বোরকার আরেক ভূমিকা

লায়লা আল-ওসমানের জন্ম ১৯৪৫ সালে, কুয়েত শহরে। এবং এখনো তিনি সেখানেই বাস করছেন। তার জন্মের পর তার মা তাকে জানালা দিয়ে ছুড়েই ফেলে দিচ্ছিলেন প্রায়, কারণ তিনি পুত্র সন্তান চেয়েছিলেন। শেষে, এক সেবিকা সদ্যোজাত লায়লাকে রক্ষা করেন।

বড় হয়ে লায়লা যেসব লেখা লেখেন সেসবের অনেকগুলোই এই ঘটনার দ্বারা প্রভাবিত। তিনি তার শৈশবের বাড়িটিকে ঠান্ডা এবং তার মা-বাবাকে অত্যন্ত কঠোর বলে বর্ণনা করেছেন। বাইশ বছর বয়সে স্থানীয় খবরের কাগজে সমাজ ও সাহিত্য বিষয়ে নিজের নানা পর্যবেক্ষণ আর মন্তব্য দিয়ে তিনি তার লেখালেখি শুরু করেন। তার সুদীর্ঘ জীবনে তিনি ৯টি উপন্যাস, ১৪টি গল্প-সংকলন আর অসংখ্য সংবাদবিষয়ক আর্টিকেল রচনা করেছেন। তিনি ১৯৯৫ সালে বিচার নামে আত্মজীবনীমূলক একটি প্রবন্ধ রচনা করেন; গত শতকের আটের দশকে লেখা তার একটি উপন্যাস ‘প্রস্থান’-এ কথিত অশ্লীলতার জন্য কুয়েতি ইসলামপন্থিরা তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায় এবং তাকে দুই সপ্তাহ কারাবাস করতে হয়। ‘বোরকার আরেক ভূমিকা’ গল্পটি তার কৃষ্ণ অবরোধ নামের ছোটগল্প সংকলনের অন্তর্ভুক্ত ‘Another Role for the Abaya’-র বাংলা অনুবাদ। লায়লা তার সাহিত্যকর্মে সাধারণত উত্তম পুরুষভিত্তিক বর্ণনা আর ফ্ল্যাশব্যাক ব্যবহার করে থাকেন। এবং তার বর্ণিত নারীদেরকে স্বাধীনতা ও তাদের একটি নিজস্ব পরিসরের সন্ধানে ব্যাপৃত দেখা যায়। বক্ষ্যমাণ গল্পে এক নিষ্ঠুর পিতাজ্জযিনি তার অনিচ্ছুক কন্যার ওপর বোরকা চাপিয়ে দিচ্ছেন এবং সুপার মার্কেটের পাহারায় থাকা ইরাকি সৈনিকের মধ্যে সম্পর্কটি একটি পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর প্রিজমের মাধ্যমে আমাদের সামনে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। গল্পটি মিরিয়াম কুকের ইংরেজি থেকে নেওয়া। অনুবাদ : জি এইচ হাবীব

বহুদিন ধরে ফেলে রাখা আলমারিগুলো খোলার সময় আমার হাতটা আমার হৃদয়ের মতো কাঁপছিল। একটা পুরোনো বাক্সের খোঁজে হাতড়ে ফিরছিল হাতটা, আর সেই বাক্সে ছিল আমার শত্রু। আমাদের শত্রুটা ঠিক সেই দিন থেকে যেদিন আমি আমার প্রথম গোলাপ কুঁড়ি আর ডালিমের উদগম দেখে খুশি হয়ে আমি নিজেকে আমার বাবা আর সেই কুৎসিত কালো জিনিসটির সামনে নিজেকে আবিষ্কার করেছিলাম। তিনি আমার বিরক্তি আর বিষণ্ণতা লক্ষ ক’রে রাগে গরগর ক’রে বলে উঠলেন, ‘তুই বড় হয়েছিস। তোকে এটা পরতে হবে।’ 

সেই রাতে আমি কেঁদে ভাসালাম। আমার স্কুলের ব্যাগটার পাশে স্তূপাকৃতি হয়ে থাকা জিনিসটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। মনে হচ্ছিল ছিঁড়ে টুকরো টুকরো ক’রে ফেলি, অথবা দাঁত দিয়ে কুটি কুটি ক’রে কাটি ওটাকে, যেমন ক’রে রাতের বেলা ইঁদুর আমার কাঠের দরজাটাকে দাঁত দিয়ে কাটে, কিন্তু আমার বাবার মুখটা সেই কালো জিনিসটার মাঝে এসে দাঁড়াতে আমি নিজেকে সামলে নিয়ে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়লাম। স্বপ্ন দেখলাম আমি একটা পোকা হয়ে গেছি।

পরদিন সকালে সেটা যখন আমি ওটা পরলাম মনে হলো একটা কাফনের কাপড় যেন আমার মৃত্যু ঘোষণা করছে। স্কুলের ফটকে পৌঁছতে পৌঁছতে আমি আমি কাপড়টায় হাজারবার হোঁচট খেলাম। আমার স্কুলের বন্ধুরা খুব অবাক হলো, এবং আমাকে দেখতে কেমন লাগছিল তাই নিয়ে তারা খুব মজা করল।

*****

জিনিসটা থেকে নিজেকে মুক্ত করার পর বিশ বছরেরও বেশি কেটে গেছে, আর এখন আমি ক্রমবর্ধমান ঘৃণা নিয়ে ওটা খুঁজছি। আমার শৈশব আর আমার সুন্দর, দুমড়েমুচড়ে যাওয়া যৌবনের দুর্গন্ধ ভুর ভুর-করা নানা জিনিসপত্রের মধ্যে ওটাকে দলা-মোচড়া পাকানো অবস্থায় খুঁজে পেলাম। টেনে ওটাকে বের ক’রে শরীরের জড়িয়ে নিলাম, যেন আমি তখনো সেই ভেড়ি-ই রয়ে গেছি যেটাকে পুরুষের নজর থেকে তার স্তনজোড়াকে রক্ষা করতে হয়। দরজার দিকে ছুটে গেলাম। সেটা খুলতে না খুলতেই লোকটা লাফ দিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন।

‘চললি কোথায়?’

‘বাইরে যাচ্ছি।’

তিনি দরজা আটকে দিলেন; মনে হলো একটা সমাধিপ্রস্তর এসে পড়ল আমার লাশের ওপর।

‘আজ নয়।’

আমি চিৎকার ক’রে বলে উঠলাম, ‘তিন দিন হয়ে গেছে। আমাকে বের হতে হবে।’

তিনি আমাকে থামাবার চেষ্টা করলেন। মনে হলো হঠাৎ একটা শক্তি এসে ভর করেছে আমার মধ্যে। আমি তাকে সজোরে ধাক্কা দিলাম। আমার ক্রোধ আর একগুঁয়েমির খণ্ডগুলোকে জড়ো করার চেষ্টায় তিনি আমাকে জাপটে ধরলেন। কাজেই আমি আবার চেঁচিয়ে উঠলাম।

‘আমি বাইরে যাচ্ছি।’

তিনি দরজা আটকে দাঁড়ালেন, আমি সবলে তার বুকে আঘাত করলাম; আমার চিৎকার আরও জোরালো হলো। আমার শক্তির কাছে হার মেনে তিনি সরে দাঁড়ালেন, ‘তোর এই পাগলামির জন্যে তুই-ই দায়ী থাকবি।’

**** 

আমি দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। গাড়িতে পৌঁছে স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে বসার আগে আমি আবায়ার প্রান্তে পা বেঁধে বার কয়েক হোঁচট খেলাম। হুইলটার ওপর মাথাটা ঠেকালাম একটু। হঠাৎ ক’রে আমার মনে হলো আমি আমার মা-বাবাকে হারিয়েছি, এবং অনুভূতিটা এতই প্রবল যে সেটা আমার হাড়ের মধ্যে ঢুকে গেল। আমার দেশটা কি মরে গেছে? সব কিছু কি মরে গেছে? আমার বাগদানের কথা মনে পড়ে গেল, বাড়িতে সেদিন সব সংস্থান শেষ হয়ে গিয়েছিল, এবং আমরা সেটা সুটকেস দিয়ে ভরেছিলাম। রইল না আর কিছুই, কেবল অজানা ছাড়া, যার অলিতে গলিতে আমরা কোনো এক প্রেম নগরের প্রাচীন মধুর স্মৃতি টেনে নিয়ে বেড়াই।

প্রধান সড়কে ঢোকার পর গাড়িগুলো দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম, কিছু বিধ্বস্ত, অন্যগুলো পাগলের মতো চারদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে ট্রাফিক বাতি উপেক্ষা করে, সেগুলোর মধ্যে কিছু ছিল এক কোণে, অন্যগুলো উপড়ে পড়ে আছে। এক অদ্ভুত হই হট্টগোল। আমার শহরের মুখটা এক নিঃসঙ্গ বিধবার মুখের মতো পাণ্ডুর। সব কিছু ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। সবগুলো মুখে কালো অবরোধ। দাড়ি, নাকের কাছে আটকে থাকা অশ্রুভেজা মুখাবরণ। বিষণ্ণতা এসে ভর করেছে বোরকাগুলোতে। অজ্ঞাতপরিচয় লোকজন কালো মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, হাতে তাদের এমনকি আরও কালো কালো অস্ত্র। অবরোধের পর অবরোধ, অথচ আগে সেখানে সেরকম কিছু ছিল না। সেই সব মুখ যেগুলোর দিকে আমি তাকাতেই সাহস করি না, পাছে আমার ঘৃণা আমাকে জয় ক’রে ফেলে আর আমি আমি থুতু ছুড়ে মারি, মারা যাই। যেসব শব্দবন্ধ গতকালও কোমলভাবে স্পর্শ করেছিল আজ তা-ই কানের পর্দা আর হৃদয়ের চারপাশ ঘিরে থাকা সুরক্ষা আবরণ ছিন্ন করে ফেলছে। অদ্ভুত সব প্রশ্ন, মর্যাদার প্রতি তাচ্ছিল্য/মর্যাদার অবমাননা, অশ্রু, আর বিষণ্ণতার চিহ্ন। 

*****

এটাকে আমার শহরের মতো মনে হচ্ছে না। আমার কাছে এ এক আগন্তুক। আমার চোখের সামনেই এটা এমন একটা চোখে পরিণত হয়েছে যে চোখ কাঁদছে আর আমি সেটার অশ্রু পান ক’রে সেটাকে আনন্দে পরিণত করার জন্য আকুল হয়ে আছি; কিন্তু আনন্দ পালিয়ে গেছে। আছে কেবল মরণ, এবং যে কোনো মুহূর্তে সেটা এসে পড়তে পারে। তার ক্রুদ্ধ স্বর আমার কানে বাজছে, ‘পাগলি, মরবি তুই!’ 

আমি, যে কিনা এই শব্দটির ধ্বনিটিকেই ঘৃণা করি, সেই আমি আকুল হয়ে নিজের মৃত্যু কামনা করলাম। কেবল হতাশাই এখন বিজয়ী। এখন মরে গেলে হয়তো আমি এই তিক্ত বাস্তবতা ভুলে যেতাম।

কালো সড়কটি আমাকে অবরোধগুলোর সঙ্গে, জিজ্ঞাসা আর অনুসন্ধানের সঙ্গে যুক্ত ক’রে দেয়। আমি কো-অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশনটা দেখতে পাই, কিন্তু সেখানে যাওয়ার পথ বন্ধ। মোড়ের পাশে গাড়িটা দাঁড় করাই। হাঁটতে শুরু করি, আর যে বোরকাটা আমার শরীরের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেনি সেটা পত পত করে নড়তে থাকে। ভয় হলো ওটা না ছিঁড়ে যায়, চিৎকার ক’রে ওঠে আর তারপর সেটা থেকে একটা অদ্ভুত গন্ধ বেরোয়। দূরে বন্দুকের গুলির শব্দ। মৃত্যু কামনা করি আমি। আমি কো-অপারেটিভের দিকে মুখ ফেরাতে আমার পিঠ সেই অজানার দিকে উন্মুক্ত হয়ে যায়। স্কোয়ারে পৌঁছাই। একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখে পুরনো শহরে আশুরার সময়ের স্কোয়ারের কথা মনে পড়ে গেল যখন সেটা বিষণ্ণতা আর অন্ধকারে বেষ্টিত থাকে। অপেক্ষমাণ নারীদের ভিড় ভয়ংকর। শিশুদের অপাববিদ্ধ মুখে আতঙ্কের হলুদ কাঁটা রুয়ে দেয়া। তাদের চোখের প্রশ্ন অনূদিত হতে, শ্বাস নিতে ভয় পায়, ফলে তারা মারা যায়। শোক। নীরব প্রার্থনা। বেহেশতের ফটক খোলার জন্য ধৈর্যশীল অপেক্ষার লাইন, আর সেই ফটকগুলোর পাহারায় রয়েছে মৃত্যুদূতের মতো শান্ত্রীরা।

ধৈর্যশীল সব হৃদয়। ধৈর্যশীল অসংখ্য পা। বিনা অপরাধে খুন হওয়া এক সহস্র হাসান ও হোসেন। কেউ কোনো চিৎকার করে না, কোনো তরবারি ওঠায় না। স্রেফ নীরব কান্না। আমার দুঃখের আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরিত হয়। আমার বিলাপ আর্তনাদে পরিণত হয়। আমারে কাছে থাকা এক বৃদ্ধা বলেন, ‘মা, কেঁদে কোনো ফায়দা নেই। ঈশ্বরের দিকে মন দাও।’ 

তার চোখের পরাস্ত রং আমার যন্ত্রণা বাড়িয়ে দেয়, তার ঠোঁটজোড়ার শুষ্কতা আমাকে ইন্দ্রবারুণী বা রাখাল শসার (colocynth) স্বাদ অনুভব করিয়ে দেয়। শিশুদের কাঁপুনি সেই ছোট্ট মেয়েটিকে ফিরিয়ে আনে যে মোটা এক লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা আমার বাবার ক্রুদ্ধ কণ্ঠের সামনে থরথর ক’রে কাঁপছিল, ‘মারটা ব্যথা দেবে ঠিকই, কিন্তু সেই সাথে ভালো একটা শিক্ষাও পাবি তুই।’ 

‘আমরা কীসের জন্য অপেক্ষা করছি?’ 

এক নারীর ভোঁতা কণ্ঠ আর একটা জবাব যেটা অবরোধগুলো ভেদ ক’রে হৃদয়ে ঢুকে যায়। ‘ওদের সৈন্যরা ভেতরে লুটতরাজে ব্যস্ত, আর আমরা হচ্ছি মালিকদের কুকুর, খুদকুঁড়োর জন্য বসে আছি।’

খুদকুঁড়ো! আমি তাহলে বাসায় কী নিয়ে যাব? সাধারণত আমি আমার দরকারি জিনিসপত্রের একটা ফর্দ তৈরি করি, কিন্তু আজ ফর্দের কোনো অর্থ হয় না, কারণ আজ আমরা খুদকুঁড়ো যা-ই পাই তাই আমাদের দরকার। বাসায় কোনো খাবার-দাবারের সংস্থান নেই। দুর্ভিক্ষ আসছে। 

বৈরুতের সবচাইতে খতরনাক অগ্নিকাণ্ড কল্পনা করি আমি। বোমাবর্ষণকালের আতঙ্ক। শিশুরা আশ্রয়ের খোঁজে ভেঙে-পড়া দেয়ালের পাশে বা জং-ধরা পানির পিপার দিকে দৌড়ে যায়। মৃত্যু। গ্রাফিতি আঁকা দেয়ালগুলো জুড়ে রক্তের ছোপ। ভাগাড়, মাছি আর আর অনাহারক্লিষ্ট বৃদ্ধ লোকজন খুদকুঁড়ো খোঁজে। 

আমার স্মৃতির গভীর থেকে আমার কাছে তার কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘সব কিছু নষ্ট হতে পারে। ক্যানের জিনিসগুলো বেহতর।’ 

আমি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো পেয়ে যাই : পানি, ক্যান, চিনি, দুধ, বিশেষ ক’রে বাচ্চাদের দুধ। বৈরুতের শিশুরা পান করার মতো দুধ না পেয়েই ঘুমিয়ে যায়। আমি গুঙিয়ে উঠি। শব্দটা কোত্থেকে আসছে তার খোঁজে সে গলা বাড়িয়ে দেয়। আমার দিকে এগিয়ে এসে সে নিষ্ঠুর গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কুত্তি, এত চিৎকার কিসের জন্য?’

‘আমাকে গালি দিও না, বাবা।’ 

‘দরকার মনে হলে আমি তোর মাকেও গালি দেব? তোর কী তাতে? বল!’ 

অবসন্ন আমি আমার পাণ্ডুর মুখটা তার দিক থেকে সরিয়ে নিলাম। সে অভব্যের মতো তার হাতটা বাড়িয়ে দিল সেটার লম্বা লম্বা নখসহ, আর আমার মুখটা ঝাঁকি দিয়ে আবার নিজের দিকে ফিরিয়ে আনল; তার দুই চোখে আমি অশুভকে দেখতে পেলাম। ‘লাইনে দাঁড়াতে ভালো লাগে না বুঝি?’

