Logo
×

Follow Us

ঈদ সংখ্যা ২০২৩

সেই পলাশী বেঁচে আছে স্মৃতি ও নামটুকু সম্বল করে...

Icon

সৌমিত্র দস্তিদার

প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১৪:৫৫

সেই পলাশী বেঁচে আছে স্মৃতি ও নামটুকু সম্বল করে...

নবাব সিরাজউদ্দৌলা। ছবি: সংগৃহীত

সিনেমার লোক হলেও, আদতে তো আমি চিত্রনাট্যকার। স্ক্রিপ্ট লিখতে লিখতেই ওইসব লাইটস, সাউন্ড, ক্যামেরা অ্যাকশন বলতে শেখা। মাঝেমধ্যে ভাবি যদি আচমকা কেউ অবিভক্ত ভারতের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতির সবচেয়ে বিয়োগান্ত সময় নিয়ে চিত্রনাট্য লিখতে বলেন, তার শুরুটা কীভাবে করব!

আপনি প্রশ্ন করবেন, সবচেয়ে বিয়োগান্ত সময়টা আগে বলুন। না হলে বুঝব কী করে কী নিয়ে লিখবেন! দেখুন, আমার উত্তর একটা শিশুও দিতে পারে। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ। ওই যুদ্ধ ভারতকে শুধু দীর্ঘদিন ধরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেই রাখেনি, সে এদেশের পুরো কাঠামোকেই বদলে দেয়। বহু চর্চিত হিন্দু-মুসলমান যে সমস্যা আজও উপমহাদেশের গভীর ক্ষত হয়ে রয়ে গেছে, তার সূচনাও ওই পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার হারের পর থেকে।

সিরাজ যদি না হারতেন, তাহলে খণ্ডিত যে উপমহাদেশকে দেখি, তা কখনোই দৃশ্যমান হতো না। আজকের ভারত বলে যা দেখি তা আসলে এক ঔপনিবেশিক ভূখণ্ড। একদিকে সিরাজের পরাজয়, অন্যদিকে ব্রিটিশ শাসনের সূচনা-এই সন্ধিক্ষণকে বুঝতে গেলে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা আপনাকে শুনতে হবে। জানতে হবে আলীবর্দী খানের প্রিয় নাতির বিরুদ্ধে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মতো জঘন্য কাহিনি।

মীর জাফর, জগৎ শেঠ, উমিচাঁদ, মহারাজা নন্দকুমার, এমনকি শ্রদ্ধেয় রানী ভবানীর সঙ্গে ক্লাইভের আঁতাত....। পলাশীর যুদ্ধের কথকতা মানেই কিন্তু অনেকের ঝাঁ চকচকে, রঙিন নমস্য ভাবমূর্তির বে আব্রু হয়ে যাওয়া। কলকাতার যে বাবু সমাজ ও তাদের নেতৃত্বে গড়ে তোলা, বহু গরিমামণ্ডিত রেনেসাঁ, তার ভিত্তি নির্মিত হয়েছিল নোংরা রাজনীতি করে সিরাজকে হারিয়ে, মুর্শিদাবাদের নবাবী তহবিল লুঠের টাকায়।

কাশিমবাজার কুঠি

ট্রেনে মুর্শিদাবাদ যেতে যেতে নদিয়া পার হয়ে পলাশী স্টেশন চোখে পড়লেই, বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে। সেই পলাশী বেঁচে আছে স্মৃতি ও নামটুকু সম্বল করে। কোথাও কোনো গোলাগুলির শব্দ নেই। ধীরে ধীরে ট্রেন চলছে। শুধু একটা স্টেশন নয়, একটা অধ্যায়, গোটা ইতিহাস পেছনে থেকে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে অলস চোখে একবার দেখা। ইতিহাস বড় নির্মম।

