
প্রতীকী ছবি
তুমি যাবেই?
বিছানার পাশে বসে সুপ্তি রাতের প্রসাধন সারছে। শরীরে হালকা লাল নাইটি। ভেতরে সাদা ব্রা। পুতুলের মতো সাজানো শরীর সুপ্তির। রাতের এই প্রসাধনের মুহূর্তে শাকিল যেখানেই থাকুক, সুপ্তির জন্য বসে থাকে। বেশ সময় নিয়ে প্রসাধন সারে নিজের। মনে হয়, এই সময়টুকু তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে সুপ্তি। আগামী সপ্তাহে চলে যাবে সুইজাল্যান্ড, এক বছরের জন্য। শাকিল হাসানের ভাবনা, সুপ্তিকে ছাড়া এই এক বছর কীভাবে থাকব?
সুপ্তি অদ্ভুত মেয়ে। সুন্দরী, সন্দেহ নেই। শরীরে ও মনের মধ্যে এক ধরনের ঘোর নিয়ে চলে। আর্কিটেক্ট। প্রাইভেট ফার্মের বড় পদে চাকরি করে। চোখে মুখে লাবণ্য ঢলে ঢলে পড়লেও মনের দিকটা দুর্ভেদ্য, কঠিন। বোঝা যায় না ওকে। ভীষণ ক্যারিয়ারিস্ট। সব সময় চোখে মুখে থাকে, কীভাবে ওপরে ওঠা যাবে, সেই আকুতি, প্রজ্ঞা আর অদম্য ইচ্ছে। শাকিল অবাক, মানুষ ক্যারিয়ারিস্ট হয়, অনেককে দেখেছে কিন্তু সুপ্তির মতো কাউকে এখনো দেখেনি। বিয়ের চার বছর হলো, এখনো বাচ্চা নেয়নি।
শাকিল বাচ্চার প্রসঙ্গ আনলে সুপ্তির কোমল মুখ কঠিন আকার ধারণ করে, আরও পরে।
তুমি জানো, বেশি দেরি করলে বাচ্চা পেটে না আসতেও পারে।
ওই সব পুরোনো ঘটনা। চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক এগিয়ে গেছে, কড়া জবাব সুপ্তি সুনয়নার। আজকাল বিয়ের দশ বছর পরও মানুষ বাচ্চা নেয়।
বাসায় একটা বাচ্চা না থাকলে ভালো লাগে? এত বড় বাসাজ্জতুমি আর আমি...
তোমার বাচ্চার শখ থাকলে আর একটা বিয়ে করতে পারো। আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি আগে আমার ক্যারিয়ার গড়ব, তারপর সন্তানের বিষয়ে ভাবব।
শাকিল বিপন্ন বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে সুপ্তি সুনয়নার দিকে, কী বলে এই নারী? সংসার সন্তানের চেয়ে আগে ক্যারিয়ার? হতেই পারে ক্যারিয়ার, ওপরে ওঠার ইচ্ছে থাকতেই পারে, কিন্তু আমাকে বিয়ে করতে বলছে অন্য নারীকে সন্তান ধারণের জন্য?
প্রেম নয়, বাবার বন্ধুর সূত্রে সুপ্তির বাবার সঙ্গে পরিচয়, শাকিলের বাবার। বিয়ের কথা শুরু হলে দুলাভাই, বন্ধুদের নিয়ে দেখতে যায় মোহাম্মদপুরের বাসায়। সুপ্তিকে দেখেই শাকিল পাগল, এক কথায় বলেছে, বিয়ে আমি এই মেয়েকেই করব।
দুই পক্ষের আলাপ আলোচনার মধ্যে বিয়ের পর যখন শারীরিক সুখে অবগাহন করতে চাইল শাকিল, দেখল মেয়ে নয়, নারী নয়জ্জএক ধরনের পুতুল। সুন্দর পুতুল। সাজিয়ে রাখা যায় শোকেসে, টেবিলের ওপর, শুইয়ে রাখা যায় বিছানায় কিন্তু আদরে আলিঙ্গনে প্রেমে ব্যবহার করা যায় না, কামার্ত সুরে ইচ্ছের সঙ্গতে। যখন পুতুল নিজে সাড়া দেবে তখনই কেবল জমে উঠতে পারে শরীরের মূর্ছনা সংগীত। শাকিল হাসান বিহ্বল, বিব্রত কিন্তু সুন্দরী স্ত্রীর প্রতি নিজের এক ধরনের প্রেম জেগে উঠেছে। শুনেছে বন্ধুদের কাছে, চাকরিরত সুন্দরী স্ত্রীরা সব সময়ে স্বামীর বা সংসারের করতলগত থাকে না, সুযোগের স্রোতে অন্য নদীতেও সাঁতার কাটে; কিন্তু নিজের এই স্ত্রী সুপ্তি সুনয়না সম্পর্কে শাকিল লিখিত দিতে পারে, এই নারী ক্যারিয়ার ছাড়া শরীর সংসার সন্তান কিছুই চেনে না, বোঝে না। মগজের বিশেষ অনুকম্পে নির্মাতা প্রেম আর শরীরের গান গাওয়ার কম্পন তৈরি করেনি... নিজেকে প্রবোধ দেয় শাকিল হাসান।
কিন্তু সুইজারল্যান্ড থেকে এক বছরের প্রশিক্ষণের অফার আসার সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করেছে সুপ্তি; কিন্তু শাকিলকে জানায়নি। কাগজপত্র প্রস্তুত হয়ে বিমানের টিকিট চলে আসার পর তিন দিন আগে জানিয়েছে অনেকটা আলু-পটোল কেনার মতো করে, শোনো আমি তো পরশু বার্র্ন চলে যাচ্ছি এক বছরের জন্য। তোমার তেমন কষ্ট হবে না, রেহানা তো আছেই। ওকে আমি সব বুঝিয়ে দিয়েছি। একটা অ্যান্ড্রয়েড ফোনও কিনে দিয়েছি, যাতে আমি সুইজ্যারল্যান্ড থেকে যখন তখন বাসার পরিস্থিতি দেখতে পারব।
তুমি যাচ্ছ পরশু, এক বছরের জন্য, আর জানাচ্ছ আমাকে আজ?
শাকিলের বিস্ময় কোনো বুদবুদই তৈরি করে না সুপ্তির মনে বা মগজে। খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় উত্তর দেয়, তোমাকে আগে জানালে কী হতো? জানি তো কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করতেজ্জঅত দূরে যাবার দরকার নেই। তোমাকে ছাড়া আমি কেমন করে থাকব? কিন্তু এত চমৎকার অফার যখন পেয়েছি, তখন তো যাবই আমি। তা ছাড়া অন্যের খরচে ইউরোপ দেখাজ্জঅনেক বড় ঘটনা। জানো, সুইস এই প্রপোজালে বাংলাদেশের প্রায় আটশ অ্যাপ্লিকেশন জমা পড়েছিল। সেই আটশ থেকে বাছাই করেছে তিনজনকে, তিনজনের একজন আমি। আমাকে নিয়ে তোমার গর্ব হওয়া উচিত; কিন্তু তুমি তো আমার মর্যাদা বুঝলে না কোনো দিন।
সুপ্তি সুনয়না চলে যায় শাকিল হাসানকে একলা রেখে, ঢাকা শহরের মগবাজারের ফ্ল্যাটে। সুপ্তির বাবা গ্রামে থাকেন, বয়োবৃদ্ধ। মা মারা গেছেন অনেক আগেই। শাকিলের বাবা মোহাম্মদপুরে নিজের বাসায় দুই পুত্র নিয়ে থাকেন। সঙ্গে নাতি-নাতনি তো আছেই। শাকিল সময় পেলেই বাবাকে দেখতে যায়। অনেক বলে কয়ে সুপ্তিকে নিয়েও মাঝেমধ্যে বাবার সান্নিধ্যে আসে। আগাগোড়া শাকিল পারিবারিক বন্ধনের মানুষ। দেখেছেজ্জমায়ের সঙ্গে বাবার নিবিড় সম্পর্ক। সময়ের যোজনায় সেই সম্পর্ক নানা রূপ পরিগ্রহ করলেও চিরন্তন সম্পর্ক কোনোকালে শেষ হয়ে যায় না।
শাকিল হাসানও ভালো একটা চাকরি করে, সিমেন্ট কোম্পানিতে। জীবন ভালোই যাচ্ছিল; কিন্তু সমস্যা শুরু হলো সুপ্তি সুনয়নার বিদেশে চলে যাওয়ার পর। প্রথম তো প্রায় দিনে রাতে সকালে বিকেলে মোবাইলে ফোনে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল শাকিলকে। বার্নের জোন হোটেলে আছে, কী কী দেখেছে, কোথায় ওদের ক্লাস হচ্ছেজ্জসব বলত আর শোনাত। আর বকার পর বকা দিয়ে রেহানাকে তটস্থ করে রাখেজ্জতোমাকে আমি দশ হাজার টাকা দিচ্ছি মাসে। ঢাকা শহরের কোনো কাজের মেয়ে দশ হাজার টাকা বেতন পায়?
না আপা।
তাহলে আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। সকালে, বিকেলে, দুপুরে, সন্ধ্যায়জ্জযদি তোমার স্যার বলে রাতেও আসতে হবে, আসবে। ঠিক আছে? শাকিল কিন্তু ফ্রিজের কোনো খাবার খেতে পারে না, প্রতিবার খাবার গরম করে টেবিলে দেবে। বিছানাটা একেবারে পরিষ্কার রাখবে। কোথাও যেন ময়লা না থাকেজ্জ
জি আপা।
এক সপ্তাহ, এক মাস টেনেটুনে ভালোই চলল কিন্তু সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্র্ন থেকে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলে ভিডিও ফোন আসা একেবারে কমে গেছে। জানিয়েছেজ্জঅনেক পরিশ্রম করতে হচ্ছে। ফলে...। হাসি পায় শাকিলের, কী এক জীবন? এই জীবনের জন্য বিয়ে? বিয়ে করে স্ত্রীকে যদি পাওয়ার মতো করে না পাওয়াই গেল, সেই বউ দিয়ে কী করব আমি?
সকালে অফিসে যায় না শাকিল হাসান। শুয়ে থাকে বিছানায়। টেবিলের ওপর নাশতা পড়ে থাকে। দুপুরের আগে বাসায় এসে দেখে রেহানা, বিছানার ওপর শুয়ে আছে শাকিল হাসান। তিন বছরের মধ্যে শাকিল ভালো করে তাকায়নি রেহানার দিকে। সুপ্তি জানিয়েছে, রেহানার স্বামী রিকশা চালায়। বাংলা মদ খায় আর সকাল-বিকাল পালা করে রেহানাকে মারে।
জানে ওই শ্রেণির মানুষের জীবন পদ্ধতিই এমন। সুতরাং কৌতূহল না দেখিয়ে চুপ থাকাই ভালো। পাশে এসে দাঁড়ায় রেহানা, দুলাভাই কী হয়েছে আপনার? জ্বর?
শাকিল চোখ মেলে তাকায়, বলতে পারি না। শরীরটা খুব দুর্বল লাগছেজ্জশীর্ণ কণ্ঠে জবাব দেয়।
পাশে বসে কপালে হাত রাখে রেহানা। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো শাকিলের, অনেক দিন পর মা কপালে হাত রাখলেন। পুরোটা শরীর অপার সুখের তরঙ্গে নেচে ওঠে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে, মায়ের স্নিগ্ধ পবিত্র মুখখানি। দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে নাক চিরে, মা!
আপনার গায়ে তো অনেক জ্বর দুলাভাই, অস্ফুট শোকাতুর গলা রেহানার।
আমি তো জানি না, আমার গায়ে জ্বর কি না! আমাকে পানি দাও এক গ্লাসজ্জ
দ্রুত রেহানা এক গ্লাস পানি এনে দেয়। অনেক কষ্টে উঠে বসে শাকিল। পানির গ্লাস নিয়ে পুরোটা পান করার পর আরও এক গ্লাস পানি চায়। রেহানা এনে দেয়, পান করে শাকিল। মুখটা মোছে পাশে রাখা তেয়ালে দিয়ে। আবার শুয়ে পড়ে।
দুলাভাই, আপনার গায়ে অনেক জ্বর। মাথায় পানি দিয়ে দিই?
শাকিল নির্বাক চেয়ে থাকে। একবারের জন্যও মনে পড়ে না সুপ্তিকে। মনে হয়, এই জীবনে কোনোদিন সুপ্তি নামের কেউ ছিল না। বাথরুম থেকে বালতি ভরে পানি আনে রেহানা, বিছনার ওপর বালিশ সাজিয়ে, বালিশের ওপর পলিথিন সাজিয়ে খুব যত্নে দুহাতে শাকিলের মাথাটা রাখে বালিশের ওপর। পাশে বসে বদনায় পানি তুলে কপালের ওপর ঢালতে থাকে রেহানা। পানি মাথায় পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শাকিলের খুব ভালো লাগে। রেহানা এক হাতে উঁচু করে পানি ঢালে, অন্য হাতে শাকিলের মাথার চুল ঘষে দেয়। এক ধরনের ভালোলাগার ক্লান্তি ঘিরে রাখে ওকে। অনেকক্ষণ পানি ঢালার পর তোয়ালে দিয়ে মাথা শরীর মুছিয়ে শুইয়ে দেয় রেহানা, শাকিলকে।
দুলাভাই, কিছু তো খান নাই। কী খাবেন? এক গ্লাস দুধ গরম করে দেব?
মাথা নাড়ায়, দাও।
দ্রুতই এক গ্লাস গরম দুধ এনে সামনে রাখলে খেয়ে নেয় শাকিল। টেবিলের ড্রয়ার খুলে ট্যাবলেট বের করে খায়। ধীরে ধীরে রুমের মধ্যে হাঁটে। ক্লান্তি লাগছে; কিন্তু হাঁটতে ভালো লাগছে।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ শরীর দুলে ওঠে, দ্রুত ধরে ফেলে রেহানা। বসায় খাটে, ধরে রাখে হাতজ্জআপনার শরীরটা দুর্বল। বসুন, না হলে শুয়ে থাকুন। আমি রান্না করছি। গরুর মাংস পছন্দ করেন আপনিজ্জফ্রিজে আছে। গরম করছি, সঙ্গে ডাল আর গরম ভাত, খেলে আপনার ভালো লাগবেজ্জ
রেহানার দিকে এই প্রথম তাকায় শাকিল হাসান। মেটে রঙের এক মেয়ে। শীর্ণ পাতলা শরীর। পরনে সস্তা শাড়ি। মাথা ভরা চুল। ঠোঁট দুটো রসে ভেজা। চোখ দুটো ভয়ানক গভীর। হাত দুটো রুক্ষ আর করুণ। সবকিছু মিলিয়ে লাবণ্যের কিছুটা খামতি থাকলেও চালিয়ে নেওয়া যায়।
তুমি আমাকে আর এক গ্লাস দুধ দাও রেহানা।
দিচ্ছিজ্জ
ঠান্ডা দুধ গরম করে গ্লাস নিয়ে সামনে দাঁড়ায় রেহানা। আবার তাকায় শাকিল, আরে মেয়েটি তো লতার মতো সুন্দর! হাত বাড়িয়ে গ্লাস নিতে নিতে প্রশ্ন করে, তোমার বাড়ি কোথায়?
শরীয়তপুর।
গ্রামে কে থাকে?
কেউ নাই। মা-বাবা মারা গেছে আমি যখন সেভেনে পড়ি। মারা যাওয়ার পর ছিলাম নানার বাড়ি দুই বছর। শেষে মামারা আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে।
জোর করে কেন?
আমি পড়ালেখা করতে চেয়েছিলাম।
শুনেছি তোমাদের কোনো বাচ্চা নেই?
ঘাড় নেড়ে রেহানা চুপচাপ বসে থাকে। দুধটুকু খেয়ে গ্লাসটা বাড়িয়ে দেয় রেহানার দিকে। রেহানা গ্লাসটা ডাইনিং টেবিলের ওপর রেখে বলে, আমি আপনার জন্য রান্না করতে যাই!
যাবে? একটু এদিকে আসোজ্জরেহানা কাছে এসে বসে। শাকিল হাতটা বাড়িয়ে রেহানার ডান হাতটা ধরে। নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে রেহানার হাতটা উল্টেপাল্টে দেখে। মাঝে মাঝে তাকায় রেহানার চোখের দিকে। অবাক নির্মল চোখে রেহানা দেখছে সামনে বসা মানুষটাকেজ্জপুরুষ মানুষটাকে। রেহানার হাতটা ছেড়ে দিয়ে দুহাতে তুলে ধরে রেহানার মুখ। রেহানার শরীর তির তির কাঁপছে। শাকিলের ঠোঁট নেমে আসে রেহানার ঠোঁটে, আচমকা দুটো শরীর সকল বাধা ও ব্যবধান মুছে একটি সুতোয় এক হয়ে যায়।
অনেকক্ষণ শাকিল আর রেহানা পাশাপাশি শুয়ে থাকে। বড় সংকুচিত আর বিপন্ন মথিত রেহানা নিজেকে নিয়ে কী করবে বুঝতে পারে না। ভালোলাগার অদ্ভুত আবেগে ভেতরটা গলে গলে জল হয়ে যাচ্ছেজ্জবুঝতে পারে জীবনে ভালোবাসা এসেছে; কিন্তু কার সঙ্গে? ভয়ে, জড়তায় বিহ্বল রেহানাকে নিজের দিকে ফেরায় শাকিল, বুঝতে পারে শরীরে কোনো অসুখ নেই, ছিল না। যা ছিল, তাজ্জশরীর আত্মদমনের তীব্র প্রতিক্রিয়া।
আপনি কী করলেন? কুণ্ঠিত প্রশ্ন রেহানার।
তোমার ভালো লাগেনি?
কোনো জবাব দেয় না রেহানা, নিজেকে শাকিলের বড় বুকটার মধ্যে বিন্দু দানার দ্রবণে মিশিয়ে দেয়। একটু একটু কাঁপে নেতানো সুখে, আবেগের পুষ্প রেণুতে দোলে, চাঁদের কণার মতো আপন মনে হাসে, সুখের বিরামহীন মৌন উল্লাসে। রেহানা ভেবে কূল-কিনারা পায়, শরীরের বিন্দুতে বিন্দুতে এত নির্গমনের সুখ থাকে? এমন করে প্রেম হয়? হয় জন্ম অনুরাগের। বুকের মধ্যে গেঁথে যাওয়া এই মানুষটার জন্য খুন হয়ে যেতে পারে চোখের সামনে দেখেছে সুপ্তি আপার অবহেলা। এমন মানুষকে কেন সুপ্তি আপা দূরে সরিয়ে রাখত? বিপন্ন জীবনের ডালপালার ভেতর থেকে জন্ম নেওয়া রেহানা নিজের মনে প্রশ্নই করতে পারে; কিন্তু উত্তর পায় না। কী করে পারে সুপ্তি আপা এমন মানুষটাকে কষ্টে রেখে?
উত্তর দিচ্ছ না কেন?
আপনি বোঝেন না! হালকা কম্পিত স্বরে পাল্টা প্রশ্নে ভালোলাগার অণু ছড়িয়ে দেয় রেহানা। আমি জীবনে এমন সুখ পাইনি।
আমার সঙ্গে থাকবে তো?
আমার স্বামী আছে না?
লোকটা তো তোমাকে কষ্ট দেয়। মারে যখন তখনজ্জ
রেহানা চুপ।
উত্তর দিচ্ছ না কেন?
কী উত্তর দেব? আমি আপনার বাসার সামান্য কাজের মানুষ। আমার তো কিছুই নেইজ্জআপনার স্ত্রী সুপ্তি আপা ফিরে এলে আমাকে আপনি এভাবে ভালোবাসতে পারবেন? আমাকে ফেলে দেবেন তো ...
একটা কঠিন ভয়ার্ত গর্তের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় সামান্য লেখাপড়া জানা রেহানা মরিয়ম জীবনের তিক্ত আর বাস্তব অভিজ্ঞতার নিরিখে। বেজে ওঠে দূর দেশ থেকে পরিচিত ভিডিও কলের গান। সঙ্গে সঙ্গে দুজনে দুদিকে ছিটকে যায়। নিজেকে খানিকটা ঠিক করে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে মোবাইল অন করে শাকিল হাসান, কী খবর তোমার সুপ্তি? অনেক দিন তোমার কোনো খবর নেই।
তুমিও তো ফোন দিতে পারতে? জানো না আমি কত ব্যস্ত দিনরাতজ্জগত কয়েক দিন আমরা ঘুরে বেড়িয়েছি ইউরোপের কয়েকটা দেশ। দৌড়ের ওপর ছিলাম তোজ্জতাই ফোন দিতে পারিনি।
বুঝতে পারছি বেশ উপভোগ করছ। আর ফোন কী করে দেব? তুমিই তো না করেছ ফোন করতে। বলেছজ্জযখন সময় হবে তুমিই ফোন করবে।
তা ঠিকজ্জআসলে আমাদের দেশ আর ইউরোপের কাজের মধ্যে অনেক পার্থক্য। এখানে জীবন সংসার অফিস চলে কাঁটা ধরে ধরে। এক সেকেন্ড এদিক ওদিক হতে পারে না। তবুও ভালো লাগছেজ্জশোনো, তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?
কী সমস্যা?
খাওয়া-দাওয়ার বিষয়ে বলছি। রেহানা ঠিকভাবে রান্না করছে তো? ঘর দুয়ার পরিষ্কার রাখছে? যদি না করে তুমি ধমক দিও।
না ঠিকই আছেজ্জশাকিল এড়িয়ে যেতে চাইছে রেহানার প্রসঙ্গ। আমি প্রায়ই বাইরে খাই নইলে মোহাম্মদপুরে বাবার বাসায় যাই।
তুমি অনেক ভালো শাকিলজ্জগলায় অবিশ্বাস্য দরদ সুপ্তি সুনয়নার। রেহানা পিছনে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে শুনছে শাকিল আর সুপ্তির কথোপকথন। সুপ্তির সঙ্গে আলাপ করছে শাকিল আর আড় চোখে দেখছে রেহানাকে। একটা ত্রিভুজ অনুভূতির আগুন মশাল জ্বলছে রুমের মধ্যে।
শোনো শাকিল, সুইস কর্তৃপক্ষ আমাদের গ্রান্ট আরও ছয় মাস বাড়িয়েছে। দেখো, এই সুযোগ তো জীবনে বার বার আসে না। আর্কিটেক্টের ওপর এই প্রশিক্ষণ দুনিয়ার সেরা। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ থেকে আমাকে বড় বড় তিনটি কোম্পানি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে মেইলে, অনেক বেশি বেতনে ওদের কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার জন্যজ্জসঙ্গে গাড়ি বাড়িজ্জ
বুঝতে পারে শাকিল, হঠাৎ ক্যারিয়ারিস্ট সুপ্তি সুনয়নার এত অনুরাগের কারণ। ভেতরে ভেতরে হাসিতে ফেটে পড়ে শাকিল, আমাকে মরুভূমির বালিয়াড়িতে রেখে তুমি ইউরোপের মধু খাও। তোমাকে দরকার নেই, একজন রেহানাই আমার...
ঠিক আছে, কী আর করা! শেষ করে আসো, বাইলাইন কেটে দেয় শাকিল হাসান।
ঘটনাচক্রে বা জীবনের চাহিদাচক্রে এক জীবনের সঙ্গে অন্য জীবনের আদি অন্ত মিলেমিশে নতুন দিশা বা পথ রচনা হয়। অবিশ্বাস্য হলেও রেহানা মরিয়মের সঙ্গে শাকিল হাসানের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়জ্জসকল বৈপরীত্যকে নির্বাসনে পাঠিয়ে। রেহানা আগের চেয়ে অনেক বেশি সময় দেয় শাকিলের বাসায়। শাকিলও সুখের সন্ধানে দ্রুত চলে আসে বাসায়। শরীর মন সংসার মিলিয়ে জটিল এক যাত্রাপথে দুজনের ক্রমশ যাত্রা চলতে থাকে...। রেহানা মরিয়ম মানুষ, নারীজ্জসুতরাং লোভীও। লোভী কে না মানুষের সংসারে? শাকিলকে ঘিরে ওর স্বপ্নের পরিধি বাড়ে, বড় সাধ জাগে একটা সন্তানের। শাকিল কি একটা সন্তানের মা হওয়ার মহার্ঘ্য সুযোগ দেবে? ধন্য করে দেবে নারী জনম?
দুজনার ক্রম বিহারের মধ্যে একদিন আসে না বাসায় রেহানা। শাকিল হাসান কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। বাসাও চেনে না রেহানার। শুনেছেজ্জএই বাসা থেকে পিছনের দিকের রেললাইন পার হয়ে বস্তির মধ্যে থাকে। গত তিন মাসে একবার জিজ্ঞেসও করেনি শাকিল হাসান। রাতটা কোনোভাবে কাটিয়ে দিলে সকালে আসে রেহানা। মুখ ম্লান। কপালে কাটা দাগ।
কী হয়েছে?
আমাকে মেরে বেহুঁশ করেছে।
কেন?
আমার নতুন শাড়ি, হাতের চুড়ি... এসব দেখে রাগে ...
বুঝতে পেরেছি রেহানা।
এক অনিয়ন্ত্রিত আক্রোশে ফুটতে থাকে শাকিল হাসানজ্জরেহানার গায়ে হাত তুলেছে...। মুষ্টি শক্ত হয়ে যায়; কিন্তু কী করবার আছে আমার? স্ত্রী তো অন্যের... হোক রিকশাঅলা; কিন্তু রেহানার স্বামী। কী করার আছে আমার? আমি কি সুখের ঘাটের নোঙর তুলব? কিন্তু আমি তো ডুবে গেছি। মেয়েটি কেবল আমার শয্যারই সঙ্গী নয়, আমার ভালোবাসার সঙ্গীও। প্রায় মুছে যাওয়া জীবনে মেয়েটি আমাকে অথৈ সুখ দিয়েছে, প্রেমের মধ্যে মাতৃত্বের ছায়া বিস্তারও করেছে, ওকে ছাড়া আমার চলবে না। সমাজ, পরিবার, বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন যা-ই বলুক, আমি রেহানাকে বিয়ে করব।
সুপ্তি সুনয়না পিছনে হাত রাখেজ্জআমি? আমি কোথায় যাব?
তুমি গোল্লায় যাও তোমার ক্যারিয়াস্টিক জীবন নিয়ে। আমি সাধারণ জীবনের আলোয় বেঁচে থাকতে চাই রেহানা মরিয়মকে কেন্দ্র করে। তুমি যাওজ্জ
আমি যাব না। এই সংসার আমার...
সংসার তোমার হতে পারে কিন্তু সংসারের প্রকৃত ধাত্রী তুমি কখনো হয়ে উঠতে পারনি। তুমি মা হতে চাও নাজ্জতুমি আমাকে ভালোবাসো না, আমার অধিকার থেকে আমাকে দিনের পর দিন বঞ্চিত করেছ। তুমি প্রবলভাবে এক আত্মকেন্দ্রিক নীল পাথর.. তুমি যাও...
ধাক্কা মারে সুপ্তি সুনয়নাকেজ্জবাঁচাও বাঁচাও ... একটা আত্মচিৎকার ক্রমশ ক্ষীণ হতে হতে নিচে মিলিয়ে যায়, বারান্দায় দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা কল্পনা করতে করতে চায়ের কাপ হাতে সামনে দাঁড়ায় রেহানা মরিয়ম, দুলাভাই আপনার চা!
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে তাকায় রেহানার দিকে, আমি তোমাকে বিয়ে করব।
কীভাবে সম্ভব? আমি তো একজনার বউ।
ওর কাছ থেকে তোমাকে কিনে আনব। ও দরিদ্র রিকশাঅলা, এক লাখ, দুই লাখ, তিন... পাঁচ লাখ টাকা পেলে ও তোমাকে তালাক দেবে। তালাক দিলে তোমার কোনো আপত্তি থাকবে না তো?
নতুন শাড়ির আঁচল দুই পাটি দাঁতের ফাঁকে কামড়ে ধরে মিটি মিটি হাসে রেহানা মরিয়ম, সুপ্তি আপা আসলে তখন কী করবেন?
যখন আসবে, তখন দেখা যাবে। আর আসতে দেরি আছে। তত দিনে আমি এক বাচ্চার বাবা হয়ে যাব, যাব না? চায়ের কাপ রেখে জড়িয়ে ধরে রেহানা মরিয়মকে। রেহানা হাসিতে উপভোগে উচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ। পরের দুই দিন আসে না রেহানা। আগেই ঠিকানা জেনে লিখে রেখেছিল শাকিল হাসান। ভোরে উঠে শাকিল ছোটে রেললাইনের দিকে। আজকেই রিকশাঅলার সঙ্গে বোঝাপড়াটা করে আসবেজ্জহালারপুত! তুই কেমনে আটকে রাখবি রেহানাকে? তুই রেহানার মূল্য জানিস? রেহানাকে না দিলে তোকে কেটে টুকরো টুকরো করব। জানিসজ্জ
-বন্ধু খুনি আতিকউল্লাহ মানুষ খুন করে এক লাখ টাকার বিনিময়ে!
রেললাইনে আসতেই দেখে, অনেক মানুষের ভিড়। পুলিশও আছে কয়েকজন। রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে পুলিশের দুটি গাড়ি। রেললাইনের পরই বস্তি, আরও ভেতরে ঢোকার আঁকাবাঁকা রাস্তা। সেই ইটের খোয়া বিছানো রাস্তা ধরে আসছে পুলিশের একটা দল। কয়েকজনার হাতে ঝুলছে প্যাকেটবদ্ধ একটা লাশ। আর দুজন পুলিশের হাতে হাতকড়া লাগানো একটা লোক। লোকটার পরনে লুঙ্গিজ্জগায়ে টি-শার্ট, অনেক পুরোনো। টি-শার্টের বুকে বিশ্ব বিপ্লবী চেগুয়েভারার ছবি। মুখে হালকা পাতলা দাড়ি। শরীরটা লম্বা। দলটা গাড়ির সামনে আসতেই টিভির সাংবাদিকরা মাইক্রোফোন হাতে এগিয়ে যায়।
পুলিশ অফিসার জানায়জ্জগত রাতে রেহানার স্বামী রিকশাঅলা মকবুলের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। ঝড়গার বিষয় ছিল, রেহানা নতুন শাড়ি গয়না টাকা কোথা থেকে এনেছে? কে দিয়েছে? রেহানা বলেছে, যে বাড়িতে কাজ করে সেই বাড়ির ম্যাডাম দিয়েছে। মকবুল বলেছে, চল সেই ম্যাডামের কাছে। রেহানা বলেছে, আমি যেতে পারব না। সঙ্গে সঙ্গে রেহানার ওপর ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এবং একের পর এক ছুরির আঘাতে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটে রেহানার।
পুলিশ লাশ, আসামি নিয়ে গাড়িতে ওঠে। গাড়ি চলেও যায়। সাংবাদিকরাও চলে যায় যে যার মতো। বস্তির এবং আশপাশের লোকজন কিছুক্ষণ জটলা করে, চা বিড়ি সিগারেট টেনে চলে যায় কাজে। ফাঁকা রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে শাকিল হাসান, যার পকেটে চার লাখ টাকার কড়কড়ে নোট।