গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ: ওয়ালীউল্লাহ্-চর্চা প্রসঙ্গে

মোহাম্মদ আজম
প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৪, ১৮:৫৯

সৈয়দ আবুল মকসুদ ও ওয়ালীউল্লাহ্। ছবি: সংগৃহীত
সৈয়দ আবুল মকসুদের বয়স হয়েছিল প্রায় পঁচাত্তর বছর। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে একে অকাল-মৃত্যু বলা যাবে না; কিন্তু তার মৃত্যু জনগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের জন্য ক্ষতিকর হয়েছে। এক প্রায় অবিরল সৃষ্টিশীলতার বয়সে তিনি গত হয়েছেন। জরুরি-সব বই লিখছিলেন একের পর এক। তার গবেষক-সত্তা আর গদ্য-লেখক-সত্তা একাকার হয়ে ওই বইগুলোকে সামাজিক জ্ঞান-ভাণ্ডারের জন্য অপরিহার্য করে তুলছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে লেখা গ্রন্থমালার কথাই ধরা যাক। যে কোনো সচল সমাজে এ ধরনের কাজ করার মতো বহু মানুষ থাকেন। সামাজিক চাহিদা ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের মিলনবিন্দুতে কুশলী গবেষক কাজগুলো করে থাকেন। আমাদের সমাজে ‘জ্ঞানে’র চাহিদা নগণ্য, প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ বিরল; আর এনজিও এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্টতা বাদ দিলে কলা ও সমাজ-বিজ্ঞানের গবেষক-সম্প্রদায় প্রায় বিলুপ্ত-প্রজাতি। একাডেমির ভিতরে ও বাইরে এরকম দু-চারজন গবেষক হয়তো পাওয়া যাবে, যারা প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনের গরহাজিরার মধ্যেও গবেষণার আবেগ বোধ করেন। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও তাদের আছে। বেশ কিছু এলাকায় সৈয়দ আবুল মকসুদ এ বিরল তালিকার একজন হিসেবে নিজেকে অপরিহার্য করে তুলতে পেরেছিলেন। কাজও করছিলেন প্রচুর। তাই ‘তার মৃত্যু জনগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের জন্য ক্ষতিকর হয়েছে’ কথাটা কোনো আলঙ্কারিক সুভাষণ নয়।
পেশায় তিনি ছিলেন সাংবাদিক। সাংবাদিকের সঙ্গে গবেষকের-যে একটা গভীর যোগ আছে, সে কথা আমাদের দেশে খুব প্রচারিত নাই। সারা দুনিয়ায় বড় সংবাদ-প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ তার গবেষণা-সেল-সে শুধু তথ্যের যথার্থতা রক্ষার তাগিদে নয়, নতুন প্রকল্প গ্রহণ করতে পারার ভিত্তি হিসেবেও; কিন্তু এখানে সাংবাদিকের সঙ্গে গবেষকের যে যোগের কথা বললাম, তা একটু ভিন্ন ঘরানার। মাঝখানে একটা গোয়েন্দা-চরিত্র আনলে কথাটা ভালো বোঝা যাবে। সাংবাদিক ও গবেষক দুজনের মধ্যেই গোয়েন্দা বাস করে-আকারে-প্রকারে তার ধরন যতই আলাদা হোক; কিন্তু এ মিলের মধ্যেও একটা বড় ফারাক আছে। সাংবাদিক তার গোয়েন্দা-স্বভাব এবং গবেষক-স্বভাব মিলিয়ে কাজ করেন মুখ্যত বর্তমানময়তায়। কথাটা মোটেই মূল্যায়নমূলক নয়, বৈশিষ্ট্যমূলক। অন্যদিকে গবেষকের যে কোনো বর্তমানময়তায়ও থাকে বর্তমানকে ছাড়িয়ে যাওয়ার কোশেশ। সৈয়দ আবুল মকসুদ তার গবেষক-সত্তায় সম্ভবত সাংবাদিক-সত্তার আনুকূল্য পেয়েছেন; অথবা বলা যায়, তিনি সে আনুকূল্য তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তার গবেষক-সত্তারই জয় হয়েছে।
কিন্তু এটুকু দিয়েও সৈয়দ আবুল মকসুদের গবেষণার চরিত্র ঠিকঠাক চেনা যাবে না। তার গবেষণায় আরেকটি মাত্রা খুবই সক্রিয় সেটা তার বুদ্ধিজীবী সত্তা। ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটি, বহুদিন হলো, বাংলাদেশে তেমন কিছু আর বোঝায় না। পেশাজীবিতার বিকাশ ঘটে নাই, অর্থাৎ কাঠামোগত নৈর্ব্যক্তিকতায় পরিচালিত হয় না, এমন একটি সমাজে কিন্তু বুদ্ধিজীবীর প্যাশন খুবই জরুরি উপাদান। সৈয়দ আবুল মকসুদের মধ্যে এ বস্তু খুব ছিল। তার প্রস্তুতি ছিল। তিনি জানতেন, এবং জানাতে পছন্দ করতেন। তার এ গুণের প্রকাশ ঘটেছে জনপ্রিয় কলাম-লেখক হিসেবে; কিন্তু তিনি গেছেন আরও কয়েক ধাপ গভীরে। হয়েছেন গবেষক। ভাসানীকে নিয়ে অতি-জরুরি কাজ করেছেন। প্রায় একই রকম গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্কে নিয়ে। আগে-পরে প্রকাশ করেছেন আরও বহু বিষয়ে বহু প্রয়োজনীয় গবেষণা-গ্রন্থ। সব বইয়ে তার বুদ্ধিজীবী-সত্তাটি সক্রিয়ভাবে হাজির। অর্থাৎ শুধু তথ্য-উপাত্তের নৈর্ব্যক্তিকতা দিয়ে তার এসব রচনাকে বোঝা যাবে না। বস্তুনিষ্ঠতা তিনি যথাসম্ভব রক্ষা করেন। আমরা পরে দেখব, প্রাথমিক উৎসের প্রতি তার দুর্মর আকর্ষণ ছিল; কিন্তু গবেষক হিসেবে নৈর্ব্যক্তিকতা তার প্রধান বিশিষ্টতা নয়। বরং যেভাবে তিনি দেশ ও দশকে বুঝতে চাইতেন, যেভাবে বোঝাটা কল্যাণকর ও যথার্থ মনে করতেন, তার জাহেরি-বাতেনি নানা ছাপ পষ্ট থাকত তার গবেষণামূলক রচনায়। এ কারণেই তার গবেষণা থেকে খুব সহজে তাকেও চিনে নেওয়া যায়।
বর্তমান প্রবন্ধে আমরা গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা-গ্রন্থ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র জীবন ও সাহিত্য অবলম্বন করে বইটির বস্তুগুণ এবং তার ব্যক্তিগুণ আংশিকভাবে বুঝতে চাইব।
দুই
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র জীবন ও সাহিত্য বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল দুই খণ্ডে-যথাক্রমে ১৯৮১ ও ১৯৮৩ সালে। ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় এর আমূল পরিবর্তিত অখণ্ড নতুন সংস্করণ। ওয়ালীউল্লাহ্-চর্চায় সৈয়দ আবুল মকসুদের বইটি প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলেছে। ‘দ্বিতীয় খণ্ডের উপক্রমণিকা’য় তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন, প্রথম খণ্ড বের হওয়ার পরই ওয়ালীউল্লাহ্কে ঘিরে বিচিত্র তৎপরতা শুরু হয়। আর ‘বিরাশীই যেন হয়ে ওঠে ‘ওয়ালীউল্লাহ্-বছর”। আগের প্রায় এক দশকের নৈঃশব্দ্যের পর ঢাকার সাহিত্যিক মহল-যে তুলনামূলক সক্রিয়তায় ওয়ালীউল্লাহ্কে জানতে-বুঝতে চেয়েছে, তাতে ১৯৮১ সালের বইটি নিশ্চয়ই প্রভাব ফেলেছে। তার কারণ, ব্যক্তি জীবনে বেশ কতকটা দূরবর্তী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ নানা তথ্য-উপাত্তের সমবায়ে এ গ্রন্থে ভালোভাবেই অবয়ব পেয়েছিলেন। বস্তুত, এ বইয়ের-পুরোনো ও নতুন সংস্করণের-সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক বহু-বিচিত্র তথ্যের নির্ভরযোগ্য সংস্থান।
তথ্য-উপাত্তের প্রতি সৈয়দ আবুল মকসুদের দুর্নিবার আগ্রহ ছিল। অনেকটা পুরনো ধারার ঐতিহাসিকদের মতো। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র জীবন ও সাহিত্য বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করতে তিনি দেড় দশকেরও বেশি সময় নিয়েছেন শুধু নতুন তথ্য যোগ করার আগ্রহ থেকে। নতুন অনেক তথ্য তিনি যোগ করেছেন। আর প্রথম সংস্করণ ও দ্বিতীয় সংস্করণের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য তিনি যেসব উৎসের খোঁজ করেছেন, আর যেভাবে সংগ্রহের কাজটা করেছেন, তাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শুধু তাই নয়। অন্যদের গবেষণায়ও তিনি দেখতে চেয়েছেন ‘নতুন তথ্য’।
কাগুজে তথ্য বা সংখ্যা তো বটেই, এমনকি মত বা মন্তব্যকেও তিনি নির্ভরযোগ্য উৎসের বরাতে ‘তথ্য’ বানিয়ে তুলতেন। অখণ্ড সংস্করণের ‘প্রবেশক’ অংশ থেকে একটা উদাহরণ দেয়া যাক। ওয়ালীউল্লাহ্র রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তিনি বেশ কয়েকবার মন্তব্য করেছেন। একবার লিখেছেন, সেকালের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল কংগ্রেস বা মুসলিম লিগের সাথে ওয়ালীউল্লাহ্র কোনো সাংগঠনিক সংযোগ ছিল না। সম্পর্ক ছিল না কোনো কম্যুনিস্ট রাজনীতির সঙ্গেও; কিন্তু ‘সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে তিনি সকল সময়ই সংহতি প্রকাশ করেছেন প্রকাশ্যে অথবা গোপনে।’ এ কথার সমর্থনে তিনি কবি ও বাম-কর্মী গোলাম কুদ্দুসের সাথে ওয়ালীউল্লাহ্র এক ঘটনার উল্লেখ করেছেন। দেখিয়েছেন, বামপন্থিদের প্রতি ওয়ালীউল্লাহ্র সহমর্মিতা ছিল। তথ্যটি তিনি পেয়েছেন খোদ গোলাম কুদ্দুসের কাছ থেকে। ১৩ মার্চ ২০০০ তারিখে কলকাতার আহিরিপুকুর লেনের বাসায় গোলাম কুদ্দুস লেখককে এসব তথ্য জানান। দেখা যাচ্ছে, গোলাম কুদ্দুসের সাথে সংশ্লিষ্ট ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তিনি তার কাছেই গিয়েছেন। বেশিরভাগ তথ্যের ক্ষেত্রেই তিনি এরকম করার চেষ্টা করেছেন। যদি সম্ভব না হয়, একাধিক উৎস থেকে তথ্য নিয়ে তথ্যের ‘সত্যতা’ নিশ্চিত করতে চেয়েছেন।
তথ্যের প্রতি এবং প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহের প্রতি তার অপরিসীম মনোযোগ বোঝা যাবে আরেকটি দৃষ্টান্ত থেকে। ১৯৩৯ সালে ঢাকা কলেজ বার্ষিকীতে ওয়ালীউল্লাহ্র একটি লেখা ছাপা হয়েছে-এটা তিনি জানতেন; কিন্তু দশ বছর চেষ্টা করেও তিনি সংকলনটি জোগাড় করতে পারেননি। শেষে এক প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ‘অনেকটা অলৌকিকভাবে’ তিনি এটি খুঁজে পান, আর ‘এক পুরাতাত্ত্বিকের কোনো হারিয়ে-যাওয়া নগরীর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের আনন্দ লাভ’ করেন। এ নিষ্ঠা এবং ‘আনন্দ লাভে’র ব্যাপার না-থাকলে কারো পক্ষে প্রাতিষ্ঠানিক আওতার বাইরে এরকম সফল গবেষক হওয়া অসম্ভব।
পেশাগত কারণে তিনি বহুবার বিদেশে গেছেন। সুযোগটা কাজে লাগিয়েছেন গবেষণায়। ওয়ালীউল্লাহ্-গবেষণায় এ সুবিধা ও প্রবণতা তাকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে, অন্য গবেষকদের পক্ষে যেখানে পৌঁছানো খুব দুরূহ হতো। বইটির প্রথম সংস্করণের (ডিসেম্বর, ১৯৮১) ভূমিকা থেকে একাংশ পড়া যাক :
ইতোমধ্যে ওয়ালীউল্লাহ্র দু-তিনটি বাদে সবগুলো কর্মস্থল যেমন নয়াদিল্লি, বন, লন্ডন, প্যারিস এবং কলকাতা সফর করার সুযোগ হয় আমার। সে-সব জায়গায় নানা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁর জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করি।... আমি প্যারিসে ইউনেস্কো অফিস এবং লন্ডনে তাঁর প্রকাশক ‘চ্যাটো অ্যান্ড উইন্ডাস’-এর সঙ্গেও যোগাযোগ করি।
এ তালিকা কেবল বিচরণের বিস্তার সম্পর্কে ধারণা দেয় না, জীবনী-গবেষকের দৃষ্টির প্রসারতাও নির্দেশ করে।
কিন্তু তার এ দীর্ঘমেয়াদি অখণ্ড মনোযোগ এবং নিষ্ঠার উৎস কী? বাংলাদেশের গবেষণা-জগতের হাল-হকিকত সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে, তারা এ প্রশ্নের মাজেজা বুঝতে পারবেন।
বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছেন, ‘বাংলা একাডেমী প্রকাশিত সৈয়দ আকরম হোসেন সম্পাদিত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ রচনাবলি-র অন্তর্ভুক্ত নয় এমন কিছু গল্পের সন্ধান আমি পেয়েছি।’ বিচিত্র-জনের বরাতে এরকম অনেকগুলো লেখার সংবাদ তিনি দিয়েছেন। একজন লেখককে দীর্ঘ অধ্যবসায়, ধৈর্য, পরিশ্রম আর কৌতূহলের আভায় পূর্ণরূপে আবিষ্কারের এ আগ্রহ বাংলাদেশে অতি বিরল। উন্নত দুনিয়ায় বড় লেখকদের সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হয়ে-ওঠার একটা তাৎপর্যপূর্ণ অর্থনীতি আছে। সামাজিক সুনাম ও প্রতিপত্তির মধ্য দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি এবং সম্মানজনক কেরিয়ারে উন্নীত হওয়া-এরকম ব্যাপার সেখানে হামেশাই ঘটে। কলকাতায় এরকম সংস্কৃতির বিকাশ এক-আধটু ঘটেছিল; কিন্তু ঢাকায় এ বস্তু প্রায় অনুপস্থিত। রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ হিসেবে দুই বাংলায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন, এমন উদাহরণ বাংলাদেশে দুর্লভ। তবু বেশ কয়েকজন পাওয়া যাবে, যারা রবীন্দ্রনাথে জীবনভর লিপ্ত ছিলেন, বা আছেন। নজরুলের ক্ষেত্রেও নিবেদিত-প্রাণ একাধিক বিশেষজ্ঞ আছেন। এ দুজনের সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা আছে। ওয়ালীউল্লাহ্র ক্ষেত্রে এ কথা বলা যাবে না। এখন যতটা হয়েছে, সেই ১৯৮০-র দশকে তার কানাকড়িও ছিল না।
আরো কয়েকটি তথ্য মনে করা যাক। আবদুল মান্নান সৈয়দ এরকম তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে এবং পরিবেশন করতে পছন্দ করতেন। একজন লেখক-বিষয়ে নিবিষ্টতার ক্ষেত্রে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র জীবন ও সাহিত্য বইয়ের সঙ্গে তুলনীয় উদাহরণ মান্নান সৈয়দের আছে। যেমন তিনি ফররুখ আহমদকে নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। দুজনের কাজের মধ্যে প্রধান পার্থক্য, আবদুল মান্নান সৈয়দের গবেষণায় জীবনী খুব কম অংশ দখল করে, যেখানে সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখায় জীবনীর ভাগই প্রধান। আমাদের জন্য এখানে জরুরি কথা হলো, আবদুল মান্নান সৈয়দ একজন সাহিত্যিক-অধ্যাপক-গবেষক। ফলে তার নিবিষ্টতার পেশাগত ও সাহিত্যসেবীর আবেগগত পটভূমি আছে। সৈয়দ আবুল মকসুদের ক্ষেত্রে তা নাই। তাহলে তিনি অন্তরের তাগিদটা এত দীর্ঘ সময় ধরে কীভাবে রক্ষা করলেন?
কথাটা আরো বাড়ানো যাক। ভাসানীকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। এর সাথে তার রাজনৈতিক পক্ষপাত যুক্ত থাকা বিচিত্র নয়। তার চেয়ে বড় কথা, মওলানা ভাসানীর অনুসারী আছে, এবং সমাজে তার জীবনকথা শুনতে-পাওয়ার চাহিদা আছে। সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও ফররুখের ক্ষেত্রেও কথাটা ভিন্ন অর্থে সত্য। কিন্তু ওয়ালীউল্লাহ্র বেলায় এ হিসাবগুলোর একটাও প্রযোজ্য নয়। ‘আধুনিকতাবাদী’ সাহিত্যের প্রচার-প্রসার চান, এমন একটা দল হয়তো আছে। কিন্তু তারা সংখ্যায় অতি অল্প। আর সৈয়দ আবুল মকসুদ নিজেও সে দলের নন, এবং তার ওয়ালীউল্লাহ্ তথা সার্বিক সাহিত্য-পাঠ মোটেই ‘আধুনিকতাবাদী’ নয়। তাহলে তার এরকম নিষ্ঠাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? গবেষকের মেজাজ, বড় মানুষের পটভূমি আবিষ্কারের কৌতূহল, দেশ ও মানুষের বিশেষ ধরনের কল্যাণ-আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি দিয়ে হয়তো একটা প্রাথমিক ব্যাখ্যা চলতে পারে। কিন্তু এগুলোর পেছনে নিশ্চিতভাবেই কাজ করেছে একজন ‘বড়’ মানুষের সুরত খাড়া করার প্রেরণা, যা সমাজে অন্য মানুষদের বড় হতে উৎসাহ জোগাবে। একে বলতে পারি ক্ল্যাসিকেল লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গি। সৈয়দ আবুল মকসুদ মোটা-দাগে এ দৃষ্টিভঙ্গির মানুষব্যক্তিগত স্বভাবে, বুদ্ধিজীবিতায়, এবং গবেষণায়ও।
তিন
যাকে খুব পরিষ্কারভাবে সাহিত্য-সমালোচনা বলা চলে, এ বইয়ে তার পরিসর খানিকটা সংকীর্ণ। এতে ওয়ালীউল্লাহ্র সমগ্র রচনার ওপর মন্তব্য আছে, আর তা নানা দিক থেকে মূল্যবানও বটে। কিন্তু এমনকি সাহিত্য-আলোচনায়ও সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্তের দিকে নিবিষ্টতা লক্ষ করা যায় প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই, যেসব উপকরণ একটি বিশুদ্ধ জীবনীগ্রন্থেও থাকতে পারত। ধরা যাক, কোনো রচনার পুনর্লিখন-সংক্রান্ত তথ্য, কিংবা অনুবাদ ও প্রকাশনা বিষয়ক খবরাদি। এগুলো সাহিত্য-পাঠে খুব কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হতে পারে, এবং সৈয়দ আবুল মকসুদ চল্লিশ বছর আগের সংস্করণে যেসব খবর দিয়েছিলেন, তা ইতিমধ্যেই বহু পাঠে কাজে এসেছে। কিন্তু তিনি নিজে ওই তথ্য-উপাত্তের ব্যবহার ঠিক সাহিত্য-পাঠের জন্য করেন নাই। বরং সাহিত্যকর্ম-বিষয়ক তথ্য হিসেবে সেগুলো বিবৃত করেছেন। বিস্ময়কর নয়, এ বইয়ের ‘অগ্রন্থিত গল্পে’র আলোচনা-অংশটি-এ সম্পর্কে পরে বেশ কিছু আলোচনা হওয়া সত্ত্বেও-বিশেষভাবে মূল্যবান। কারণ এ অংশে ‘সাহিত্য-পাঠে’র তুলনায় সাহিত্যিক জীবনের পটভূমিটাই প্রধান আলোচ্য। অবশ্য, মনে রাখা দরকার, ওয়ালীউল্লাহ্র অগ্রন্থিত গল্পের মধ্যে ‘না কান্দে বুবু’র মতো মাস্টারপিচ আছে; এবং সৈয়দ আবুল মকসুদ এ গল্প সম্পর্কে উপকারী আলোচনা করেছেন।
এ বইয়ের গল্প-উপন্যাস-নাটক আলোচনায় এমনসব তথ্য-উপাত্ত আছে, যেগুলো জীবনী-অংশে থাকাই সঙ্গত হতো। জীবনী ও সাহিত্যের মধ্যে ফারাক রাখা বোধ হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে নাই। আরো ভালো হয় বললে, লেখক সেরকম চানও নাই। ওয়ালীউল্লাহ্র সাহিত্যকর্মের অনুবাদ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা সাহিত্য-পাঠ হয়েও মুখ্যত জীবনী-পাঠেরই অংশ। লালাসালুর ইংরেজি অনুবাদের সাথে তুলনামূলক আলোচনা, এবং ইংরেজি ভার্সনের বাড়তি অংশের বাংলা তরজমা করে সৈয়দ আবুল মকসুদ একটি জরুরি কাজ করেছেন। তার এ মন্তব্যও বোধ হয় তাৎপর্যপূর্ণ, “অনুবাদের এই সম্প্রসারণে লালসালু একটি সরল ‘অস্তিত্ববাদী উপন্যাস’-এর রূপ নিয়েছে, বলা যেতে পারে।” উল্লেখ্য, লালসালুর অনুবাদ এবং বিদেশে তার পাঠ-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সৈয়দ আবুল মকসুদ যে-দীর্ঘ আলোচনা করেছেন, তা সম্ভবত আর কারো পক্ষেই করা সম্ভব ছিল না। কারণ, এত বিপুল তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পরিস্থিতিই আর কেউ তৈরি করতে পারেন নাই; কিন্তু পুরো অংশটিকে ‘সাহিত্য-সমালোচনা’ করে-তোলার চেষ্টা খুব দেখা যায় না।
ওয়ালীউল্লাহ্র সাহিত্যকর্ম বিশ্লেষণে সৈয়দ আবুল মকসুদ অন্তদৃষ্টি-সম্পন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও মন্তব্য যথেষ্ট করেছেন। চাঁদের অমাবস্যার চরিত্রগুলো সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, তারা সকলে ‘সমাজবিশেষের সদস্য যে-সমাজ বাঙালি মুসলমানসমাজ : স্তব্ধ ও অনগ্রসর।’ সমালোচক আসলে এ অনগ্রসর সমাজের পটে অগ্রসর ওয়ালীউল্লাহ্কে একজন আদর্শ হিসেবে আঁকতে চেয়েছেন। তবে বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক পটভূমিতে ওয়ালীউল্লাহ্কে স্থাপন করার চেষ্টা তাঁর আলোচনার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। চাঁদের অমাবস্যা সম্পর্কে তার উচ্চাভিলাষী মন্তব্যে ওই মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে, ‘সর্বাধুনিক বাংলা উপন্যাসের সূচনা চাঁদের অমাবস্যা থেকে সে-সম্পর্কে এখন আর কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। যেমন এ বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই যে দুর্গেশনন্দিনী থেকে আধুনিক বাংলা উপন্যাসের শুরু।’ পরে কাঁদো নদী কাঁদো সম্পর্কে লিখেছেন, ‘চেতনাপ্রবাহরীতিতে রচিত এটি বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস। এখন পর্যন্ত অদ্বিতীয়।’ সাহিত্য-পাঠে আরেকটি দিক তিনি বরাবরই মনে রেখেছেন। বাঙালি মুসলমানের খুব গভীর ও অন্তর্ভেদী চিত্রায়ণ হিসেবে ওয়ালীউল্লাহ্-রচনাবলিকে পড়তে-চাওয়া তার কাণ্ডজ্ঞানেরই পরিচায়ক। যেমন কাঁদো নদী কাঁদো সম্পর্কে তার মন্তব্য : এ উপন্যাস ‘তো বাংলাদেশের-বাঙালি মুসলমানের অন্তর্লোকেরই শিল্পিত বিবরণ।’
সাহিত্য-পাঠের ক্ষেত্রে সৈয়দ আবুল মকসুদের বাস্তববাদী ঝোঁক অতি স্পষ্ট। ওয়ালীউল্লাহ্র ছবি-আঁকার ঝোঁকের কথা বিশেষভাবে মনে রেখেছিলেন বলেই হয়তো, তিনি তার লেখায় ফুটে-ওঠা তীক্ষ্ণ-সব স্কেচের কথা বারবার উল্লেখ করেছেন। তাতে বাস্তবের নির্ভরযোগ্য প্রকাশ হিসেবে ওয়ালীউল্লাহ্র সাহিত্যকর্মের প্রতিষ্ঠা আরো জোরালো হয়েছে। দুই তীর বইয়ের আলোচনায় প্রথম গ্রন্থ নয়নচারার সাপেক্ষে তার মনে হয়েছে, ‘ধীরে ধীরে ওয়ালীউল্লাহ্ বহির্জীবনের চেয়ে অন্তর্জীবনের দিকে ঝুঁকেছিলেন।’ এ সিদ্ধান্ত সমালোচককে নিতে হয়েছে, কারণ তিনি ‘বিষয়ে’র ভিত্তিতে আলোচনা করেছেন; কিন্তু খোদ ‘নয়নচারা’ গল্পই সাক্ষ্য দেয়, এবং অন্য বহু গল্পকারের দুর্ভিক্ষ-বিষয়ক গল্পের উল্লেখ করে সৈয়দ আবুল মকসুদ নিজেই দেখিয়েছেন, ওয়ালীউল্লাহ্ দুর্ভিক্ষের মতো ‘বাস্তব’ বিষয়কে অবলম্বন করেও চলে যেতেন, যেতে পারতেন, অন্য জগতে, যেখানে ওই বিষয় তার বাস্তব পটভূমি রক্ষা করেও সম্পূর্ণ অন্য রূপ ধারণ করত। সেদিক থেকে বরং বলা যেত, প্রথম দিকের ওয়ালীউল্লাহ্ মনস্তত্ত্ব বা মনঃসমীক্ষণকে খুব একটা গল্পের ‘বিষয়’ করেন নাই, যেমন করেছেন দ্বিতীয় বইতে। বিষয়ের এ ফারাক লক্ষ করলেই বোঝা যাবে, আদতে ওয়ালীউল্লাহ্ বরাবরই, এমনকি উপন্যাসে-নাটকেও, মুখ্যত অন্তর্জীবনের শিল্পীল-অন্তর্জীবন ‘মূল বিষয়’ হোক বা না হোক। সৈয়দ আবুল মকসুদের আলোচনায় কথাটা তথ্য হিসেবে উল্লেখিত হলেও পাঠ-পদ্ধতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
‘দ্বিতীয় খণ্ডের উপক্রমণিকা’য় তিনি লিখেছেন, ‘যে-কোনো ব্যক্তির জীবনবেদ তৈরি হয় তাঁর ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও শিক্ষাদীক্ষার প্রকৃতি ও পরিমাণের পরিপ্রেক্ষিতে।’ তিনি শোপেনহাওয়ার, নিৎশে, কাফকা প্রমুখের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, জীবন-বাস্তবতার মধ্যেই এদের প্রধান প্রবণতাগুলোর উৎস খুঁজে পাওয়া যায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ওয়ালীউল্লাহ্র ‘দুঃখবাদী ও অস্তিত্ববাদী’ মানসতার তত্ত্বতালাশ করতে চেয়েছেন।
অন্যদিকে নিজের জীবনদৃষ্টি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, মার্কসবাদী না-হলেও মার্কসের সমাজতান্ত্রিক ও আর্থসামাজিক দর্শন দ্বারা তিনি বিপুলভাবে প্রভাবিত। সেদিক থেকে অন্য অনেকের মতো তিনিও বিশ্বাস করেন, শিল্প-সাহিত্যের একটি সামাজিক ভিত্তি না থেকে পারে না। ওয়ালীউল্লাহ্ নিজে মার্কসবাদী না-হলেও, সৈয়দ আবুল মকসুদ পশ্চিমা বহু লেখকের উদাহরণ দিয়ে বলছেন, ওই বুর্জোয়া লেখকদের যেভাবে মার্কসবাদী কায়দায় পড়া হয়েছে, তিনিও ওয়ালীউল্লাহ্র ক্ষেত্রে তা-ই করতে চেয়েছেন। তিনি ‘বাম ও প্রগতিশীল বলয়ে তার অবস্থান চিহ্নিত করার প্রয়াস’ পেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তার একটি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শনাক্তির উল্লেখ না করে পারা যায় না : ‘এ যাবৎ ওয়ালীউল্লাহ্র রচনাবলির আলোচকগণ তার ওপর শুধুমাত্র অস্তিত্ববাদী শিল্পীর শীলমোহর এঁকে লেখক হিশেবে তাঁর অসামান্য প্রগতিশীল ভূমিকাকে উপেক্ষা করে গেছেন।’ এ মন্তব্যে একটা অনাবশ্যক বাইনারি আছে। পড়লে মনে হয়, অস্তিত্ববাদ ও প্রগতিশীলতা পরস্পর-বিরোধী উপাদান। তবে ওয়ালীউল্লাহ্-পাঠ সম্পর্কে তিনি যে-মন্তব্য করেছেন, তা যথার্থ। সার্ত্রীয় অস্তিত্ববাদের একাংশকে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করে ওয়ালীউল্লাহ্র সাহিত্যকর্মের প্রায় সবটা বিশ্লেষণের কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সৈয়দ আকরম হোসেন। জুতসই তত্ত্বায়ন ও পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্তের সমন্বয়ে তিনি তার প্রস্তাবকে নান্দনিকভাবে বৈধ করতে পেরেছেন। ওয়ালীউল্লাহ্র সাহিত্য-পাঠের সামগ্রিক আবহে এটা সম্ভবত সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পর্ব। কিন্তু তার অনুকারীরা বিপুল সংখ্যায় ওই কাঠামো হুবহু ব্যবহার করে শুধু পুনরাবৃত্তির সংকট তৈরি করেন নাই, অন্য বিপুল পাঠ-সম্ভাবনারও ক্ষতি করেছেন। সৈয়দ আবুল মকসুদের পূর্বোক্ত বাক্য সে ইতিহাসকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।
তিনি অবশ্য আরো যোগ করতে পারতেন, লালসালুসহ ওয়ালীউল্লাহ্র অনেক গুরুত্বপূর্ণ রচনাকে ‘বাস্তববাদী’ দৃষ্টিভঙ্গিতে পাঠ করার রেওয়াজ সামাজিক ভাষার মতো সাহিত্য-সমালোচনায়ও রীতিমতো আসর গেড়ে বসেছে। ফলে রচনাগুলোর প্রতীকী-রূপকী তাৎপর্য খুব সামান্যই বিশ্লেষিত হয়েছে। ‘ধর্ম’-যে ওয়ালীউল্লাহ্র রচনায় মতাদর্শিক প্রতিপক্ষ, এবং এর জন্য পাকিস্তান রাষ্ট্র বা ধর্মীয় ‘কুসংস্কার’ মোটেই জরুরি উপাদান নয়, সে কথা একেবারেই প্রচারিত হয় নাই। এ ধরনের কোনো বাস্তবতা ছাড়াই পশ্চিমে ওয়ালীউল্লাহ্র ঘরানার লেখকদের লেখায় ধর্ম প্রতিপক্ষ হিসেবে চিত্রিত-চিহ্নিত হয়েছে; পরিমাণের ও মাত্রার হেরফের হয়েছে বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতের কারণেই। তাছাড়া ওয়ালীউল্লাহ্র প্রজন্মের এবং পরের প্রজন্মের এমন লেখক বস্তুত একজনও পাওয়া যাবে না, যারা ধর্মীয় কুসংস্কারের বিপরীতে আলো জ্বালানোর প্রকল্প নিয়ে কাজ করেন নাই। কাজেই এ ক্যাটাগরিতে ওয়ালীউল্লাহ্কে বিশেষত্ব দেওয়ার চেষ্টা করা বিপুল পরিপ্রেক্ষিতকে অস্বীকার করার শামিল।
নিঃসন্দেহে এ সবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও তৎকালীন পূর্ব বাংলার গভীর-ব্যাপক বাস্তবতার বহুমাত্রিক প্রকাশ হিসাবে ওয়ালীউল্লাহ্-রচনাবলির পাঠ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র অগ্রন্থিত রচনার ভূমিকায় সাজ্জাদ শরিফ (২০১৩) প্রসঙ্গটি তুলেছেন। যেমন তুলেছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ; কিন্তু সাজ্জাদ শরিফ এ বিষয়ে কথা বাড়ান নাই। আর আবুল মকসুদ বিস্তারিত প্রস্তাবনা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত থেকে গেছেন ‘অস্তিত্ববাদী’ ও ‘ধর্মীয় কুসংস্কারবাদী’ পাঠের পরিসরে। সচেতনভাবে তিনি হয়তো তা চান নাই; কিন্তু সময়ের প্রভাবশালী ডিসকোর্সের অচেতন প্রতাপ তাকে ওই বলয়েই রেখে দিয়েছে। অবশ্য ঢাকার বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও পাকিস্তান-পাঠের যে- প্রভাবশালী ডিসকোর্স তিনি তার এ গ্রন্থে প্রায় হুবহু অনুসরণ করেছেন, তাতে অন্য পাঠ খুব একটা সম্ভবও ছিল না। তবে বলা দরকার, বিচার-বিশ্লেষণে প্রবল হয়ে না-উঠলেও বহুবার উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে এবং কখনো কখনো বিস্তারিত মন্তব্যের ভিতর দিয়ে পূর্ব-বাংলার গভীরতর অধ্যয়নের খুব কার্যকর উপাদান হিসেবে তিনি ওয়ালীউল্লাহ্-রচনাবলিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। সম্ভবত আগামী দিনগুলোতে এ পাঠ হবে ওয়ালীউল্লাহ্-পাঠের সবচেয়ে কার্যকর এলাকা।
চার
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র জীবনী-পুনর্গঠন সৈয়দ আবুল মকসুদের এক অক্ষয় কীর্তি। জন্ম ও কর্মসূত্রে ওয়ালীউল্লাহ্ বাংলাদেশের সাহিত্যিক অঙ্গন থেকে বেশ দূরবর্তী ছিলেন। কম বয়সে মৃত্যুর কারণে নিজের জীবন সম্পর্কে তিনি কিছু লিখে যেতে পারেননি। আবার স্ত্রী বিদেশি হওয়ায়, আর সন্তানরা ফরাসি হিসেবে বড় হওয়ায়, পরিবার-সূত্রে খোঁজ-খবর করাও বেশ দুষ্কর ছিল। এ পরিস্থিতিতে যে ধরনের তৎপরতা ও লিপ্ততার মধ্য দিয়ে গেলে জীবন-তথ্য ও প্রবণতার গভীরে পৌঁছানো যেতে পারত, আবুল মকসুদ ঠিক সে পথেই গেছেন। স্ত্রীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। নথি ও চিঠিপত্র ব্যবহার করেছেন। বন্ধু-বান্ধবের লেখাপত্র খুঁজে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা বের করেছেন।
জীবনী-প্রণয়নে সৈয়দ আবুল মকসুদ দুটি প্রাথমিক সূত্র সর্বত্র রক্ষা করতে চেয়েছেন বলেই মনে হয়। প্রথমত, তিনি ঢাকার প্রভাবশালী বাঙালি জাতীয়তাবাদী কাঠামোর মধ্যে ওয়ালীউল্লাহ্কে ফেলতে চেয়েছেন; দ্বিতীয়ত তাকে আলঙ্কারিক অর্থে হলেও মার্কসবাদী বা অন্তত বামঘেঁষা হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। আমাদের বিবেচনায় দুটোই ওয়ালীউল্লাহ্র ক্ষেত্রে কম-প্রযোজ্য বর্গ। কিন্তু এরকম বর্গের ভিত্তিতেও পাঠ সম্ভব, যদি তাতে আরোপণমূলকতার প্রতাপ না ঘটে। মুশকিল হলো, সৈয়দ আবুল মকসুদ টেক্সটের পর্যাপ্ত বরাত ছাড়া কেবল জীবন-তথ্যের বাহ্য-বরাতের ভিত্তিতে কাজটা করতে চেয়েছেন, বা তাকে করতে হয়েছে।
ওয়ালীউল্লাহ্ সমাজতন্ত্র ও সমধর্মী তৎপরতার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন, এটা দেখানোর একটা বাসনা বইয়ে পাওয়া যায়। রাশিয়া ও চীনকে তৃতীয় দুনিয়ার মুক্তি-সহযোগী হিসেবে তিনি ভাবতেন; ফিদেল ক্যাস্ট্রো এবং চে গুয়েভারার সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন, বিশেষত চে গুয়েভারার সাথে হাত-মেলানোর সময় বিশেষ পুলক অনুভব করেছিলেন-অ্যান-মারির বরাত দিয়ে আবুল মকসুদ খুব আগ্রহের সাথে এ ধরনের তথ্য উল্লেখ করেছেন।
বইয়ের ‘বাম বলয়ের বাসিন্দা’ পরিচ্ছেদটির মধ্যে একটু সারল্য আছে। ‘বাম’, ‘মার্কসবাদী’, ‘প্রগতিশীল’ ইত্যাদি শব্দের খুব আলগা ধরনের ব্যবহার এখানে আছে। বস্তুত ওয়ালীউল্লাহ্র লেখা থেকে প্রায় একটি উদাহরণও না-দিয়ে তিনি এ বাবদ সমস্ত দৃষ্টান্ত নিয়েছেন তার বন্ধু-বান্ধবের সাক্ষ্য থেকে। লেখক সার্ত্রের উদাহরণ থেকে অনুমান করেছেন, ওয়ালীউল্লাহ্ হয়তো সার্ত্রের মতোই মার্কসবাদ ও অস্তিত্ববাদকে মেলাতে চেয়েছেন; কিন্তু এমন একটা গুরুতর বিবৃতির পক্ষে তিনি তার সাহিত্যকর্ম থেকে একটি উদাহরণও দেন নাই। তার বন্ধুরা বামপন্থি বা প্রগতিশীল-এ কথারও বিশেষ কোনো অর্থ হয় না। কারণ চল্লিশের দশকে এমন লেখক খুব কমই পাওয়া যাবে, যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব এ দুই বর্গে পড়বে না।
সমস্যাটা জোরদার হয়েছে যখন তিনি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র সঙ্গে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ কোনো লেখকের সম্পর্ক ছিল না বলে রায় দিয়েছেন। এখানে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলতে তিনি বুঝিয়েছেন ওই লেখকদের, যারা কোনো-না-কোনোভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি অনুকূল মনোভাব পোষণ করতেন, যিনি নিজেই ইউনেস্কোতে ‘সর্বোচ্চ বেতনপ্রাপ্ত পাকিস্তানি অফিসার’ ছিলেন, তার চিহ্নায়নে এ ধরনের ভাষা-ব্যবহার খুব মুশকিলের। সংকটের গভীরতা বোঝা যায় যখন তিনি ওয়ালীউল্লাহ্র প্রতিক্রিয়াশীলতা-বিরোধী অবস্থানের নমুনা হিসেবে লালসালু উপন্যাস এবং ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ গল্পের উল্লেখ করেন। লালসালুর মজিদকে পাকিস্তান-সমর্থক হিসেবে পাঠ করা, বিশেষত ১৯৪৫-৪৮ সালের একটি রচনাকে, খুবই হাস্যকর পাঠ; কারণ তখন একজন ‘মার্কসবাদী’ বা ‘প্রগতিশীল’ লেখকও ঢাকায় ছিলেন না, যিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের ‘মুক্তি’-প্রকল্পে আস্থাবান হন নাই। ওয়ালীউল্লাহ্ নিজেই ঘোরতর পাকিস্তান-সমর্থক এবং জিন্নাভক্ত মানুষ। আর ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ গল্পের বামপন্থি তরুণটি বরং সময়ের প্রচণ্ড অভিঘাতে বেশ কতকটা দোদুল্যমানতায় পড়ে গিয়েছিল।
ওয়ালীউল্লাহ্র আদর্শিক এ ম্যাপিংয়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ ১৯৮০-র দশকের ঢাকার প্রতাপশালী ভাষা-কাঠামোর আওতায় ঢুকে পড়েছিলেন। বামপন্থি বা মার্কসবাদী প্যাশন বা ফ্যাশন যেমন এ বিবরণীতে প্রবল, ঠিক তেমনি ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্রের ভয়াবহ অভিজ্ঞতাকে নানান কায়দায় পুনর্নির্মাণের যে-যজ্ঞ তখন চলছিল, ওয়ালীউল্লাহ্-পাঠে সৈয়দ আবুল মকসুদ তার বাইরে যেতে পারেন নাই। স্পষ্টতই বাংলাদেশে দীর্ঘ-সময় ধরে অত্যন্ত প্রভাবশালী ‘প্রগতিশীল’ বর্গের সাথে ওয়ালীউল্লাহ্কে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলার আগ্রহ থেকেই জীবনীকারের এ প্রয়াস। ওয়ালীউল্লাহ্কে ‘খাঁটি’ বাঙালি বা এমনকি বাঙালি জাতীয়তাবাদী হিসেবে দেখানোর অবিরাম চেষ্টাও প্রায় সমধর্মী দৃষ্টিভঙ্গির ফসল।
‘রাজনীতি সচেতনতা’ অংশে সৈয়দ আবুল মকসুদ ওয়ালীউল্লাহ্কে পাকিস্তান-আন্দোলন ও মুসলমানের স্বাতন্ত্র্যবাদী রাজনীতি থেকে যথাসম্ভব বাঁচাতে চেয়েছেন। সাতচল্লিশ-পূর্ব স্বাধীন-বাংলার আন্দোলনের প্রতি তার ও সমধর্মী লেখকদের সমর্থনের কথা বলেছেন। কিন্তু ঋষীকেশ লাহিড়ীকে লেখা, এখন বেশ বিখ্যাত, যে-চিঠির একাংশ তিনি উল্লেখ করেছেন, তাতে পরিষ্কার বোঝা যায়, ওয়ালীউল্লাহ্ শুধু জিন্নাভক্ত ছিলেন না, পাকিস্তান-আন্দোলনের ব্যাপারে প্রচলিত সমস্ত যুক্তিকেই তিনি ঠিক মনে করতেন। তার এ বিশ্বাস গভীর না-হলে জিন্নাকে ‘এ যাবৎ পৃথিবীর মহত্তম ব্যক্তিদের একজন’ বলার কোনো কারণ থাকতে পারে না। তাছাড়া অগ্রন্থিত গল্পগুলোর জাহেরি-বাতেনি দৃষ্টিভঙ্গিও ওয়ালীউল্লাহ্র সমধর্মী দৃষ্টিভঙ্গির প্রবলতা প্রতিষ্ঠা করে। আবুল মকসুদ নিজেই মোটামুটি দীর্ঘ পরিচ্ছেদে গল্পগুলোর বিশ্লেষণ করেছেন, এবং নিজ কম্যুনিটি হিসেবে মুসলমান-সমাজের জন্য ওয়ালীউল্লাহ্র যে-প্রবল আকুতি ওই গল্পগুলোতে প্রকাশ হয়েছে, তা খুলে দেখিয়েছেন। তা সত্ত্বেও ওয়ালীউল্লাহ্কে মুসলিম লিগ বা মুসলমান নেতৃবৃন্দের বিরোধী হিসেবে বর্ণনা করার লোভ আবুল মকসুদ সামলাতে পারেন নাই, আর এ কাজে তিনি যে-ভাষা ব্যবহার করেছেন, তা বাংলাদেশের প্রচলিত প্রভাবশালী ভাষাই বটে।
পুরো বইতেই ওয়ালীউল্লাহ্র পাকিস্তান-সংস্রব, এমনকি মুসলমানি-সংস্রব নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ভুগেছেন তিনি। বিয়েতে অ্যান-মারি মুসলমান নাম নিয়েছেন, এ তথ্যের উল্লেখ করে বাড়তি রকমের কৈফিয়ত দিয়েছেন। ওয়ালীউল্লাহ্ করাচিতে বদলি হয়ে বন্ধু নাজমুল করিমকে লিখেছিলেন, ভালোই আছি। বোধ হয়, ‘আমার পূর্বপুরুষরা আরব অঞ্চল থেকে এসেছে বলে’ নৈকট্যজনিত কারণে খারাপ লাগছে না। মকসুদ সাহেব এ বিবৃতির জন্যও কৈফিয়ত দেবার দরকার বোধ করেছেন। এরকম উদাহরণ দেখি ‘করাচি লেখক সম্মেলন ’৫৯’-এর বর্ণনায়ও। ওয়ালীউল্লাহ্ এ সম্মেলনে বিশেষ তৎপর ছিলেন না, সরকারি চাকরির কারণে একেবারে যোগ না-দিয়ে পারেননি-এরকম একটা ভঙ্গিতে তিনি পুরো বর্ণনা দিয়েছেন। অথচ অন্য সব বাংলাদেশি লেখক-যে ভীষণ আগ্রহের সাথে দুই মাস পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণ করে বেড়িয়েছেন সরকারি টাকায়, তারও উল্লেখ করেছেন। এ দ্বারা কী বোঝায়? ওয়ালীউল্লাহ্ কি তখনি বেশ ‘পাকিস্তান-বিদ্বেষী’ হয়ে উঠেছিলেন, যেখানে পূর্ব বাংলার গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিকদের প্রায় সবাই ছিলেন যথেষ্ট ‘পাকিস্তানবাদী’?
বাংলা টাইপরাইটার সম্পর্কে ওয়ালীউল্লাহ্র আগ্রহের হদিস দিয়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ জরুরি দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে একে তিনি মিলিয়েছেন বাংলা ভাষাপ্রেমের সঙ্গে, যা হামেশাই ষাটের দশকের বাঙালি জাতীয়তাবাদী বয়ানের সাথে একাত্ম হয়ে বেশ আরোপণমূলক হয়ে উঠেছে। ওয়ালীউল্লাহ্ ব্যক্তিগত চিঠিপত্রও ইংরেজিতে লিখতেন। এমতাবস্থায় বাংলা ভাষা ও তার উন্নতি-সংক্রান্ত যে কোনো উল্লেখকে জাতীয়তাবাদী অবস্থান থেকে দেখা বেশ মুশকিলের কথাই বটে। অন্যত্র তিনি লিখেছেন, ওয়ালীউল্লাহ্ এমনকি পাকিস্তানিদের সঙ্গেও উর্দুতে বাতচিত করতেন না, যদিও তিনি উর্দু ভালোই জানতেন। এ কথা বলার বা এ ‘তথ্যে’ জোরারোপের কারণ খুব পরিষ্কার। কিন্তু কথাটা বলার জন্য ওয়ালীউল্লাহ্র নিজের মন্তব্য থেকে বা নিদেনপক্ষে তার ঘনিষ্ঠ কারো বয়ান থেকে সূত্র উল্লেখ করা অত্যন্ত জরুরি ছিল। কারণ ওয়ালীউল্লাহ্র নিজের জীবনে পশ্চিম-পাকিস্তান বা উর্দু-বিদ্বেষ থাকার কোনো প্রমাণ নাই। থাকার কোনো কারণও নাই। সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অবলম্বন হওয়ার কারণে উর্দুর বিরোধিতা আর ব্যক্তিগত উর্দু-বিদ্বেষ দুটো খুবই আলাদা জিনিস। এ দুটোকে একাকার করে ইতিহাস-প্রণয়ন বা মন্তব্য করার প্রবণতা বাংলাদেশে খুবই সুলভ। এ জীবনীগ্রন্থে তা বেশ ভালোভাবেই আছে।
তবে তথ্য উপস্থাপনায় সৎ থাকতে চেয়েছেন বলে অনেক সময়েই লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে খোদ তথ্যই ভিন্নরকম সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। ওয়ালীউল্লাহ্র মতাদর্শ, সাহিত্যিক সহযাত্রী ও রাষ্ট্রপক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক শনাক্ত করতে গিয়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ পাকিস্তান রাষ্ট্র ও ‘পাকিস্তানবাদী’ মানসিকতার বিরোধী এক প্রবল পক্ষ সাব্যস্ত করতে চেয়েছেন। ঢাকার সংস্কৃতিতে আশির দশকে প্রবল হয়ে ওঠা এ প্রভাবশালী ডিসকোর্স তিনি কেবল সম্পূর্ণ অনুমোদনই করেন নাই, ওয়ালীউল্লাহ্কে অবলম্বন করে তাতে বাড়তি মেদ সঞ্চারেও প্রয়াসী হয়েছেন। কিন্তু এটা আসলে ভিত্তিহীন বাইনারি। ঢাকার প্রভাবশালী শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে পাকিস্তান আমলের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এমন কিছু আসলে ছিল না, যাকে পাকিস্তান-রাষ্ট্র-বিরোধী বলে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়। ওয়ালীউল্লাহ্র ‘পাকিস্তান-বিরোধী’ অবস্থান চিহ্নিত করার জন্য আবুল মকসুদ যেসব তথ্য ব্যবহার করেছেন, সেগুলো একটি আরেকটিকে খারিজ করে, তাকে বাদ দিয়ে বাকি বিপুল লেখক-সাহিত্যিককে বিপরীত কোটায় ফেলে দেয়, আর এভাবে শেষ পর্যন্ত পুরো বাইনারিটিই ধসে পড়ে।
তবে না-মেনে উপায় নাই, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী’, ‘প্রগতিশীল’ ‘বামঘেঁষা’ ইত্যাদি ক্যাটাগরিতে ওয়ালীউল্লাহ্কে স্থাপন করার আন্তরিক চেষ্টা জীবনীগ্রন্থটির কোনো কোনো অধ্যায়ে দারুণ সুফল ফলিয়েছে। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বৃহৎ দুনিয়ার অন্য বহু সংস্কৃতি, দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ওয়ালীউল্লাহ্র সংযোগ দেখানো সুবিধাজনক হয়েছে। সম্ভবত লেখকের এ দৃষ্টিভঙ্গির সবচেয়ে গভীর ফল ফলেছে ‘মুক্তি সংগ্রামে অবদান’ শীর্ষক সুগঠিত-সুলিখিত অধ্যায়টিতে। প্রয়োজনীয় নথিপত্রের সন্নিবেশ, সম্ভাব্য অসংখ্য রেফারেন্সের ব্যবহার এবং ব্যক্তিগত চিঠিপত্রের সংযোজনায় অধ্যায়টি কেবল ওয়ালীউল্লাহ্কে একজন গুরুত্বপূর্ণ মুক্তি-সংগ্রামী হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেয়নি, মুক্তিযুদ্ধের একটা কম-চেনা পর্বে জরুরি আলোও ফেলে গেছে।
আরেকটি কথাও বিশেষভাবে স্মরণীয়। ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী’, ‘প্রগতিশীল’ ‘বামঘেঁষা’ ইত্যাদি পরিচয়ের সাথে বাঙালি মুসলমানের ‘মুসলমান’ পরিচয়ের একটা বিরোধ আমাদের প্রভাবশালী সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত আছে। সৈয়দ আবুল মকসুদের বিবরণীতেও এ বিরোধ খুব তীব্র। কিন্তু তিনি ‘মুসলমান’ পরিচয়ের দিকটাকে খারিজ করে দেন নাই। বরং এক ধরনের বোঝাপড়ার চেষ্টা বইয়ের নানা অংশে বিকীর্ণ হয়ে আছে। ‘আন্দালুসিয়া ভ্রমণ’ অংশটি তারই পরিচয় বহন করে। অংশটি সুলিখিত। আন্দালুসিয়ার প্রতি ওয়ালীউল্লাহ্র আগ্রহ বিশেষভাবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মুসলমান-শাসনের পুরনো নিদর্শন এবং সেকালের মুসলমান-শাসনের যেসব পরিস্থিতি জ্ঞান-বিজ্ঞানের এ বিস্ময়কর উন্নতি সম্ভব করেছিল, তা খতিয়ে দেখাই-যে এতবার সেখানে যাবার কারণ, তা অ্যান-মারির বরাতে নিশ্চিত করেছেন লেখক। বলেছেন, মুসলমানদের সেক্যুলার-শাসনের নমুনা এবং ঔদার্যের ব্যাপারটা বহুবার ওয়ালীউল্লাহ্র আলোচনার বিষয় হয়েছে। ওয়ালীউল্লাহ্র আগ্রহের এ ধরন এবং সৈয়দ আবুল মকসুদের বিবরণী ‘মুসলমান’ বর্গ সম্পর্কে তাদের দুজনের আগ্রহ ও লিপ্ততা সম্পর্কে আমাদের নিশ্চিত করে।
অ্যান-মারির সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ওয়ালীউল্লাহ্র জীবনী-পুনর্গঠনের পরিকল্পনা একটা অসাধারণ ঘটনা। সৈয়দ আবুল মকসুদ এ কাজ না করলে সম্ভবত বাংলাদেশের সাহিত্য ও বিদ্যাবত্তার জগৎ থেকে এ অংশ চিরকালের মতো হারিয়ে যেত। ওয়ালীউল্লাহ্র অতি-বিশিষ্ট জীবন-যাপনের কারণেই এরকম হয়েছে। প্রবাস-জীবন, বিশেষত বিয়ের পরের জীবন, সম্পর্কে এর মধ্য দিয়ে আরো অনুসন্ধানের সূত্রও তৈরি হলো। এমনকি যারা সাহিত্য-পড়ার জন্য সাহিত্যিকের ব্যক্তি-জীবনকে অবলম্বন করা জরুরি মনে করেন, তাদের জন্য ওয়ালীউল্লাহ্র দ্বিতীয় পর্বের সাহিত্য-পাঠে এসব উপাদান খুব উপকারী গণ্য হওয়ার কথা। যেমন অ্যান-মারি তাকে জানিয়েছেন, ওয়ালীউল্লাহ্ ১৯৫২-তে মারির সাথে দেখা হওয়ার আগেই ফরাসি সাহিত্যে ব্যুৎপন্ন ছিলেন। সার্ত্রের রোডস টু ফ্রিডম ট্রিলজি তিনি অ্যান-মারির আগেই পড়েছিলেন। এসব তথ্য চূড়ান্ত গুরুত্ব না-পাক, অন্তত প্রাথমিক তথ্য-ভিত্তি হিসেবে ওয়ালীউল্লাহ্-পাঠের জন্য অবশ্যই গুরুত্ব বহন করে।
পাঁচ
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র জীবন ও সাহিত্যের আলোচনায় সৈয়দ আবুল মকসুদ ‘বাঙালি মুসলমান’ বর্গটিকে নিজের মতো করে পুনর্গঠন করেছেন। বলা যায়, এ ব্যাপারে তিনি একটি ‘গ্রহণযোগ্য’ রীতি তৈরি করতে চেয়েছেন। পুরো বইয়ের প্রকাশ্য ও অন্তর্নিহিত স্তরে বর্গটি আমূল সক্রিয় ছিল। এ কারণেই ওয়ালীউল্লাহ্-রচনাবলিতে ‘মুসলমান’ বর্গটির, বিশেষত ধর্ম-পরিচয়টির, নানামাত্রিক অপরায়ণ সম্পর্কে তিনি ক্রিটিক্যাল ছিলেন। ১৯৮৩ সালে লেখা দ্বিতীয় খণ্ডের উপক্রমণিকায় তিনি লিখেছেন :
তবে কুক্রিয়াশীলতার সমালোচনা করতে গিয়ে-বাঙালি মুসলমানসমাজের চিত্রাঙ্কন করতে গিয়ে-তিনি অনেক গ্রগতিশীল আধুনিক মুসলমান লেখকের মতো জোর দিয়ে ইসলামের নেতিবাচক দিকটিই শুধু তুলে ধরেছেন, অবহেলা ও অবজ্ঞা করেছেন ইতিবাচক দিকটি যা মোটেই উচিত হয়নি।
মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও আরবিতে ফেল করে ওয়ালীউল্লাহ্ অষ্টম শ্রেণিতে দুবছর পড়েছিলেন সে-জন্যেই, কিংবা মুসলমান ধর্ম-ব্যবসায়ীদের অজ্ঞতা, উগ্রতা ও উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়েই তিনি ধর্মবিষয়ে বীতশ্রদ্ধ হন কিনা বলা শক্ত। তবে অনেক বাঙালি মুসলমান যে শ্রেষ্ঠ মানবিক গুণাবলির অধিকারী তার উজ্জ্বল উদাহরণ ওয়ালীউল্লাহ্ নিজেই।
ওয়ালীউল্লাহ্র ‘ধর্ম-বিদ্বেষ’ শনাক্ত করার ক্ষেত্রে এ বিশ্লেষণ অবশ্য মোটেই যথেষ্ট নয়। এতে খুবই উপরিতলের একটা ঘটনা দিয়ে গভীর মতাদর্শিক-দার্শনিক এক সিদ্ধান্তের মীমাংসা করা হয়েছে। তা ছাড়া ‘ধর্ম-বিদ্বেষ’, ‘মুসলমান-বিদ্বেষ’, ‘ইসলাম-বিদ্বেষ’ এবং ‘পাকিস্তান-বিদ্বেষ’ ইত্যাদি ধারণা-যে মোটেই একসূত্রে ব্যাখ্যা-যোগ্য নয়, সেরকম সচেতনতাও এ বইতে তেমন একটা পাওয়া যায় না। তার প্রমাণ মিলবে লালসালু উপন্যাসের দীর্ঘ আলোচনার নানা অংশে।
প্রথম প্রকাশের পর লালসালুর সমাদর না-হওয়ার কারণ নির্দেশ করেছেন তিনি। বলেছেন, বৃহত্তর অর্থে ‘পাকিস্তানি’ মনোভাবের প্রবলতাই এ লেখার যথার্থ মূল্যায়ন না-হওয়ার কারণ। তাহলে ষাটের দশকে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার পরে রাতারাতি উপন্যাসটি এতটা গৃহীত হলো কিভাবে? তথ্যগুলো আবুল মকসুদ নিজেই দিয়েছেন। একটি বইয়ের জন্যই ওয়ালীউল্লাহ্ বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। বইটি জনপ্রিয় হয়েছিল, এবং ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠ্য-বই হিসাবে গৃহীত হয়েছিল। তাহলে কি বলতে হবে, ষাটের দশকে ‘পাকিস্তানি’ মনোভাব হ্রাস পেয়েছিল? পাঠক-পর্যায়ে জনপ্রিয় হওয়ার তথ্যকে কেউ চাইলে তার ইঙ্গিত হিসাবে গ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু পুরস্কৃত হওয়া এবং পাঠ্যভুক্ত হওয়ার ঘটনা স্পষ্টতই সরকারি-কাঠামোর সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের সিদ্ধান্ত। আমরা কি ধরে নেব, তারা না-বুঝেই কাজগুলো করেছেন? নাকি ‘পাকিস্তানবাদী’ তৎপরতায় খুবই ‘সক্রিয়’ ওই ব্যক্তিদের অচেতনেও পাকিস্তান-বিরোধী বাঙালি জাতীয়তাবাদ কাজ করে যাচ্ছিল? স্পষ্টতই সমন্বয়বাদী-স্বাতন্ত্র্যবাদী বৈপরীত্যে পাকিস্তান-আমলের ইতিহাস-পাঠের যে-প্রবল ধারা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত আছে, সৈয়দ আবুল মকসুদ এখানে তার আওতায় ওয়ালীউল্লাহ্কে পড়তে চেয়েছেন। কিন্তু অন্যসব উদ্যোগের মতো এ ক্ষেত্রেও এ ধরনের কোনো সঙ্গতিপূর্ণ পাঠ আসলে সম্ভব নয়। কারণ
চূড়ান্ত-বিচারে এ ধরনের কোনো বৈপরীত্য ছিল না। ‘পাকিস্তানবাদী’ ওয়ালীউল্লাহ্ যেমন ধর্মীয়-কুসংস্কারের ছবি এঁকে উপন্যাস লিখেছেন, ‘পাকিস্তানবাদী’ পুরস্কার-দাতারাও তেমনি সমাজের উন্নতির জন্য লালসালুকে পুরস্কৃত করেছেন, পাঠ্য করেছেন। এ দুয়ের মধ্যে কোনো আবশ্যিক বিরোধ ছিল না।
দেখা যাচ্ছে, সচেতন থাকা সত্ত্বেও ‘মুসলমান’ পরিচয়ের সাথে ‘বাঙালি’ পরিচয়ের কোনো আপস-মীমাংসা, অন্তত এ বই লেখার কালে, সৈয়দ আবুল মকসুদ করে উঠতে পারেননি। এ ব্যাপারে বিদ্যমান বড় প্রশ্নগুলো অবশ্য তার বিবেচনায় সবসময়ই ছিল। বইটির ভূমিকা, ফ্ল্যাপ ও অন্য নানা জায়গায় দাবি করা হয়েছে, এর পটভূমি সমগ্র বাংলা সাহিত্যে বিস্তৃত। এ দাবি সমর্থনযোগ্য নয়; কারণ ‘সমগ্র বাংলা সাহিত্য’ এখানে উল্লেখ-হিসেবে এসেছে মাত্র, বিশ্লেষণের আওতায় আসে নাই। তবে বাংলা সাহিত্যের বৃহৎ পটভূমিতে ওয়ালীউল্লাহ্কে স্থাপন করার চেষ্টাটা দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিমাণেই আছে। লেখকের লক্ষ্য ছিল, এ বৃহৎ পটভূমিতে একজন সফলকাম পূর্ববঙ্গবাসী ও বাঙালি মুসলমান হিসাবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্কে উপস্থাপন করা। লালসালু উপন্যাসের বিদেশ-অভিযানের ব্যাপক সাফল্যের অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন তিনি; সাথে যোগ করেছেন বাংলা কথাসাহিত্য-অনুবাদের সামগ্রিক অবস্থা। তারপর লিখেছেন, ‘এই হলো বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক পরিস্থিতি, পূর্ব বাংলার সাহিত্যের অবস্থা অতি শোচনীয়।’ এ পটভূমিতেই তিনি লালসালু তথা ওয়ালীউল্লাহ্র ব্যাপক বিদেশ-বিজয়ের বিস্তারিত এবং অনুপুঙ্খ বিবরণ দাখিল করেন। ওয়ালীউল্লাহ্র শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করার মনোভঙ্গিটা মোটেই গোপন থাকে নাই।
এ মর্মে আরেকটি উদাহরণ দেয়া যাক।
গল্পকার ওয়ালীউল্লাহ্র নান্দনিক কীর্তি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন :
ওয়ালীউল্লাহ্র সঙ্গে তার পূর্ববর্তী বাঙালি গল্পকারদের ব্যবধান এখানেই, তিনি নিছক কাহিনী শোনানোর জন্য গল্প লেখেননি, কাহিনী তার কাছে উপায় এবং উপলক্ষ মাত্র-লক্ষ্য নয়। গল্প বলার জন্যে তিনি একটি নিজস্ব শৈলী ও ঢঙ রপ্ত করেছিলেন যা তার সমসাময়িকদের চেয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এবং তিনি অগ্রসর।
এ মন্তব্যে ওয়ালীউল্লাহ্র সাহিত্যিক-সত্য তিনি সম্ভবত বেশ অনেকটা ধরতে পেরেছেন। তবে সাহিত্যের আলোচনায় তিনি নিজে মুখ্যত থেকেছেন বাস্তবের স্তরে বা কাহিনির স্তরে। যেমন-উচ্চ-মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজের চিত্র, দুর্ভিক্ষ ও দেশ-ভাগের চিত্র, ধর্ম-ব্যবসায়ী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের মুখোশ উন্মোচন-এগুলোই তার ওয়ালীউল্লাহ্-পাঠের প্রধান সূত্র। তার নিজের মন্তব্য আমলে নিয়ে বলতে পারি, তিনি ‘লক্ষ্যে’র দিকে খুব কমই মনোযোগ দিতে পেরেছেন, অধিকতর নিবিষ্ট ছিলেন ‘উপলক্ষে’।
এ থেকে যদি সমালোচক-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের অচেতন সম্পর্কে আন্দাজ করতে চাই তাহলে বলতে হবে, যে লক্ষ্যে তিনি নিজে এ পরিশ্রম-সাপেক্ষ কাজে নেমেছেন, সে লক্ষ্য গল্পগুলোর কাহিনির স্তরে বা বাস্তবের স্তরে হাসিল হয় বলেই তিনি এ স্তরে এত নিবিষ্ট ছিলেন। কী সেই লক্ষ্য? নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে আলোচনার ধরন, অভিমুখ এবং জোরারোপের জায়গা দেখে কিছু আন্দাজ করা যেতে পারে।
উপরের উদ্ধৃতিতে সৈয়দ আবুল মকসুদ ‘বাঙালি গল্পকারদের’ কথা বলেছেন, শুধু বাংলাদেশের নয়। এ উল্লেখটা সাধারণভাবে খুব মামুলি মনে হতে পারে; এমনকি আলাদা করে কেবল এ বাক্যে দেখলে অসচেতন উল্লেখও মনে হতে পারে। কিন্তু পুরো বইয়ের অন্য অংশগুলোর সাথে মিলিয়ে পড়লে বোঝা যাবে, ‘বাঙালি’ অর্থাৎ সমগ্র বাংলাভাষী অর্থাৎ কলকাতাসহ বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠিত এলিট অংশের প্রেক্ষাপটে ওয়ালীউল্লাহ্কে স্থাপন করার এবং ওই বৃহৎ পটভূমিতে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করার একটা চেষ্টা সর্বত্রই আছে। সৈয়দ আবুল মকসুদ আসলে পূর্ব বাংলার বা ঢাকার এবং কেজো অর্থে বাঙালি মুসলমানের পক্ষে ওয়ালীউল্লাহ্কে নিয়ে এক প্রকার বাজি ধরেছেন। ওয়ালীউল্লাহ্র মাপের মানুষ ও সাহিত্যিক-যে এ আওতার মধ্যে জন্মাতে পারেন, এবং রীতিমতো জন্মেছেন, তার প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য হাজির করা এ গ্রন্থ-প্রণয়নে তার অন্যতম লক্ষ্য। এই ওয়ালীউল্লাহ্ কেমন মানুষ?
আবুল মকসুদের ওয়ালীউল্লাহ্ অভিজাত এবং উচ্চশিক্ষিত। তিনি মুসলমান জনগোষ্ঠীর নিপীড়িত হওয়ার ইতিহাসকে গ্রাহ্য করেন, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতাকে একবিন্দুও প্রশ্রয় দেন না। তিনি ভদ্র, মার্জিত ও শোভন; কিন্তু বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-পরিজন তো বটেই, এমনকি সাধারণ মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনেও অক্লান্ত। পশ্চিমা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অতুলনীয় অধিগম্যতা সত্ত্বেও তিনি নিজের বাঙালিত্বকে উপেক্ষা করেন না। পাকিস্তান রাষ্ট্রের বড় কর্মকর্তা হয়েও বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ও মতাদর্শে নিষ্ঠা দেখান। গোটা দুনিয়ার বিপ্লবী ও মার্কসবাদীদের প্রতি আগ্রহের প্রমাণ পাওয়া যায় তার ব্যক্তি-জীবনে। সর্বোপরি ‘প্রগতিশীল’ বর্গে তাকে খুব ভালোভাবেই আঁটিয়ে নেয়া যায়। কাজেই সৈয়দ আবুল মকসুদের প্রণয়নে ওয়ালীউল্লাহ্র যে-সুরত গড়ে ওঠে, তাতে প্রত্যক্ষত রাজনৈতিক না হোক, সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক প্রবল চিহ্নায়ন খুব সহজেই শনাক্ত করা যায়।
অবশ্য ‘আদর্শ বাঙালি মুসলমান’ নির্মাণ করার এ বাসনা পুরো বইতে একটা বড় কুফলও ফলিয়েছে। ওয়ালীউল্লাহ্ বৃহৎ পরিপ্রেক্ষিত থেকে আলগা হয়ে ‘ভিনদেশি’ হিসাবে নির্মিত হয়েছেন। সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে তো বটেই, এমনকি সাহিত্যিক সংস্কৃতি ও চর্চার ব্যাকরণ থেকেও। এটা করা সম্ভবপর হয়েছে ওয়ালীউল্লাহ্ বিদেশে থাকার কারণে, এবং পশ্চিমা সাহিত্যিক-দার্শনিক প্রভাব তার সাহিত্যে প্রবলতর হওয়ার কারণে। কিন্তু আসলে বিযুক্তি যেমন ছিল, তেমনি ছিল নানামাত্রার সংযুক্তি। ষাটের দশকের ঢাকার সাহিত্যের প্রবল পশ্চিমায়ন-অংশত কলকাতার মধ্যস্থতাসহ-এ আলোচনায় একেবারেই বাদ পড়েছে। তারচেয়ে বড় কথা, ওয়ালীউল্লাহ্কে দেশ ও দশের প্রতি বিশেষভাবে লগ্ন প্রমাণের জন্য যে-বিপুল পরিমাণ পৃষ্ঠা বইটিতে খরচ হয়েছে, তার সবটাই মাটি হয়ে যায়, যদি দেশজ-পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের-সার্বিক বাস্তবতার সাথে তার বিশেষ যোগ দেখানো না-যায়। যেভাবে বইটিতে বহু সাহিত্যিক ও ঢাকার সাহিত্যিক সংস্কৃতিকে খারিজ করা হয়েছে, তাতে মনে হয় সৈয়দ আবুল মকসুদ এ ব্যাপারে বিশেষ সতর্ক ছিলেন না।
দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে ওয়ালীউল্লাহ্-চর্চা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। খেয়াল করেছেন, ‘১৯৪৭-৭১ সময়ে বাংলাদেশে রচিত সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে শুধু নয় তার আগে অবিভক্ত বঙ্গে রচিত মুসলমান লেখকদের সম্পর্কেও পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য-সমালোচক ও গবেষকগণ আশ্চর্য নীরবতা পালনে অভ্যস্ত।’ ওয়ালীউল্লাহ্র উপন্যাসের আলোচনা করতে গিয়েও বেশ লম্বা পরিসরে উনিশ-বিশ শতকের কথাসাহিত্যে মুসলমানদের অনুপস্থিতির কথা বলেছেন। পূর্ববঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশ সম্পর্কে কলকাতার উন্নাসিকতার প্রসঙ্গ তুলেছেন। এ ব্যাপারটা সৈয়দ আবুল মকসুদ সারাজীবন খেয়াল করেছেন। এটাই এখানকার স্বাভাবিক প্রবণতা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অন্য অনেক ‘স্বাভাবিকে’র মতো বাংলাদেশে এ বস্তুও কার্যত বেশ দুর্লভ। কলকাতার সামগ্রিক সংস্কৃতিতে-যে একটা আধিপত্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আছে, তা বুঝতে পারা এবং থাকার যদি যথেষ্ট কারণ থাকেও সে সম্পর্কে সতর্ক থেকে তা দূর করার কোশেশ জারি রাখা বাংলাদেশের যে কোনো বুর্জোয়া বা লিবারেল ব্যক্তির প্রাথমিক মনোযোগের বিষয় হওয়ার কথা। সৈয়দ আবুল মকসুদের ক্ষেত্রে বলা যাবে, তিনি ভারত-বিরোধিতা বা হিন্দু-বিদ্বেষ বা কলকাতা-বিরোধিতার মতো বাংলাদেশে খুব প্রভাবশালী অপচর্চা থেকে মুক্ত ছিলেন, কিন্তু ভারত বা কলকাতার সব ধরনের আধিপত্যবাদী চর্চার বিরুদ্ধে তার নিজের ধরনে সরব ছিলেন। তিনি-যে ঢাকার জন্য খুব জরুরি বুদ্ধিজীবী হয়ে উঠেছিলেন, তার অন্যতম প্রধান কারণ এ লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গির সংস্থান।
ছয়
আমাদের দেশে জীবনী লেখার চল নাই। লিবারেল জমানায় পশ্চিমে জীবনী-চর্চা তত্ত্বীয়-প্রায়োগিক দিক থেকে একটা উঁচু মানে পৌঁছেছিল। ব্যক্তির মধ্যে মেধা-মনন-সৃষ্টিশীলতার চরম বিকাশ ঘটতে পারে, যা কাজ করবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর পাথেয় হিসাবে-এ ধরনের একটা জীবনদৃষ্টি সে বিকাশের মূল। জাতীয় চেতনা বিকাশের কালেও জীবনী খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ব্যক্তিকে জনগোষ্ঠীর উৎকর্ষের মূর্তরূপ হিসাবে দেখার বাসনাই ওই চর্চার ভিত্তি। কলকাতায় এ দু-বর্গেই জীবনী-সাহিত্যের চর্চা কম-বেশি হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গির নানামাত্রিক গরিবি এবং জাতীয় চেতনার ভয়াবহ দুরবস্থার মধ্যে জীবনী-চর্চা তথ্যাদির চটি-সংস্থানেই সীমিত হয়ে আছে।
পুরনো মানুষদের জীবনী-পুনর্গঠনের সংস্কৃতি আমাদের এখানে বিকশিত না-হওয়ার আরেক কারণ এই যে, লোকে এ জনগোষ্ঠীর পুরনো কায়কারবারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শরমিন্দা বোধ করে। এ অস্বস্তি সৈয়দ আবুল মকসুদের মধ্যেও, দেখা যাচ্ছে, প্রবল ছিল। তবু তিনি জীবনী লিখেছেন। অনেকগুলো। তিনি বাংলাদেশকে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। দেশের গভীর ইতিহাস, শক্তি ও দুর্বলতা, ঐশ্বর্য ও গরিবি উন্মোচন করতে চেয়েছেন। এদিক থেকে তিনি বাংলাদেশের বিরলতম ব্যক্তিদের একজন। তার জীবনী-প্রণয়ন কোনো প্রজেক্টের পরিণতি নয়, প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা-প্রকল্প নয়, এমনকি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার পরিকল্পিত উদ্যোগও নয়। স্রেফ দেশকে আবিষ্কার করে জনগোষ্ঠীর জন্য দিক-নির্দেশনা প্রণয়ন করাই ছিল তার লক্ষ্য। দেশ ও মানুষের প্রতি নিঃশর্ত অঙ্গীকারের এসব প্রামাণ্য দলিল একদিকে গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের পরিচয় বহন করে, অন্যদিকে আগামী বহুকালের জন্য তাকে প্রাসঙ্গিক ও জরুরি করে তোলে।