একবার চোখ বন্ধ করে কল্পনা করুন তো, ভোরের শিশির বুকের ওপর নিয়ে এক কচি দূর্বা ঘাস মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে পড়েছে সূর্যের আলো, সে আলোর ঝিকিমিকি লাগছে চোখে। কিংবা কল্পনা করুন কোনো দিন বৃষ্টির পানি আটকে যাচ্ছে গাছের পাতায়, অন্ধকার দিন আরো অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে গহিন ছায়ায়। অথবা কল্পনা করুন, খুব কাছেই পানির মধ্যে এক ঝাঁক বক এক পায়ে দাঁড়িয়ে, নাম না জানা পাখির হুটহাট ডেকে ওঠা নির্জনতায় শব্দের ঢেউ তুলছে। এগুলো কল্পনা হলেও একসঙ্গে বাস্তবে পাওয়া সম্ভব, যদি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচিতি
পাকিস্তান আমলে ১৯৭০ সালে ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭০’-এর আওতায় ৬৯৭.৫৬ একর জায়গাজুড়ে ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বেছে নেওয়া হয় ঢাকা থেকে মাত্র ৩৪ কিলোমিটার দূরে সাভার, প্রকৃতির কোলঘেঁষে থাকা এক স্থান। ১৯৭০ সালের ২০ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু। চার দিন পর, ২৪ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমেদ নিয়োগ পান। ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ক্লাস অনুষ্ঠিত হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধন করা হয় ১২ জানুয়ারি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ১৯৭৩ সালে ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ, ১৯৭৩’ পাস হলে মুসলিম শব্দটি লোপ পায় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নাম নিয়ে পরিচালিত হতে থাকে।
অনুষদ ও বিভাগ
প্রতিষ্ঠালগ্নে অর্থনীতি, ভূগোল, পরিসংখ্যান ও গণিত- এই চারটি বিভাগে মোট ১৫০ জন শিক্ষার্থী এবং ২১ জন শিক্ষক নিয়ে স্নাতক শ্রেণির কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি অনুষদের আওতাভুক্ত ৩৫টি বিভাগ এবং চারটি ইনস্টিটিউট রয়েছে।
নয়নাভিরাম ক্যাম্পাস
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচিত সবুজ স্বর্গ নামে। নামের যথার্থতা কেউ বুঝবে তখন, যখন সে ক্যাম্পাসে পা রাখবে। চারদিকে নানা রকমের সবুজ, এর ফাঁকে ফাঁকে আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে লাল রঙের সব বিল্ডিং। লেকের পানিতে সে বিল্ডিংয়ের প্রতিচ্ছবি। লন্ডন ব্রিজের লেকে শীতের বিকেলে অতিথি পাখিদের ওড়াউড়ির ল্যান্ডস্কেপ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের পাশের শান্তিনিকেতনের নিশ্চুপ পরিবেশ, মাঝে মাঝে ঘন হয়ে থাকা গাছের পাতার ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া শনশন বাতাসের শব্দ- এসব দেখতে হলে জাহাঙ্গীরনগরেই যেতে হবে!
সাংস্কৃতিক রাজধানী
সবুজ স্বর্গের মতো সাংস্কৃতিক রাজধানী উপাধিও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নিজের করে রেখেছে। বাংলায় ১২ মাসে হয় ১৩ পার্বণ, আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় ২৪ পার্বণ! প্রতি মাসেই কোনো না কোনো উৎসব ক্যাম্পাসে চলছেই, হয় অমুক ব্যাচের র্যাগডে, নয় তমুক ব্যাচের পুনর্মিলনী কিংবা কোনো বিভাগের বর্ষপূর্তি কিংবা কোনো একাডেমিক কনফারেন্স। আর মুক্তমঞ্চের নাটক, কনসার্ট, খেলাধুলা, মেলা ও অডিটরিয়ামে দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্র প্রদর্শনী থাকবেই। তবে ক্যাম্পাসের সবচেয়ে আনন্দমুখর দিনগুলোর মধ্যে আছে বিশ্ববিদ্যালয় দিবস ও হিম উৎসব। সপ্তাহব্যাপী হিম উৎসবে সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত অব্দি নাচ, গান, নাটক জীবনের রং চেনাবে।
আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়
জাহাঙ্গীরনগর শতভাগ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সর্বজন পরিচিত। অর্থাৎ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিজন ছাত্রের জন্য হলে একটি করে সিট বরাদ্দ রয়েছে।
বছরের কিছু নির্দিষ্ট দিনে (যেমন- স্বাধীনতা দিবস কিংবা বিজয় দিবসে) ক্যাম্পাসের হলগুলোতে ফিস্টের আয়োজন করা হয়। নামমাত্র মূল্যে কুপন কেটে ছেলেমেয়েরা নিজ নিজ হলের ফিস্টে অংশ নেন। মেয়েদের হলের ব্যাপারটা আরো সুন্দর- ফিস্টের দিন শাড়ি পরা, ছবি তোলা- এই বিষয়গুলো ফিস্টের আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে।
একাডেমিক দিক থেকে এগিয়ে
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক দিক থেকে আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। অবশ্য কিছুটা সেশনজট আছে, কিন্তু পাশাপাশি এটাও সত্যি যে করোনা মহামারির পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নানা উদ্যোগ নিয়েছে ক্লাস ও পরীক্ষা নিয়মিত করতে। বর্তমানে ক্যাম্পাসে একাডেমিক নানা কনফারেন্স, দেশ-বিদেশের নানা স্কলারের সঙ্গে কাজ করার, তাদের অভিজ্ঞতা জানার ও শোনার সুযোগ আগের চেয়ে বেড়েছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বর্তমানে শিক্ষার্থীদের গবেষণা ক্ষেত্রে আগ্রহী করে তোলার দিকেও বিশেষভাবে মনোযোগ দিয়েছে। ফলে অনেক শিক্ষার্থীই বর্তমানে দেশে-বিদেশে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে প্রতিভার সাক্ষর রাখছে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh