বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা
সংখ্যায় অগ্রগতি হলেও মানে পিছিয়ে

এম ডি হোসাইন
প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:২৪

প্রতীকী ছবি
স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে দেশে নিরক্ষরতা কমেছে আশানুরূপ গতিতে। বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থী এখন বাড়ছে। সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে শিক্ষার চাহিদা তৈরি, ছেলে-মেয়ে সবার মধ্যে সমান শিক্ষা; শিক্ষায় মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ায় নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে।
বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেল। প্রতি বছর গড়ে ৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছেপে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। ঝরে পড়ার হার দিন দিন হ্রাস, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পাওয়া, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে লিঙ্গ সমতা অর্জন, কারিগরি শিক্ষার হার ১৪ শতাংশে উন্নীত হওয়া, ব্যাপকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মাদ্রাসা শিক্ষাধারার আধুনিকায়নসহ গত অর্ধশতকে শিক্ষার ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে।
তবে শিক্ষার মানের প্রশ্নে শিক্ষাবিদদের অতৃপ্তি রয়েই গেছে। সংখ্যাগত দিক থেকে শিক্ষায় ব্যাপক অগ্রগতি হলেও মানের দিক থেকে কাক্ষিত লক্ষ্যে এখনো পৌঁছানো যায়নি বলে মনে করেন তারা। এছাড়া করোনা মহামারি সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে শিক্ষা খাতে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, গত ৫০ বছরে শিক্ষার বিস্তার বেড়েছে, তবে মানের আশানুরূপ উন্নয়ন হয়নি। মানের দিকে আরও নজর দিতে হবে। শিক্ষার মানের সঙ্গে শিখন পদ্ধতি, পাঠ্যক্রম, পাঠ্যবই, শিক্ষক সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের মননশীলতা জাগিয়ে তুলতে না পারলে ফলসর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে মানের উন্নয়ন ঘটবে না। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দিকে আমরা পা বাড়াচ্ছি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ক্ষণে দাঁড়িয়ে শিক্ষাব্যবস্থার মূল্যায়ন প্রসঙ্গে আমি বলব, যা হয়েছে তা ভালোই হয়েছে।
তিনি বলেন, ভবিষ্যতে শিক্ষার বাজেটের দিকে সবিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে শিক্ষায় জিডিপির ৪ শতাংশ অর্থ ব্যবহারের কথা বলেছিলেন। স্বাধীনতার পর প্রণীত ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষানীতিতে জিডিপির ৫ থেকে ৭ শতাংশ অর্থ ব্যবহারের কথা বলা হয়েছিল। ৫০ বছর পর এখন এসে আমরা মাত্র ২ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছি। এ দিয়ে আন্তর্জাতিক মানে শিক্ষাকে উন্নীত করা তো দূরের কথা, দেশীয় মানটাও আমরা ধরে রাখতে পারব না।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষকদের জীবনমান উন্নত করতে তাদের বেতন-ভাতা বাড়াতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সেন্টার অব এক্সিলেন্সে পরিণত করতে হবে। শিক্ষা খাতে এগুলোই আমার প্রত্যাশা।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, শিক্ষার উন্নয়নে আত্মতুষ্টি নয়, আত্মবিশ্বাসকে গুরুত্ব দিতে হবে। গুণগত শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে বৈষম্য কমাতে হবে। নেতিবাচক সমালোচনা কমিয়ে, কী করে সামনে এগোনো যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। দেশ হিসেবে ৫০ বছরে আমাদের অনেক অর্জন রয়েছে। সামরিক সরকারের আমলে কিছুটা আমরা হোঁচট খেয়েছি। গণতান্ত্রিক আমলে অর্থনীতি, দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আমরা বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছি। শিক্ষা খাত নিয়ে আমি বলব, প্রত্যাশিত মান আজও আমরা অর্জন করতে পারিনি। শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো পরীক্ষানির্ভর, সনদসর্বস্ব। শিক্ষা খাতে বৈষম্যের লাগাম আমরা আজও টানতে পারিনি। এগুলোই এখন শিক্ষা খাতের বড় চ্যালেঞ্জ। প্রত্যাশা থাকবে- আগামী দিনগুলোতে শিক্ষার মান বাড়বে।
বই বিতরণে রেকর্ড
দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে অন্যতম বৃহৎ অর্জন কোটি কোটি শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে বই বিতরণ। বিশ্বের অনেক উন্নত ও সমৃদ্ধিশালী দেশও এই উদ্যোগ নিতে পারেনি। ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে সব শিক্ষার্থীকে নতুন বই দেওয়া শুরু হয়েছে। প্রতি বছর প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীকে ৩৫ কোটি বই দেওয়া হচ্ছে। গত ১২ বছরে একবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ২০২০ সালে করোনা মহামারিতে সারা বিশ্বই ছিল ঝুঁকির মুখে। তবুও সব শঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে করোনার মধ্যেও চলতি ২০২১ শিক্ষাবর্ষে বছরের প্রথম দিনেই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে নতুন বই।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্র জানায়, ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০২১ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত মোট ১২ বছরে ৩৬৫ কোটি ৮৪ লাখ ৪৫ হাজার ৭৮১টি বিনামূল্যের বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ চলতি ২০২১ শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চার কোটি ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ২২৬ জন শিক্ষার্থীকে ৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬২ হাজার ৪১২টি বিনামূল্যের বই দেওয়া হয়েছে।
সরকার ২০১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাঝে তাদের নিজেদের ভাষায় বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ শুরু করেছে। চাকমা, মারমা, সাদ্রী, গারো ও ত্রিপুরা এই পাঁচ ভাষার শিশুদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক স্তরে তাদের মাতৃভাষায় বই ছাপানো হয়। এ ছাড়া দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদেরও বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে ব্রেইল বই।
নারী শিক্ষা ১৯৭১ থেকে বর্তমান
ব্যানবেইসের আর্কাইভ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ১৯৭০-৭১ সালে দেশের শিক্ষা পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এর আগের বছরের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে দেওয়া হয়েছে। এতে দেখা যায়, ওই বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে নারী শিক্ষায় হঠাৎ পিছিয়ে যায় দেশ। স্বাধীন বাংলাদেশ ওই পিছিয়ে যাওয়া অবস্থা থেকে নারী শিক্ষা নিয়ে শুরু করে নতুন যাত্রা।
‘অ্যানুয়াল রিপোর্ট অন পাবলিক ইন্সট্রাকশন ফর দ্য ইয়ার ১৯৭০-৭১’ প্রতিবেদন অনুসারে, ওই সময় দেশে মোট শিক্ষার্থীর ২৮.৪ শতাংশ ছিল মেয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ১৮৮টি অনুমোদিত ডিগ্রি কলেজে ৯ শতাংশের বেশি এবং তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩ শতাংশের মতো ছাত্রী ছিলেন। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ হাজার ৯৪৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে নারী ছিলেন ১ হাজার ২৯৪ জন। তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (এখন বুয়েট) ১ হাজার ৭১৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ছিলেন ১২ জন। ময়মনসিংহে অবস্থিত একমাত্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ হাজার ৭৮১ শিক্ষার্থীর মধ্যে কোনো ছাত্রীর তথ্য নেই প্রতিবেদনে। ১০টি আইন কলেজ ও দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ৩ হাজার ৭১৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ৩৬ জন, ৯টি মেডিকেল কলেজে ৩ হাজার ৩৪৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ছিলেন ৬১১ জন। ২টি কমার্স কলেজ ও ৫টি কমার্শিয়াল স্কুলে ৪ হাজার ৩১ জনের মধ্যে ছাত্রী ৫৫ জন, চিত্রাঙ্কন ও হস্তশিল্পের ১টি কলেজ ও ২টি স্কুলে ২৯৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ছিল ৮৭ জন।
৬ হাজার ১৪৭টি সরকারি ও বেসরকারি সিনিয়র মাদ্রাসা, জুনিয়র মাদ্রাসা, হাফিজিয়া ও ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় ৭ লাখের বেশি শিক্ষার্থী থাকলেও ছাত্রীর সংখ্যা কত ছিল, সে তথ্য দেওয়া নেই প্রতিবেদনে। এর আগের বছরে ১৯৬৯-৭০ সালে প্রাথমিকে ৩৪ শতাংশের বেশি এবং মাধ্যমিকে প্রায় ২৯ শতাংশ মেয়ে পড়ত। ১৯৭২-৭৩ সালে ৩২ শতাংশের কিছু বেশি মেয়ে শিক্ষার্থী ছিল। প্রাথমিকে মেয়ে ছিল প্রায় ৩৫ শতাংশ। ১৯৭৩-৭৪ সালে ২৯ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী ছিল দেশে। প্রাথমিকে মেয়ের হার ছিল ৩৩ শতাংশ।
দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নকালে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্পের অধীনে ১৯৮১ সালে প্রথম প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর গঠন করা হয়। এরপর ১৯৯২ সালে এটি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ এবং ২০০৩ সালে স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় হিসেবে গড়ে ওঠে। ২০০৩ সালে প্রাথমিকে মেয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির হার ছিল ৪৯ শতাংশ। মাধ্যমিকে গ্রামীণ পর্যায়ে প্রায় ৫৪ এবং শহরাঞ্চলে এ হার ৫১ শতাংশের কিছু বেশি ছিল। ২০১৫ সালে পেশাদারি শিক্ষায় ৩৯, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে (১৬২টি) ৪৩, দাখিলে ৫৯, আলিমে ৫৪ শতাংশের বেশি এবং কারিগরি শিক্ষায় মেয়ে শিক্ষার্থীর হার ছিল প্রায় ২৪ শতাংশ।
ব্যানবেইসের সর্বশেষ ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, ১৩ ধরনের পেশাগত শিক্ষায় ৫৪, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক (ভকেশনাল) শিক্ষায় ২৫ শতাংশের কিছু বেশি, ইংরেজি মাধ্যমে স্কুলে (১৪৫টি) প্রায় ৪৪ এবং দাখিলে ৬০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী মেয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দা তাহমিনা আখতার বলেন, বাল্যবিবাহ, দারিদ্র্য, বখাটেদের উৎপাতসহ নানা কারণে মেয়েদের শিক্ষা ব্যাহত হলেও সার্বিকভাবে সাধারণ শিক্ষা ও পেশাগত শিক্ষায় মেডিকেল, প্রকৌশল এবং কারিগরি সব ক্ষেত্রে মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। শিক্ষার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের হার বেশি। উপবৃত্তিসহ নানা সুযোগ-সুবিধার কারণেও অনেক অভিভাবক মেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন।