Logo
×

Follow Us

শিক্ষা

শিক্ষাসামগ্রীতে মূল্যস্ফীতির খড়গ

অভিভাবকদের নাভিশ্বাস

Icon

এ আর সুমন

প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২২, ১০:৪৭

শিক্ষাসামগ্রীতে মূল্যস্ফীতির খড়গ

স্টেশনারি সামগ্রী। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেওয়া তথ্যানুসারে গত আগস্টে দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর সেপ্টেম্বর মাসে তা কিছুটা কমে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ হয়। আগস্ট মাসে গত ১১ বছর ৩ মাসের (১৩৫ মাস) মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ২০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। ২০১১ সালের মে মাসের পর মূল্যস্ফীতি আর কখনো ৯ শতাংশের বেশি হয়নি। 

আর সেই সঙ্গে ইউক্রেন- রাশিয়া যুদ্ধের বৈশ্বিক সংকট তো আছেই। দেশে আন্তর্জাতিক মুদ্রার সাশ্রয়ে আমদানিতে লাগাম টানা হয়েছে। টাকার মান কমে যাওয়ায় বেড়েছে কাগজ, কলমসহ সব ধরনের স্টেশনারি সামগ্রীর দাম। তাতে বেড়েছে শিক্ষাব্যয়। নিম্ন- মধ্যবিত্ত পরিবারে ব্যয়ের সঙ্গে তালমেলাতে না পারলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষাসামগ্রীর উচ্চমূল্যে নাভিশ্বাস ছুটে যাচ্ছে অভিভাবকদের। 

লেখার কাগজ দুই মাস আগে প্রতি রিম ছিল ২৮০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা। গত সপ্তাহে তা বেড়ে হয়েছে ৪৮০ টাকা থেকে ৫২০ টাকা। অর্থাৎ আট সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ। এমন তথ্য দিয়েছে ঢাকার বাংলাবাজার, নীলক্ষেত, পল্টন, মতিঝিল ও ফকিরাপুল এলাকার বিক্রেতা ও ক্রেতারা। তারা বলছেন, শুধু কাগজ না, প্রতিটি শিক্ষা উপকরণ- স্টেশনারির দাম বেড়েছে ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত। 

দোকানদাররা বলছেন, যারা আগে সপ্তাহে তিন দিস্তা কাগজ কিনতেন, তারা এখন এক দিস্তা দিয়েই সারছেন। কম দামের কাগজ খুঁজছেন। তাতে তাদের ব্যবসাও খারাপ যাচ্ছে। আর ক্রেতারা বলছেন, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ তাদের আয়ের সঙ্গে এই বর্ধিত মূল্যের সমন্বয় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

বাংলাবাজারের কয়েকটি স্টেশনারি দোকান ঘুরে পরিশ্রান্ত আফসার রহমানের সঙ্গে কথা হলো। তিনি বলেন, তার দুই মেয়ের জন্য প্রতি মাসে কাগজ, কলম, পেন্সিল, রাবার কিনতে হয়। বাঁধাই করা ৩০ টাকার কাগজের খাতা এখন ৫০ থেকে ৬০ টাকা হয়েছে। যে কলমের ডজন ছিল ৩৮ টাকা, সেটি এখন ৫২ টাকা; পেন্সিল ও রংপেন্সিলের দাম গড়ে ৫ টাকা বেড়েছে। বাঁধাধরা স্যালারির চাকরি করে প্রতিনিয়ত খরচ বেড়ে এখন সন্তানের লেখাপড়ার খরচ সামলানো মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামনে কী হবে বুঝতে পারছি না।

নীলক্ষেতের একটি স্টেশনারি দোকানে আসা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আশা বলেন, চারটি ব্যবহারিক খাতা কেনার জন্য কয়েকটি দোকানে ঘুরেছি। যে খাতা গত জানুয়ারি মাসে ১২০ টাকায় কিনতে পারতাম, তার দাম এখন ২০০ টাকা। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের রাবার আগে ৫ থেকে ১০ টাকায় কিনতে পারতাম, তা এখন ১০ থেকে ২৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ব্যয় বেড়েছে ফটোকপিতেও। সেখানেও নাভিশ্বাস।

শিক্ষার্থীদের জন্য সাশ্রয়ে ফটোকপির জন্য বিখ্যাত নীলক্ষেত। সেখানে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মিনার রহমান বলেন, আগে ফটোকপি এক থেকে দেড়শো পৃষ্ঠার বেশি হলে প্রতিপৃষ্ঠায় দিতে হতো দেড় টাকা। এখন আড়াই টাকা প্রতিপৃষ্ঠা। এক থেকে দুই পৃষ্ঠার ফটোকপির মূল্য তিন টাকা করে দিতে হচ্ছে। এটা নিয়ে সেখানকার দোকানদার রইস বলেন, কাগজের মূল্য বেড়েছে। আবার সব সময় বিদ্যুৎ থাকে না। অনেকের জরুরি ফটোকপি করে দিতে হয়। এজন্য জেনারেটর ব্যবহার করেন। আমরা কী করব বলেন। 

পল্টনে মল্লিক প্লাজার একটি স্টেশনারি দোকানে আসা অভিভাববক রনি আব্দুল্লাহ খুঁজতে এসেছেন সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর। দাম শুনে দাঁড়িয়ে গিয়েছেন। দোকানদাররা তাকে জানিয়েছেন, ক্যালকুলেটর আমদানি কম। ক্যাসিও ব্র্যান্ডের সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর মডেলভেদে যেখানে আগে দাম ছিল সাড়ে তিনশ থেকে সাতশ টাকা। এখন সেগুলো সাড়ে চারশো থেকে বারোশ টাকায় দাঁড়িয়েছে। 

চক বাজারের একটি পাইকারি দোকানদার বলেন, ডলারের দাম বাড়ার কারণে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। করোনায় দীর্ঘদিন যাবৎ চায়নিজ স্টেশনারি সামগ্রী আসাও বন্ধ ছিল। পাইকারি পর্যায়ে দাম ৫ থেকে ১০ শতাংশ বেড়েছে দাবি করে তিনি বলেন, খুচরা পর্যায়ে তো দাম একটু বেশিই হবে। 

কল্যাণপুরের অভিভাবক রাবেয়া খাতুনের সঙ্গে কথা হলো। তিনি বলেন, তার সন্তানের জন্য স্কুল থেকে বিষয়ভিত্তিক খাতা কিনতে হয়। ছেলের ড্রয়িং খাতা কেনার জন্য স্কুলে গিয়ে দেখেন বছরের শুরুতে যে খাতা কিনেছেন ৬০ টাকা দিয়ে, সেটি এখন ১০০ টাকা। এ বিষয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানান, কাগজের দাম ও বাঁধাই খরচের কারণে নতুন খাতার দাম বেশি নিচ্ছেন তারা। 

উদ্বেগ প্রকাশ করেন অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু। তিনি সাম্প্রতিক দেশকালের এই প্রতিবেদককে জানান, মৌলিক চাহিদার অন্যতম একটি ‘শিক্ষা’। এটিকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি না। প্রতিদিন নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে- এ নিয়ে হৈ চৈ। সুক্ষচিন্তা করলে কী বোঝা যায়- একজন অভিভাবক যখন নিজের সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন, তখন এই শিক্ষাব্যয় মিটিয়ে তার সন্তানের লেখাপড়া চালিয়ে নিতে পারবেন? নিশ্চয় এরা শিক্ষা থেকে ঝরে যাবে। 

বিষয়টি নিয়ে শিক্ষাবিদ মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘সরকার প্রতিবছর ঝরে পড়া কমানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন স্তরে বৃত্তি, উপবৃত্তি প্রদান করছে। এখন প্রশ্ন হলো- ওই বৃত্তির আর্থিক সুবিধা কতটুকু একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাব্যয় নির্বাহের জন্য সহায়ক? বাস্তবসম্মত একটা পরিমাণ অর্থ দেওয়া উচিত সরকারের। আবার দেখা যায় এই বৃত্তি প্রদানের নীতিমালাও ত্রুটিপূর্ণ। এখন সবার আর্থিক সমস্যা; কিন্তু নীতিমালায় অনেক শর্ত। সে কারণে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে শিক্ষাব্যয় অভিভাবকদের সহনীয় করে রাখার বিষয়ে।’ বিষয়টি নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ারও আহ্বান জানান এই শিক্ষাবিদ।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