কোথায় সেদিনের সব দোর্দণ্ড প্রভাবশালী ক্লাইভ, মীর জাফর, কোথায় বা সিরাজের বিশ্বস্ত দুই সেনাপতি মীর মদন ও মোহনলাল। গঙ্গা ভাঙনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সেদিনের সেই আমবাগান। তবুও চোখ বন্ধ করলে, কল্পনায় শুনতে পারছি অস্ত্রের ঝনঝনানি, আর্ত চিৎকার, ঘোড়ার খুরের শব্দ, হাতির গর্জন। অন্ধকার নেমেছে বাইরে। মনে মনে ভাবছি এমন এক আলো-আঁধারিতেই ঘনিষ্ঠ দু-একজন অনুচর নিয়ে সিরাজ হার মেনে, প্রাণভয়ে ছুটে চলেছিলেন সদর মুর্শিদাবাদের দিকে। যা কয়েক ঘণ্টা আগেও ছিল স্বাধীন, সার্বভৌম। কতজন মনে রেখেছি ইতিহাসের সেই বিয়োগান্ত অধ্যায়কে!

কখনো কখনো ভাবি যে চিত্রনাট্য শুরু হতে পারে কলকাতার ভোরে। রাত তখনো শেষ হয়নি। পুব দিকের আকাশ ফর্সা হচ্ছে। পাখি ডাকছে। বিপুল ব্রিটিশ স্থাপত্য কয়লাঘাটের রেল অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ফ্ল্যাশব্যাকে আপনি চলে যাচ্ছেন, পলাশী যুদ্ধের ঠিক এক বছর আগে, ১৭৫৬ সালে। কয়লাঘাট, আজকের জিপিও বা জেনারেল পোস্ট অফিস, পাশের রিজার্ভ ব্যাংক, সব মিলিয়ে ছিল ইংরেজের প্রথম কেল্লা।

কেল্লা ঘাট থেকেই তো লোকমুখে আজ তা কয়লা ঘাট। ওই কেল্লাতে বসেই ব্রিটিশদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্ষুধার্ত শ্বাপদের মতো লোলুপ দৃষ্টিতে বঙ্গের বিপুল ধনসম্পদের দিকে তাকিয়ে ছিল। মুর্শিদাবাদ ছিল তাদের পথের কাঁটা। অনেক ঐতিহাসিক সিরাজ চরিত্রের ভুল-ত্রুটি নিয়ে এমন চেঁচামেচি করেন যে মনে হয়, সিরাজউদ্দৌলা পূতপবিত্র ঋষি সন্তান হলে নিশ্চিত তার বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রের নীলনকশা তৈরিই হতো না।

পলাশী যুদ্ধের কথা বলতে গেলে একসঙ্গে অনেক প্রসঙ্গ চলে আসে। রাজরাজড়াদের ইতিহাস মানেই তো যুদ্ধ বিগ্রহ, ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ, ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের আত্মীয় পরিজন ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে কেউ ছাড় দেন না। লোভ, ঈর্ষা, পরশ্রীকাতর মানসিকতা কি সেকালে, কি আধুনিক যুগে কিছুই বদলাল না। মহাভারতের যুগেই বলুন বা মোগল জামানা, রক্তপাত ছাড়া ক্ষমতা দখল নিঃসন্দেহে অসম্ভব ব্যাপার।

ফলে মুর্শিদ কুলি খান বা নবাব আলীবর্দী খানের বিজয় অর্জন এক ছকে বাঁধা। তাই অকারণে বিস্তারে গিয়ে লাভ নেই। তবে এটুকু বলা আজকের দিনে প্রাসঙ্গিক। আলীবর্দী খান ছিলেন সুশাসক। কঠোর পরিশ্রম করতেন। বিলাসবহুল জীবন পছন্দ করতেন না। তার রাজত্বকালে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যথেষ্ট মৈত্রী ছিল। বঙ্গের ইতিহাস আলীবর্দী খানকে মনে রাখবে তিনি ভয়ঙ্কর বর্গীদের বাংলা থেকে উৎখাত করতে পেরেছিলেন বলে।

মীর জাফরের বাড়ি ‘নিমক হারাম দেওড়ি’র প্রবেশপথ

এহেন প্রজাহিতৈষী নবাব আলীবর্দী খান ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল ৮০ বছর বয়সে মারা গেলেন। আলীবর্দী খানের কোনো ছেলে ছিল না। দুই মেয়ে। ঘসেটি ও আমিনা। আমিনার তিন ছেলে। মীর্জা মোহাম্মদ সিরাজউদ্দৌলা, একরামুল উদ্দৌলা ও মীর্জা মেহেদী। ১৭৫২ সালেই আলীবর্দী খান সিরাজকে নিজের মসনদের উত্তরধিকারী মনোনীত করেন। এ বিষয়টি ঘোর অপছন্দ ছিল ঘসেটি বেগমের। তার কোনো ছেলে ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন, আমিনার অন্য দুই ছেলের কোনো একজন নবাব হোন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দুজনেই অল্প বয়সে মারা যাওয়ায় সিরাজ নিষ্কণ্টক হলেও খালার সঙ্গে দ্বন্দ্ব থেকে গেল। 

মুর্শিদাবাদের পাশাপাশি ক্ষমতার আর এক প্যারালাল কেন্দ্র ছিল ঢাকা। যা নিয়ন্ত্রণ করতেন ঘসেটি বেগম। তার স্বামী ছিলেন অসুস্থ ও দুর্বল। ফলে রাজ্য পরিচালনায় ঘসেটি বেগমের মূল ভরসা ছিল দেওয়ান হোসেন কুলি খান। ১৭৫২-এ দাদুর প্রশ্রয় পেয়ে সিরাজ বেপরোয়া হতে লাগলেন এটা ঠিক। কিছু উদ্ধত, অহংকারী, দুর্বিনীত। শাসন করার দক্ষতা আলীবর্দী খানের মতো না থাকার হীনমন্যতা সিরাজ এড়াতেন সময় সময় নিষ্ঠুর আচরণের মধ্যে দিয়ে। 

অপরের খ্যাতি প্রশংসা সিরাজ পছন্দ করতে পারতেন না। কানাঘুষোয় সিরাজ জানতে পারেন যে মা আমিনা ও মাসি ঘসেটি বেগম এক সঙ্গে দেওয়ান হোসেন কুলি খানের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। এমনিতেই হোসেন কুলি খানের জনপ্রিয়তা সহ্য হচ্ছিল না তরুণ যুবরাজের। তারপর আবার কেলেঙ্কারি। ১৭৫৪ সালে ঢাকার রাজপথে খুন হয়ে গেলেন দেওয়ান হোসেন কুলি। ঘসেটি নতুন দেওয়ান মনোনীত করলেন বিক্রমপুরের যুবক রাজবল্লভকে। 

তিনিও অল্প দিনের মধ্যে সিরাজের বিরাগভাজন হলেন। তার বিরুদ্ধে সিরাজ তহবিল তছরুপের অভিযোগ আনলেন। ঘোষণা করলেন এই গর্হিত অপরাধের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তখনো আলীবর্দী বেঁচে। তিনি অবধি বোঝালেন এরকম হঠকারী সিদ্ধান্ত না নিতে। কিন্তু অল্পবয়সী গোঁয়ার্তুমি কি আর সৎ পরামর্শ নেবার পাত্র! কিছুদিন বাদেই তো আলীবর্দী খান চলে গেলেন। আর আনুষ্ঠানিকভাবে সিরাজউদ্দৌলা বাংলা, বিহার, ওড়িশার নবাব হলেন। শেষ স্বাধীন নবাব।

ওদিকে ঢাকার দেওয়ান রাজবল্লভ বুঝেছিলেন, আজ না হোক কাল নবাব তাকে ফাঁসিতে ঠিক লটকাবেন। তাই তিনি ক্ষমতা, যশের মায়া সব ছেড়ে লুকিয়ে চলে এলেন কলকাতায়। সেখানে তখন ধীরে ধীরে প্রভাব বাড়ছে ইংরেজদের। ইংরেজদের সঙ্গে আবার কোনোদিনই ঠিক বনিবনা ছিল না সিরাজের। কেউ কেউ অবশ্য উল্টো কথাও বলেছেন।

পলাশী যুদ্ধের স্মৃতিসৌধে সিরাজউদ্দৌলার ভাস্কর্য

প্রথম দিকে নাকি নবাব ভালো ব্যবহার করতেন সাহেবদের সঙ্গে। কিন্তু ইংরেজদের কিছু আচরণ নবাবকে ক্রমেই ক্ষিপ্ত করে তুলতে লাগল তাদের ওপর। শোনা যায় মৃত্যুর আগে দাদু আলীবর্দী খাঁ স্বয়ং নাকি ইংরেজদের সম্পর্কে নাতিকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ওদের বেশি আশকারা দিও না। সিরাজ তা ভোলেননি।

তাছাড়া সিরাজের অন্য কারোর মাতব্বরি মেনে নেওয়া ধাতে ছিল না। আর ইংরেজরা যে নাক উঁচু দাম্ভিক, পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করে এ নিয়ে তো কোনো সন্দেহ নেই। সিরাজ একটু চপলমতি, অপরিণত হলেও তার সাহস ও লড়াই করার ক্ষমতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠে না। মাত্র ১৩ বছর বয়সে সিরাজের কঠিন যুদ্ধ জয়ের অনেক নজির আছে। তাই ইংরেজদের মাতব্বরি, হামবড়া মেজাজ সিরাজ বিনা প্রশ্নে মানবার বান্দা নন, এটা ইংরেজদের মনে রাখা উচিত ছিল।

আর একটা কথা, স্বাধীনতা নিয়ে সিরাজ আদৌ চিন্তিত ছিলেন বলে মনে হয় না। আর তখন এদেশে তথাকথিত জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়নি। কিন্তু সিরাজ এটা বুঝতেন, রাজত্ব আমার। তুমি যেই হও, আমার অনুমতি না নিয়ে কিছু করার অধিকার তোমার নেই।

সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের মন কষাকষি শুরু ওই রাজবল্লভকে নিয়ে। কলকাতা যাবার আগে যাবতীয় টাকা-পয়সা, সোনা-দানা নিয়ে ছেলে কৃষ্ণরামসহ পরিবারের সবাই তীর্থ যাবার নামে ইংরেজদের পায়ে পড়ার অনেক বাদে সিরাজ নাটকটি জানতে পারেন। তিনি এও বোঝেন তার অনুমান যথার্থ ছিল। রাজবল্লভ সাধু চরিত্রের নয়। কোষাগার থেকে না বলে ধনসম্পদ নিশ্চিত সরিয়েছে। আলীবর্দী না বললে লোকটাকে তখনই কয়েদ করা উচিত ছিল। সিরাজ তখনও নবাব হননি। আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি যুবরাজ মাত্র।

তবুও তিনি ইংরেজদের চিঠি দিলেন ‘শত্রু’কে তার হাতে তুলে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে। নবাব হবার পরে নারায়ণ সিং নামে এক দূতকে পাঠালেন ব্রিটিশ কেল্লায়। গভর্নর রজার ড্রেক ছিলেন অসভ্য টাইপের লোক। সত্যি কথা বলতে কি প্রথমদিকে যে ইংরেজরা ভারতে স্রেফ টাকা লুঠতে এসেছিল, তারা অধিকাংশই এক্কেবারে বাপে খেদানো, মায়ে তাড়ানো, মূর্খ। রজার ড্রেক আবার এক কাঠি ওপরে লুম্পেনপনায়। সে নবাবের দূতকে পাত্তা তো দিলই না, বরং গুপ্তচর বলে তাকে গালমন্দ করতে করতে নবাবের চিঠি কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। নবাবের তরুণ বয়স। সবে মসনদে বসেছেন। মাথা গরম হয়ে গেল সব শুনে।

পলাশীর যুদ্ধের পর মীর জাফর ও রবার্ট ক্লাইভের দেখা করার চিত্র (১৭৬০)

 ততদিনে নবাব হয়ে মোটামুটি খালা ঘসেটি বেগমকে খানিকটা নিজের দিকে নিয়ে এসেছেন। শত্রু তখন একজনই। পুর্ণিয়ার শাসক সৌকত জং। নবাব যাচ্ছিলেন তাকে শায়েস্তা করতে। নবাব ব্রিটিশ ঔদ্ধত্য শুনে ঠিক করে ফেললেন যে আগে গোরাদের একটু সমঝে দিয়ে আসি। কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি আক্রমণ করে তাদের নাস্তানাবুদ করে লিখিয়ে নিলেন, ভদ্র ব্যবহার না করলে ভবিষ্যতে বিপদ আছে। আরও বলে দিলেন, কথা শুনে চলতে হবে। অনুমতি ছাড়া ওসব কেল্লা, পরিখা যা করে ফেলেছেন তা অবিলম্বে ভেঙে ফেলতে হবে। মন জুগিয়ে চললে বাণিজ্য করার অনুমতি দেব। 

ইংরেজদের মধ্যে ছিল প্রচুর স্ববিরোধ। একজন বলেন সিরাজের সঙ্গে মানিয়ে চলতে, অপরজন গর্জে ওঠে, ইংরেজ মরে যাবে তবুও মাথা নোয়াবে না। সত্যি সত্যি কাশিমবাজার কুঠির অধ্যক্ষ ওয়াটস, সিরাজের সঙ্গে অন্য সহকর্মীরা শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে বলে তিনি রাগে-দুঃখে আত্মহত্যা করে বসলেন। এদিকে ড্রেক ছিলেন ওয়াটস গোত্রের। সে কিছুতেই সিরাজের কোনো কথা শুনতে নারাজ। 

অনেকে লিখেছেন, সিরাজের দুর্বিনীত আচরণ ক্ষেপিয়ে তুলেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের। আমি কিন্তু সিরাজের পক্ষে। অল্প বয়সে নবাব হয়েছেন বলে কিছু চারিত্রিক ত্রুটি হয়তো সিরাজের ছিল। কিন্তু পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া বিনা প্ররোচনায় ইংরেজদের তরফেই আগে শুরু হয়েছে। আসলে একদিকে সম্ভ্রান্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু প্রভাবশালী অংশ, মুসলমানদের কয়েকজন এলিট মিলে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সিরাজ নিধনের যে নীল নকশা প্রস্তুত করছিলেন, সিরাজ তা একদম আঁচ করেননি, তাও নয়। পেরেছিলেন বলেই তো মীর জাফরকে ফৌজের মাথা থেকে সরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন মীরমদনকে।

প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে মসনদ সামলাবার গুরুভার দিয়েছিলেন মোহনলালের হাতে। কাশ্মীরি পন্ডিত চতুর মোহনলাল দক্ষতার সঙ্গে রাজ কারবার সামলাচ্ছিলেন। কিন্তু মীরমদন ও মোহনলালের প্রতিপত্তি, আলীবর্দী জামানার লোকদের ঈর্ষান্বিত করে তুলছিল, যা পরবর্তীকালে ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে সিরাজের ক্ষমতা কেড়ে নেয়। এদের মধ্যে জগৎ শেঠ, রায়দুর্লভ ও মীর জাফর ছিলেন তিন কলঙ্কিত খলনায়ক।

কলকাতা দখল করতে নবাব বড় ফৌজ নিয়ে রণংদেহী মেজাজে মুর্শিদাবাদ থেকে এগোতে লাগলেন। এসেই ইংরেজদের কেল্লা আক্রমণ করলেন এবং অচিরেই তা দখল করে শহরের নাম পালটে রাখলেন আলীনগর। নবাবের অতি বড় নিন্দুকেরাও বলেননি যে তিনি কাশিমবাজার বা কলকাতা কোথাও ইংরেজদের ওপর অত্যাচার করেছেন। কোনো ধনসম্পত্তিতে হাত দিয়েছেন এমন অপবাদ কেউ দেননি। ব্ল্যাকহোল হত্যা বলে যে ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা বলে হলওয়েল সাহেব দীর্ঘদিন বাজার গরম করে রেখেছিলেন, তাও পরে জানা গেছিল বিষয়টি নিতান্তই, আজকের ভাষায় ফেক নিউজ। একটা ছোট ঘরে একসঙ্গে জনা চল্লিশ সাহেবকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। গরমে তাদের মধ্যে ১৬ জন মারা যান।

