথা সত্য, বিভিন্ন সময় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব হয়েছে। অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনভাবে জ্ঞানের চর্চা করতে পারেনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও রাষ্ট্রীয় বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ চালিয়েছে। বারংবার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে। বৈরিতার এই পরিবেশের ভেতরই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান যে কাজ- জ্ঞান আহরণ, জ্ঞান সৃষ্টি ও জ্ঞান বিতরণ, সেই কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে। শিক্ষাদান চলেছে, শিক্ষকরা গবেষণা ও প্রকাশনা করেছেন। হ্যাঁ, কাজটা হয়তো সন্তোষজনক মাত্রার হয়নি; কিন্তু তার দায়-দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের একার নয়, গোটা সমাজের।’ 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