Logo
×

Follow Us

ঈদ সংখ্যা ২০২৪

‘পুবের সুইজারল্যান্ড’

সিকিম

Icon

জাকিয়া সুলতানা

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৪, ১৮:২৪

সিকিম

গ্যাংটক শহরের একাংশ। ছবি: লেখিকা

ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য সিকিম। জনপ্রিয় একটি পর্যটন এলাকা। পুরো রাজ্যটিই বৈচিত্র্যময়, বিশাল সব পাহাড়, দুধসাদা ঝরনা, গহিন বন, সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে যাওয়া পাহাড়ি স্রোতঃস্বিনী নদী, নাম জানা-অজানা সব ফুলের মেলা-সব মিলিয়ে আলাদা সৌন্দর্যের এক রূপে মাথা উঁচু করে আছে সিকিম। সিকিমকে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য ডাকা হয় ‘পুবের সুইজারল্যান্ড’। একসময় বাংলাদেশের নাগরিকদের সিকিম ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা ছিল। সে নিষেধাজ্ঞা এখন নেই। তবে সিকিমে বিদেশিদের জন্য অবাধ প্রবেশ ও ঘোরাঘুরিতে বিধিনিষেধ রয়েছে। সিকিম যেতে বিদেশিদের অনুমতিপত্র বা আরএমপি নিতে হয়। এজন্য বৈধ পাসপোর্ট, ভারতীয় ভিসা ও ছবি প্রয়োজন। 

আমাদের হঠাৎ করেই সিকিম যাওয়ার সুযোগ আসে। আমার হাজব্যান্ড একদিন বাসায় এসে জানায়, তার দুই কলিগ-বন্ধু মিলে পরিবারসহ সিকিম যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। সঙ্গে সঙ্গেই বললাম আমিও যেতে চাই-এই সুযোগ মিস করা যাবে না। যদিও ওই দুই কলিগ-বন্ধু আমাদের সঙ্গে আর যাননি। আমরা পরিবারের সবাই গিয়েছি। 

এরপর শুরু হয়ে যায় ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি। কীভাবে যাব, কখন যাব, কত দিন থাকব, কোথায় কোথায় ঘুরব, এসব নিয়েই আমি আর আমার ছেলে মিলে গবেষণা করতে থাকি। গুগল, ইউটিউবে ভিডিও দেখে যাওয়া-আসা মিলিয়ে আমরা সিকিম-দার্জিলিংয়ের বেড়ানোর ৯ দিনের পরিকল্পনা করি। যাব বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী ট্রেন মিতালী এক্সপ্রেসে। সময়টা ছিল ২০২২ সালের জুলাই মাস। তখন সিকিমে বর্ষাকাল চলছে। একটু ভয় ছিল যে বৃষ্টি-ভূমিধসে ভ্রমণ পণ্ড হয়ে যায় কি-না। তবে ভালোয় ভালোয় আমরা ঘুরে এসেছি, যদিও বৃষ্টি একটু বাগড়া দিয়েছিল। 

অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন এসেই যায়। আমাদের ট্যুর ছিল পাঁচজনের-আমি, আমার হাজব্যান্ড, ছেলে ইয়াকিন, মেয়ে শারলিজ আর ছোট বোন দীপ্তি। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে ১৮ জুলাই রাত ৯.৫০ মিনিটের ট্রেন মিতালী এক্সপ্রেসে রওনা হই সিকিমের উদ্দেশে। রাত ৮টায় আমাদের চেকিং ছিল, আমরা সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে স্টেশনে পৌঁছে যাই। ইমিগ্রেশন ও চেকিং শেষে ৯টার মধ্যে আমরা ট্রেনে উঠে বসি। করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে এই ট্রেন দুই বছর বন্ধ ছিল। এরপর চালু হলেও সুযোগ-সুবিধা সীমিত ছিল। আমরা স্লিপিং বার্থ নিয়েছিলাম, ছিল না কোনো চাদর বা বালিশ। রাত কাটাতে হয়েছে ব্যাগ মাথার নিচে রেখে। রাতের খাবারও ছিল না (ভারতের রাজধানী বা দুরন্ত এক্সপ্রেসে রাতের খাবার, চা, সকাল ও বিকেলের নাশতা ছিল। তাই আশা করেছিলাম এখানেও থাকবে); তবে বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে বিরিয়ানি পাওয়া যাচ্ছিল (অখাদ্যই বলা যায়)। ফেরার সময়ও একই অভিজ্ঞতা হয়।

