
মেডিকেল কলেজের সব বর্ষের শিক্ষার্থীই এখন ইমপোস্টার সিনড্রোমে ভুগছেন। ছবি: সংগৃহীত
দেশের বেশিরভাগ মেডিকেল শিক্ষার্থী এখন ইমপোস্টার সিনড্রোমে ভুগছেন। নিজেদের প্রতারক ও অযোগ্য ভাবছেন তারা। এই হতাশা কাটতে যোগ্য শিক্ষকেরও অভাব রয়েছে। ইমপোস্টার সিন্ড্রোম একটি মানসিক অবস্থা, যেখানে ব্যক্তি নিজের অর্জন সম্পর্কে দ্বিধায় থাকেন। যার এমন সিন্ড্রোম থাকে সে সব সময় নিজে প্রতারক হিসেবে অন্যদের কাছে প্রকাশ হওয়ার ভয়ে থাকেন। বাহ্যিক সাফল্য থাকলেও, ব্যক্তির এমন সিনড্রোম থাকলে সে নিজেকে প্রতারক মনে করে। এছাড়াও সে বিশ্বাস করে তার অর্জনের জন্য সে যোগ্য নয়।
দেশের মেডিকেল কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই মানসিক অবস্থা বিরাজ করছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, সরকারি মেডিকেল পড়ুয়া ৩৬ শতাংশ শিক্ষার্থী এখন ইমপোস্টার সিনড্রোমে ভুগছেন। বেসরকারি মেডিকেল কলেজে এ হার প্রায় ২৯ শতাংশ। সরকারি আর বেসরকারি মিলে গড়ে এ হার দাঁড়ায় ৩২ শতাংশ এর কিছু বেশি।
এ দিকে দেশের সরকারি-বেসরকারি অনেক মেডিকেল কলেজে শিক্ষকস্বল্পতা রয়েছে। শিক্ষার্থীদের এই হতাশা কাটতে যোগ্য শিক্ষক নেই বেশির ভাগ মেডিকেল কলেজে। বিশেষ করে মৌলিক বিষয় পড়ানোর শিক্ষক নেই। এ অবস্থায় পাঠদান ব্যাহত হওয়ার কথা জানিয়ে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে একাধিকবার চিঠি পাঠিয়েছে; কিন্তু এর সমাধানের জন্য কার্যক্রম কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। একইসাথে ঘাটতি রয়েছে অবকাঠামোগত বিষয়গুলোতেও। দেশে ১৬ কোটি মানুষের প্রতি এক হাজারের জন্য একজন করে চিকিৎসক দরকার হলেও, ১ লাখ ৬০ হাজার চিকিৎসক প্রয়োজন। এত চিকিৎসক দ্রুত তৈরি করার ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক সব সহযোগিতা প্রয়োজন। মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা সে সহযোগিতা পাচ্ছেন না।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, দক্ষ শিক্ষক তৈরি করতে না পারলে, দক্ষ চিকিৎসক তৈরি হবে না। শুধু মেডিকেল কলেজের বড় বড় বিল্ডিং বানানোর চেয়ে মানসম্মত শিক্ষক বেশি জরুরি। মানসম্মত শিক্ষা পেলে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের দুশ্চিন্তা কেটে যাবে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, মেডিকেল কলেজে মানসম্মত শিক্ষক না হলে মানসম্মত ডাক্তারও বের হবে না। জনগণ গুণগত চিকিৎসা সেবাও পাবেন না। মেডিকেল শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য দেশি-বিদেশি প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিজ্ঞান খুবই জরুরি। তাহলে রোগীদের বিদেশগামিতাও কমে যাবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি, বদলি না করে একটি নীতিমালা তৈরি করে যোগ্যতার ভিত্তিতে মেডিকেল শিক্ষার উন্নতি সম্ভব।
রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি ৫০০ মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীর মধ্যে এ গবেষণা চালানো হয়। এতে দেখা গেছে, পুরোপুরি অমূলক হলেও মেডিকেল কলেজের সব বর্ষের শিক্ষার্থীই এখন ইমপোস্টার সিনড্রোমে ভুগছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন কুইন্সল্যান্ড ও ইউনিভার্সিটি অব সিডনির একদল বিশেষজ্ঞ সম্প্রতি এ গবেষণা চালান।
গবেষণায় পাওয়া ফলাফল ব্রিটিশ প্রকাশনা এফ ১০০০ রিসার্চ জার্নালে ‘ডিস্ট্রিবিউশন অব ইমপোস্টার সিনড্রোম অ্যামাং মেডিকেল স্টুডেন্টস অব বাংলাদেশ : আ ক্রস সেকশনাল স্টাডি’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে প্রকাশ হয়েছে। সাধারণ মানসিক রোগের সাথে ইমপোস্টার সিনড্রোমের দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাঝারি ও গুরুতর মাত্রায় ইমপোস্টার সিনড্রোমের উপস্থিতি তাদের মনস্তাত্ত্বিক ও একাডেমিক অবস্থানকে প্রভাবিত করে। এসব শিক্ষার্থী আত্মবিশ্বাসী হতে পারেন না।
মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস অধ্যয়নরত সব বর্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যেই কম বেশি এ সমস্যা দেখা যায়। এর মধ্যে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ২৭, দ্বিতীয় বর্ষের ১৯, তৃতীয় বর্ষের ৪০, চতুর্থ বর্ষের ৪০ ও পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ৩৮ শতাংশের মধ্যে নিজেকে প্রতারক মনে করার প্রবণতা রয়েছে।
পরিবারের আয়ও মেডিকেল শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইমপোস্টার সিনড্রোমের প্রাদুর্ভাবে বড় ভূমিকা রাখে। আয়ভিত্তিক বিভাজনে দেখা গিয়েছে, সবচেয়ে কম আয়সীমার পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে এর প্রকোপ বেশি। মাসিক আয় ২০ হাজার টাকার কম, এমন পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪২.৯, ২১ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয়সীমার পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইমপোস্টার সিনড্রোমে ভুগছেন ৩৮.৯, এ ছাড়া ৩১ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয়সীমার ক্ষেত্রে এ হার ৩৫.১ শতাংশ। মাসে ৪১ হাজার টাকা বা তার বেশি আয়কারী পরিবারগুলোর শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তা ৩০.২ শতাংশ ।
এছাড়া ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে ইমপোস্টার সিনড্রোমের প্রাদুর্ভাব কিছুটা বেশি। ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের তুলনামূলক বাড়তি উদ্বেগে ভুগতে দেখা যায়। আবার পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে পরিশ্রম করার প্রবণতাও তাদের মধ্যে বেশি।
নোয়াখালীর আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আব্দুছ ছালাম বলেন, আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে। তাছাড়া মেডিকেলের পাঠ্যক্রমেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়ে একজন শিক্ষার্থী চিকিৎসক হওয়ার জন্য যে শিক্ষা নিচ্ছে, তার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। এখানে বাস্তবসম্মত জ্ঞানের অভাব রয়েছে। তাদের সাহিত্য, সমাজ, নৃবিজ্ঞান শেখানো হচ্ছে না। ফলে ওই শিক্ষার্থী এ সমাজের সাথে তার জ্ঞানের সমন্বয় পায় না।
পাস করে বের হওয়ার সময় এগিয়ে আসার সাথে সাথে মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তার পরিমাণও বাড়তে থাকে। বিশেষ করে পাঠ্যক্রম, অধ্যয়ন ও নিজের কর্মক্ষমতা নিয়ে উদ্বেগে থাকেন তারা। আর সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ কাজ করে ভবিষ্যতের পেশাগত অবস্থান নিয়ে। মানসিক চাপের কারণে এক পর্যায়ে কেউ কেউ পড়াশোনাও ছেড়ে দেন।
গবেষকদের অন্যতম মো. শাহজালাল বলেন, মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইমপোস্টার সিনড্রোমের প্রভাব কেমন সেটিই মূলত দেখার চেষ্টা করেছি। এ গবেষণার ফলাফল আমলে নিয়ে পরবর্তী সময়ে আরো বিস্তর গবেষণা করা যেতে পারে। সেখানে হয়তো উঠে আসবে কী কারণে এমন হচ্ছে।
ইমপোস্টার সিনড্রোমে ভুক্তভোগীদের ৩৩ শতাংশ পরিবারের ইচ্ছায় মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিলেন বলে গবেষকদের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। বাকিদের মধ্যে ১৭ ভালো চাকরির আশায়, ৩৮ চিকিৎসাশিক্ষায় মান ভালো এমন ভাবনায় এবং ৩৪ শতাংশ নিজের ইচ্ছায় মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন।