পথিকৃৎ আলোকচিত্রী: হেমেন্দ্রমোহন বসুর অজানা কথা

সাহাদাত পারভেজ
প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৪, ১৮:৪০

স্টিরিওস্কোপ চিত্র। আলোকচিত্র : হেমেন্দ্রমোহন বসু
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় স্বদেশি আন্দোলনের ছবি তুলে ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেন হেমেন্দ্রমোহন বসু। আমাদের গৌরবময় আন্দোলন ধরে রাখা এই কিংবদন্তি আলোকচিত্রী পরিচিত ছিলেন এইচ বোস নামেও। বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসুকে দেখে তিনি ছবি তোলায় ঝুঁকে পড়েছিলেন। আলোকচিত্র শিক্ষার হাতেখড়িও পেয়েছিলেন জগদীশচন্দ্রের কাছে। ছবি তোলার নেশা তাকে এতটাই পেয়ে বসেছিল যে, তিনি বিদেশ থেকে একাধিক ক্যামেরা আনিয়েছিলেন। বাড়িতে তৈরি করেছিলেন ডার্করুম। ছবিতে থ্রি ডাইমেনশন বা ত্রিমাত্রিক ভাবনা তার মস্তিষ্কপ্রসূত। এই উপমহাদেশে রঙিন ফিল্মের প্রচলনও শুরু হয় তার হাত ধরে। বঙ্গভঙ্গ ও এর কাছাকাছি সময়ে তোলা তার ছবিগুলোর মধ্য থেকে হাতেগোনা কয়েকটি ছবিই এখন বর্তমান। স্লো-স্পিড ফিল্ম, ভারী ক্যামেরা, গ্লাস প্লেট নেগেটিভ আর কাঠের তৈরি ট্রাইপড-আলোকচিত্রের সে যুগের সমস্ত বোঝা ও মন্থরতা উপেক্ষা করে তিনি স্বদেশী আন্দোলনের ছবি তুলেছিলেন। তার অসংখ্য ছবির গ্লাস প্লেট নেগেটিভ কিংবা স্লাইড নষ্ট হওয়ায় শুধু আলোকচিত্রী হেমেন্দ্রমোহনের ব্যক্তিগত কুশলতার নিদর্শন লুপ্ত হয়নি, ইতিহাসের আবিলতায় হারিয়ে গেছে বিশ শতকের প্রথম দশকের বিপুল এক চিত্রসম্ভারও।
অনেক বিপর্যয়ের পরও হেমেন্দ্রমোহনের তোলা বেশ কিছু গ্লাস প্লেট আর স্টিরিও নেগেটিভের ভগ্নাবশেষ এখনো তার ফটোগ্রাফি চর্চায় বিপুল উৎসাহ আর পারদর্শিতার সাক্ষী হয়ে আছে। এর মধ্যেই রয়েছে ১৯০৫ সালের ১৫ অক্টোবর তোলা বঙ্গভঙ্গবিরোধী জনসভা ও গঙ্গায় রাখিস্নান উপলক্ষে তোলা বেশ কিছু স্টিরিওস্কোপিক নেগেটিভ ও স্লাইড। ছোট একটা টেবিলে চড়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন স্বদেশি আন্দোলনের নেতা স্যার সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় [সুরেন ব্যানার্জী]। গাছের ডাল বা ভাঙা পাঁচিলের ওপরেও লোক চড়েছে। দুটি ফেস্টুন-একটিতে লেখা Bengal Shall never be reconciled to partition, অন্যটিতে ‘দেবী আমার সাধনা আমার স্বর্গ আমার দেশ’। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে এই দৃশ্যের বহু ফটোগ্রাফ আছে। আছে ব্রাহ্ম স্কুলের মেরি কার্পেন্টার হলের সামনে ও গঙ্গার ঘাটে তোলা জমায়েতের ছবি। সুরেন ব্যানার্জী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেষ্ট মিত্তির ভাষণদানের ছবি ছিল তার সংগ্রহে। এর মধ্যে গুটি কয়েক গ্লাস প্লেটের স্টিরিও-ছবির ভগ্নাংশ থেকে ভাষণরত সুরেন ব্যানার্জীকে আবিষ্কার করা গেছে। ১৯০৫ বা ১৯০৬ সালে তোলা তার স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর একটি ছবি এখনো দেখতে পাওয়া যায়। মৃণালিনীর শাড়ির আঁচলে লাগানো ব্রোচ। তাতে জ্বলজ্বল করছে ‘বন্দেমাতরম’। বহু ক্ষত বুকে নিয়েও দুই-তিনটি গ্রুপফটো ও রাস্তার দৃশ্য তার কম্পোজিশন বোধ আর সার্থক আলোকচিত্রী সুলভ দৃষ্টির পরিচয় বহন করে।

