
গ্রাফিক্স: সাম্প্রতিক দেশকাল
বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করতে করতে তনুজা বারান্দার দক্ষিণ প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ায় এবং গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিকণা উড়িয়ে আনা বাতাসে পায় একটা মিষ্টি গন্ধ। মহুয়া ফুটেছে। অথচ গন্ধটা একবারও পায়নি আগে। সে কি এতটাই ব্যস্ত ছিল যে গন্ধটা খেয়াল করেনি, নাকি ফুলগুলো গন্ধ বিলাতে শুরু করেছে আজই? তনুজা জামরুল গাছের পেছনে পাঁচিল ঘেঁষে দাঁড়ানো মহুয়া গাছটা খোঁজে। বাতাসের আরেকটা ঝাপটা আসে এবং ব্যস্ততা কমে গিয়ে মনের যে জায়গাটা খানিকটা আলগা হয়ে আছে, গন্ধটা ছড়িয়ে পড়ে ঠিক সেখানে।
বৃষ্টি কমে আসে এবং তনুজা আকাশ দেখার জন্য কুলগাছটার পাশ দিয়ে তাকায় ওপরে। মেঘ কেটে গেছে দেখে তড়িঘড়ি করে ঘরে যায় এবং প্রদর্শনীর কার্ডগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে দেখে, গেট পার হয়ে বাগানের পাশ দিয়ে হেঁটে আসছে দুজন পুলিশ।
তনুজার মনে যে ধারণাটা এসে হানা দেয় সেটা জাভেদকে নিয়ে-তার মামলার কোনো ঘটনা? কিন্তু ধারণাটাকে সে উড়িয়ে দেয় এবং ভাবে, পুলিশ হয়তো এসেছে অন্য কারও বাসায়।
দোতলার বেল বাজে। পুলিশ কি ভুল করে বাজিয়েছে? তনুজা ভাবে। কিন্তু বেলটা আবারও ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে।
রুপালি দৌড়ে আসে রান্নাঘর থেকে।
‘দেখো, ভুল করে বেল টিপল কিনা।’
রুপালি নিচে গিয়ে দরজা খুলে দেয় এবং পুলিশ উঠে আসে দোতলায়।
‘কাকে চাচ্ছেন?’
‘আপনি তনুজা শারমিন?’
‘হ্যাঁ।’
তনুজা নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দেয়, কিন্তু তার মন সন্ত্রস্ত হয়ে দিগবিদিগ ছোটাছুটি করে। যিনি কথা বলছেন সেই পুলিশের ডান পকেটের উপরে লেখা ‘সেলিম’। তীক্ষ্ণ চোখ এবং কোমরে পিস্তল।
‘জাভেদ কায়সার আপনের হাসব্যান্ড?’
‘হ্যাঁ, ওর কিছু হয়েছে?’ উদ্বেগ নিয়ে তনুজা বলে।
‘না। কিছু হয় নাই।’
‘তাহলে?’
‘আমরা আসছি আপনার কাছে।’
‘কেন?’
‘বলতেছি। এখানে দাঁড়ায়াই বলব?’
‘না না, বসেন।’
বসার ঘর খুলে দিয়ে তনুজা অস্থির হয়ে ঘামতে শুরু করে। সারা ঘরে চানাচুর আর চিপসের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টুকরা আর পড়ে থাকা খালি প্যাকেটগুলো রুপালি সরিয়েছে; কিন্তু ফুলদানির পাশে রাখা অ্যাশট্রেটা আছে এখনো, আছে একটা মাটির সরা, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেটের ফিল্টারে ভরা এবং পাশে নতুন-পুরোনো কিছু মদের বোতল, খালি যদিও। রুপালি কেন যে এগুলো সরায়নি, আর ছোট খাটটার দিকে তাকিয়ে তনুজার মেজাজ আরও চড়ে যায়। কালচে একটা ছিদ্র তাকিয়ে আছে তার দিকে, আগের রাতে গান্ধি বসেছিল ওখানে, আর ওই গান্ধির সিগারেট থেকেই আগুন খসে গিয়ে পুড়েছে চাদর, বলে কিনা ভাব গান, ভাবের জোয়ারে এমন ভেসেছে যে, সিগারেটের আগুন কোথায় পড়ে খেয়াল থাকে না।
বসার ঘরে কোনো চেয়ার বা সোফা না থাকলেও মোড়া আছে কিছু। তনুজা দুটো মোড়া এগিয়ে দেয় পুলিশের দিকে এবং যার পকেটের ওপরে ‘সেলিম’ লেখা, তিনি মোড়ার ওপর বসতে বসতে জানান, তিনি থানার উপ-পরিদর্শক এবং বলেন, ‘আপনের হাসব্যান্ড যা করতেছেন তাতে রাষ্ট্রের আপত্তি আছে।’
‘ও কী করছে?’ তনুজা এমনভাবে বলে যেন সে কিছুই জানে না এবং তার মুখভাব এমন হয় যে এসব তার জানারই কথা না।
‘বিদেশে বসে উনি গুজব ছড়াইতেছেন, বুঝলেন তো, ওগুলো দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতেছে, দেশের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হইতেছে।’
উপ-পরিদর্শক থামেন।
তনুজা দাঁড়িয়ে ছিল তার স্টুডিওতে ঢোকার দরজার পাশে। বলল, ‘আমি কী করব?’
‘আপনে থামাইবেন। আপনেই থামাইবেন।’
‘কীভাবে?’
‘সেইটা আপনেই বুঝবেন।’
উপ-পরিদর্শক আরও কিছু বলতে মুখ খুলেছিলেন কিন্তু আকস্মিকভাবে তার ভীষণ হাঁচি পায় এবং অনুচ্চারিত শব্দটা একটা দীর্ঘ নাসিক্য ধ্বনিতে রূপান্তর হয়ে বেরিয়ে যায় সেই হাঁচির সঙ্গে। পরপর দুটো হাঁচিই তার দেহের গভীর তল থেকে এমন অনিবার্যতা নিয়ে উঠে আসে যে মোড়াসহ নড়েচড়ে ওঠেন। তারপর স্থির হয়ে বসা মাত্র চেষ্টা করেন পকেট থেকে রুমাল বের করতে।
তনুজা দ্রুত পায়ে মাঝের দরজা দিয়ে তার স্টুডিওতে ঢোকে এবং একটা টিস্যুবক্স এনে উপ-পরিদর্শককে দেয়।
‘ধন্যবাদ।’
কথাটা বলতে বলতে তিনি নাক মোছেন এবং তারপর ব্যবহৃত টিস্যুটা কোথায় ফেলবেন তা নিয়ে সঙ্কটে পড়েন। আশেপাশে তাকান, কিন্তু জুতসই কোনো জায়গা খুঁজে পান না। টিস্যুটা তার হাতেই থাকে এবং অন্য হাতে ধরে রাখেন টিস্যুবক্স।
উপ-পরিদর্শকের পাশে বসে ছিলেন যে পুলিশ এবং যার ডান পকেটের উপরে লেখা ‘রাসেল’, হঠাৎ কিছুটা চঞ্চল হয়ে ওঠেন এবং তার দৃষ্টি সারা ঘরে ঘুরতে ঘুরতে মাটির সরাটার উপর গিয়ে স্থির হয়। তিনি উঠে দাঁড়ান এবং ফুলদানি রাখা কাঠের ফ্রেমটার দিকে এগিয়ে যান। তখনো তার দৃষ্টি ছাইদানির দিকে। কিন্তু কাছে গিয়ে হাতে নেন শূন্য বোতলগুলোর একটা। ছিপি খুলে গন্ধ শোঁকেন এবং বলেন, ‘এ তো মাদক!’
‘কী বলতেছ?’ উপ-পরিদর্শক রাসেল-পুলিশের দিকে তাকান।
তনুজাকে উদ্বিগ্ন দেখায়।
‘মদ খান নাকি?’ উপ-পরিদর্শক তনুজার দিকে তাকান এবং তনুজা বুঝতে পারে না, তিনি কি আন্তরিকভাবে জিজ্ঞেস করছেন, নাকি এটা একটা অভিযোগ।
‘না না, ওগুলো পানি রাখার জন্য,’ তনুজা কথাটা বলে এবং মনে মনে নিজের উপর ক্রুদ্ধ হয়, ভাবে, দিনে দিনে নিজের উপর ক্রুদ্ধ হওয়াটা কেন এত বাড়ছে।
‘এই যে শুঁকে দেখেন,’ রাসেল-পুলিশ বোতলটা উপ-পরিদর্শকের দিকে এগিয়ে ধরেন এবং তিনি টিস্যুবক্সটা নিচে রেখে ডান হাত দিয়ে লাউডার্সের খালি বোতলটা নাকের ফুটোর কাছে টেনে নেন। শ্বাস নিয়ে বলেন, ‘মদের গন্ধ!’
‘বাসায় আরও মাদক আছে নাকি?’ রাসেল-পুলিশ তনুজার দিকে তাকায়।
‘নেই।’
‘নেই?’ উপ-পরিদর্শক যেন হতাশ।
‘কিন্তু যা ছিল তার জন্য আপনাকে থানায় যেতে হবে,’ রাসেল-পুলিশের কণ্ঠস্বর বেশ দৃঢ়।
‘আমরা আপনাকে থানায় নিয়ে যাব,’ উপ-পরিদর্শক পুনরুক্তি করেন।
‘কেন?’
‘কেন সেটা তো বুঝবেন।’
‘কী বুঝব?’
‘বুঝবেন রাষ্ট্র কী...’ বলতে বলতে উপ-পরিদর্শক আবারও একটা হাঁচি দেন এবং তনুজা মোবাইলের বাটন টিপতে টিপতে তার স্টুডিওতে ঢোকে। পুলিশ মাঝখানের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন এবং মুখ-চাওয়া-চাওয়ি করেন পরস্পর।
রাসেল-পুলিশকে কিছুটা উদ্বিগ্ন দেখায়।
‘পলায়া যাইতে পারে।’
‘পলায়া যাইবে কই?’
উপ-পরিদর্শক মৃদু হাসেন।
তনুজা এসপি আখলাকুর রহমানকে ফোন করে কয়েকবার, তিনি ফোন না ধরলে ‘জরুরি’ লিখে একটা টেক্সট পাঠায় এবং ফোন করে কামরুল নামে আরেকজনকে।
‘শোনো, তুমি আখলাক ভাইকে ফোন করে বলো, আমার বাসায় পুলিশ।’
‘পুলিশ? কেন?’
‘বলতেছে জাভেদকে থামাইতে। আর বলো, আমার নামে মাদকের মামলা দিবে বলতেছে।’
‘আচ্ছা, বলতেছি।’
‘তাড়াতাড়ি বলো।’
‘তুমি ঢাকা কবে যাইতেছ?’
‘পরশু।’
‘আমি কি যাব তোমার সঙ্গে?’
‘ওহে ভিমরুল! আগে আখলাক ভাইকে ফোন দাও।’
তনুজা শোবার ঘরে ঢোকে। বসে পড়ে বিছানায়। তার দুই চোখ উদ্ভ্রান্ত। রুপালি আসে ঘরে।
‘পুলিশকে কি চা দেওয়া লাগবে?’
‘জিজ্ঞেস করো গিয়ে।’
তনুজার গলার তীব্র ঝাঁজ রুপালিকে নিরস্ত করে।
তনুজা বসে ছিল বিছানার কিনারে। তখন যেভাবে কোনো অস্থিরতা বাড়তে বাড়তে একটা মুহূর্তকে বিদীর্ণ করে নিজেকে মুক্ত করে, ঠিক সেরকম একটা বিদারণ ঘটে এবং তনুজা ঝট করে উঠে পড়ে, দ্রুত পায়ে হেঁটে যায় স্টুডিও পার হয়ে সোজা বসার ঘরে।
কিছু একটা সে বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু উপ-পরিদর্শক ফোনে কথা বলছেন কারও সঙ্গে, হয়তো ফোনের সেই কথা শেষ হয়ে এসেছিল এবং তনুজা শুনতে পাচ্ছিল, উপ-পরিদর্শক কেবল জি জি আর হ্যাঁ হ্যাঁ বলে যাচ্ছেন।
‘তো আমরা উঠতেছি, কিন্তু আবার আসব, যদি আপনের হাসব্যান্ড ওই আপত্তিকর কাজগুলা না থামায় আমাদের আসা লাগবে।’
‘কিন্তু আমি কীভাবে থামাব?’ তনুজার কণ্ঠ বেশ দৃঢ়।
‘থামাইবেন। না হলে আমরা তো আসব এবং সেটা ভালো কিছু হবে না।’
পুলিশ চলে যায়।
তনুজা বারান্দায় গিয়ে কুলগাছটার ডালপালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখে, বাগানের পাশ দিয়ে ফিরে যাচ্ছে পুলিশ। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলে তারা গেটের দিকে দৌড়ায়। কোথা থেকে উড়ে আসে বাতাসের একটা ঝাপটা। তনুজা বারান্দার দক্ষিণ প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ায় এবং খেয়াল করে, মহুয়ার মিষ্টি গন্ধটা নেই। একটা কাঠবিড়ালী জামরুল গাছের এক ডাল থেকে আরেক ডালে দৌড়ে যায় এবং ডিগবাজি খেয়ে আঁকড়ে ধরে মহুয়ার একটা ডাল। দারুণ এই দৃশ্যটা দেখেও তনুজার মনে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। সে বুক ভরে নিশ্বাস নেয়। মহুয়ার গন্ধটা খোঁজে। কিন্তু নেই, গন্ধটা একেবারে উধাও।