সে রাতে আর ঘুম হয়নি। জানালা দিয়ে রাতের অপূর্ব দৃশ্য দেখতে দেখতেই সময় পার করছিলাম। শিলিগুড়ির নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে (এনজেপি) সকাল ৭টায় ট্রেন পৌঁছানোর কথা থাকলেও পৌঁছায় সাড়ে ৮টার দিকে। ট্রেন থেকে নেমে হকচকিয়ে যাই-ইমিগ্রেশনের বিশাল লাইন। ট্রেনে ২০০ জনের মতো যাত্রী ছিল, লাইনে আমরা ছিলাম ১৮০ জনের পেছনে। ইমিগ্রেশন শেষ করে ফিরতি ট্রেনের টিকিট কিনে ও ডলার ভাঙিয়ে বের হতে হতে দুই ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছিল। ততক্ষণে সবাই গরমে ঘেমে নেয়ে ক্ষুধায় অস্থির। স্টেশনের বাইরে একটা হোটেলে খেয়ে ট্রাভেল এজেন্টের মাধ্যমে ট্যুর পরিকল্পনা ঠিক করে, মোবাইলের সিম কিনে গ্যাংটকে রওনা হতে হতে বেলা আড়াইটা। পরিকল্পনার মধ্যে ছিল গ্যাংটক, লাচুং, ইয়ামথাম ভ্যালি, জিরো পয়েন্ট, ছাঙ্গু লেক, দার্জিলিং, মিরিক হয়ে শিলিগুড়িতে ফেরা। এ জন্য আমাদের খরচ হয় ৫৫ হাজার রুপি (গ্যাংটকে হোটেল, লাচুং যাওয়া-আসার ট্যাক্সি, হোটেল, ডিনার-লাঞ্চ-সকালের নাশতা, ছাঙ্গু লেক, দার্জিলিং হোটেল, ঘোরাঘুরি, মিরিক হয়ে শিলিগুড়ি ফেরা)। 

বাক থাং ঝরনা

শিলিগুড়ির গরম আর জ্যাম পার হয়ে উঠলাম ন্যাশনাল হাইওয়ে ১০-এ (এনএইচ ১০)। সড়কের দু পাশে সবুজ বন আর ঠান্ডা বাতাস, মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম চারপাশ। শিলিগুড়ি থেকে ধীরে ধীরে ওপরের দিকে উঠছিলাম আমরা। একপর্যায়ে দেখলাম দুদিকে ভাগ হয়ে গেছে রাস্তা। বাঁ দিকের রাস্তা সিকিমের পথ। আর ডান দিকে গেলে দার্জিলিং। সিকিম যেতে অনুমতি নিতে হয়। অনুমতি এসএনটি ট্যুরিজম অফিস ও রংপো থেকে নেওয়া যাবে। রাংপো হলো পশ্চিমবঙ্গ থেকে সিকিম প্রবেশের প্রথম শহর। আমরা রাংপো থেকে অনুমতি নেই। অনুমতি নিতে আবেদন ফরমের সঙ্গে পাসপোর্ট ও ভিসার ফটোকপি এবং পাসপোর্ট সাইজের ছবি প্রয়োজন হয়, কোনো টাকা লাগে না। সিকিমে কত দিন থাকব সেটাও উল্লেখ করতে হয়। এখানে আমাদের একটু ভুল হয়েছিল, আবেদনপত্রে মাত্র তিন দিনের কথা উল্লেখ করা হয়। পরে আবার আমাদের আবেদন করতে হয় এবং সেজন্য ১৫০০ রুপি দিতে হয়েছিল। যা হোক, তিস্তা সেতুর একপাশে পশ্চিমবঙ্গ, অন্যপাশে রংপো শহর। অনুমতি নিতে যান আমার হাজব্যান্ড ও গাড়ির চালক। অনুমতি পাওয়ার পর গ্যাংটকে পৌঁছানোর তাড়া। কারণ গ্যাংটকে রাত ৮টা-সাড়ে ৮টার মধ্যে সব বন্ধ হয়ে যায়। খাওয়া নিয়ে অবশ্য সমস্যা ছিল না। কারণ হোটেলে আগেই বলে দেওয়া ছিল আমরা খাব। এর মধ্যে আবার বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে চলছিল রাস্তা। আর পাহাড়ের গায়ে থাকা বাড়িগুলোর আলো দেখে মনে হচ্ছিল যেন আলোর ফুল ফুটে রয়েছে। রাত ৮টার দিকে আমরা গ্যাংটকে পৌঁছাই। 

