এইচএসসিতে অটোপাস
উচ্চ শিক্ষায় আসন সংকটের আশঙ্কা

মাহমুদ সালেহীন খান
প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৯:৩৭

ফাইল ছবি
মহামারি করোনাভাইরাসের জন্য দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পরীক্ষার হলে বসা হয়নি দেশের ১৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭৭ এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার্থীর।
পরীক্ষা ছাড়াই ইতিমধ্যে এইচএসসির ফল প্রকাশিত হয়েছে। এই ফলে সবাই পাস করেছে অর্থাৎ পাসের হার ১০০ ভাগ। পরীক্ষায় কেউ ফেল করেনি, তাই সবাই খুশি।
ডিজিটালভাবে ফল প্রকাশের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম। আগের পরীক্ষার ভিত্তিতে করা মূল্যায়নে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে এক লাখ ৬১ হাজার ৮০৭ জন। ২০১৯ সালের এইচএসসি ও সমমানে পাসের হার ছিল ৭৩.৯৩ শতাংশ এবং জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪৭ হাজার ২৮৬। এর আগের বছর ২০১৮ সালে পাসের হার ছিল ৬৬.৬৪ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছিল ২৯ হাজার ২৬২ জন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ফল নিয়ে বিরূপ মন্তব্য না করার আহ্বান জানিয়েছেন। তারপরও শিক্ষাবিদরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। উদ্বেগ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছেন অভিভাবকরা। তাই সর্বোচ্চ জিপিএ প্রাপ্তির উচ্ছ্বাসের সাথে দুশ্চিন্তাও বেড়েছে। শিক্ষাবিদদের কেউ কেউ বলছেন, অটোপাস কোনো শিক্ষায় ভালো উদ্যোগ হতে পারে না। এতে শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। চাকরির বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলেও মনে করেন তারা।
শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, দেশের ভালো বা নামকরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে সেখানে ভর্তির ক্ষেত্রে এবার সুযোগবঞ্চিত হবে লক্ষাধিক শিক্ষার্থী। তারা বলছেন, উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ থাকে বুয়েট, মেডিকেল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশসেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া; কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের মোট আসনসংখ্যার চেয়ে এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি শিক্ষার্থী। ফলে তিন ভাগের দুই ভাগ জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীই তাদের কাক্ষিত প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাবেন না।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এইচএসসির অটোপাসকে ‘সরকারের একটি ভুল সিদ্ধান্ত’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘সরকার চাইলেই সব কিছু করতে পারে। তবে আমাদের সন্তানদের অন্ধকারেও ফেলে দিতে পারে। এই ফলাফলের মাধ্যমে এটিই প্রমাণিত হলো। মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার সুযোগ পাবে না। সরকার চাইলে আরেকটু সময় নিয়ে পরীক্ষা নিতে পারতো। এখন দেখার বিষয় উচ্চ শিক্ষায় ভর্তির প্রক্রিয়া কী হয়। এখন আরো একটি আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এইচএসসির মতো যদি অন্যান্য পরীক্ষার ফলও এভাবে দেয়া হয়, তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থা পুরোটাই নড়বড়ে হয়ে যাবে। এখন তো সব কিছু খোলা। তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে অটোপাস দেয়ার যুক্তিটা কোথায়। এর পেছনে অন্য কোনো ষড়যন্ত্র আছে কি-না, এটিও দেখার বিষয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ভালো প্রতিষ্ঠানে যেসংখ্যক আসন রয়েছে, তার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি শিক্ষার্থী এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায় সর্বোচ্চ জিপিএ নিয়েও অনেককে এবার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে হবে। কেননা আসন সংকটের কারণে পছন্দের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেক শিক্ষার্থীর ভর্তির সুযোগ হবে না।’
অন্যদিকে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানিয়েছেন, ‘উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা সব শিক্ষার্থীর জন্য এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর্যাপ্ত আসন থাকতে হবে বিষয়টি এমন নয়। সীমাবদ্ধতা নিয়েই আমাদের চলতে হবে। আবার সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে, তাও তো নয়। আমাদের আরো নানারকম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘কারিগরি শিক্ষার অনেক জায়গা আছে। সেখানে আসন খালি থাকে; কিন্তু আমরা শিক্ষার্থী পাই না। এবার আশা করি, সেদিকে যেতে অনেকে উদ্বুদ্ধ হবেন। এটি তাদের জন্যও ভালো, দেশের জন্যও।’
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া দেশের ৪৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট আসন রয়েছে ৪৭ হাজার ১৭১টি। সেক্ষেত্রে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কমিটি এ সিদ্ধান্ত নেবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল এই ফলকে একটি ‘প্রহসনের ফলাফল’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, ‘সবকিছু নিয়ে ছিনিমিনি খেলা ঠিক না। পাস করা এতসংখ্যক শিক্ষার্থী কি উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি হতে পারবে? ভর্তি হলেও কীভাবে সেই প্রক্রিয়া শেষ হবে? সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে ভর্তি হতে না পেরে বহু শিক্ষার্থী এবার নিম্নমানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে। কারণ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসন খুবই সীমিত আর ভালোমানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রেও রয়েছে প্রতিযোগিতা। ফলে এবার বিনা পরীক্ষায় এইচএসসিতে উত্তীর্ণ হওয়া দুর্বল শিক্ষার্থীরা সহজলভ্য হিসেবে নিম্নমানের কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নেবে। আর এতেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লাভ সবচেয়ে বেশি।’
‘পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাই এখন আইসিইউতে আছে’ মন্তব্য করে জাহাঙ্গীরনগর বি্বেবিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘মানুষের শরীরে অক্সিজেনের লেভেল ৯৫-এর নিচে এলে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নিতে হয়। এই অটোপাসের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থাকে এখন আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হলো। অটোপাস কোনো যুক্তিতেই হতে পারে না। ১৯৭২ সালেও এমন অটোপাসের ব্যবস্থা করা হয়। তখন থেকেই শুরু হয় নকল প্রবণতা। যার খেসারত জাতি আজও দিচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘যে দেশে করোনাকালীন নির্বাচন হয়, সে দেশে পরীক্ষা হতে পারবে না কেন? বলা হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ; কিন্তু সেই ব্যবস্থায় তো পরীক্ষা নেয়া হলো না। তাহলে কোথায় ডিজিটাল বাংলাদেশ? এ শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আরো ভেবেচিন্তে এ সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন ছিল। আমি মনে করি, সরকারের এ সিদ্ধান্ত অগ্রহণযোগ্য।’