বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্ত্র চর্চা ও শিক্ষা সংকট
অস্বস্তিকর আত্মসমীক্ষা

আহমেদ কামাল
প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২১, ১৪:৫৪

ফাইল ছবি
সম্প্রতি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রী এক প্রেস ব্রিফিংয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা নিয়ে কিছু বিরূপ মন্তব্য করেছেন। এতে শিক্ষকদের অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে শিক্ষকদের নিয়ে অনেক অপ্রীতিকর মন্তব্য এসেছে। একটি মন্তব্য আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। একজন লিখেছেন, ‘নিজেদের মর্যাদা না রাখতে পারলে, রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে এভাবেই অপমানিত হতে হয়।’ কথাটি সত্য এবং বাস্তবসম্মত।
ষাটের দশকের শেষে এবং সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও পরে শিক্ষক হিসেবে দেখেছি রাজনৈতিক নেতারা আমাদের শ্রদ্ধেয় কিছু শিক্ষকের বাসায় যাতায়াত করতেন রাজনৈতিক পরামর্শের জন্য। বড় মাপের জাতীয় নেতাদেরও আমাদের কয়েকজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের বাসায় যাতায়াত করতে দেখেছি। আশির দশক থেকে শুনতে শুরু করি- শিক্ষকরা মন্ত্রীর দর্শনপ্রার্থী হিসেবে তাদের একান্ত সচিবের কক্ষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেন।
সরকার প্রধানদের সঙ্গে দেখা করার রীতি অনেক দিন ধরে প্রচলিত আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য নানা রঙের যেসব দল আছে, তারা বহুদিন ধরেই রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিতে অভ্যস্ত। এ ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমাদের শিক্ষকসমাজ এক অস্বস্তিকর ভ্রান্তিতে আক্রান্ত। যেসব শিক্ষক বড় দলের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত এবং সেই দলের রাজনৈতিক আদর্শকে মনেপ্রাণে লালন করেন; তারা সেই দলের নেতা-কর্মীদের সব কর্মকাণ্ড সমালোচনার উর্ধ্বে মনে করেন। ফলে গঠনমূলক সমালোচনার সংস্কৃতিদলীয় শিক্ষকদের মধ্যে তৈরি হয় না। ফলে তাদের মর্যাদাও নেতাদের কাছে অন্যান্য কর্মীদের স্তরেই স্থান পায়। আমি এই বক্তব্যটি অনুসরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদার প্রশ্ন নিয়ে কিছু লিখতে চাই।
১৯৯৩ সালে ‘New York Times’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে Most violent campus in the world নামে আখ্যায়িত করেছিল; আমি তখন আমেরিকাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকর্মে নিয়োজিত ছিলাম এবং এই ক্যাম্পাস সম্বন্ধে এ কথা কেন বলা হলো এর উত্তর আমার সহকর্মীদের কাছে অনেক দিন দিতে হয়েছে। সহকর্মীদের কাছে সেদিন যে উত্তর দিয়েছিলাম আমার আজকের উত্তর সেরকম হবে না। সেদিন আমি কখনো দেশের রাজনীতি, কখনো রাজনীতিবিদ, কখনো ছাত্র, কখনোবা অন্য শিক্ষকদের দোষারোপ করে বিদেশিদের কাছে আমার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার চেষ্টা করেছি। তাদের প্রশ্নের পুরো উত্তর আজও পাওয়া যায়নি।
