
মহামারি করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) সংক্রমণ শুরুর পর বিশ্বের প্রায় সব দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অবশ্য কিছু দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসায় ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে বাংলাদেশে কবে নাগাদ শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে তা নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে।
করোনা বিস্তার রোধে দেশের সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সময়সীমা বাড়িয়ে আগামী ৬ আগস্ট পর্যন্ত করা হয়েছে। তবে ঈদের পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে কবে তা নিয়ে দোটানায় রয়েছেন অভিভাবকেরা। করোনার কারণে প্রায় পাঁচ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে সব প্রকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
সর্বশেষ সিদ্ধান্তে বলা হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটির সময়ে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রচারিত ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রেণি পাঠ গ্রহণ করতে হবে। অবশ্য সরকার থেকে ইঙ্গিত দেয়া হয়, করোনাভাইরাসের বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে এই ছুটি আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গড়াতে পারে।
তবে ঈদের পরে স্কুলে ছুটির বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিব আকরাম-আল-হোসেন শীর্ষস্থানীয় একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ছুটি অবশ্যই বাড়বে। যে অবস্থা, তাতে সেপ্টেম্বরের আগে খুলতেই পারব না। আগে বাচ্চাদের নিরাপত্তা। তারপরে অন্য কিছু। সেপ্টেম্বরকে লক্ষ্য করে আমরা এগোচ্ছি। সেপ্টেম্বরের আগে স্কুল খুলব না।
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তারা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছেন। ছুটির বিষয়ে সম্ভবত ঈদের আগেই জানানো হবে।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে গত ১৮ মার্চ থেকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এরই মধ্যে ভাইরাসের বিস্তার রোধে দেশের সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সময় তিন দফা বাড়িয়ে আগামী ৬ আগস্ট পর্যন্ত ছুটি বাড়ানো হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিকের দিকে গেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন পাঠ কার্যক্রমের বাইরে থাকায় তাদের ফের অভ্যস্ত করার প্রয়োজন হবে। পাশাপাশি করোনা থেকে তাদেরকে পুরোপুরি সুরক্ষিত করাও বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া সিলেবাস ও পরীক্ষা নিতে না পারায় যে ক্ষতি হচ্ছে, তা পুষিয়ে নিতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে।
বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামসুদ্দিন মাসুদ গণমাধ্যমকে বলেন, শিক্ষকরা অনেকেই শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে আছেন। অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন, টেলিভিশনেও ক্লাস চলছে। তবে করোনার পর ক্লাস-পরীক্ষা শুরু বিষয়ে পরিকল্পনা নিতে হবে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথাও ভাবতে হবে।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সংক্রমণের মাত্রা বিবেচনায় বিভিন্ন দেশে শিক্ষা কার্যক্রম ধীরে ধীরে চালু হচ্ছে। ডেনমার্কে গত ১১ মার্চ বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুল খুলছে আগামী ২০ এপ্রিল। ব্রিটেনে জুন থেকে কিছু কার্যক্রম শুরু হয়েছে। চলতি জুলাইয়ের শুরুতে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছে থাইল্যান্ডে। তবে তাদের জন্য কাঁচের বিশেষ নিরাপত্তা দেয়াল করা হয়েছে। পাশাপাশি তাপমাত্রা মাপা, হাত ধোয়াসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
তবে প্রতিবেশী দেশ ভারত এখনো স্কুল খোলার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। সেখানে প্রতিদিনই করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে। বাংলাদেশেও একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ অবস্থায় আপাতত পরীক্ষা ছাড়াই পাস করিয়ে দেয়াসহ অনলাইনে কার্যক্রম জোরদার করার মতো নানা বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
শিক্ষা সংশ্লিষ্ট এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগে করোনার ঝুঁকি কমাতে মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহার, হাত ধোয়া কিংবা তাপমাত্রা মাপার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সেজন্য বড় পরিসরে প্রস্তুতি নিতে হবে আগে থেকেই। শ্রেণিকক্ষে কীভাবে বসবে তা ঠিক করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের শ্রেণিকক্ষ সংকট বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমন সমস্যা সমাধানে জার্মানি, ইংল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশে আলাদা শিফট করে শ্রেণি কার্যক্রম চালানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এছাড়া শিক্ষার্থীদের পরস্পরের সরাসরি যোগাযোগ কার্যক্রম বন্ধ রাখা দরকার। যেমন অ্যাসেম্বলি, টিফিনের মতো সময় রয়েছে। বিদ্যালয়ে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময়ের বিষয়টিও ভাবতে হবে। গণ পরিবহন ব্যবহারের ঝুঁকিও রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকার মতো শহরে এ ধরনের সমস্যা প্রকট। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে করণীয় কি? সিলেবাস, পরীক্ষা, পরবর্তী শিক্ষাবর্ষ কীভাবে শেষ হবে, সে ব্যাপারে বৃহৎ পরিকল্পনা নিতে হবে। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থিক সক্ষমতার বিষয়টিও আমলে নিতে হবে।
তবে বিষয়টি নিয়ে সরকার ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে বলে জানান জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির (নেপ) শিক্ষা গবেষক মুহাম্মদ সালাউদ্দিন। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, করোনা পরবর্তী শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর জন্য সরকার ইতোমধ্যে একটি নীতিমালা তৈরি করেছে। আগে থেকেই সব ঠিক করে রাখা হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেই সরকার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে দেবে।
তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকরাও তাদের দায়িত্ব তখন বুঝতে পারবেন। সেক্ষেত্রে সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক তারা সিলেবাসসহ সার্বিক কার্যক্রম শেষ করবেন। এছাড়া টেলিভিশনে ক্লাস, বাড়ি বাড়ি গিয়ে তদারকির মতো বিষয়গুলো তো রয়েছেই।
এসব বিষয়ে নিয়ে সরকারও নানা পরিকল্পনা নেয়ার কথা জানিয়েছে। সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, মনে হয়, একাদশে খুব শিগগিরই ভর্তি শুরু করতে পারবো। করোনার মধ্যেই এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল দিতে পারলাম। এখন তাদের কলেজে ভর্তির বিষয়। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য আরো অপেক্ষা করতে হবে হয়তো। কিন্তু ভর্তি অনলাইনে করা যায়, তাই শিগগিরই ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবো।
এদিকে সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ৬ আগস্ট পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। এরপরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হচ্ছে না ইঙ্গিত করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেছেন, করোনার মধ্যে কবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছেনা। সোমবার (২৭ জুলাই) এডুকেশন রিপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ (ইরাব) আয়োজিত অনলাইন সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, করোনা সংক্রমণের মধ্যে মার্চের মাঝামাঝি থেকে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘ এ বন্ধে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অনলাইন ও সংসদ টিভিকে ক্লাস নেয়া হচ্ছে। তবে আমরা সবাইকে এখানে অন্তর্ভুক্ত করতে পারিনি। এ বিষয়ে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। আগামী ৬ আগস্ট পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। এরপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার কোন সিদ্ধান্ত এখনো নেয়া হয়নি। আর কবে খুলছে তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছেনা। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোনা যাচ্ছে ঈদের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলা হচ্ছে, এটা সম্পূর্ণ গুজব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলার সিদ্ধান্ত হলে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবে কিংবা তা বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা হবে।
তিনি বলেন, করোনার কারণে চলতি শিক্ষাবর্ষ বাড়িয়ে পরবর্তী শিক্ষাবর্ষ কমিয়ে আনারও পরিকল্পনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে বর্তমান শিক্ষাবর্ষ আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টেনে নেয়া যেতে পারে। আর সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলা হলে ডিসেম্বরের মধ্যে শিক্ষাবর্ষ শেষ করারও পরিকল্পনা রয়েছে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে করোনা পরিস্থিতির ওপর।
মহামারি করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে গত ১৮ মার্চ থেকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এরই মধ্যে ভাইরাসের বিস্তার রোধে দেশের সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সময় তিন দফা বাড়িয়ে আগামী ৬ আগস্ট পর্যন্ত ছুটি বাড়ানো হয়। করোনা সংক্রমণ এখনো উচ্চ থাকায় নীতি নির্ধারকরা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না, কবে চালু করা যাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।