আমরা গ্যাংটকের ডেভেলপমেন্ট এরিয়ার সোনম বিল্ডিং কমপ্লেক্সের ভুমপ্রাদজং রিট্রিট হোটেলে ছিলাম। এটা এমজি মার্গ থেকে ১৫ মিনিটের রাস্তা। হোটেলে নেমে গোসল করে, গরম জামা-কাপড় পরে গেলাম অন্য একটা হোটেলে খাবার খেতে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। খেয়ে এসে যেন আর শক্তি অবশিষ্ট নেই। টানা ২৬ ঘণ্টার জার্নিতে সবাই কাহিল।

গ্যাংটক শহর

গ্যাংটক থেকে লাচুং বা অন্য শহরে যেতে আলাদা অনুমতি ও গাইড নিতে হয় এবং অন্তত একদিন সময় লাগে। সেজন্য আমরা পরদিন গ্যাংটক শহর ঘুরে দেখার জন্য রাখি। আর আবেদনের কাগজপত্র, ছবি আমরা আগের দিনই হোটেল ম্যানেজারের কাছে দিয়ে রেখেছিলাম। পরদিন হোটেলে নাশতা করে বের হই গ্যাংটক ঘুরে দেখতে; কিন্তু বৃষ্টি আর কুয়াশার জন্য ঠিকমতো এনজয় করতে পারিনি। প্রথমে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ফ্লাওয়ার ফেস্টিভ্যালে, যদিও জুলাই মাস হওয়ায় ফুল কম ছিল। সেখানে থেকে যাই গণেশ টক মন্দিরে, যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি শুরু হয় এবং কুয়াশায় চারপাশ ঢেকে যায়। সেখানে পাশেই ভয়ের অভিজ্ঞতা নিতে যাই ভূত বাংলোয় বা স্পুকি হাউসে। এর পর যাই ভুলভুলাইয়া ঝরনায়, ছবিটবি তুলে গোনজাং মনাস্ট্রিতে যাওয়ার সময় একটা ভিউপয়েন্ট দেখে দাঁড়িয়ে যাই। বৃষ্টি থেমে আকাশ পরিষ্কার হওয়ায় অপূর্ব সুন্দর গ্যাংটক শহরের দেখা পাই। গ্যাংটকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভিউ পয়েন্ট হলো তাসি ভিউ পয়েন্ট। বৃষ্টির জন্য সেখানে যেতে পারিনি। ইচ্ছে ছিল প্যারাগ্লাইডিং করার; কিন্তু আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় সেটাও হয়নি। আর পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকা গোনজাং মনাস্ট্রি শান্ত, চুপচাপ একটি জায়গা। ২৫ রুপি করে টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে একটু নিচে নেমে যেতে হয়। মঠের ভেতরে ২৪ ক্যারেট স্বর্ণখচিত বুদ্ধমূর্তিসহ নানা ধরনের পেইন্টিং রয়েছে। মন্দিরের ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ। আমি চুপি চুপি একটা ছবি তুলেছিলাম। মঠের চত্বর থেকে দেখা যায় গ্যাংটক শহর। এরপর বাকথাং ঝরনা দেখতে যাই। সেখানে সিকিমের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে ছবি তোলা যায় জনপ্রতি ১০০ রুপি করে। আমার ছেলেমেয়ে আর বোনকে প্রায় জোর করেই পোশাক পরিয়ে দেওয়া হয়। আর এই ঝরনা দেখেই শেষ হয় ওই দিনের ঘোরাঘুরি। গাড়ি আমাদের গ্যাংটকের বিখ্যাত এমজি মার্গে নামিয়ে দেয়। সেখানে খেয়েদেয়ে নিজেদের মতো কতক্ষণ ঘুরে কেনাকাটা করে হোটেলে ফিরে আসি। 

হোটেলে ফিরে জিনিসপত্র গুছিয়ে ঘুম দেই। কারণ পরের দিন সকালে যাব উত্তর সিকিমের লাচুংয়ে। সেখানে থাকব এক দিন। তাই হোটেলেই লাগেজ রেখে ছোট ব্যাগে একদিনের কাপড় নেই।

পরের দিনের প্রভাতে হোটেলেই নাশতার পাট চুকিয়ে ভজরা ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে যাই। এখান থেকেই উত্তর সিকিম যাওয়ার গাড়ি ছাড়ে। আমাদের ট্যুর ম্যানেজার ট্যাক্সি চালকের দেওয়া নম্বরে বারবার ফোন করেও তার গাড়ি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। প্রায় এক ঘণ্টা পর তাকে পেলাম এবং তখন আবার বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো লাচুংয়ে যাওয়ার অনুমতিপত্র আর গাইডের জন্য। এরপর লাচুংয়ের পথে যাত্রা শুরু, দোকান থেকে জুস, পানি আর চিপস কিনে নিলাম। গ্যাংটক থেকে লাচুংয়ের দূরত্ব প্রায় ১২৬ কিলোমিটার। যেতে ৫/৬ ঘণ্টা সময় লাগে। আমাদের গাড়িচালক নেপালি এবং তার নাম গণেশ লামা, আর গাইড ছিলেন অস্মীন, স্থানীয় ছেলে। ট্যুরিজম বিষয়ে পড়াশোনা শেষে ইন্টার্ন করছেন।

লাচুং নদী

লাচুংয়ের পথে

আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা, দুই পাশে সবুজ বন, একপাশে পাহাড় অন্যপাশে গভীর খাদ। গাইড আমাদের নানা বিষয়ে নানা তথ্য জানাচ্ছিল। লাচুং যাওয়ার দুই রাস্তা, একটা তিস্তা নদীর পাশ দিয়ে, অন্যটা বাইপাস। আমরা যাওয়ার সময় বাইপাস দিয়ে যাই। যেতে যেতে দেখি পাহাড়ের বুক চিরে যাওয়া খরস্রোতা পাথুরে নদী, নাম জানা-অজানা ঝরনা, গ্রাম, রং- বেরঙের ফুল, দারুণ সব ভিউ পয়েন্ট। যাওয়ার পথে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমরা পৌঁছে যাই সেভেন সিস্টার ফলসে। বিশাল এক ঝরনা, পাহাড়ের বুক চিরে সবুজের মাঝে যেন সাদা মুক্তা ঝরে পড়ছে। গাইড জানালেন, এই ঝরনার সাতটি ধারা, আমরা এখানে মাত্র একটা দেখতে পাচ্ছি। সাতটি ধারা দেখতে হলে দুই ঘণ্টা ট্র্যাকিং করে দুর্গম পাহাড়ের উপরে উঠতে হবে। সে ইচ্ছা আমাদের কারও ছিল না... এমনিতেই আমরা সমতলের মানুষ। ঝরনার পাশেই একটি পুরোনো ব্রিজ, পাশে আবার গাড়ি চলাচলের সেতু। পুরোনো ব্রিজে নানা রঙের পতাকা লাগানো। আরেক পাশের পাহাড়ে বুদ্ধের একটা মনুমেন্ট। 

দুপুরে কী খাব, যেতে যেতে তা নিয়ে কথা হচ্ছিল। কথা শুনে ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলেন আমরা গরুর গোশত খাই কি না। বললাম, এখানে পাওয়া যাবে? এরপর তিনি আমাদের একটা হোটেলে নিয়ে গেলেন.. সেখানে ছিল রুটি, গরুর গোশত, আলু ভাজি, বাদাম আর আচার। খেয়ে আবার যাত্রা শুরু। পথে থেমে থেমে পাহাড়ি ঝরনা দেখাচ্ছিলেন আমাদের চালক। নাগা ফলস ছিল সবচেয়ে সুন্দর। স্বচ্ছ নীল পানি। আমরা থামি তিস্তা ড্যামে। ড্যামের এক পাশে প্রচুর পানি, অন্যপাশে শুকনা। ড্যামের পাশেই চুংথাম শহর। ২০২৩ সালের অক্টোবরে মেঘভাঙা বৃষ্টিতে ভেসে যায় এই ড্যাম, সঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে চুংথাম শহরও। আর চুংথাম থেকেই লাচুং আর লাচেন যাওয়ার পথ আলাদা হয়ে গেছে। পথে আরেকটা বিশাল ঝরনা দেখে থামলাম, নাম ‘অমিতাভ বচ্চন ফলস’। এমন নামকরণের কারণ হলো ঝরনাটি অনেক লম্বা, অমিতাভ বচ্চনের মতো। এখানে নেমে ছবি তুলে, চা-নাশতা খেতে খেতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। 