হলওয়েলের হিসেবে বন্দি ছিলেন ১৪৬ জন। তাদের মধ্যে ১শর মতো মারা গিয়েছিল। পরে বিষয়টি অন্যান্য ব্রিটিশ ঐতিহাসিক লিখে গিয়েছেন মনগড়া। অত লোক মারা যাননি। যা-ই হোক, দুর্ভাগ্যবশত যে কজন মারা যান, তার পিছনে সিরাজের কোনো হাত ছিল না। তিনি জেতার পরে পরেই দুর্গ ছেড়ে চলে গেছিলেন। গভর্নর ড্রেক দলবল নিয়ে কোনোরকমে প্রাণ হাতে করে নিজের সৈন্যদের ফেলে পালিয়েছেন।

সিরাজ কলকাতার ভার সেনাধ্যক্ষ মানিকচাঁদের হাতে দিয়ে পুর্ণিয়া চললেন সৌকত জংকে উচিত শিক্ষা দিতে। ওদিকে ফলতায় জমিদারদের নিরাপত্তায় নিশ্চিন্তে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়া ড্রেক ও অন্য গোরারা পরিকল্পনা করতে লাগলেন, চিরকালের মতো সিরাজকে খতম করে বাংলা, বিহার, ওড়িশার দখল নেওয়ার। সে কাজে ব্রিটিশদের দোসর হলেন এদেশের তথাকথিত মান্যবরেরা।

পুর্ণিয়াও ছিল ঢাকার মতো ক্ষমতার আর এক ভরকেন্দ্র। সেই ভরকেন্দ্র সিরাজ বাহিনী ভেঙে দিলেন অতি সহজেই। পুর্ণিয়ার কিছু দূরে নিহত হলেন সৌকত জং। কলকাতা জয় ও প্রতিদ্ব›দ্বী সৌকত জংকে হারিয়ে দেওয়ার পর সিরাজউদ্দৌলা কয়েক দিন বেশ খোশমেজাজে কাটালেন। বুঝতেও পারলেন না ঈশান কোণে কতটা মেঘ জমেছে। হিন্দু উচ্চবর্গীয় ও মুসলিম অভিজাতদের সহায়তায় ইংরেজ সাজ সাজ রব তুলে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিতে লাগল জোর কদমে। তারপরের ইতিহাস শুধু মিথ্যাচার, শঠতা, ধূর্তামি ও বিশ্বাসঘাতকতার।

সিরাজকে যেখানে খুন করা হয়েছিল, মীর জাফরের সেই প্রাসাদকে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে বাবা সন্তানকে বলেন, দ্যাখো, এই হচ্ছে নিমকহারাম দেউড়ি। আসল নাম জাফরগঞ্জ তা লোকে ভুলতে বসেছে। লালবাগ গেলে লোকে হাজার দুয়ারী বা অন্যান্য যা ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখেন সব কিন্তু মীর জাফর পরিবারের। আস্তাবল, কবরখানা, নহবতখানা সব। ছোট্ট একটা নিরাভরণ সাদা মসজিদ ছাড়া স্বাধীন নবাবের চিহ্নমাত্র নেই। গঙ্গার ওপারে রয়ে গেছে সিরাজ আর লুৎফার সমাধি। 

মীর জাফরের বংশধরেরা এখনো আছেন। পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর ইস্কান্দার মির্জা ছিলেন এই মীর জাফর পরিবারের। মীর জাফরের ছেলে মীরনের সপ্তম পুরুষ রেজা আলী খানকে নিয়ে একবার ঢুকেছিলাম জাফরগঞ্জ প্রাসাদের ভেতর। গা ছমছম করছিল। কড়িবরগার মধ্য থেকে শব্দ করে বাদুড় ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে গেল। 

হাজারদুয়ারী প্রাসাদ

বোঝা যায় যে বহুদিন পর সে মানুষের পায়ের শব্দ পেয়ে ভয় পেয়েছে। রেজা আলী রিটায়ার্ড স্কুল টিচার। তিনি বোঝাতে লাগলেন, মীর জাফরকে একা দোষ দিয়ে লাভ নেই। বললেন, মীরনকে নাকি ক্ষমতা দখলের কিছুদিন বাদে ইংরেজরাই গুলি করে মেরে ফেলেছিল। বাইরে ট্যাঙ্গা থেকে ট্যুরিস্ট কোলাহল শুনতে পাচ্ছি। এই যে এখানেই থাকত বেইমান মীর জাফরটা। 

রেজা আলী চোয়াল শক্ত করে ফিসফিসিয়ে অনুনয় করলেন, চলুন চলে যাই। প্রৌঢ় লোকটির চোখে মুখে অসহায় আকুতি। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর পূর্বপুরুষের বিশ্বাসঘাতকতার মাসুল এভাবে গালমন্দ খেয়ে দিয়ে যেতে হচ্ছে। শেষবারের মতো নিচে, মেঝের দিকে তাকালাম। হয়তো তলাতে ছিল কোনো গুমঘর। যেখানে এরকমই এক বিষণ্ন সন্ধ্যা বেলায় আচমকা ছুরি হাতে মোহাম্মদ বেগকে ঢুকতে দেখে সিরাজ আতঙ্ক ও বিস্মিত গলায় চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, তুমি, তুমি আমাকে মারতে এসেছ! সিরাজের মা-বাবা রাস্তা থেকে তুলে এনে অনাথ মোহাম্মদী বেগকে মানুষ করেছিলেন।

পলাশীর যুদ্ধ তো কয়েক ঘণ্টার নাটক। নতুন করে বিবরণ শুনিয়ে কী লাভ! যুদ্ধ শুনতেই, আসলে তো প্রহসন। ইউরোপিয়ানদের মধ্যে মৃত মোটে চারজন, আহত ১৫। নবাবের সৈন্যদের মধ্যে নিহত ১৫, আহত ৮০ জন। নবাবের সেনাবাহিনী ছিল বিশাল। পদাতিক ৩৫ হাজার। ১৫ হাজার ঘোড়া, কামান ছিল ৫৩টি। দুঃখ এটাই যে প্রায় পুরো নবাব বাহিনীই ছিল মীর জাফর, ইয়ার লতিফ ও রায়দুর্লভদের অধীনে।

এ কাহিনির শেষ নেই। অন্ধকারের গল্প বেশিক্ষণ বলতেও ইচ্ছে করে না। পলাশীর পর অনেক কিছু ঘটতে লাগল। কয়েকশ সিপাহিকে বরখাস্ত করা হলো। সত্যি কথা যদি বলতে হয়, তাহলে খোলাখুলি বলাই ভালো যে পলাশীর পর থেকে মুসলমান জীবনে ধীরে ধীরে আঁধার নামতে লাগল।

কখনো চিত্রনাট্য লিখলে কলকাতা দিয়েই শুরু করব, আগেই বলেছি। তার কারণ নবাবের শোচনীয় হারের পর এ শহরের উত্থান। পুরনো কেল্লা ভেঙে গড়ে উঠল ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ। সেখান থেকেই বাংলা ভাষা সাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়ে ফার্সি জলাঞ্জলি দিয়ে ভাষার সংস্কৃতায়নের সূচনা। কলকাতা শহরে হাঁটতে হাঁটতে যে অভিজাত অট্টালিকা চোখে পড়বে, তার অনেকগুলো নির্মাণের পেছনেই খুঁজে পাবেন পলাশী বিপর্যয়ের পর নবাবের কোষাগার লুঠের কোটি কোটি টাকা। ওই টাকাতেই গড়ে উঠেছিল বাবু সমাজ। দুর্গাপূজার রমরমা। বনেদি বাড়িতে সংবর্ধিত হতেন পলাশীর খলনায়ক ক্লাইভ ও অন্য সাহেবেরা। থিয়েটার, দোলচড়ক হিন্দু পার্বণের জোয়ার এলো। তথাকথিত যে নবজাগরণ, সেখানেও পলাশীর ঘাম-রক্ত একেবারে নেই বলা যাবে না। 

লেখক: তথ্যচিত্র নির্মাতা, কলকাতা

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