
প্রতীকী ছবি
হাটে তেরো হাজার সাতশত টাকায় অস্ট্রেলিয়ান সংকরজাত বাছুরটা কিনে বাড়ি ফেরার সময় শুটকু মামুদ ম্যাজিক দেখায়। নিজের তাবৎ স্মৃতি-স্বপ্ন চারপেয়ে কচি জন্তুটার পিঠে তুলে দিয়ে জোরে চাট্টি মারে, আদিম যুগের শিকারির মতো জিভেও টঙ্কার তোলে-হাট্টেক। ছুটে পালাতে চায় বাছুরটা, মামুদ শক্ত হাতে গলার রশি টেনে ধরে জোরে হাঁটে।
হাটুরে পথিক জানতে চায়, দাম কত হইল বাহে? মামুদ জবাব দেয়, এক লাখ পনেরো হাজার। বছর পরে সম্ভাব্য বেচা দামের স্বপ্নটা মুখ ফস্কে বেরিয়ে যাওয়ার পরও অবাক হয় না লোকটা। বাছুরটার দিকে চোখ রেখে জবাব দেয়, হইবে, নওয়াবজাদাকে তেমন খাদ্যখোরাকি জোগাইলে ছয় মাস পরেই লাখের ওপর যাইবে।
খেতে ধান-পাট আলু-বেগুন যাই করো, চাষাবাদের তুলনায় বিদেশিজাত গরু মোটাতাজা করলেই অধিক লাভ। হিসাবটা ভূমিহীন খেতমজুর কি পুঁজিপাট্টাঅলা গেরস্ত সবাই জানে। এ পথ নিয়েছে অনেকেই। লাখো-কোটি টাকার পুঁজিপতিরা গরুর ফার্ম দিয়েছে গ্রামেও। পুরোনো গোয়ালঘর শূন্য হয়েছিল যেসব চাষির, তারাও অনেকে গোয়াল সংস্কার করে অন্তত একটা বিদেশি জাতকে কোলের মাইচোষা বাচ্চার চেয়েও বেশি যত্নআত্তি করছে। গাই হলে বাছুর ছাড়াও রোজ আট/দশ সের দুধ দেবে, দামড়া বাছুর হলে বছরখানেক খাদ্যখোরাক জোগালে লাখ টাকার মাল হবে।
মামুদ গাঁয়ের খুদে চাষিদের একজন। পিতা একদা সচ্ছল গেরস্ত ছিল বটে, কিন্তু তার মৃত্যুর পর পৈতৃক সম্পত্তি ছয় ওয়ারিশের মধ্যে কাড়াকাড়ি ভাগাভাগির লড়াই শেষে, তার অবস্থা অন্য ভাইদের চেয়েও নাজুক। নিজের আলাদা বাড়ি ও চাষের জন্য মাত্র বিঘা খানেক জমির মালিক হয়েছে সে; কিন্তু এটুকু ভিটা-মাটিতে নানারকম আবাদের কসরত করেও সংসারের টানাপড়েন কাটেনি। বাধ্য হয়ে ভূমিহীন কামলাদের দলে ভিড়ে পরের ক্ষেতে কাজ করে মামুদ। তবে নিজের কি পরের ক্ষেতে জন খেটে যেটুকু আয়রুজি, তার চেয়ে সংসার চালাতে বউয়ের ভূমিকাই বেশি উপকারী। ভালোবাসার বউ বলে নয়, পাড়ার সবাই বলবে মামুদের বউ অতিশয় সংসারী মহিলা বলেই ছেলে দুটি লেখাপড়া শিখে মানুষ হচ্ছে। ভিটেমাটিতে লাউ-কুমড়াসহ নানারকম সবজির আবাদে সবুজের বাপের তুলনায় মায়েরই কৃতিত্ব বেশি। মামুদের দায়িত্ব শুধু সেগুলি সাইকেলে হাটে নিয়ে বেচে নগদ টাকাটা বউয়ের হাতে তুলে দেওয়া। এ ছাড়া হাঁস, মুরগি ও ছাগলের পর গরু পুষেও মামুদের বউ গ্রামের আর সব গেরস্তকেই টেক্কা দিয়েছে। গত আট বছরে পাঁচটা বাছুরকে মানুষ করা, দুটি গাইয়ের গড়ে রোজ আট সের দুধ পুরো বছর ধরে বেচার পরও গাই ও তার জোয়ান সন্তানকে বেছে দু লাখের বেশি টাকা রোজগার কি এমনি এমনি হয়েছে? স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই যৌথ সেবাযত্ন চুষে খায় গোয়ালবন্দি জীবগুলি। একদিনও ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই। এত যতœআত্তির পরও বছর তিনেক আগে একটা দামড়া জোয়ান হতে না-হতেই কী এক কঠিন ব্যারামে আজগুবি মরেছে। কমসে কম ৬০-৭০ হাজার টাকা হারানোর শোক স্থায়ী করতে গোয়াল শূন্য রাখেনি
অবুজ-সবুজের মা-বাপ। ধারকর্জ করে বারো হাজার টাকায় আর একটা বাছুর কিনেছিল। সেই বাছুর আড়াই বছরে দুই লাখ টাকার সম্পদ হয়েছে। দুই পাইকার এক লাখ নব্বই ও দুই লাখ পর্যন্ত বলেছে কিছুদিন আগে। সবাই বলছে কোরবানি ঈদ পর্যন্ত রাখতে পারলে আড়াই লাখ ছাড়াবে। লোভী ও হিংসুটে মানুষের বিষাক্ত দৃষ্টির আড়ালে, দিনরাত গোয়ালে বাঁধা এবং স্বামী-স্ত্রীর একনিষ্ঠ সেবা ও প্রহরায় আছে বলে এমন মোটাতাজা হয়েছে গরুটা। তবে আর বেশি মোটাতাজা হওয়ার সময় দেওয়া যাবে না, লাভ যা-ই হোক, মাসখানেকের মধ্যে ওটাকে বেচতে হবে অবশ্যই। এ কারণেই শূন্য গোয়াল ভরাতে নতুন বাছুরটাকে আগাম কিনে কিনল আজ।
ঘনিষ্ঠ পড়শি শুটকু বাছুরসহ হাটফেরতা মামুদকে রাস্তায় থামিয়ে জানতে চায়, তোর গেইল গরুটা কি ঈদের বাজার আসার আগেই দুই লাখের ওপর বেচে দিছিস মামুদ ভাই? ফের এই নয়া বাছুর কিনলু কত দিয়া?
মামুদকে পোড়া বিড়ির অবশিষ্ট খেতে দিয়ে শুটকু বাছুরটাকে দেখে।
গোয়ালে ঢোকানোর পর বিদেশি জাতের জীবগুলোকেও এক দিনের জন্যও বাড়ির প্রাঙ্গণের ঘাস-কি আলো-বাতাস খাওয়ানোর প্রয়োজন হয় না। তারপরও শুটকুর মতো ঘনিষ্ঠজন মামুদের গোয়ালের খবর জানে। পড়শিরা তার লাভ-ক্ষতির হিসাবটা কষে কী সুখ পায় কে জানে। এর আগে ভেটেরিনারি পল্লীডাক্তারকে হাজার টাকা দিয়েও যখন আশি হাজার টাকার মাল গরুটা আজগুবি মরল, হিংসুটে পড়শির অনেকের মুখে চাপা খুশির হাসির ঝিলিক লুকাতে পারেনি। মামুদও তাই শুটকুকে সতর্ক জবাব দেয় -আর গরু কেনা ও গরু পোষার দিন হামার শেষ রে! খালি গেইলটাকে বেচে দুই-আড়াই লাখ পাইলেও হবার নয়, ভিটামাটি বন্ধক থুইয়াও বেটাকে বিদেশ পাঠানোর টাকা জোগাড় করতে পারিম কি না আল্লাই জানে। বেটা তো আইএ পাসের পর বিদেশ যাওয়ার বায়না ধরিয়া ঠ্যাং আসমানে তুলিয়া বসিয়া আছে।
অবুজকে ঢাকায় পাঠায় বুদ্ধিমানের কাম করছিস। চাকরিখান যেমনই হউক, মাসে মাসে বাড়িতে তো দেয় কিছু। সবুজকেও দে বিদেশ পাঠায়। আল্লায় সবুজের মাথায় এত বেরেন দিছে, দেশে ভালো চাকরি না পাউক, বিদেশে পাঠাইতে পারলেই তোর বিদেশি গেইলের চাইতেও দশ গুণ বেশি টাকার মানুষ হইবে, কয়া থুনু কথাটা-মনে থুইস।
এত বড় একটা দোয়ার সাক্ষী বাছুরটাকেও চাটি মেরে শুটকু আবার হাটের দিকে হাঁটতে থাকে। আর শুটকুর দেওয়া বিড়ির ধোঁয়া ছেড়ে মামুদ এবার বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে দুই ছেলের টানা স্বপ্নের রেলগাড়িতে চেপে বসে যেন। শুটকুর কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
অবুজ ও সবুজ-দুটি মাত্র ছেলে নিয়ে চারজনের সংসার মামুদের। মা ছিল, মরে গেছে। একটা মেয়ের শখ ছিল মামুদের। আল্লাহ দেয়নি। তবে মৃত মা ও স্ত্রীর গর্ভে-না-আসা মেয়ের জন্য দরদ, ঘুরেফিরে স্ত্রীর উপরেই বর্তায়। স্ত্রীকে কই রে, হ্যাঁ রে কিংবা অবুজের মা হিসেবে সম্বোধন করে মামুদ। আর স্ত্রী তাকে অবুজ-সবুজের বাপ হিসেবেই ডাকে। সমাজে মাবুদের স্বনামে যেটুকু সম্মান, তার চেয়ে অবুজ-সবুজের বাপ হিসেবেই গর্ববোধটা বেশি। কামলাখাটা গরুর গোবরঘাটা খুদে চাষি হিসেবে যারা তাকে অবজ্ঞা করে, মামুদের দুই ছেলেরই মানুষ হওয়া নিয়ে সন্দেহ নেই তাদেরও। বড়টা অবুজ কোনো মতে ম্যাট্রিক পাশের পর কলেজে ভর্তি হয়ে সুবিধা করতে পারেনি। তাই লেখাপড়ার নামে গরিব বাপের পয়সা ধ্বংস করেনি আর। ছোট ভাইয়ের উচ্চ শিক্ষার পথ সুগম করতে রুজি-রোজগারের ধান্ধায় ঢাকায় গেছে। বছরখানেকের মধ্যে নিজের চেষ্টায় এক প্লাস্টিক কারখানায় ঢুকে মাসিক দশ হাজার টাকা বেতনে চাকরিও পোক্ত করেছে। মামুদকে ছেলের চাকরির জন্য ঘুষ দিতে হয়নি এক টাকাও, ছেলেই বরং ছোট ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে এখন মাসে দু-তিন হাজার টাকা বাবাকে দেয়। চাকরিজীবী বড় ছেলে ও গোয়ালের পোষা বিদেশি গরুর