চুংথাম এলাকার টুং চেক পোস্টে ফাইনাল চেক করা হয়। চেকপোস্টে আমরা গাড়িতেই বসে ছিলাম, আমাদের চালক আর গাইড গিয়ে অনুমতি নিয়ে এলেন। লাচুংয়ে প্লাস্টিক একেবারেই নিষিদ্ধ। তাই পানির বোতল, চিপসের প্যাকেট..বিশেষ করে ওয়ান টাইম ইউজ করা হয়... এমন সবকিছু চেকপোস্টের আগে বিনে ফেলে দিতে হয়। যদি পাওয়া যায় তাহলে জরিমানা দিতে হয়। আমরা পানির জন্য পুনরায় ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের বোতল কিনে নিয়েছিলাম। ৭টার দিকে আমরা গন্তব্যে পৌঁছে যাই। হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রাতেই শহর দেখতে বের হই। যদিও অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। হাঁটতে হাঁটতে লাচুং নদী পর্যন্ত যাই, নদীর কল কল শব্দ অনেক দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল। ফেরার সময় দেখি আর উঠতে পারছি না... মনে হচ্ছিল ফুসফুস ফেটে যাবে। কারণ লাচুং শহর ৮ হাজার ফুটের বেশি উঁচু। থেমে থেমে হেঁটে হোটেলে পৌঁছানোর আগেই বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। কী আর করা... রুমে বসেই সময় কাটানো। রাতের খাবার হতে হতে ১০টা, মেন্যু ছিল পাহাড়ি মুরগি ভুনা, সবজি, ডাল আর ভাত। রান্না খুবই মজার ছিল। লাচুংয়ে কিন্তু অনেক ঠান্ডা, জুলাই মাসেও ৬-৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল তাপমাত্রা, সঙ্গে বৃষ্টিও থাকে। তাই প্রয়োজনমতো গরম কাপড় নিয়ে আসবেন। আর পানি এত ঠান্ডা যে খাওয়ার জন্য রুমে গরম পানি দিয়ে যায়। 

মজার বিষয় হলো-ঝরনাগুলোতে পানির পাইপ দেওয়া থাকে, সেখান থেকেই খাওয়ার পানি দেওয়া হচ্ছে এবং পানির স্বাদ খুবই ভালো ছিল। গ্যাংটক-লাচুং হাইওয়ে যেমন সুন্দর তেমনি ভয়ঙ্কর। রাস্তার একপাশে বিশাল পাহাড়, অন্যপাশে গভীর খাদ। বৃষ্টি হলে পাহাড়ধস হয়, আবার বরফ পড়ে রাস্তা বন্ধও হয়ে যায়।

তারপর চতুর্থ দিনের ভোর এলো আমাদের জন্য বিস্ময় নিয়ে। রুম থেকে বের হয়ে চোখ ছানাবড়া। এত এত সুন্দর চারপাশ, ভাষাহীন-বাকরুদ্ধ হওয়ার জোগাড় হয়ে গিয়েছিলাম ক্ষণিকের জন্য। সুইজারল্যান্ড বললে যেমন চোখে ভেসে ওঠে উঁচু পাহাড়, ঝরনা, এখানেও ঠিক তেমনি। চারপাশে উঁচু পাহাড়- মেঘের জন্য পাহাড়ের শেষ পর্যন্ত দেখা যায় না। আর যেন মেঘ ভেদ করে ঝরনার পানি পড়ছে। অনেক ছবি তুলেছি, ভিডিও করেছি; কিন্তু ছবি ও ভিডিওতে প্রায় কিছুই আসেনি। এর আসল রূপ শুধু এবং শুধু সামনাসামনি দেখতে হয়। আবেগে ঘোষণা দিয়ে ফেললাম, আমি এখানে আবার আসব, আর তিন দিন থাকব এখানে। কোত্থাও যাব না, হোটেলের প্রাঙ্গণে বসে প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করব। 

ইয়ামথাম ভ্যালি

ইয়ামথাম ভ্যালি ও জিরো পয়েন্ট

আমাদের আজ ইয়ামথাম ভ্যালি ও জিরো পয়েন্ট ঘুরে গ্যাংটক ফেরার কথা। তাই সকাল ৭টার মধ্যে নাশতা করে আমরা হোটেল থেকে বের হই। পথে যেতে যেতে নানা গল্প শুনছিলাম। গাইড জানাল, এখন বর্ষার সময় তাই কোনো ফুল নেই। এপ্রিল-মে মাসে বরফ থাকে না, তখন ফুলে ফুলে চারপাশ ভরে যায়। এটাই সিকিমে বেড়ানোর পিক-টাইম। পথে অ্যাভালান্স বা হিম-ধস পয়েন্ট নামে একটা জায়গায় থামলাম। সেখানে ২০১১ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্পে বিস্ফোরণ হয়ে পাহাড় ধসে পড়ে। ক্ষত তখনো ছিল; কিন্তু প্রকৃতি যেন সেখানে নতুন করে সেজে উঠেছে। দেড় ঘণ্টার মধ্যে আমরা ১১,৮০০ ফুট উচ্চতার ইয়ামথাম ভ্যালিতে পৌঁছে গেলাম। সেখানে বাংলাদেশি দুই পরিবারের দেখা হয় এবং একটা মজার ঘটনা ঘটে (সেটা এখানে বলা যাচ্ছে না)। ইয়ামথাম ভ্যালির আরেক নাম ভ্যালি অব ফ্লাওয়ারস। আমরা ফুল পাইনি, যদিও ছোট ছোট বুনো ফুল ছিল। নেটে দেখেছিলাম ফুলের মধ্যে শুয়ে-বসে তোলা নানা ছবি। আমারও তেমন ইচ্ছা ছিল, কিন্তু এ যাত্রায় তা পূরণ হয়নি। ভ্যালির পাশেই পান্না রঙের পানির নদী বয়ে যাচ্ছে, তার পাশেই বিশাল বিশাল পাহাড়, পাহাড়ের বুকে ছোট-বড় কত ঝরনা, যা নদীতে এসে পড়েছে। যখন পৌঁছি তখন সেখানে রোদ থাকলেও একটু পরেই মেঘ ঢেকে বৃষ্টি শুরু হয়। আমরাও দৌড়ে গাড়িতে উঠে বসি।

ইয়ামথাম ভ্যালি দেখে জিরো পয়েন্টের দিকে যাই। চীন সীমান্তের নৈকট্য ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিধিনিষেধের কারণে এখানে আলাদা করে অনুমতি নিতে হয়। প্রতি জিপের জন্য অফ-সিজনে ৩৫০০ রুপি ও পাসপোর্ট, ভিসা, ছবি, সিকিমে প্রবেশের অনুমতিপত্রের ফটোকপি দিতে হয়। মাঝে একটা সেনা ক্যাম্পে থেমে টয়লেটে যাই। সেখানে স্যুভেনির শপের দায়িত্বে থাকা সেনাসদস্যের সঙ্গে কথা হয়, কথায় কাথায় জানলাম তিনি বাঙালি। সেখান থেকে কলিগ-বন্ধুদের জন্য কিছু উপহার নিলাম। জায়গাটা এতটা সুন্দর যে সেখানে বসে সারাদিন অনায়াসে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। লাল পাথরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নীলরঙা নদী। তাড়া ছিল, তাই আর সময় নষ্ট না করে সামনের দিকে এগোনো শুরু করি। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা, পেঁচানো রাস্তা দিয়ে উপরের দিকে উঠছি আর ভয়ে আমি জোরে জোরেই দোয়া পড়া শুরু করি। সবুজ শেষ হয়ে প্রকৃতি যেন আস্তে আস্তে রুক্ষ হতে শুরু করল। রুক্ষতাও যে এত সুন্দর হতে পারে। কিছু কিছু জায়গায় পাথর আর পাথর... নানা রং, নানা আকারের। তার মাঝে আবার ছোট ছোট নালা, স্বচ্ছ পানি, সেগুলোর উপর দিয়ে গাড়ি ছুটছে। মনে হচ্ছিল গাড়ি থামিয়ে থামিয়ে ছবি তুলি। যেতে যেতে সমতল ভূমির মতো জায়গা এলো, ছোট ছোট ফুল দিয়ে ভরা। একটা জায়গায় বাংকার আর বাংকার। গাইড আগেই বলে দিল, এখানে ছবি তোলা নিষেধ। অবশেষে আমরা জিরো পয়েন্টে পৌঁছলাম। আমরা যেহেতু জুলাই মাসে গিয়েছি তাই কোথাও বরফ ছিল না। জিরো পয়েন্টে পাহাড়ের চূড়ায় বরফ দেখে লাফিয়ে উঠি। গাড়ি থেকে নেমেই ছবি তোলা শুরু হয়ে যায়। ১৫ হাজার ফুট ওপরে প্রচণ্ড ঠান্ডা আর শুষ্ক বাতাসে আমার মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়। শারলিজ ৫ মিনিট থেকেই ঠান্ডায় গাড়িতে বসে রইল। দূরে তিব্বতের বরফে ঢাকা পাহাড়, সেখানে থেকে বয়ে আসা নদী, পাথর, রুক্ষ প্রকৃতি, সব মিলিয়ে এক অন্যরকম সৌন্দর্য। গাড়িচালক জানালেন, শীতে এখানে গাড়ি পার্ক করার জায়গা থাকে না। পর্যটকদের এত ভিড় থাকে। চারপাশ বরফে সাদা হয়ে যায়।

