
প্রতীকী ছবি
মেলবোর্ন খুব সুন্দর নগর। আধুনিকতার জন্য শহরটা বৈশ্বিক মাপে খুব উঁচু অবস্থানে আছে। সমুদ্রকন্যা যদি বলা হয় সঠিক অর্থে এটা তাই। আর এর রূপের সত্যি কোনো তুলনা হয় না।
কদিনের জন্য এসেছি, সময়টা কাজে লাগাতে চাই। আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি হরদম। মুগ্ধ হয়ে শহর দেখছি। টুরিস্ট বাসে চড়ে সারাদিন শহর দেখা যায়। কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা চোখে পড়ে না। জীবনের নিরাপত্তা এখানে অতুলনীয়। রাষ্ট্র সে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।
আমার এক বন্ধু এখানে আছে। আমি ওর ব্যক্তিগত সময়ও অনেকটাই কদিন যাবৎ আমার দখলে নিয়ে নিয়েছি। এখানকার সময়ের দাম আমি কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারি। আমার বন্ধু বলে, সময় এখানে ডলারে বিক্রি হয়। সময় মানে ডলার, সময়ের অপচয় মানে ডলারের অপচয়।
তবু আমার বন্ধু আমাকে সময় দিচ্ছে, বেলা শেষে হাসিমুখেই সে আমাকে নিয়ে এখানে ওখানে ঘুরতে বের হয়।
প্রতিদিনের বিকেল আর সন্ধ্যায় আমি ওর সঙ্গে নানা জায়গায় যাই। শপিংমলে যাই, সিনেমাও দেখি। সন্ধ্যাটা কাটাই, নদী, হ্রদ আর সাগরের কাছে। ইয়ারা নদীর তীরে ঘুরে বেড়িয়ে ঐতিহ্যবাহী মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব চত্বরে বসে থেকে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের ইতিহাস নিয়ে ভাবি। মহাকালের হিসাবে খুব বেশি দিনের কথা নয়, একটা অজানা মহাদেশ ছিল অস্ট্রেলিয়া। ইউরোপ এসে তার সবকিছু দখল করল, বদলেও দিল। ইংল্যান্ডে যে খেলার সুতিকাগার সে অপর ভূখণ্ডে এসেও কী শৌর্যশালী হয়ে উঠল!
আমি স্বগতোক্তি করি, কীভাবে সম্ভব হলো!
সভ্যতা। আমার বন্ধু আমাকে জোর দিয়ে বলে, অস্ট্রেলিয়ান জাতি পৃথিবীর যে কোনো জাতির তুলনায় সভ্য। যে ফরাসি জাতি সভ্যতার জন্য অহংকার করে তারাও অস্ট্রেলিয়ান্দের সমকক্ষ নয়।
কিন্তু এদের সভ্যতা বেশি দিনের নয়। শহরটা দেখেও সেটা বোঝা যায়।
হ্যাঁ, সভ্যতা বস্তুগত উন্নতির মাপকাঠি। এখানে সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার আর অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের নিশ্চয়তা রাষ্ট্র দিয়ে থাকে।
আমার মনে তখন অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস ভেসে উঠতে চায়, কিন্তু আমি চাপা দিয়ে রাখি। আমি বন্ধুর সামনে সে ইতিহাস তুলে আনি না। তবু জিজ্ঞেস না করে পারি না, আচ্ছা, এখানকার আদিবাসীরা কোথায় থাকে? ওদের দেখার খুব ইচ্ছে ছিল।
বন্ধু বলে, এখন কি আদিবাসী আছে? মিলে মিশে এক হয়ে গেছে।
তবু যদি দেখতে পেতাম, কারও সঙ্গে পরিচিত হতে পারলে ভালো লাগত। তুমি কি ওদের দেখা পাও না?
আমার দেখার ইচ্ছা হয়নি কখনো। আর শুনেছি ওরা খুব অসভ্য ছিল, এখনো সেই অসভ্যতা ছাড়তে চায় না। এমনকি ওরা ওদের বাচ্চাদেরকেও স্কুলে দিতে চায় না।
কেন?
জানি না। এমনকি তারা সরকারি সহায়তা নিতে চায় না, সরকারের উন্নয়নের সিদ্ধান্ত মানতে চায় না।
কেন এমন করে?
ঐ যে বললাম, সভ্য হতে পারেনি।
ইয়ারা নদীর তীর ধরে হেঁটে যাচ্ছি আর আমার বন্ধুর মুখে গল্প শুনছি। শীত নেমেছে বেশ। রাতের খাবার খেয়ে আমি আমার হোটেলের কক্ষে আর বন্ধুটি ওর ডেরায় যাবে। কাল সকালে আমি ফিরে আসব দেশে। কটা দিন বেশ কাটিয়েছি। মনের ভেতর একটা অতৃপ্তি রয়ে গেছে। একজনও আদিবাসীর দেখা পেলাম না। যে দেশ আদিবাসী অধিকার নিয়ে এত সোচ্চার সে দেশে আদিবাসী সম্মেলনে এসে একজন আদিবাসীর দেখা না পেয়ে চলে যাচ্ছি।
আমরা রাতের খাবার খেতে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়ি। আরও কিছু গল্প যা অবশিষ্ট ছিল গ্লাসের শেষ চুমুকের মতো তাও শেষ করে বের হলাম।
শহরটা এখন নীরব। পথে দু-একটা যান চোখে পড়ছে। নিঝুম রাতে মেলবোর্ন শহরটা অতুলনীয় মোহময়ী হয়ে আমার চোখে ধরা দিয়েছে। নিয়ন আলোর ফোয়ারার তলে পাথুরে ফুটপাথ চকমকি পাথরের মতো উদ্ভাসিত হয়ে আছে। অস্ট্রেলিয়া যে খনিজের আধার ফুটপাথে তাকালেও আন্দাজ করা যায়।
আমার শীতল হাত আমার বন্ধুর হাতে এখনো ধরা আছে। যেন সে আমাকে ছাড়তে চাইছে না। আর তখন ফুটপাতে একটা পলিথিনে ঢাকা তাঁবুর তলে কিছু একটা শব্দ শুনে আমার কান সজাগ হয়ে ওঠে।
কী ওখানে?
আমার বন্ধু বলে, কোনো প্রাণী-ট্রানি হবে হয়তো।
তবু আমার চোখ সেদিক থেকে সরে আসে না। সহসা তাঁবুর তল থেকে একটা মানুষের হাত আর তার পর মাথাও বের হয়। তবে আমি তার মুখ দেখতে পাই না। সে হাত নেড়ে দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু যেন বলছে। তাকে একটা প্রাণী অর্থাৎ ক্যাঙারু বলে কারও ভুলও হতে পারে।
আমি ইংরেজিতে বলি, তোমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
লোকটা আমাকে কম্বলের তল থেকে দেখতে থাকে; কিন্তু কিছু বলে না। আমি আবার বলি, আমি কি কোনো সাহায্য করতে পারি?
লোকটা কিছু বলে না। বিড়বিড় করে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি। চারদিকে তাকাই।
দু-একজন এ দেশেও আছে, যারা জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ায়, নেশাটেশা করে। এ এমনই একজন মনে হচ্ছে।
বন্ধুর মন্তব্যে আমি সন্তুষ্ট হতে পারি না। ঝলমলে শহরে এমন অন্ধকার কিছু দেখতে পাব সেটা আমার ভাবনার বাইরে ছিল। দেখতে পাই তখন একটা লোক হেঁটে এদিকেই আসছে। সে হেঁটে এসে তাঁবুর কাছে দাঁড়ায়। তাঁবুতে থাকা লোকটা অচেনা ভাষায় আবার কিছু বলে। পথচারীও প্রত্যুত্তরে কিছু বলে।
আমি পথচারীকে বলি, হ্যালো, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আমার নাম আলি।
আমি উইলসন। তোমার সাক্ষাতে খুশি হয়েছি।
ধন্যবাদ। আমি কি তোমার কিয়ৎপরিমাণ পরিমাণ সময় নিতে পারি? দুয়েকটা কথা বলতে পারি?
কী বলবে, বলো।
এই লোকটার সম্পর্কে।
তুমি একটু দাঁড়াতে পারবে?
হ্যাঁ, তা পারব।
অপেক্ষা করো, আমি এই এক্ষুনি আসছি।
পথচারী আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখেই রেস্টুরেন্টের দিকে যায় এবং সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। আমি দাঁড়িয়ে তাঁবুর নিচে সেঁধিয়ে থাকা লোকটার মুখ দেখতে উদগ্রীব হয়ে আছি। বন্ধুটি আমার আদেখলাপনায় কিছুটা বিরক্ত হচ্ছে। ওর বিরক্তি কাটাবার জন্য আমি এ কদিন ওর আতিথেয়তার অযাচিত প্রশংসা করতে থাকি। আর রেস্তোরাঁয় ঢুকে যাওয়া লোকটার ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করি।
ততক্ষণে লোকটা হাতে কিছু নিয়ে ফিরে আসে। সে তাঁবুতে থাকা লোকটার কাছে বসে প্যাকেটটা তাকে দেয়। অন্য ভাষায় কিছু বলে। তার পর উঠে দাঁড়ায়। আমি দেখতে পাই তাঁবুর ভেতরে দেহ লুকিয়ে রেখেই একজন খাবার খেতে থাকে।
পথচারী আমাকে প্রশ্ন করে, তোমার কি আর কিছু জানার ছিল?
লোকটা তাঁবুতে থাকে কেন?
ঘর না থাকলে তোমার দেশের লোক কোথায় থাকে?
ঘর নেই!
বাড়ি না থাকলে ঘর কী করে থাকবে?
বাড়িও নেই! কেন?
মাটি কেড়ে নিলে বাড়ি কী করে থাকবে?
কারা কেড়ে নিয়েছে?
তুমি দেখছি এ দেশের ইতিহাস একেবারেই পাঠ করোনি।
এ লোক কোন ভাষায় কথা বলেছে?
সে তার মাতৃভাষায়।
আমাকে কী বলেছিল একটু জিজ্ঞেস করবে?
পথচারী তাঁবুর তলের লোকটাকে আবার কিছু বলে। তাঁবুর তল থেকে উত্তর আসে।
পথচারী আমাকে বুঝিয়ে বলে, সে তোমাকে তার মতো দেখে তার স্বজাতি মনে করেছিল। তোমার চেহারা আর দৈহিক গড়ন তার মতোই। তাই সে তার ভাষায় তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল। তুমি তার ভাষা বুঝতে পারোনি।
সে সরকারি ভাতা পায় না?
সে ভাতা নেয় না।
সে সরকারের সাহায্য নেয় না কেন?
তোমার দেশ যারা কেড়ে নেবে তুমি কি তাদের সাহায্য নেবে?
আমি পথচারী লোকটাকে বলি, তুমি তাকে বলো সে আমাকে স্বজাতি ভেবেছে বলে আমি প্রীত হয়েছি। ওকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আর বলো, আমি ইতিহাস থেকে জেনেছি, পুরাকালে তার নৃতত্ত্বের সঙ্গে আমার রক্তধারার সম্পর্ক ছিল। আমার মাতৃভাষায় তার ভাষার শব্দ আছে।
লোকটা তার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে আমার কথা তাকে বলে।
পথচারী তাঁর একটা পরিচিতি কার্ড আমাকে দিয়ে বিদায় নেয়, শুভরাত্রি।
শুভরাত্রি।
আমি পথচারী ব্যক্তির পরিচিত কার্ড পকেটে রাখার আগে একবার দেখে নিই। ড. উইলসন, অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান, মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি।
পথচারীর মুখে আমার কথা শুনে লোকটা ফের মাথা বের করে আমার দিকে তাকায়। এখন আমি তার মুখটা দেখতে পাচ্ছি। তাকে অস্ট্রেলিয়ার আর পাঁচজনের মতো মনে হয় না। তার মুখ এ কদিন দেখা মানুষের মুখের আদলের সঙ্গে মেলাতে পারি না। সে আমার দিকে তার শীর্ণ হাত বাড়িয়ে দেয়। আমিও। তার হাত যথেষ্ট উষ্ণ।
আমি আদি অস্ট্রেলিয়ান নৃতাত্ত্বিক উষ্ণতা সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে
থাকি।