তুলনায় ছোট ছেলে সবুজই কেবল বাবা-মাকে নয়, গ্রামবাসীকেও উন্নত ভবিষ্যৎ ও সুখ-স্বপ্নের জোগান দেয় বেশি। ছোটবেলা থেকেই স্কুলের পরীক্ষায় ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়ে আসছে। আর ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ও কলেজের ফাইনাল পরীক্ষার সবুজের চেয়ে ভালো ফল করতে পারেনি এ গ্রামের আর কোনো ছাত্রছাত্রী। কলেজে ও কোচিংয়ে দুবছর দিনেরাতে পড়ে পরীক্ষাতেও ভালো ফল করে সবুজ তাই বায়না ধরেছে, দেশের সরকারি ইউনিভার্সিটি চান্স না দিক, বিদেশে গিয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়বে। পড়ার পাশাপাশি চাকরিও করবে। আর বিদেশি চাকরির রোজগার দিয়ে বাড়িতে বিল্ডিংবাড়ি তুলতে সময় লাগবে না তার। ছোট্ট গোয়াল নয়, এক সাথে কয়েক ডজন গরু পালার জন্য বাবা-মাকেও বড় গরুর ফার্ম বানিয়ে দেবে একটা।
শহরের কলেজ-কোচিং-পরীক্ষা শেষ করে বাড়িতে এসে বসে আছে সবুজ। আর তাকে ঘিরে বিদেশ আর সোনালি ভবিষ্যৎ মামুদের উঠানে প্রায় সারাদিনই নৃত্যগীতি করছে। অসম্ভব দিবাস্বপ্ন বলে উড়িয়ে দিতেও পারে না মামুদ। নিজে সে এক মামলার সাক্ষী হয়ে শহরে দুবার যাওয়া ছাড়া গ্রাম ছেড়ে আজীবন যায়নি কোথাও। যে ভূমিহীন কামলাদের দলে মিশে ক্ষেতের কাজ করে, তারাও বেশি রোজগারের আশায় ধানকাটা কি মাটিকাটা কাজে গ্রাম ছেড়ে দূর-দূরান্তে যায় অনেকেই। শুটকু গেল বছরেও চট্টগ্রামে কাজ করতে গিয়ে দুমাসে নগদ ছয় হাজার টাকা পকেটে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। আর লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে প্লেনে চড়ে সৌদি কি দুবাই গেছে যারা, তারা অনেকেই বাড়িতে বিল্ডিং তুলেছে, জমি কিনেছে। কাজেই মামুদের মেধাবী ছেলে সবুজ আরব-দুবাইয়ের চেয়েও উন্নত কোনো দেশে যেতে পারলে বেশি বেশি রোজগার করার স্বপ্নটা দুঃস্বপ্ন হবে কেন? সমস্যা হলো সবুজকে বিদেশে পাঠাতে যে আট-দশ লক্ষ টাকা প্রয়োজন, তার জোগান দেবে কীভাবে? কয়েক মাস ধরে এই কঠিন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে মামুদের আধাপাকা চুল ঝরে পড়তে শুরু করেছে।
গরু নিয়ে বাড়িতে ঢোকার মুখে সবুজকে দেখে মামুদ। হাটে যাওয়ার আগে যেমন দেখেছিল এখনো তেমন ভঙ্গিতেই বসে আছে। বাড়ির প্রাঙ্গণে আমগাছতলায় সুপারিগাছের ফালায় বানানো টঙে বসে কালো ম্যাজিক বইখানা পড়ছে। দামি ফোন হিসেবেই সাত হাজার টাকায় ছোট ভাইকে কিনে দিয়েছিল অবুজ। কিন্তু এটা যে মামুদ ও তার স্ত্রীর মালিকানায় প্রবাসী ছেলের সঙ্গে কথা বলার জন্য ছোট মোবাইল ফোন নয়, প্রায় একটা বইয়ের মতো চওড়া এ ফোনে পড়ার মতো নানারকম দেশি-বিদেশি বইও আছে, দেশ-বিদেশে ফোন করা ছাড়াও চাকরির দরখাস্ত পাঠানোর ব্যবস্থা আছে, ঘরে বসেও বিদেশ ভ্রমণের ব্যবস্থা আছে-স্ত্রীর কাছে বয়ান শুনে শুনে ম্যাজিক ফোনটার এসব গুণ সম্পর্কে কিছু ধারণা পেয়েছে মামুদও। শুধু সবুজ নয়, গাঁয়ের আরো কিছু সচ্ছল গেরস্তের ছেলেদের হাতেও এই ফোন দেখেছে মামুদ। এই ফোন দেখেই বিদেশে যাওয়ার রাস্তা চিনেছে সবুজ। উপায়ও খুঁজে বের করেছে।
