
অনলাইন পাঠদানের মাধ্যমে ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। ফাইল ছবি
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়াশোনা করে আয়ুস্মান। আয়ুস্মানের মা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। গত বছর থেকে শুরু হওয়া করোনার কারণে দেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। তাই তার পড়াশোনাও বন্ধ। আয়ুস্মানের মায়ের অভিযোগ তার ছেলে মোটেও পড়াশোনা করে না। করতেও চায় না। সারাদিন ঘ্যান ঘ্যান করলেও আয়ুস্মানের একটাই কথা, স্কুল বন্ধ পড়াশোনা কেন করব! যদিও অনলাইন পাঠদানের মাধ্যমে এই ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে সেখানেও তো বাচ্চাদের আগ্রহ নেই।
উপরের কথাগুলো বলেছেন এক অভিভাবক। তিনি আরও বলেন, আমরাই কতটা অনলাইনের বিষয়ে গুরুত্ব দেই। সেখানে ছোট ছোট শিশুরাইবা কী করবে। বলার জন্য বলতে হয়, বাচ্চার ক্লাস হচ্ছে অনলাইনে। এভাবে কী হয়! সেজন্য বাচ্চারা পড়ছে না, শিখছে না। যদি বলা হয়ে থাকে তবে তা লোক দেখানো।
এমন আরও একজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা হলো, তিনি মঈন আব্দুল্লাহ। পেশায় সংবাদকর্মী। তিনি তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলেন, ‘ক্লাস সেভেনে পড়া আমার ছেলে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। সে এখন ব্যস্ত থাকে টিভিতে খেলাধুলা দেখে। কিছু বললে বলে, এ বছর আর পড়াশোনা নেই। কারণ স্কুল খুলছে না। খুবই হতাশ। কী হবে বাচ্চার ভবিষ্যৎ!’
এসব খুদে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অসংখ্য। করোনার কারণে যারা পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ছে, আগ্রহ হারাচ্ছে বইয়ের প্রতি। তাতে শঙ্কিত অভিভাবকরা। বর্তমানে দেশে কী পরিমাণে শিক্ষার্থী পড়াশোনার বাইরে চলে যাচ্ছে, সেটি নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করেছে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি)। তাতে উঠে এসেছে আশঙ্কাজনক চিত্র।
করোনাভাইরাসের মহামারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। এ সময়ে দেশের প্রাথমিকের ১৯ শতাংশ ও মাধ্যমিকের ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী শিখতে না পারার (লার্নিং লস) ঝুঁকিতে আছে। পুনরুদ্ধার কর্মসূচি হাতে নিয়ে এদের না শেখালে তারা ঝরে পড়বে। বেসরকারি এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণাটি শহর ও মফস্বলের প্রায় ৬ হাজার ৯৯ জন অভিভাবকের ওপর জরিপের ভিত্তিতে করা হয়েছে। গত ১১ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত এই জরিপটি করা হয়। গবেষণাটি করেছে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি)।
পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, গবেষণায় উঠে আসা শিখতে না পারার ঝুঁকিতে থাকা শিক্ষার্থীদের হার দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের মোট শিক্ষার্থীর সঙ্গে মেলালে প্রায় ৬০ লাখ শিক্ষার্থী এ ঝুঁকিতে আছে। তারা ঝরে যাওয়ার হুমকির মুখে আছে। কারণ তারা এখন মোটামুটি পড়াশোনার বাইরে রয়েছে। পুনরুদ্ধার করা না গেলে তাদের অবধারিত হবে ঝরেপড়া। তাই তাদের জন্য পুনরুদ্ধার কর্মসূচি হাতে নিতে হবে।
একটি ইতিবাচক তথ্যও উঠে এসেছে গবেষণায়। গবেষণায় পুনরায় স্কুল খোলার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তবে করোনাভাইরাসে গতিবিধি দেখে স্কুল খোলার দিনক্ষণ ঠিক করতে হবে। উল্লেখ্য করোনাভাইরাসের কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চলমান ছুটি ২৯ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এই সময়ে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এর আগের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ২৩ মে থেকে স্কুল, কলেজে এবং ২৪ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কথা ছিল। করোনা ভাইরাসের কারণে ১৪ মাস ধরে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। ফলে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী মারাত্মক সমস্যায় পড়েছে। ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের অনেকে ঘাটতি নিয়ে ওপরের ক্লাসে উঠছে। কতটুকু শিখল, সেটাও যাচাই করা যাচ্ছে না।
জানা গেছে, এর আগে সরকার করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করে ২৩ মে থেকে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল; কিন্তু সম্প্রতি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় এবং ভারতীয় ধরন নিয়ে উদ্বেগ থাকায় চলমান বিধিনিষেধ বৃদ্ধির চিন্তাভাবনার পাশাপাশি স্কুল-কলেজ খোলাও পিছিয়ে যাচ্ছে।
শিশুদের শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ার পাশাপাশি বেড়েছে শিক্ষা খরচ। গবেষণায় সেই তথ্যও উঠে এসেছে। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, গত বছর জুন থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত শিক্ষা খরচ বেড়েছে প্রায় ১২ গুণ। শিক্ষার এই খরচ বাড়ায় ৪৬ শতাংশ অভিভাবকরা শঙ্কিত।
গবেষণায় বলা হচ্ছে, দরিদ্র নয় এমন শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রাইভেট টিউশনে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। এই হার মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৬১ শতাংশ। গবেষণায় উঠে আসে, শহরের বস্তিতে দৈনন্দিন খরচ বেশি। ফলে শহরের বস্তিতে বসবাসরত শিক্ষার্থীদের কোচিং কিংবা প্রাইভেটে গিয়ে পড়ালেখা করার হার কম। এ ক্ষেত্রে তারা মা-বাবা ও ভাই-বোনদের সহায়তা নিয়ে পড়ালেখা করে। গবেষণায় মহামারিতে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থাও উঠে আসে। গ্রামের চেয়ে শহরের ১০ থেকে ২০ বছর বয়সীদের মানসিক চাপ বেশি। গ্রামে এই হার ৮.৪ শতাংশ, শহরে ১৫.৭ শতাংশ। এই মানসিক চাপের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে অধৈর্য ভাব প্রকাশ, রাগ কিংবা উগ্র ভাব, বাইরে যেতে ভয় পাওয়া।
ড. হোসেন জিল্লুর স্কুল বন্ধের ফলে সৃষ্ট তিনটি প্রধান সংকটের কথা তুলে ধরেন। শিক্ষণ ঘাটতি, শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন স্তরের সামাজিক দূরত্ব।
বিষয়টি নিয়ে সাম্প্রতিক দেশকালকে শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা করোনার কারণে একটি অনিশ্চয়তার মাঝে বাস করছি। দেশে বর্তমানের করোনাভাইরাসের যে দ্বিতীয় ঢেউ চলছে, তা আমলে নিয়ে এখন উচিত শিশুদের মাঝে শিক্ষার ঘাটতি ঠেকানো, শিক্ষায় অনাগ্রহ কমাতে এবং অভিভাবকদের শিক্ষাসংক্রান্ত আশঙ্কা দূর করতে পুনরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া। করোনা-পরবর্তী পর্যায়ে মানবসম্পদ পুনরুদ্ধারের জন্য অতিরিক্ত কার্যক্রম, ক্লাসের বাইরের শিক্ষণ কর্মসূচিকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। নইলে আমাদের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ শুধু শিক্ষা থেকে দূরে সরে গিয়ে অদক্ষ হিসেবে বেড়ে উঠবে। প্রচলিত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বৃত্তি প্রদান কর্মসূচিকে শিক্ষা খরচ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। পুনরুদ্ধার কর্মসূচি নিয়ে তাদের শেখানোর উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি সরকারের করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিকে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান এই শিক্ষাবিদ।
গবেষণা অনুযায়ী শিখতে না পারার ঝুঁকিতে থাকা শিক্ষার্থীদের শতাংশ দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের মোট শিক্ষার্থীর সঙ্গে মেলালে তা সংখ্যায় দাঁড়ায় প্রায় ৬০ লাখ। গবেষণায় লেখাপড়ার বিষয়ে অভিভাবকদের চিন্তার মধ্যে রয়েছে শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমে যাওয়া, শিক্ষার খরচ তুলনামূলক বৃদ্ধি, স্কুল কবে খুলবে সেটি নিয়ে চিন্তা এবং পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি নিয়ে চিন্তা। তারা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি দেখে স্কুল খোলার দিনক্ষণ ঠিক করার পরামর্শ দেন।
সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৯৭ দশমিক ৭ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষার্থীর অভিভাবক এবং ৯৬ শতাংশ মাধ্যমিকের অভিভাবক বলেছেন, পুনরায় স্কুল খুললে তারা সন্তানদের স্কুলে পাঠাবেন।