জিরো পয়েন্টে লেখিকা

আমি আর বাইরে থাকতে পারছিলাম না। ঠান্ডায়, মাথাব্যথায় আমিও গাড়িতে গিয়ে বসলাম। এত শীত লাগছিল যে, শারলিজকে বললাম, আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখ। বেশ কিছুক্ষণ পর শীত একটু কমলে কফি খেয়ে ফেরার পথ ধরি। অস্থায়ী দোকানে দুজন কফি, ম্যাগি, নানা ধরনের ড্রিঙ্কস বিক্রি করছে (সিকিমে ধূমপান নিষিদ্ধ, মদ্যপান বৈধ)। জিরো পয়েন্টের আশপাশে কোনো বাড়ি-ঘর নেই। দোকানও অস্থায়ী। গাড়িচালক বলছিল, কাছেই একটা উষ্ণ প্রস্রবণ আছে, সেখানে যাব কিনা। আমার খারাপ লাগছিল, তাই যাইনি। হোটেলে যখন ফিরি তখন টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। এরই মধ্যে বসে দুপুরের খাবার খেয়ে গ্যাংটকে ফেরার পথ ধরি। 

এবার অন্য পথে... তিস্তার তীর ধরে। কিন্তু প্রায় পুরো পথেই বৃষ্টি ছিল। ভিউ পয়েন্টে নেমে নেমে রংধনু, তিস্তা, পাহাড়, মেঘের ছবি তুলি। চাইছিলাম, রাতের আগেই যেন গ্যাংটক পৌঁছতে পারি। বারবার চালককে জিজ্ঞাসা করছিলাম, আর কতক্ষণ? গ্যাংটকের কাছাকাছি আসতেই এমন ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো যে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। কিন্তু দেখি চালকের বা বাকি যাত্রীদের কোনো বিকারই নেই। ৭টার দিকে হোটেলে পৌঁছলাম, একই রুম আমাদের জন্য রেখে দিয়েছিলেন ম্যানেজার। 

ছাঙ্গু লেক

পঞ্চম দিন আমরা ছাঙ্গু লেক ঘুরতে যাই। গ্যাংটক শহর থেকে ছাঙ্গু লেকের দূরত্ব ৪০ কিলোমটিার এবং যেতে সময় লাগে এক থেকে দুই ঘণ্টা। এখানে যেতেও চেকপোস্টে অনুমতি নিতে হয়। এখানেও একটু ঝামেলা হয়। আধা ঘণ্টা পর আমরা সব কাগজপত্র জমা দিয়ে অনুমতি পাই। এদিনও আমাদের একই গাড়িচালক ও গাইড ছিলেন। ছাঙ্গু লেক যাওয়ার রাস্তাটা বেশ ভালো, চওড়া। কারণ এখান দিয়েই যেতে হয় নাথুলা পাস (চীন সীমানা), প্রাচীন সিল্ক রোডের অংশ। লেক থেকে নাথুলা পাস মাত্র ৫/৬ কিলোমিটার। কিন্তু ভারতীয়রা ছাড়া সেখানে বিদেশিদের যাওয়ার অনুমতি নেই। এই রাস্তায়ই ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার কয়েকটা ভিউ পয়েন্ট। প্রথম ভিউ পয়েন্ট দেখে গাড়ি থামানো হয়। নীল আকাশে সাদা বরফচূড়ার কাঞ্চনজঙ্ঘা। এরপর আরেকটা ভিউ পয়েন্টে থামি, সেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা আরেকটু পরিষ্কার দেখা যায়। এখানে কয়েকটা অস্থায়ী দোকান থেকে শীতের কাপড় কিনি। কারণ জিরো পয়েন্টে ভারী পোশাক না থাকায় অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল (পরে ফোনে দেখি, তখন জিরো পয়েন্টে ২-৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল। ছাঙ্গু লেকেও এমন তাপমাত্রা থাকে)। এদিনই আমাদের দার্জিলিং ফেরার কথা। তাই আর দেরি না করে আবার চলতে থাকি। মার্কেটমতো একটা জায়গায় থেমে ম্যাগি নুডুলস আর চা খাই (পাহাড়ে মনে হয় শুধু ম্যাগি নুডুলসই পাওয়া যায়)। ইয়াকিন একটা জ্যাকেট ভাড়া নেয়। 

ছাঙ্গু লেকে যাওয়ার সড়ক

লেক দেখে একটু হতাশই হচ্ছিলাম। খুবই সাধারণ মনে হয়েছে। যদিও চারপাশটা অনেক সুন্দর। লেকের চারপাশ ঘুরে দেখতে ইয়াক রাইড নেওয়া যায়। দাম তুলনামূলক অনেক বেশি; আমার হাজব্যান্ড ইয়াকের পিঠে চড়ে কিছু ছবি তুলল (১০০ রুপি নিয়েছে)। শারলিজও উঠতে চেয়েছিল; কিন্তু ইয়াকের নড়াচড়া দেখে আর সাহস পায়নি। গাইড জানালেন, শীতে পুরো লেকের পানি জমে যায়। তখনকার সৌন্দর্য আবার অন্যরকম। 

ছাঙ্গু লেক সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২ হাজার ফুট উপরে অবস্থিত। আমরা পরে ক্যাবল কার দিয়ে সাড়ে ১৪ হাজার ফুট ওপরে উঠি। সেখান থেকে পুরো লেক দেখা যায়। কিন্তু আমাদের কপাল খারাপ, প্রায় কিছুই দেখতে পারিনি। ঘন মেঘে সব ঢেকে যায়, আমরা অপেক্ষা করছিলাম যে মেঘ কেটে যায় কিনা। দেখলাম আরও বেশি করে মেঘ জমছে আর ঠান্ডা বাতাস। উপরে বেশ ভালো লাগছিল। আরও উপরে কোনো একটা মন্দির আছে, দেখলাম ঘন কুয়াশার মধ্যেই এক বৃদ্ধ দম্পতি সেখানে উঠছেন; কিন্তু ঠান্ডায় আমাদের সবার অবস্থা খারাপ। ঠান্ডা থেকে বাঁচতে আমরা ক্যাবল কারের ভেতরে গিয়ে বসে রইলাম। নিচে নেমে বাংলাদেশি একটা বিশাল গ্রুপের সঙ্গে দেখা হয়। তাদের সঙ্গেও ছবি তুললাম। ফেরার পথে যে দোকান থেকে জ্যাকেট ভাড়া নিয়েছিলাম সেখানে গিয়ে আবার ম্যাগি আর চা খেয়ে গ্যাংটকে হোটেলে ফিরে আসি। এই গাড়িতে করেই আমরা দার্জিলিং যাব। গাইড বিদায় নিয়ে নিলেন আর চালক একটা গ্যারেজে গাড়ি নিয়ে গেলেন গাড়ির চাকা আর ব্রেক ঠিক করতে। কারণ দার্জিলিংয়ের রাস্তা বেশ খাড়া। এই গাড়ি নিয়ে যাওয়া একটু রিস্কের। 

আমরা দার্জিলিং ও শিলিগুড়িতে একদিন করে থেকে মিতালী এক্সপ্রেসে করেই বাংলাদেশে ফিরে আসি। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