
শরিফা পসুন তার স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে কাবুলে বাস করছেন। আফগানিস্তানের রেডিও প্রোগ্রাম New Home, New Life-এর স্ক্রিপ্ট রাইটার। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য বিষয়ে অধ্যয়ন করেছেন। গল্পটি পশতু থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন জারঘুনা কারগার- অনুবাদ : মাজহার জীবন।
সানজাকে আমি পরের দিন দেখলাম। সে জাতীয় বেতার ও টেলিভিশন ভবনের সামনে একটা ধূসর রঙের কার থেকে নামল। কালো স্কার্ফের সঙ্গে একটা খাকি জ্যাকেট পরা। হাতে কিছু বই আর হ্যান্ডব্যাগ। কাঁধের সাথে তার হ্যান্ডব্যাগটা ঠিকঠাক করে নিল। চশমাটা খুলে কপালের উপর মাথায় রাখল। ভবনে প্রবেশের আগে গত দিনের ধ্বংসযজ্ঞের দিকে তাকাল। শান্তভাবে এবং সতর্কতার সাথে সবকিছু দেখল আর তারপর ভেতরে চলে গেল।
ওয়ারড্রোবটা খোলে। স্কার্ট আর স্যুট-জ্যাকেট বের করে। এরপর দরোজা বন্ধ করে। পোশাক পরে তিন দিকওয়ালা আয়নায় নিজেকে দেখে। চুল আঁচড়ায়। আবার নিজেকে দেখে। নিজেই নিজের প্রশংসা করে। ভাবে দেখতে সে সত্যিই খুব সুন্দর। লম্বা চুল কাঁধে এসে পড়েছে। জানালা দিয়ে বিকেলের সূর্য কিরণে চুলগুলো চকচক করে।
ড্রেসিং টেবিলে রাখা কলমটা তার হ্যান্ডব্যাগে পুরে নেয়। ঘড়ির দিকে তাকায়। বিকেল পাঁচটা। গাড়ির হর্ন শুনে জানালা খোলে। অ্যাপার্টমেন্টের দ্বিতীয়তলা থেকে নিচে তাকিয়ে দেখে। দালানের সিঁড়ির কাছে ধূসর রঙের কার অপেক্ষা করছে। ড্রাইভার তাকে দেখতে পেয়ে হর্নে চাপ দেয়া বন্ধ করে। সানজা চটজলদি হ্যান্ডব্যাগটা ঘাড়ের ওপর নেয়। ঘর থেকে বের হয়ে যায়। করিডর থেকে মাকে ডাক দেয়, “আমি বের হলাম মা। বাইরে আমার জন্য কার দাঁড়ানো।”
তার মা করিডরে ছুটে আসে। তার কাপড়ের হাতা মোড়ানো। হাতে ছুরি। পেঁয়াজ কাটার কারণে চোখে পানি।
সানজা পেছন ফেরে। মাকে অনুনয় করে, “ঘামাইয়ের দিকে খেয়াল রেখো মা! আমি চাই না ও আমাদের কথা শুনে ফেলুক। ব্যালকনিতে তার বাইক নিয়ে ও এখন ব্যস্ত আছে।”
দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে বেরিয়ে পড়ে সে। তার মা তাকিয়ে থাকে। সানজা গাড়িতে উঠে দরোজা বন্ধ করার আগ পর্যন্ত তার নিরাপত্তার জন্য দোয়া করতে থাকে মা।
*
সানজা জাতীয় বেতার ও টেলিভিশন হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে যায়। সেখানে সে সান্ধ্যকালীন চাকরি করে। আর দিনে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী।
ভবনের দ্বিতীয়তলায় করিডরের শেষ প্রান্তে মেকআপ রুম। সেখানে সে সরাসরি চলে গেল। মেকআপ লেডি মরিয়ম রুমেই ছিল। লম্বা গড়ন। কোঁকড়ানো চুল। বাদামি রঙ করা। চশমাটা মাথার ওপর তোলা। চশমার কর্ড দুটো পেছনের ঘাড় অবধি ঝুলে আছে। মাঝখানের আয়নার সামনে দাঁড়ানো। আরেকজন সংবাদপাঠিকার চুলের কালার খুলতে ব্যস্ত সে।
সানজা একটা বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মুখমণ্ডল গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নেয়। তারপর আয়নার দিকে তাকায়। পেপার ন্যাপকিন দিয়ে মুখ শুকিয়ে নেয়। মরিয়ম সাতটার সংবাদপাঠিকার চুল ঠিক করছিল। তাকে জিজ্ঞাসা করল, “আপনার মেকআপ করে দেব, নাকি আপনি নিজেই করে নেবেন?”
উত্তরে সে বলল, “আপনি এখন সানজার চুল ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন, হাতে তেমন সময় নাই। আমার মেকআপ আমি নিজেই করে নেব।”
সানজা সাতটার সংবাদপাঠিকার পাশে গিয়ে বসল। মরিয়ম সানজার পেছনে দাঁড়াল। সানজার নরম চুল স্পর্শ করল। তার পোশাকের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি ভদ্র পোশাক পরেছেন। আপনাকে দেখতে বেশ লাগছে।”
মন্তব্যটা সানজার ভালো লাগল না। সে বলতে যাচ্ছিল যে, সে সব সময় মার্জিত ও উপযোগী পোশাক-আশাকই পরে। এমন সময় তারা কাছেই একটা রকেটের বিকট আওয়াজ শুনতে পেল। সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। আতঙ্কে তাদের চোখ ছানাবড়া। সাতটার সংবাদপাঠিকা কোনোরকমে কথা বলতে পারল। সে ফিসফিস করে বলল,
“আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে এটা খুব নিকটে এসে পড়েছে।”
মেকআপ লেডি মরিয়ম বলে উঠল, “আল্লাহ বাঁচাও আমাদের। এ আক্রমণ যেন আর চলমান না থাকে।”
সানজা মরিয়মের দিকে তাকিয়ে বলল, “যদি জলদি আপনি আমার মেকআপ আর চুল ঠিক করে দিতে পারেন তাহলে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যেতে পারবেন। সাড়ে আটটা থেকে নটা অবধি আমাকে থাকতে হবে।”
সময়টা ১৯৮৫। বিরোধীরা আফগান আর্মির সাথে যুদ্ধে ব্যস্ত। সরকারি ভবন আর প্রতিষ্ঠানে রকেট হামলা চালাচ্ছে। মানুষজন এগুলোকে অন্ধ-রকেট বলে মস্করা করে কারণ একশটার মধ্যে হয়তো এগুলোর একটা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম হয়।
সানজার বুক দুরু দুরু কাঁপছে। আজ সে তার দুই বছরের ছেলেকে চুমু দিয়ে বিদায় নিয়ে আসেনি। এটা করতে গেলে ঘামাই হয়তো তার সাথে আসার জন্য জেদাজেদি শুরু করতো। তাকে কর্মস্থলে নিয়ে আসা সম্ভব না। তাই সে তাকে এভাবে সচরাচর না জানিয়েই কাজে বের হয়ে আসে।
মরিয়ম ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, ‘কেমন দেশ এটা? ওরা আমাদের শান্তিতে থাকতে দেবে না। কীভাবে আমরা কাজ করব আর কীভাবেই বা বাস করব এ রকম পরিবেশে?’
তখন সন্ধ্যা ছয়টা কুড়ি। টেলিফোন বেজে উঠল। তারের টেলিফোন বার্তা এটা। কারণ এ সময় অফিসে সবাই উপস্থিত। মরিয়ম টেলিফোনটা উঠাল। নির্দেশনা শুনে সাতটার সংবাদপাঠিকাকে নিউজরুমের দিকে যেতে বলল। ও জানাল, ‘ওরা বলল খুবই গুরুত্বপূর্ণ খবর। অনেকগুলো বিষয়। এখনই আপনাকে যেতে হবে।’
এ সময় বেতার আর টেলিভিশন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এই নিউজরুম নেতা, কেবিনেট মন্ত্রী এবং তাদের কর্মকাণ্ড প্রচার করে। এর সাথে আরও রয়েছে সেনাবাহিনীর বিজয়ের সংবাদ যারা বিরোধীপক্ষের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। খবর প্রচারের শেষের দিকে যদিও কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদও থাকে। সারা দেশের মধ্যে এ সময় কাবুলের একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল যারা লাইভ নিউজ প্রচার করে।
খবরপাঠিকা হ্যান্ডব্যাগ থেকে তাড়াতাড়ি তার কলম বের করে। আয়নায় নিজেকে আরেকবার দেখে নেয়। আরেক দফা লাল লিপলাইনার লাগিয়ে নেয়। দ্রুত চলে যায় সে। তার দরোজা বন্ধ করার সময় আরেকটা রকেট আঘাত করে। মেকআপ লেডি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বলে, “অবশ্যই এটা একটানা আক্রমণ। আরও রকেট পড়বে এখানে।”
মরিয়ম তার মেকআপ শেষ না করেই চলে যেতে পারে এই ভেবে সানজা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে আসার আগে সংবাদ পাঠিকাদের সব সময় চুল পরিপাটি আর মেকআপ শেষ করে আসতে হয়। মরিয়ম ধাতব চিরুনি তুলে নেয়; সানজার চুলগুলোকে ছোট ছোট অংশে আলাদা করে বিনুনি করে। হেয়ার-ড্রায়ার চালিয়ে দেয়। সানজা শান্ত হয়ে তার নিচে বসা। গরম হাওয়া তার চুলের ওপর বয়ে যায়।
সাতটার সংবাদ পাঠিকা মেকআপ রুমের দরোজা খোলে। তার হাতব্যাগ নিতে রুমে ঢোকে। তার কাজ শেষ করেছে। তাকে নিয়ে যাবার জন্য একটা কার অপেক্ষা করছে। মরিয়ম দ্রুত বলে ওঠে, “আপনার সাথে আমি যেতে চাই। আমরা একই এলাকায় থাকি।”
*
সানজা একা রয়ে যায়। সে মেকআপ রুমের জানালা দিয়ে তাকায়। এখন অন্ধকার। তার একা থাকতে ভালো লাগছে না। তাই মেকআপ রুম থেকে নিউজরুমে চলে যায়। সবার ওপরে সম্পাদকের ডেস্ক। সম্পাদক সাধারণত আট ঘণ্টার শিফটেরও বেশি সময় থাকে। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ অফিস। সম্পাদক থেকে সংবাদদাতা এমনকি সাপোর্ট স্টাফরাও অতিরিক্ত সময় কাজের জন্য ওভারটাইম পায়।
সানজা নিউজরুমে ঢুকে তার সহকর্মীদের সাথে কুশল বিনিময় করে। রুমের ঠিক মাঝখানে রাখা লম্বা ডেস্কের পেছনে সে বসার জন্য চলে যায়। একজন সহকর্মী জানায় তার জন্য সব নোট এখনো লেখা শেষ হয়নি। তবে কিছু কপি রেডি হয়েছে। সেগুলোই সে পড়তে থাকে। ঠিক সেই মুহূর্তে প্রকাণ্ড এক বিস্ফোরণের পর গুঞ্জন ওঠে। এবার রকেট টেকনোলজি ভবনে আঘাত হানে। এটি নতুন ভবন। ঠিক জাতীয় বেতার ও টেলিভিশন ভবনের পেছনে। বিস্ফোরণটা এত জোরে হয় যে, নিউজরুমের জানালার কাচ ভেঙে পড়ে।
তখন শরতের শেষ তবুও ঠান্ডা আবহাওয়া। তীব্র ঠান্ডা হাওয়া নিউজরুমে ঢুকে পড়ছে। একজন দরোজা খুলে আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল, “আপনারা সবাই নিচের ফ্লোরে নেমে যান। আরও আক্রমণের আশঙ্কা আছে! তাড়াতাড়ি করুন, আমাদের সবাইকে এখনই নিচতলায় যেতে হবে।”
সকলে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। চেয়ার থেকে উঠে পড়ে। প্রায় সকলেই তাদের কলম আর কাগজ সাথে নিয়ে নেয়। নিউজরুম থেকে বের হয়ে যেতে থাকে সবাই। সানজা তার নোটগুলো টেবিলে রেখে দেয়। খুব ভীত হয়ে পড়ে। একজন তার নিকটে এসে ফিসফিস করে তার কানের কাছে বলে, “ভয় পাবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
সানজা উত্তর করে, “হাজারটা রকেট দেখেছি আমি। প্রতিদিনই তা আঘাত করে। রকেটে আমি ভয় পাই না। আমি আল্লাহকে ভয় পাই।”
সানজা তার কথা শেষ করতে না করতেই আরেকটা রকেট কাছেই নতুন প্রশাসন ভবনের সামনে আঘাত করে। নিউজরুমের জানালা দিয়ে তাকালে ভবনটার ছাদ দেখা যায়। সানজা কয়েক সেকেন্ড আগে যে চেয়ারে বসা ছিল সেখানে গোলার একটা টুকরা এসে পড়ে। এর মধ্যে কেবল সে নিউজরুমের দরোজা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
এর মধ্যে সবাই চলে গেছে। সানজা দ্রুত করিডরের দিকে যায়। জোরে একটা নিঃশ্বাস নেয়। পড়ি মরি করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়। আটটা বাজতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। সানজাকে লাইভ-স্টুডিওর দিকে চলে যেতে হয়।
স্টুডিওতে ঢোকার আগে সানজা জুতা খোলে। মেটাল কাপবোর্ডে রাখা বড় সাইজের স্যান্ডেল পরে। মেশিনের ক্ষতি হতে পারে এই ভেবে স্টুডিওর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা চায় না কেউ ধুলা নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করুক। সানজা নিউজরুমে নোটগুলো ফেলে এসেছে তাই তাকে শূন্য হাতে প্রবেশ করতে হয়। স্টুডিওর ভেতরে ঢুকে বসার পর তার স্টুডিও-লাইটে গরম অনুভব হয়। এডিটর নিউজ কপি নিয়ে আসে। সানজার হাতে ধরিয়ে দেয়। এখন আটটার নিউজ পাঠের সময়। সানজা কপিগুলো হাতে নেয়ার সময় সামনে রাখা আয়নায় নিজের মুখ দেখে নেয় এবং নিউজ লাইভে যাওয়ার চূড়ান্ত সংকেত শুনতে পায়। এরপর সে নিউজ বুলেটিন পড়া শুরু করে। ঠিক সময়ে পড়া শেষ করে। স্টুডিও সাউন্ডপ্রুফ। বাইরের বিস্ফোরণের কোনো শব্দ প্রবেশ করে না।
*
মেকআপ এবং চুল স্টাইল করা অবস্থাতেই সানজা বেতার ও টেলিভিশন ভবনের সামনে অপেক্ষা করে। অন্য স্টাফরাও দল বেঁধে বিল্ডিং থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। ছোট এবং বড় আকারের কার তাদেরকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। সবাইকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। অনেকে মাথা নিচু করে তাদের কারের দিকে হেঁটে যাচ্ছে যেন এভাবে হেঁটে গেলে তারা রকেট হামলা থেকে বেঁচে যাবে।
একজন ড্রাইভার সানজাকে তাড়াতাড়ি তার কারে উঠতে বলে। সানজা উঠে পড়ে। ড্রাইভার তিন নম্বর ম্যাক্রোরায়ানের দিকে গাড়ি চালানো শুরু করে। এসব আবাসিক এলাকা ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে রাশিয়ানরা নির্মাণ করেছিল। কারটা প্রথম গোলচত্বরে পৌঁছানোর আগেই এক রকেট ওখানে পড়েছে। সানজা পুরুষ, নারী আর শিশুর চিৎকার শুনতে পায়। তার চারপাশে আতঙ্ক আর বিশৃঙ্খলা। তার বুক দ্রুত কাঁপতে থাকে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে যদি নিরাপদে বাড়ি পৌঁছাতে পারে তবে সে এই উপস্থাপনার চাকরিটা ছেড়ে দেবে।
এর আগে সে চাকরিটা কয়েক বার ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু যতবারই এ বিষয়টি নিয়ে ভেবেছে ততবারই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, চাকরি ছাড়া জীবন ধারণ কঠিন ব্যাপার। আর মনে হয়েছে এ চিন্তা তার মৃত্যু চিন্তার মতোই খারাপ।
তারা দ্বিতীয় গোলচত্বরে পৌঁছানোর আগেই আরেকটা রকেট তাদের নিকটে এসে পড়ল। রকেটটা তাদের কারের উপর দিয়ে গিয়ে পড়ল ব্লকের কিনারে। ড্রাইভার ও সানজা দুজনই চট করে মাথা নোয়াল। ভয় ও আতঙ্কে ড্রাইভার প্রায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিল। কিছু সময়ের জন্য থেমে আবার কার চালাতে শুরু করল।
কারটা এতক্ষণে তার ম্যাক্রোরায়ান এলাকায় পৌঁছাল। পুরো রাস্তা ধরে তারা আহত মানুষের আর্তচিৎকার আর সাহায্যের আকুতি শুনতে পেল। কিন্তু সাহায্যের জন্য কাউকে এগিয়ে আসতে দেখতে পেল না।
*
সানজা শেষ পর্যন্ত তার বাড়ি পৌঁছাতে পারল। রাত নটা বাজে এখন। সে জলদি উপরে উঠে তার অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে জোরে দরোজায় ধাক্কা দিল। দরোজা বন্ধ ছিল না। তার মা তার ফেরার অপেক্ষায় দরোজার পেছনে বেশ কিছুক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিল। যখন সে সানজার জন্য দরোজা খুলল, তার চোখ অশ্রুতে ভরে গেল যদিও সেটা সে দেখাতে চাচ্ছিল না।
সানজা তার মায়ের সাথে নিজের ঘরে ঢুকল। ঘামাইয়ের বিছানার কাছে গেল। তখন ঘামাই গভীর ঘুমে। সানজা তাকে আস্তে চুমু দিল, চুল স্পর্শ করল এবং তারপর গভীর এক নিঃশ্বাস নিয়ে তার বিছানায় গিয়ে বসে পড়ল। তার মায়ের মুখে এখন হাসির রেখা। সানজা তাকে জিজ্ঞাসা করল, “ঘামাই কি রকেটের শব্দে ভয় পেয়েছিল, মা?”
“না। ও তখন ঘুমোচ্ছিল। এমনকি এক ফোঁটা নড়েনি পর্যন্ত।” সে বলল।
“আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছিল আমাদের ব্লকের কাছে কোনো রকেট না পড়ে আবার!”
মা মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছিল। সানজা তাকে বলল যে, আজ সে যেখানেই গেছে সেখানেই রকেট তার পিছু পিছু গেছে, “আমি নিজের চোখে দেখেছি আজ। আমি যেই চেয়ার থেকে উঠেছি, এমনকি তখনো নিউজরুমের দরোজার কাছেই পৌঁছতে পারিনি যখন রকেটটা পড়ল। আর একটা গোলা চেয়ারটাকে আঘাত করল। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধান। আমি উঠেছি আর পেছন ফিরে তাকিয়েই দেখলাম চেয়ারটা ভেঙে গেছে এবং তা ধ্বংস হয়ে গেছে।”
তার মা শুনে ভয়ে চিৎকার করে উঠল।
সানজার মা কোনোভাবেই কান্না থামাতে পারছে না। তার কণ্ঠ ঘর জুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সে সানজার কাছে গেল। জড়িয়ে ধরল। তারপর চুমু খেল। সানজা মায়ের বাহুতে শান্তি অনুভব করল। তার মা স্কার্ফের কোনা দিয়ে চোখের পানি মুছল। ঘর থেকে বের হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড পর এক গ্লাস লেবুর জুস নিয়ে ফেরত এলো। সানজা জুস খেয়ে যেন তার শক্তি ফিরে পেল। তাকে বিশ্রাম করতে বলে তার মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
*
তখন রাত এগারোটা বাজে। দূরে কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্স চলাচলে ব্যস্ত তখন। রকেটের শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না। সানজা জানে বিরোধীপক্ষের রকেট শেষ হয়ে গেছে। সে অনুভব করে তারাও নিশ্চয় তার মতোই পরিশ্রান্ত। সে চিন্তা করে তারা এখন ঘুমোবে আগামীকাল নতুন করে আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে। কিন্তু কেউ জানে না পরবর্তী আক্রমণ কোথায় হবে এবং তা কখন ঘটবে।
সানজা শক্ত করে দুই হাত দিয়ে তার মাথা ধরে আছে। তার মন খবর দিয়ে ভরা। সাথে বিস্ফোরণ আর অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। সে ঘামাইয়ের শরীরে লেপ জড়িয়ে দেয় যাতে তার ঠান্ডা না লাগে।
সে তার বিছানার পাশেই রাখা ওয়ারড্রোব খোলে। তার কাপড়চোপড়গুলো এমনভাবে দেখে যেন সে পরার জন্য পোশাক পছন্দ করছে। কিছু কাপড় বের করে আনে। সেগুলো দরোজার সাথে ঝুলিয়ে রাখে। পর্দা টেনে দেয় যাতে বাইরে থেকে ঘরের ভেতর না দেখা যায়। এবার টেলিভিশন ছেড়ে দেয়। তখন মাওয়াশের গান প্রচার হচ্ছিল। গানটা শেষ হওয়ার আগেই বিদ্যুৎ চলে গেল।
সানজা উঠে পড়ল এবং পর্দা সরিয়ে দিল। চাঁদের আলোয় ঘর উজ্জ্বল হয়ে উঠল। টেলিভিশনের সুইচ বন্ধ করল এবং বিছানায় গা এলিয়ে দিল। কিন্তু ঘুম এলো না। ঘামাইয়ের সুন্দর মুখ চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। ঘুমের মাঝে তাকে ফেরেস্তা বলে মনে হচ্ছে।