’৬২-এর কালাকানুনের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রসমাজ প্রায় এক যুগব্যাপী এক ঝুঁকিপূর্ণ লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছিল। সেই লড়াইয়ের প্রথম সারির শিক্ষকদের অনেককেই ’৭১’র রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। প্রতি ডিসেম্বরে আমরা তাঁদের আত্মদানকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। একটি গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণে তাঁদের আত্মত্যাগ দীর্ঘদিন আমাদের চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকবে। স্বাধীনতা লাভের পর ৪৪ বছর পার হওয়ার পথে। যে স্বপ্ন নিয়ে আমরা একদিন হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলাম, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমাদের প্রচেষ্টার খতিয়ান দেওয়ার দাবি ক্রমে উচ্চকিত হচ্ছে।
’৭৩-এর অধ্যাদেশ প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে বিজয় সূচিত হয়েছিল সেই সুদীর্ঘ লড়াইয়ের; যে লড়াই ছিল গণতন্ত্রের জন্য, যে লড়াই ছিল শিক্ষাঙ্গনে স্বায়ত্তশাসনের জন্য। সে দিন আমাদের ধারণা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গণতন্ত্রায়ন হলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন এলে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন ও সৃষ্টিশীল চিন্তাধারা বিকশিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় হবে গণতন্ত্র চর্চার সূতিকাগার আর অবসান হবে স্বার্থান্বেষী মহলের প্রগতিবিরোধী ষড়যন্ত্রের। সেদিন আরও ধারণা হয়েছিল, কেবল একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পরিবেশই একটি উন্নয়নশীল দরিদ্র দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার উপযোগী হতে পারে। দুঃখের বিষয়, আজ আমরা একথা জোর গলায় বলতে পারি না, আমাদের ধারণা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। কেন হয় নি, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আজ আমাদের কঠোর আত্মসমালোচনার মুখোমুখি হতে হবে। যদি সে আত্মসমালোচনা সততার সঙ্গে করা যায় তাহলে এখনো যে ভ্রান্তির জালে আমরা আটকে পড়ে আছি, তা থেকে মুক্তি সম্ভব বলে মনে করি।
’৭৩-এর অধ্যাদেশের মাধ্যমে প্রশাসনে ব্যাপক গণতন্ত্রায়ন হলো, কিন্তু সে গণতন্ত্রায়ন ছিল নিতান্তই আনুষ্ঠানিক ‘কতগুলো নির্বাচনের সমাহার মাত্র’। সেই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে আমরা ভুলে গেলাম, শুধু ভোট দিলেই গণতন্ত্রায়ন হয় না এবং প্রয়োজন যে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ তা আমরা অচিরেই বিসর্জন দিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে অবহেলিত হলো গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধির প্রচেষ্টা, তৈরি হলো না যুগোপযোগী কারিকুলাম, হলো না মেধার সঠিক মূল্যায়ন। অনিয়মের অভিযোগ এলো শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে- মেধা প্রায় হটে গেল দলীয় শক্তির দাপটে। এই প্রক্রিয়ায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার মান হলো নিম্নগামী, শিক্ষকের মর্যাদা হলো ভূলুণ্ঠিত। জাতীয় রাজনীতি ও ছাত্র রাজনীতির অদূরদর্শী আঁতাতে শিক্ষাঙ্গন হলো সন্ত্রাসের আখড়া। কিছু শিক্ষকের জন্য ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ভিত্তি হলো ব্যক্তিগত হীনস্বার্থ চরিতার্থতার কৌশল। নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাত্রা যে গতিতে বাড়ল সেই গতিইে হারিয়ে গেলো শিক্ষকদের জবাবদিহির প্রক্রিয়া। প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য শুরু হলো রাজনৈতিক দলের বেপরোয়া লেজুড়বৃত্তি, রাজনৈতিক দলের কর্মীদের জন্য সৃষ্টি করতে হলো অন্যায় সুযোগ-সুবিধা। আর নিজেদের জন্য এই অন্যায় সুযোগ-সুবিধার খেলায় অনেক শিক্ষকই পিছপা ছিলেন না। এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বড় সহায়ক হলো ’৭৩-এর অধ্যাদেশ। এই অধ্যাদেশে আমাদের জন্য সবই ছিল, ছিল না শুধু জবাবদিহির ব্যবস্থা। কারণ, আমাদের গণতান্ত্রিক বোধের গভীরে বাসা বেঁধে রয়েছে এক নিরেট স্বেচ্ছাচারিতা আর স্বার্থপরতা। গণতন্ত্রায়ন ও স্বায়ত্তশাসনের পরিমণ্ডলে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমাদের উৎসাহিত করতে পারতো জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার নতুন নতুন প্রশ্ন উত্থাপনে, উৎসাহিত করতে পারতো সুদীর্ঘ পরাধীনতাপ্রসূত হীনম্মন্যতা ঝেড়ে ফেলে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে, আমাদেরই দায়িত্বহীনতায় সেই সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হলো। এটা নিশ্চিত যে, এই পরিস্থিতি দিনের পর দিন আমাদের অনেকের মানসিক শান্তি হরণ করে চলেছে। পাশাপাশি একথাও ঠিক যে, এর জন্য ‘আমি নই- অন্য কেউ দায়ী’; এ কথা বলে আজ আর পার পাওয়া যাবে না। এর দায় আমাদের সবাইকে নিতে হবে।
আজকে আমরা একটা ভিন্ন জগতে প্রবেশ করেছি, সে জগতের সমস্যা বুঝতে হলে সেই জগৎটাকে আমাদের বুঝতে চেষ্টা করতে হবে। আমরা বলি বিশ্বায়ন, অর্থাৎ ‘বাজার’ এর প্রাধান্য; বাজারের এই প্রাধান্যের মানেটা কি? বাজারের প্রাধান্যের মানে হচ্ছে ক্রেতা, বিক্রেতা, ফড়িয়া আর দালাল-বাটপারদের আধিপত্য। অতএব, এই ধরনের একটি যুগে, এমন একটি সমাজব্যবস্থা যেখানে দুর্নীতি হবে না, যেখানে সন্ত্রাস হবে না; এটা চিন্তা করাই বাহুল্য মাত্র এবং তার সমাধান শুধু শিক্ষাঙ্গনে থাকবে, তার সমাধান শিক্ষাঙ্গনের বাইরে এককভাবে থাকবে, সেটা ভাবাটা এক ধরনের বোকামি। এ সমস্যাটা যেমন বিশ্বব্যাপী, এর সমাধান করতে গিয়েও আমাদের সেই বিশ্ব সমস্যার সঙ্গে জাতীয় সমস্যা, শিক্ষার সমস্যা, সেই শিক্ষার সমস্যার মধ্যে আমার অস্তিত্বগত সমস্যা- এগুলোকে পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে।
আমরা কেন দুর্নীতিগ্রস্ত হই? কেন একজন দুর্নীতি করেনি বলে তাকে সবাই বোকা বলে? মানুষের এই মূল্যবোধ কিভাবে বদলে গেল- তার রূপান্তরের প্রক্রিয়াটা যদি আমরা বুঝতে পারতাম, আলোচনা করতে পারতাম, তাহলে আমরা অনেক বেশি শিক্ষিত হতে পারতাম।
এরকম আলোচনা উঠলেই অনেকে মনে করেন, ষাটের দশক ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দশক। এই গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পেছনের কারণটা আমরা আলোচনা করি না। ষাটের দশকে ভালো ছেলেদের সামনে বিকশিত হওয়ার পথ খুব খোলা ছিল না। এই কারণে ভালো ছাত্রদের রাজনীতিতে আসতে হতো। তারা লেখাপড়া করত আবার রাজনীতিও করত। কারণ তারা জানত, যে ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে তারা আছে ওই রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে তারা বৈষম্যের শিকার হবে, এর থেকে বের হতে পারবে না, তাদের জীবন বিকশিত হবে না। তাই রাজনীতিও তাদের লেখাপড়া চর্চার একটি অবশ্যম্ভাবী অংশ হিসেবে গণ্য হয়েছিল।
আজ কি হচ্ছে? আজ বিকশিত হওয়ার জন্য আরও একটি পথ খুলে গেছে অর্থাৎ যারা লেখাপড়া করে তাদের বিকশিত হওয়ার পথে বাধা থাকলেও আরেকটি পথও তৈরি হয়েছে। সেটি হচ্ছে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের পথ। এর মাধ্যমে সে ওপরে উঠতে পারে। বর্তমানে অনেকেই ওই পথে ওপরে উঠে যাচ্ছে। বরং বলা ভালো, এ পথেই বেশি মানুষ ‘উপর’-এ উঠছে।
ঢাকা শহরে বাংলাদেশের হাজার হাজার গ্রাম থেকে দু’শ্রেণির মানুষ আসছে। একদল মধ্য এবং উচ্চ কৃষকের সন্তান। তারা লেখাপড়ার মাধ্যমে নিজেদের শ্রেণী উত্তরণে ব্যস্ত। এই শ্রেণি উত্তরণ উচ্চ শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব হচ্ছে। আর গ্রামের ওই দরিদ্র যারা নদীভাঙনে বসতবাড়ি হারিয়ে, কাজ না পেয়ে এবং ধার-দেনায় জর্জরিত হয়েছে তারাও ঢাকা শহরে আসছে নতুনভাবে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে অংশগ্রহণের জন্য।
ধনী কৃষক ও মধ্য কৃষকের সন্তানরা যারা ঢাকায় আসছে, চাকরি খুঁজছে, পড়াশোনা করছে, আত্মীয় খুঁজছে, নিদেনপক্ষে জেলার লোক খুঁজছে তারা জেলাবাদ (আঞ্চলিক ইজম) করছে। তারা Old association করছে, তারা পুরনো কলেজ Associatio করছে। এর মাধ্যমে একটা নেটওয়ার্ক তৈরি হচ্ছে যে নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে তারা ফরমাল সেক্টরে ঢোকার চেষ্টা করছে। এটিকে বলি ‘মামা খোঁজা’। এই মামা খোঁজাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পড়তে সম্পন্ন করছে। শহরে জায়গা দখল করার জন্য জেলা, আত্মীয়তা ও গ্রাম সম্পর্কের মধ্য দিয়ে তাকে ঢুকতে হচ্ছে। এই ঢোকার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই দুর্নীতি বিকশিত হচ্ছে। কারণ এই ঢোকার মধ্য দিয়ে একটা লেনদেন (Exchange) হচ্ছে। যার মাধ্যমে আমি ঢুকেছি তার জন্য কী করব আর আমার জন্য সে কী করবে। এই প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক কর্মীও সংগ্রহ হচ্ছে। Third world, First world, বরিশাল-মাদারীপুর প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের ‘World’ তৈরি হচ্ছে। গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, কখনো কখনো জেলাভিত্তিক এই আঞ্চলিকতা। তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আঞ্চলিকভাবে সংহতি তৈরির এই প্রক্রিয়া এখনো অনেক বেড়ে গেছে। কারণ সমর্থক ও সহযোগীদের সংখ্যার ওপর রাষ্ট্রীয় সম্পদ হস্তগত করার সুযোগ বাড়ে এবং এই পথ দিয়ে উপরে ওঠার জায়গাও হয়ে যায়। আমরা এই পথ দিয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করি। তাই এই অর্থনীতির মধ্যে, এই সমাজব্যবস্থার মধ্যেই এমন একটি প্রক্রিয়া চালু হয়েছে যে প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি, সন্ত্রাস পাশাপাশি চলতে বাধ্য এবং চলছেও। ফলে আজ এককভাবে শিক্ষাঙ্গনের কথা বলে আমরা এই সমস্যার সমাধান করতে পারব না। পুরো সমাজব্যবস্থাটা বদলাতে হবে, পুরো সমাজব্যবস্থা কীভাবে বদলাবে, কী করে নতুনভাবে গড়ে তোলার সংগ্রাম হবে- এই প্রশ্নগুলো মোকাবেলা করতে হবে। এ প্রক্রিয়াটি বদল করতে বা এ প্রক্রিয়াটিকে পাল্টে দিতে যে উদ্যোগ প্রয়োজন সেটিই আজকের কর্মসূচি।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের পদোন্নতি কেন্দ্র করে খুব উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আলোড়ন তুলেছিল বিষয়টি। কারণ তার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। এখন প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এরূপ ঘটনা ঘটছে, কেউ আলোচনাও করে না। সব গা-সওয়া হয়ে গেছে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫- এই তিন বছরে কোনো অনিয়মের জন্য যে পরিমাণ উত্তেজনার সৃষ্টি হতো, আজ আমরা সেগুলো জানিও না, খোঁজও রাখি না, জানতেও চাই না, কেউ বললে শুনতেও চাই না। এগুলো সব গা-সওয়া হয়ে গেছে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রক্রিয়াও দুর্নীতিগ্রস্ত আজকে। আমরা যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করি, অনেক সময় সেটি করার কারণ হলো, আরেকটি অন্যায় করতে চাচ্ছি অথবা ওই অন্যায়ের সুবিধাটি ভোগ করতে পারছি না। এ কারণেই ওই অন্যায়ের প্রতিবাদ করছি। আজ দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চেহারাটা তেমনি দাঁড়িয়ে গেছে।
১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশের ভিত্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্ত্র এসেছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বৈরাচারিতার অবসান ঘটেছিল। যে অধ্যাদেশ নিয়ে আমরা গর্ব করেছি, যার ভিত্তিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আমরা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় করতে চেয়েছিলাম, আজ ওই অধ্যাদেশের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হওয়ার সব সুযোগ তৈরি হয়ে আছে। কারণ আমরা সেটিকে ঠিক সেভাবে ব্যবহার করছি। আমরা ধীরে ধীরে ওই অধ্যাদেশকে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করা যায় তা রপ্ত করে ফেলেছি। আজ কোনো শিক্ষককে যদি উপাচার্য নির্বাচিত হতে হয় তাহলে কী কী করতে হয়, ওই তালিকা যদি উল্লেখ করি তাহলে পাঠক ঘাবড়ে যাবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও এসব করতে হয়! এই তালিকা যদি আমরা খোলামনে আলোচনা করি তাহলেই একদিন সব বেরিয়ে আসবে। এই অবস্থা প্রমাণ করে, একটা ভালো আইন থাকলেও দুর্নীতি বন্ধ হয় না- এটিই হচ্ছে আমাদের অভিজ্ঞতা। তাহলে দুর্নীতি ও সন্ত্রাস বন্ধ করার জন্য আমরা কী করব? আমাদের একটাই কাজ- প্রশ্ন করা, প্রতিবাদ করা, প্রতিরোধ করা; কিন্তু প্রতিরোধ তো প্রতিকার নয়। আমরা মনে করি, প্রতিরোধ চিরন্তন হতে হবে।
আত্মগ্লানি আর আত্মশ্লাঘা কখনোই আত্মশক্তি অর্জনে সহায়ক হতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়টিকে এর পূর্ব গৌরবে ফিরিয়ে আনার জন্য পেছনে আর না তাকিয়ে এবার সামনে তাকানো যাক।
আমরা একুশ শতকের আঙিনায় প্রবেশ করেছি। সারাবিশ্ব আজ এরই আয়োজনে মুখর। বিশ্ব পরিসরে নতুন শতাব্দীতে কে কোথায় জায়গা করে নেবে ওই চিন্তায় সবাই নিমগ্ন। আমরা দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের সদস্য। তাই দেশ ও জাতিকে একুশ শতকের জন্য তৈরি করার গুরুদায়িত্ব অনেকটা আমাদের কাঁধে। ‘একুশ শতক’ শুধু শতবর্ষব্যাপী সময়ের কোনো সূচক নয়। এটি বিশ্বব্যাপী মুক্তবাজার অর্থনীতির অসহনীয় দাপট, জাতিরাষ্ট্রের অবলুপ্তির আয়োজন, প্রযুক্তির আকাশছোঁয়া বিকাশ। আমাদের ঐতিহ্য লালিত যা কিছু মহান ও সুন্দর এর অনেক কিছুই বিশ্বকরণ প্রক্রিয়ার জোরে অবলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা। একমাত্র গভীর মননশীলতা ও সৃষ্টিশীলতার বিকাশ ঘটিয়েই এ অবস্থার মোকাবেলা সম্ভব। আর তা সম্ভব হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় জ্ঞান ও বিজ্ঞানচর্চা আরও সৃষ্টিশীল করে।
এ দায়িত্ব পালন করতে হলে আমাদের ক্ষুদ্র্র স্বার্থ প্রসূত দলাদলি আর যথেচ্ছাচারিতার ঊর্ধ্বে অবস্থান নিতে হবে। সেটি সম্ভব করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়কে রঙবেরঙের দলাদলির ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। অগ্রাধিকার দিতে হবে শিক্ষকদের জবাবদিহির প্রক্রিয়াকে, শিক্ষাকে করতে হবে যুগোপযোগী। সর্বোপরি বর্জন করতে হবে গণতন্ত্র আর স্বায়ত্তশাসনের নামে সব স্বার্থন্বেষী ও দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ড।
লেখক : সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক
ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়