এমন একাগ্র দৃষ্টিতে ফোন দেখছিল সবুজ, গরুসহ বাপকে বাড়িতে আসতে দেখেও মনোযোগ তার কাটে না। অগত্যা নতুন মেহমান বাছুরটার সঙ্গে কথা বলে মামুদ, চল তোকে ঘরে ঢোকাই আগে, তারপর দিনেরাতে খাওয়া-হাগা আর মোটাতাজা হওয়া ছাড়া কাম নাই তোর।
সবুজ টঙ থেকে লাফিয়ে নামে। কত টাকা দিয়া বাছুরটা কিনলেন বাবা? দুই তিন বছরে এটাও ক্রিস্ট গেইলের মতো দামি মাল হবে। এটার নাম রাখলাম আমি মেসি। খাড়ান একটা ছবি তুলে রাখি, ফেসবুকে পোস্ট করি দেব, ভাইও দেখতে পাবে।
সবুজ গরু ও বাপের ছবি তোলে। দুলাখ টাকার সম্পদ হওয়া গরুটার নাম গেইল সেই রেখেছে। বিদেশের কোনো বিখ্যাত খ্রিষ্টান খেলোয়াড়ের নাম রাখলে কোরবানির হাটে গরুটার নাম-দাম বেশি হবে, এরকম স্বপ্ন ও যুক্তি দেখিয়েছিল বাপকে। কিন্তু লাখ টাকার সম্পদ তৈরিতে বাবা-মাকে যেরকম কষ্ট করতে হয়, রোজ কত টাকার খাইখরচ জোগাতে হয়-সে হিসাব শিক্ষিত ছেলে একটুও আমলে নেয় না বলে আজ ক্ষোভের সঙ্গে জবাব দেয়, আছিস তো খালি তোর বিদেশ যাওয়ার বায়না নিয়া। এই বিদেশি গরু মানুষ করতে যে গোয়া ফাটে হামার, সে খবর কি রাখিস তোরা?
সবুজ জবাব না দিয়ে ফোনে চোখ রাখে আবার; কিন্তু নতুন অতিথিকে দেখে সবুজের মায়ের খুশি অনেকটা নতুন বধূকে বরণ করে নেওয়ার মতোই। গোয়ালের লাইট জ্বেলে দেয়। গোয়াল ঘরটা তিনটা গরু পালার মতো ছোট; কিন্তু এখন একমাত্র বাসিন্দা গেইল। শুয়ে জাবর কাটছিল, নতুন বাচ্চা সঙ্গীকে দেখে লেজটা একটু নাড়ে মাত্র। সবুজের মা ধুনা জ্বেলে দেয় মশামাছি তাড়াতে। খড় ও তাজা ঘাস কেটে রাখা হয়েছিল গেইলের জন্য, তার কিছুটা মেসির সামনের খাদ্যভাণ্ডে ছড়িয়ে দেয়। খাওয়া শুরু করার আগে মেসি লেজ তুলে পেসাব-পায়খানাও করে। তার গোবর পরীক্ষা করে সবুজের মা রায় দেয়, ভালো জাতই মন কয়, গোবর দেখি গন্ধ শুঁকি বোঝা যায় অসুখবিসুখ নাই কোনা।
অতই যদি ভেটেরিনারি ডাক্তার হইছিস, একটা থার্মোমিটার কিনিয়া দেব। গোয়ায় ঢোকায় দিয়া গরুর জ্বরজারি মাপিস।
থার্মোমিটার লাইগবে না। সেবার গেইলের গায়ে হাত দিয়া জ্বর আমি টের পাইছি আগে, ডাক্তার আসি পরীক্ষা করিয়াও দেখল জ্বর।
তোর গরুর ডাক্তারি আর নার্সগিরি করার দিন খতম রে! মাস
দ্-ুএকের মধ্যে এ দুইটা বেচে দিয়াও বাকি টাকা কেমনে জোগাড় করিয়া উড়োজাহাজে ওড়ায় দিবু তোর বেটাকে, সেই চিন্তা কর।
সবুজের কপাল ভালো হইলে টাকার জোগাড়ও হইবে। অত চিন্তা কইরেন না।
স্ত্রীর অভয় ও সান্ত্বনাবাণী শুনেও নিশ্চিন্ত হতে পারে না মাবুদ। দশ লাখ টাকা কি মুখের কথা! নিজের জীবনে তো বটে, চৌদ্দ পুরুষেও এত টাকা একত্রে দেখেনি মামুদ। অথচ বংশের সেরা শিক্ষিত ছেলের স্বপ্নপূরণে এত টাকা একত্রেই দিতে হবে। এর মধ্যে পাসপোর্ট করে ফেলেছে সে। বিদেশে গিয়ে যে ইউনিভার্সিটিতে পড়বে সেখানে কাগজপত্রও পাঠিয়েছে। এখন দালালকে ধরে ঢাকা গিয়ে ভিসা করবে। দালালকে তার প্রাপ্য নগদে বুঝে দিয়ে উঠে বসবে প্লেনে। তারপর কয়েক বছরের অপেক্ষা ছাড়া কিছুই ভাবতে হবে না মামুদ ও তার বউকে।
নাম দস্তখত করার সামান্য শিক্ষা নিয়ে গরুর রাখালি আর ক্ষেতের কাম করে সারাজীবন গ্রামে পড়ে থাকলেও দেশে ভেজাল আর দালাল তথা দুই নাম্বারির দৌরাত্ম্য বিষয়ে মামুদ মোটেও অজ্ঞ নয়। গ্রামেও বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে দালালকে টাকা দিয়ে নিঃস্ব হয়েছে অনেকেই। মামুদ তাই ছেলেকে বিশ্বাস করার আগে হেডমাস্টারের কাছে গিয়েছিল। হেডমাস্টার সবুজের সঙ্গে আলাপ করে সব জেনেছে। তারপর অভয় দিয়েছে মামুদকে, পাঠাও, বিদেশেই পাঠাও। এ দেশে ভালো চাকরি হয় না; কিন্তু বিদেশে যাইতে পারলে লেখাপড়া যা-ই হোক, রুজি-রোজগারের রাস্তা একটা অবশ্যই পাবে।
কিন্তু এতগুলো টাকা নিয়া দালালের খপ্পরে পড়িয়া যদি বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন মাটি হয় বেটার? আমও যাইবে, ছালাও যাইবে মোর!
হেডমাস্টার জ্ঞান দেয়, দালাল ছাড়া আজকাল কোনো কাজ হয়? শিক্ষা এখন বড় ব্যবসা, যেখানে ব্যবসা সেখানেই দালাল-মিডলম্যান আছে। ঢাকায় ছাত্রদের বিদেশ পাঠানোর লাইনে তুলে দেওয়ার জন্য কতজনে অফিস খুলে বসে আছে। দালাল ধরে হোক আর যে করেই হোক বিদেশ যেতে পারলে কপাল খুলবে তোর ছেলের। মানুষ জীবন হাতে করে নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়া ইতালি যাইতে চায় এমনি এমনি? রিস্ক তো নিতেই হবে।
এরপর ছেলেকে আর অবিশ্বাস করতে পারে না মামুদ। আর স্ত্রীর আল্লার ওপরে যেমন, তেমনি সন্তানের উপরেও অন্ধ বিশ্বাস। বাকি টাকার প্রশ্নে সে স্বামীকে পরামর্শ দেয়, অবুজের বিয়া করার বয়স হইছে। তাকে বিয়া দিয়া শ্বশুরের কাছে পাঁচ লাখ টাকা ডিমান্ড পাওয়া যাইবে না? ছোট ভাইয়ের পেছনে শ্বশুরের টাকা খরচ করতে সে আপত্তি করবে না।
প্রস্তাবটা পছন্দ হয় মামুদেরও। সবুজ চাকরি করতে ঢাকায় থাকবে, বাড়িতে বউ থাকলে বাড়ির প্রতি টান ও দায় বাড়বে তার। অন্যদিকে মাবুদের নিজের মেয়ের শখ পুত্রবধূই পূরণ করবে অনেকখানি। যেমন ভাবা তেমন কাজ। অবুজের মা বালিশের তলা থেকে ফোন বের করে ছেলেকে কল দেয়। ভূমিকা ছাড়াই জানায় সিদ্ধান্তটা। কিন্তু সবুজ বেঁকে বসে। অনিশ্চিত হবু-শ্বশুরের টাকা নেওয়ার ভয়ে এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানায়, ছোট ভাই বিদেশে গিয়া মানুষ না হওয়া পর্যন্ত বিয়ের চিন্তা করবে না সে। আর সবুজকে বিদেশ পাঠানোর পুঁজি জোগাড়ে নিজেও কিছু যোগ করতে চাকরিদাতা মালিকের কাছে হাজার পঞ্চাশেক টাকা লোন চাইবে। বাকি টাকা ভিটামাটি বন্ধক রেখে জোগাড়ের পরামর্শ দেয় সে।