বিশ শতকের প্রথম দশকে তোলা গ্লাস প্লেটগুলোর একটিও এখন আর অক্ষত নেই। কাচ ভেঙেছে, ইমালশন উঠে গেছে-তবু আবছা চেহারা, জনসমাবেশ আর ফেস্টুনের দু-চারটি শব্দ থেকে বোঝা যায় ছবিগুলো বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন যুগের। এ রকম কত ছবি যে তিনি তুলেছেন এখন তার হদিস মেলা ভার। আয়তাকার কাচের পাতগুলো খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় প্রতিটিতে এক জোড়া ছবি রয়েছে। একই দৃশ্যের পাশাপাশি দুটি ছবি। এগুলোকে বলা হয় স্টিরিও-ফটোগ্রাফ বা ত্রিমাত্রিক ছবি। হেমেন্দ্রমোহনের পরিবার তার স্টিরিওস্কোপের কোনো সন্ধান দিতে পারেনি। তবে তার ব্যবহৃত একটি ‘আইকা পলিস্কোপ’ স্টিরিও ক্যামেরা সযত্নে সংরক্ষণ করেছেন তার পৌত্র ড. সুগত বসু। ক্যামেরাটি বেশ বড়, ওজনও যথেষ্ট। ৯ সেন্টিমিটার ফোকাসের টেসার লেন্স [১ : ৪.৫]। হেমেন্দ্রমোহনের ১৯১২ সালের ডায়েরির পাতায় বিভিন্ন কোম্পানির তৈরি স্টিরিও ক্যামেরার উল্লেখ আছে। গ্লাস প্লেটের স্লাইডের বাক্সে ছাপা লেবেল থেকে জানা যায়, তিনি পলিস্কোপ ছাড়াও একটি ভৈরাস্কোপ ক্যামেরা ব্যবহার করতেন। এ ছাড়া ‘আইকা স্লেরা আইডিয়াল নম্বর ৬৫১’ ক্যামেরা যাতে ৬ বাই ১৩ মাপের প্লেট ধরত এবং একটি C.P Goertz ক্যামেরাও তিনি ব্যবহার করতেন। ওই সময় সাদাকালো ছবির প্রচলন ছিল। তিনি অটোক্রোম লুমিয়ের স্লাইড ব্যবহার করে রঙিন ছবির প্রচলন করেছিলেন। রঙিন ছবি বা ‘অটোক্রোম ব্যবহারে তাকে ভারতীয় উপমহাদেশে একজন অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে স্বীকৃত। হেমেন্দ্রমোহনের তোলা তার পত্নী মৃণালিনী দেবী ও কন্যা মালতী ঘোষালের একটি অটোক্রোম দেখে অনুমান করা যায়, ছবিটি ১৯১২ সালে তোলা। স্টিরিওস্কোপিক অটোক্রোম প্লেটে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিও তুলেছিলেন। ক্ষত চিহ্নিত ভগ্ন অবস্থায় একই কালের আরও কিছু অটোক্রোম চিত্র তাদের ৫২ নম্বর আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতে এখনো রয়ে গেছে।
হেমেন্দ্রমোহনকে বুঝতে হলে তার পারিবারিক ঐতিহ্যের দিকে চোখ বুলানো দরকার। তার জন্ম ১৮৬৪ সালে কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি গ্রামে। তিনি বহু গুণের অধিকারী ছিলেন। এ দেশের শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ ও উন্নয়নে তার ভূমিকা অপরিসীম। তার দাদা পদ্মলোচন বসু ছিলেন খুবই বনেদি ও ময়মনসিংহের অন্যতম সচ্ছল ব্যক্তি। তার পিতা হরমোহন বসু ছিলেন সরকারি আদালতের মুন্সেফ। তার কাকা আনন্দমোহন বসু ভারতের প্রথম র্যাঙ্গলার ও ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা; তার নামেই ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ। তার আরেক কাকা মোহিনীমোহন বিদেশের ডিগ্রিধারী ওভারতের প্রথম হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শিক্ষাকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা। বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসু সম্পর্কে তার মামা [আনন্দমোহনের স্ত্রীর বড় ভাই জগদীশচন্দ্র বসু]। চার ভাইয়ের মধ্যে হেমেন্দ্রমোহন বড়। তার অন্য তিন ভাই হলেন যতীন্দ্রমোহন, সুরেন্দ্রমোহন ও সত্যেন্দ্রমোহন। এমন একটি পরিবারের ছেলে রুচিশীল আর সময়ের থেকে এগোনো মানুষ হয়ে উঠবেন এমনটাই স্বাভাবিক।

বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ ছিল ছোটবেলা থেকেই। ছাত্র হিসেবেও তুখোড় ছিলেন। আইএ পাস করে ভর্তি হয়েছিলেন মেডিক্যাল কলেজে। মেডিকেলে পড়ার পেছনে ছিল জগদীশচন্দ্র বসুর উৎসাহ। জগদীশচন্দ্র সেই সময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক। সেই প্রেসিডেন্সি কলেজের ল্যাবরেটরিতেই ঘটল দুর্ঘটনাটা। হেমেন্দ্রমোহন সেখানে গিয়েছিলেন রসায়ন ও বোটানি বিষয়ে গবেষণা করতে। অসাবধানতায় তার চোখে এসে লাগে রাসায়নিক দ্রব্য। সাড়ে পাঁচ মাস চিকিৎসার পর দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেও তার ছাত্রজীবনের যবনিকা ঘটে। ফলে ১৮৯০-৯১ সালে তিনি কুন্তলীন কেশ তেলের ব্যবসা শুরু করেন। কুন্তলীনের পর বাজারে আনেন দেলখোস সুগন্ধি। এর সুঘ্রাণ ও সুনাম এত দূর ছড়িয়ে পড়ল যে, তার বৌবাজার স্ট্রিটের বাড়িটার নামই হয়ে গেল ‘দেলখোস হাউস’। পান সুবাসিত করার ‘তাম্বুলীন’ খুব বাজার পেয়েছিল। এরপর এইচ. বোস পারফিউম কারখানা থেকে তৈরি হতে লাগল ল্যাভেন্ডার ওয়াটার, ও-ডি কোলন, মিল্ক অব রোজসহ নানা সুগন্ধি দ্রব্য। বাঙালিদের মধ্যে তিনিই প্রথম তার ভাই যতীন্দ্রমোহনকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতার হ্যারিসন রোডে সাইকেলের কোম্পানি খোলেন। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ওস্যার নীলরতন সরকারকে নিজ হাতে সাইকেল চালানো শেখান হেমেন্দ্রমোহন। এরপর তিনি ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে গড়ে তোলেন ‘গ্রেট ইস্টার্ন মোটর কোম্পানি’ নামে এক বিশাল মোটরগাড়ির ব্যবসা।
খেলাধুলার প্রতিও আগ্রহী ছিলেন হেমেন্দ্রমোহন। তিনি কলকাতা স্পোর্টস ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি ছিলেন। তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বাঙালি সমাজে কলের গানের প্রচলন। ১৯০০ সালে তিনি একটি ‘এডিসন ফোনোগ্রাফ’ আনিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সে কালের বিখ্যাত শিল্পীদের গান মোমের সিলিন্ডার রেকর্ডবন্দি করেছিলেন। ১৯০৪ সালে ফ্রান্সের প্যাথেফোন কোম্পানির সঙ্গে তার বাণিজ্যিক যোগাযোগ হয়। ৪১ নম্বর ধর্মতলা স্ট্রিটের মার্বেল হাউসে শুরু হয় সিলিন্ডার রেকর্ড ও ফোনোগ্রাফের ব্যবসা। তার এই প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ‘টকিং মেশিন হল’। ১৯০৬ সালে তিনি গড়ে তোলেন নিজস্ব রেকর্ডের প্রতিষ্ঠান ‘এইচ বোসেস রেকর্ড’। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী অন্দোলনে গোটা দেশ যখন উত্তাল সেই সময় তিনি স্বদেশি রেকর্ড ব্যবহারের ডাক দিয়ে দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গাওয়া দেশাত্মবোধক গান ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল হেমেন্দ্রমোহনের মোমের তৈরি সিলিন্ডার রেকর্ড। সিলিন্ডার রেকর্ডেই রবীন্দ্রনাথ রেকর্ড করেছিলেন যদুভট্টের সুরে বন্দেমাতরম। সেই সময় স্বদেশি গানের উপর ব্রিটিশ সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ১৯০৮ সালের ৯ ডিসেম্বর তৎকালীন পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে পুলিশ অভিযান চালায় তার অফিস ও কারখানায়। বাজেয়াপ্ত ও ধ্বংস করা হয় প্রচুর মোমের রেকর্ড ও ব্যবসার নথিপত্র। এর মধ্য দিয়েই হারিয়ে যায় বাঙালির রেকর্ড সংগীতের দুর্মূল্য প্রমাণ।

ব্যবসার ধারাবাহিকতায় হেমেন্দ্রমোহন কলকাতার বৌবাজার স্ট্রিটের ৬২ নম্বর বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন বিশাল এক ছাপাখানা। নাম দেন কুন্তলীন প্রেস। এই প্রেস থেকে ছাপা হওয়া বইগুলো চোখে না দেখলে এর গুণগতমান সম্পর্কে বোঝা মুশকিল। এই প্রেসের রোটারি মেশিনে তিনিই ভারতবর্ষে প্রথম মনোটাইপ ও লাইনোটাইপ প্রথা প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ছাপার কাজ বৌবাজার স্ট্রিটের বাড়িতে হলেও ব্লক তৈরি হতো উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ইউ রায় অ্যান্ড সন্স থেকে। তিনি বঙ্গসাহিত্যের উৎসাহদাতা ছিলেন। ভারতবর্ষে ‘কুন্তলীন সাহিত্য পুরস্কার’-এর প্রবর্তক তিনি। ১৩০৩ বঙ্গাব্দে ‘নিরুদ্দেশের কাহিনী’ শিরোনামের গল্পের জন্য প্রথম এই পুরস্কার পান স্যার জগদীশচন্দ্র বসু। এরপর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গল্প ‘মন্দির’ কুন্তলীন পুরস্কার পায়। কুন্তলীন পুরস্কার পুস্তিকার জন্য ‘কর্মফল’ গল্পটি লিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তিনশ টাকা সম্মানী পেয়েছিলেন।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী পরিবারের সঙ্গে হেমেন্দ্রমোহনের আত্মীয়তার কথা সবার জানা। হেমেন্দ্রমোহন বিয়ে করেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়ের ছোট বোন মৃণালিনী রায়কে। গৃহিণী হিসেবে অনন্য ছিলেন মৃণালিনী দেবী। তার স্বকীয়তা ছিল ঘর সামলানোর মাঝে। স্বামীর সমস্ত কর্মযজ্ঞের পিছনে মৃণালিনী দেবীর ছিল অপরিসীম ধৈর্য এবং নীরব সাহচর্য। ১৪ সন্তানের জননী মৃণালিনী ছেলেমেয়েদের নিয়ে মাঝে মাঝে স্বামীর ড্যারাক গাড়িতে চেপে বেড়াতে যেতেন। হেমেন্দ্রমোহনও বুঝেছিলেন তাঁর সহধর্মিণীর ক্ষমতা। হেমেন্দ্রমোহন-মৃণালিনীর সন্তানদের প্রায় সবাই পরবর্তীকালে সুপ্রতিষ্ঠিত হন। চিত্রপরিচালক ও ক্যামেরাম্যান নীতিন বসু, ক্রিকেটার কার্তিক বসু, রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী মালতী ঘোষাল স্ব স্ব ক্ষেত্রে উজ্জ্বল।

চলচ্চিত্রের প্রতিও তার আগ্রহ ছিল। রঙিন ফিল্মের পাশাপাশি তিনি বিদেশ থেকে বেশ কয়েক ধরনের মুভি ক্যামেরা আনিয়েছিলেন। তার ছেলে নীতিন বসু বাবার মুভি ক্যামেরাতেই হাত পাকিয়েছিলেন। হেমেন্দ্রমোহনের ১৯১৫ সালের ২৪ জুন প্রেরিত একটি বিলের কপি থেকে জানা যায়, তিনি ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুরকে আলোকচিত্রচর্চার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করতেন। হয়তো আরও বহু মান্যগণ্য ব্যক্তির ছবি তোলার শখ তার মধ্যস্থতায় মিটত, কিন্তু নথিপত্রের অভাবে তাদের নাম জানার এখন আর কোনো সুযোগ নেই।
চায়ের প্রতি তার আসক্তি ছিল। আয়েশ করে চা খাওয়ার জন্য চীন থেকে আনিয়েছিলেন চায়ের বাসনপত্র। দার্জিলিংয়ে তার নিজস্ব চায়ের বাগান ছিল। নিয়মিত পান, বিদেশি ক্যাডবেরি আর পিকফ্রিন বিস্কুট খাওয়ার ফলে হেমেন্দ্রমোহনের দাঁতে ছোপ পড়েছিল। ঠিক করলেন দাঁতে স্ক্রেপ করাবেন বিলিতি কায়দায়। কিন্তু স্ক্রেপ করার দুদিনের মাথায়ই শুরু হলো দাঁত থেকে অনর্গল রক্ত পড়া। একই সঙ্গে প্রবল জ্বর, বেহুঁশ অবস্থা, অসহনীয় যন্ত্রণা। মাঝে মাঝেই প্রলাপ বকেন। সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারী, প্রাণকৃষ্ণ আচার্য, দ্বিজেন্দ্র মৈত্রের মতো প্রখ্যাত চিকিৎসকের প্রাণান্ত চেষ্টাও হার মানল। চিকিৎসক প্রাণধন বসু নাড়ি ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বাড়ির উল্টো দিকের মর্টন ইনস্টিটিউশনের স্কুলঘড়ি ঢং ঢং করে জানান দিচ্ছে তখন বিকেল ৪টা। পাশ থেকে শোনা যাচ্ছে মৃণালিনীর অস্ফুট মগ্ন প্রার্থনা। দিনটা ছিল ১৯১৬ সালের ২৮ আগস্ট। বায়ান্নতেই চলে গেলেন হেমেন্দ্রমোহন বসু।
তথ্যসূত্র
ছবি তোলা : বাঙালির ফোটোগ্রাফি-চর্চা, সিদ্ধার্থ ঘোষ, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লিমিটেড, দ্বিতীয় মুদ্রণ : এপ্রিল ২০১৫, পৃষ্ঠা : ১৩৩-১৩৬, ১৬২, ১৬৮, ১৭১
সফল বাঙালি উদ্যোগপতি হেমেন্দ্রমোহন, বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্যের প্রবন্ধ, আনন্দবাজার অনলাইন, ২১ নভেম্বর ২০১৪
অমলিন সুবাসের রূপকার, রুম্পা দাসের স্মৃতিচারণা, আনন্দবাজার অনলাইন, ২৫ আগস্ট ২০১৮
বাংলাদেশে আলোকচিত্র : উৎপত্তি ও বিকাশ, অনুপম হায়াতের প্রবন্ধ, নিরীক্ষা [বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের গণমাধ্যম সাময়িকী, ৮১তম সংখ্যা], জুলাই-আগস্ট ১৯৯৭]