কিন্তু লাভ ছাড়া কেউ টাকা খাটায়? মানুষ ভিটেবাড়ি বন্ধক নিয়ে পাঁচ-ছয় লাখ টাকা দেবে, আর মাবুদ আগের মতোই গাছপালাসহ ভিটেয় নিজবাড়িতে বসবাস করবে, বন্ধক গ্রহীতার তাতে লাভ কী? আবাদি জমিটা বন্ধক রেখে বড়জোর এক দেড় লাখ টাকা পাওয়া যাবে। তবে বন্ধকের বদলে যদি অর্ধেকও বিক্রি করে দেয়, আট-দশ লাখ টাকা সহজেই জোগাড় হয়; কারণ জমি কেনার মতো আগ্রহী টাকাঅলা মানুষেরও অভাব নেই গ্রামে। সবুজই পরামর্শ দেয়, পৈতৃক জমির ভাগ আমি যেটুকু পাব, তার কিছু অংশ বেচে দিয়ে বাকি টাকা জোগাড় করো। আল্লার রহমতে ভবিষ্যতে বাড়ি পাকা ছাড়াও দেশে জায়গাজমি আরো কিনতে পারব আমি। আর আগে গরু গেইলকে বেচে দেখো কত পাওয়া যায়।
কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে পশুর হাট জমে ওঠার আগে শুটকুকে সঙ্গী করে গেইল-মেসি দুজনকেই হাটে তোলে মামুদ। দুটি মিলে দাম ওঠে মাত্র সর্বোচ্চ আড়াই। শুটকু বুদ্ধি দেয়, চট্টগ্রামের পাইকারকে ফোন করেছিল সে, দুই তিন হাট পরেই তারা গরু কিনতে এ জায়গায় আসবে। এলাকার সব হাট থেকে কয়েক ডজন গরু কিনে চট্টগ্রামে নিয়ে যাবে। তখন অবশ্যই বেশি দাম পাবে মামুদ। শুটকুর কথাটা অবিশ্বাস করতে পারে না মামুদ। কারণ বিদেশি পাইকারের কেনা গরু চট্টগ্রামে পৌঁছে দিতে দুইবার রাখাল হিসেবে গরুর ট্রাকে চড়ে চট্টগ্রামে গিয়েছিল নিজেও। কাজটা কঠিন, গরুর মতোই সারারাত ট্রাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কোনো গরু যাতে ট্রাকে শুয়ে পড়তে না পারে, সে জন্য লাঠি হাতে নিজেকেও গরুর মতো জেগে থাকতে হয় সারারাত। কিন্তু নির্ঘুম প্রায় পনেরো-বিশ ঘণ্টার যাত্রা শেষে শুটকু পারিশ্রমিক পেয়েছে দশ হাজার টাকা। তার ওপর মহাজন তাকে ঘুমানোর জায়গা ও খাওয়ার টাকা, ফেরার বাসভাড়াও দিয়েছে। দুদিনের এই কঠিন কাজের সম্মানী হিসেবে শুটকু যা রোজগার করেছে, দু-তিন মাস পরিশ্রম করেও এত টাকা পায়নি। ফলে কষ্টের স্মৃতি ভুলে মহাজন-পাইকারের গুণগান করে এখনো। ফোনেও যোগাযোগ রাখে।
শুটকুর পরিচিত পাইকার এবারেও শিগগির গরু কিনতে এই এলাকায় আসবে শুনে, আরো বেশি দাম পাওয়ার আশায় গরু বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যায় মামুদ। শুটকুকে আগাম চা-পানবিড়িও খাওয়ায়।
দশ শতাংশ জমির দাম ও ক্রেতা ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ার পরই বিদেশি পাইকারের লোক নিয়ে বাড়িতে আসে শুটকু। গরু দেখে এবং শুটকুর সুপারিশে শুধু গেইলের দাম সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা দিতে রাজি হয় পাইকার। মেসি এখনো কোরবানির উপযুক্ত হয়নি বলে, পরের কোরবানি ঈদ পর্যন্ত লালন-পালনের পরামর্শ দেয়। নগদ আড়াই লাখ টাকার বান্ডিলও বুঝিয়ে দেয় মামুদকে। হাটের দরের চেয়ে পঞ্চাশ হাজার বেশি পেল, তার ওপর হাটে বেচলে যে ট্যাক্স দিতে হতো, সেই ট্যাক্সও দিতে হলো না মাবুদকে। শুটকু সগর্বে কৃতিত্বটা দেখালে মাবুদ সরাসরি জানতে চায়, তা তোকে কয় টাকা দালালি দিতে হবে রে শুটকু?
শুটকু যে তালে মাতাল হলেও জাতে ভালো মানুষ, মাবুদের একান্ত শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুজন, সেটার প্রমাণ দিতে দালালগোষ্ঠীকে কঠিন একটা গাল দিয়ে বলে, মোকে এক টাকাও দালালি দিতে হইবে না মাবুদ ভাই। তুই সবুজকে বিদেশে পাঠাও আগে। গরুর টাকা ছাড়াও তোর জন্যে আরো বারো হাজার টাকা কামাইয়ের বন্দোব্যস্ত করি দিম মুই।
বন্দোব্যস্ত মানে, বিদেশি পাইকারের দুই ট্রাক গরু দুই/তিন দিনের মধ্যে চট্টগ্রাম রওয়ানা দেবে। যেহেতু চেনা পাইকারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, এক ট্রাকের রাখাল হবে শুটকু, আর একটি ট্রাকের রাখাল করবে এবার মামুদকে। তার নিজের গরুও থাকবে সেই ট্রাকে। গরু গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে দুই দিন পর নগদে বারো হাজার টাকা কোমরে বেঁধে নিয়ে বিড়িতে সুখটান দিতে দিতে বাড়ি ফিরবে দুই ভাই।
অন্য সময় হলে সরাসরি না করত মাবুদ। এরকম তুচ্ছ বা কঠিন কাজ দূরে থাক, ক্ষেতের কাজ করার জন্যও শুটকুদের সঙ্গে কখনো গ্রামের বাইরে যায়নি। শুটকুর মতো দিন আনা দিনে খাওয়া নিঃস্ব কামলা তো নয়। গেরস্ত মানুষ, গোয়ালের গরুও বাড়িছাড়া হওয়ার পথে বাধা। কিন্তু এবারে গেইলের সঙ্গী হয়ে দুদিনে যদি আরো দশ/বারো হাজার টাকা আসে ক্ষতি কী? সবুজের মাও বেশ উৎসাহ দিয়ে বলে, যাও, মেসিকে মুই একলায় দেখিশুনি রাখিম। বিদেশ দেখাও হইবে, টাকা রোজগারও হইবে। ফিরি আসলে মোরগ জবাই দিয়া শুটকু ভাইকে দাওয়াত খাওয়ায় দিম মুই।
অবশেষে এক বিকেলে নিজের গোয়ালের শোভা গেইলকে ট্রাকে তুলে দিয়ে ট্রাকের বারোটা গরুর সঙ্গে নিজেও যাত্রা করে মাবুদ। অন্য ট্রাকের গরুর সঙ্গী হয় শুটকু। পাইকারের লোকজন বসে ড্রাইভারের সিটের পাশে। এতগুলো জ্যান্ত পশুপূর্ণ বড় দুটি ট্রাক চলতে শুরু করলে পথচারী লোকজন গরুগুলোকে দেখে, নাকি গরুর সঙ্গী রাখালকেও দেখে, দেখে কে কী-বা ভাবে, মামুদ বুঝতে পায় না। সে একদৃষ্টে নিজের পোষা গেইলকে দেখতে থাকে। ট্রাকের অন্যসব গরুর পাশে গেইলকেই মনে হয় সেরা, দামেও বেশি। হয়তো আরো বেশি দাম পাওয়া যেত, ভালো মানুষ শুটকু পাইকারের সাথে সম্পর্কের জোরে গোপনে দশ/বিশ হাজার টাকা দালালি যে পায়নি, তার নিশ্চয়তা কী? চাষাবাদের নিজের জমি নেই যাদের, তাদের মনেই হিংসার চাষাবাদ বেশি। শুটকুও তো তাদেরই একজন। পড়শির প্রতি সন্দেহ জাগলেও, পাইকারের মাল হওয়ার পরও গেইলের জন্য গর্ববোধ হয় মাবুদের। দুবছরে বড়জোর লাখ টাকার খাদ্য ও ওষুধ খেয়েছে। বিনিময়ে সংকটের সময় দেড় লাখ টাকা লাভ দিল মনিবকে। অবলা পোষা জীব নিমকহারাম হয় না কখনো। মনিবকে পাশে দাঁড়ানো দেখে চিনতে পেরেছে নিশ্চয়। বাড়ি ছেড়ে এই প্রথম বিদেশ যাত্রায় অচেনা গন্তব্য পানে ছুটে যাচ্ছে। গেইলের মতো মামুদও, বউ ও বাড়ি ছেড়ে এক রাতও বাইরে কাটায়নি অনেক কাল। বাড়ি ছাড়া হওয়ার দুঃখেই কি গেইলের চোখের কোনটা ভেজা ছিল। নাকি আর দশ দিন পর কোরবানি ঈদে নিজের শরীরের সব রক্ত ঢেলে দেওয়ার নিয়তি টের পেয়েছে? দুবছরের নিত্যসঙ্গী প্রাণীটার এমন রক্তাক্ত পরিণতি কল্পনা করতেও ভালো লাগে না। ‘কসাই’ কথাটাকে গাল হিসেবেই জানে মামুদ এবং লাখ টাকা যৌতুক দিলেও কোনো পেশাদার কসাইয়ের ঘরে ছেলেকে বিয়া করাবে না সে।
সন্ধ্যার পর ট্রাক হাইওয়েতে ওঠে। আগুনের মতো গনগনে দুই চোখের আলোয় অন্ধকার কেটে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলে ট্রাক। একই রকম অগ্নিদৃষ্টি হেনে পেছন থেকে এবং সমুখ থেকেও বিরামহীন ছুটে আসে-যায় দূরপাল্লার যানবাহন। আকার-প্রকার ও গর্জন করে ছুটে চলা দেখে রাতের অন্ধকারে ওদের ভয়ংকর জন্তু-জানোয়ার মনে হয়। ছুটন্ত খোলা ট্রাকে গরুগুলোর পাশে ভয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। উন্মুক্ত ট্রাকে বিজলি চমকের মতো আলোর চাবুক ছিটকে পড়ে কখনো-বা, কানে যন্ত্রযানের গর্জনটাও সহসা প্রবল হয়ে ওঠে। বিজলি চমকানো ঝড়ের রাতে একবার পথ চলতে গিয়ে ঘন ঘন মেঘের ডাক শুনে যেমন বজ্রপাতের ভয় জেগেছিল, সেরকম ভয় অনুভব করে মামুদ। ভয় কমাতে, বাতাসের ঝাপটা এড়াতে গরুর পেছনে বসে কয়েকবারের চেষ্টায় দেশলাই ঠুকে বিড়ি ধরায়। সহযাত্রীদের সঙ্গে এমন ঘেঁষাঘেঁষি অবস্থান যে, ইচ্ছে করলে পা ছুড়ে কিং লেজ নেড়ে বাড়ি দিতে পারে মামুদকে; কিন্তু তেমন হিংস্র দুষ্টুমি করে না কেউ, একজন লেজ তুলে হাগে। গেইলের শরীরের ও শরীরনিঃসৃত গোবর-চোনার পরিচিত গন্ধ পেয়ে মামুদ স্বস্তি বোধ করে, উঠে দাঁড়িয়ে বিড়িতে সুখটান দিতে গেলে তীব্র বাতাসে ধোঁয়াসহ বিড়ির আগুনও উড়ে যায়।
রাত এখন কত হলো? মামুদ নিজের মোবাইলে সময় মাপতে পারে না বলে আকাশের দিকে তাকায়। আকাশের চেনা তারাও যেন হাইওয়ের আলোঝলকানি ও শব্দপ্রপাত দেখে মুখ লুকিয়েছে। চারদিক তাকিয়ে আঁধারে ডোবা চরাচর, কখনো-বা আলোর ফুটকি তোলা রাস্তার পাশের বাজার ও দোকানপাট দেখে নিজের অবস্থান বুঝতে পারে না। গরুগুলোর ওপর নজর রাখার জন্য ট্রাকের পেছনেও একটা লাল আলো জ্বালানো হয়েছে। মামুদ থেকে থেকে নজর বুলিয়ে দেখছেও, মলমূত্র ত্যাগ ছাড়া এখনো শুয়ে পড়ার চেষ্টা করেনি কেউ। ট্রাকের পাটাতনে শোয়ার মতো ফাঁকা জায়গা রাখেনি পাইকার। গেইলের পাশেরটি, সম্ভবত ঘুম সামলাতে না পেরে, পা ছুড়ে পিঠ বাঁকাচ্ছিল শোয়ার জন্য, তার পিঠে লাঠির বাড়ি ও হুটহাট করে শাসন করে মামুদ। নড়েচড়ে সেটা অন্যগুলোরও ঘুম তাড়ায় যেন।
নিজে ট্রাকে স্থির দাঁড়ালে বাতাসের ঝাপটায় চোখ বুজে আসে তার। বাড়ির বিছানা ও স্ত্রীর কথা মনে পড়ে। সবুজ কি এত রাতেও মোবাইলে চোখ রেখে পড়ছে? ঈদের পরদিনই যাত্রা করবে সে। জোতজমি বেচে জোগাড় করা দশ লাখ টাকা যাবে, সবুজও যাবে। মাবুদ যেমন অচেনা গন্তব্যে ঝড়ঝাপটা সয়ে ছুটে চলেছে, তার চেয়েও দুরন্ত গতিতে স্বপ্নের বিদেশের দিকে ছুটে যাবে সবুজ। গেইলকে আড়াই লাখ টাকায় কিনে মহাজন-পাইকার বিদেশের কোনো বড় হাটে তুলবে, কিন্তু সবুজকে দালালরা কোথায় কোন গন্তব্যে পৌঁছে দেবে? কল্পনা করেও ছেলের গন্তব্য ও সোনালি ভবিষ্যতের কোনো ভাব-ছবি মনে জাগাতে পারে না। ঘুম পাচ্ছে বলে একটা হাত গেইলের শরীরে পড়ে। আশ্চর্য, গেইলের শরীরের থরথর কাঁপুনি টের পায় সে। পাইকার নিজের আসল ও মুনাফা বুঝে নিয়ে গেইলকে যে কোটিপতি ক্রেতার কাছে তুলে দেবে, ঈদের দিনেই সে এটাকে কোরবানি দেবে অবশ্যই। গেইলের রক্তাক্ত চেহারার কথা ভাবার বদলে মামুদ ছেলেকে ঘিরে সামনের সুদিনের কথা ভাবতে চায়। কিন্তু দুঃস্বপ্নের মতো ঘুরেফিরে গেইলের রক্তাক্ত পরিণতির ছবিটাই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এবার ঈদে অবুজ-সবুজ দুভাই বাড়িতে থাকবে না। মাবুদের কোরবানি ছাড়া নিরানন্দ ঈদের দিনে, এত দিনের মায়ামমতায় লালিত গেইলের মাংস-চর্বি-হাড়-হাড্ডি-কলিজা-মগজ সব কিছুই মজা করে চিবিয়ে খাচ্ছে, ওরা কারা? মামুদ আর জেগে কিবা ঘুমিয়ে কোনো স্মৃতি-স্বপ্ন দেখতেও পারে না। কারণ ঠিক এ সময়ে সহসা ট্রাকখানা রাস্তায় ক্যারক্যার আওয়াজ তুলে হঠাৎ থেমে যায়, ট্রাকের বডি ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মামুদ তখন ছিটকে তার গেইলের শরীরের ওপরেই ঢলে পড়ে।