(প্রথমে) ভয় পেলেও, খানিকটা সাহস ফিরে এলো আমার। ‘আমরা লাইনে দাঁড়াতে অভ্যস্ত না।’ 

তার হলুদ চোয়াল ফাঁক হলো। ‘আমরা তোমাকে একটু নিয়ম-শৃঙ্খলা শেখাব।’

নারীরা এই সুযোগের সদ্ব্যবহার ক’রে তাকে দরজা থেকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সামনের দিকে ছুটে গেল। এক ঝাঁক বুলেট, দুই বার চেঁচিয়ে উঠল লোকটা। 

‘কোনো বিশৃঙ্খলা নয়। না হলে কেউই ঢুকতে পারবে না।’ 

বুলেটের হাত থেকে বাঁচতে আমরা মাথা নিচু ক’রে ফেললাম ।

*****

ব্যাগ নিয়ে সৈন্যরা বেরিয়ে এলো, আর আমরা স্রেফ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম চুরিটা। তারা যখন জিনিস-পত্রের ওপর ঝুঁকে পড়ে একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করছিল কীভাবে সেগুলো ব্যবহার করতে হয় তখন তাদের একজনের কণ্ঠ আরেকজনের কণ্ঠের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। ওরা জানত না সেগুলো কী, এবং আগে এ ধরনের কোনো জিনিস তারা দেখেওনি। যা খাওয়া উচিত নয় তাই খেতে যাচ্ছিল ওরা। ওরা যদি সব কিছু লুট করতে থাকে তাহলে ক্ষুধা আমাদের শেষ ক’রে ফেলবে।

লাইনটা খুব ধীরে ধরে এগোচ্ছিল। প্রতিটি পদক্ষেপ পেছনে লজ্জা, প্রার্থনা, আর মিনতি ফেলে যাচ্ছিল।

*****

দরজাটা খুলে গেল, আর আমরা ছুটে ভেতরে ঢুকে গেলাম। সে এক ভয়ংকর দৃশ্য। আমরা ইঁদুরের মতো ছুটে গেলাম বেশিরভাগ খালি তাক বরাবর এবং পড়ে যাওয়া যেসব পণ্যের ভেতর থেকে তরল পদার্থ বের হয়ে পড়েছিল সেগুলোর মধ্য দিয়ে। যা রয়ে গিয়েছিল তার সবগুলোতেই আমাদের হাতের ছোঁয়া লাগল। অন্য কোনো কিছুর দিকে ভ্রুক্ষেপ ছিল না আমাদের। যতটুকু পারলাম নিয়ে নিলাম আমি। সবুজ। শুকনো। কাজে লাগতে পারে এমন যে কোনো কিছু। দুধ আমাকে বাচ্চা দুটোর কথা মনে করিয়ে দিল। উন্মত্তের মতো চারদিকে তাকালাম আমি। তোবড়ানো একটা ক্যান খুঁজে পেলাম। কিছু যায় আসে না। তারপর আরেকটা। একটা হাত আমাকে থামিয়ে দিল।

‘আরও নিন।’

‘অন্য আরও বাচ্চা আছে, তাদেরও প্রয়োজন আছে।’

‘ঠিক বলেছেন। কিছু ময়দা নিন।’

‘ময়দা দিয়ে কী করব?’

‘ঘরে রুটি বানাতে হতে পারে।’

*****

অতীতের সুগন্ধ। পাম পাতা পোড়ানো আগুনের ওপর রুটির কালো তাওয়াটা পুড়ছে, আর আমার ননদ ময়দার একটা গোল তাল বানাচ্ছে। সে সেটাকে টেনে সমান ক’রে ছড়িয়ে দিচ্ছে। সেটার ওপরে খানিকটা তেল লাগিয়ে আমাকে সেঁকতে বলে। কাঁপতে কাঁপতে আমি বলি. ‘আমি তো জানি না কী ক’রে করে। একটা গামলায় পানি মেশানো ময়দা নিয়ে আমার ননদ আমাকে ঠেলে দেয় :

‘তাহলে শিখে নেন। একদিন হয়তো আপনাকেই রুটি সেঁকতে হবে।’

আমি সেঁকলাম। গরম রুটির তাওয়াটা আমার হাত পুড়িয়ে দিল। ফোস্কা পড়ে গেল । শেখা হলো।

*****

আমি মহিলাটির দিকে তাকালাম : ‘খানিকটা ময়দা কোথায় পাব?’

সে তার নিজের জিনিসপত্রের ভেতর হাতড়ে একটা ব্যাগ বের করে। ‘পাবেন না। এটা নিন।’

তার এই কাজ দেখে আমার কান্না পেলো। আমি আমার চোখ দিয়ে তার এই বদান্যতা গ্রহণ করলাম। করিডরটা জুড়ে কেবল আবায়া, বাচ্চাকাচ্চা, আর সমস্ত জিনিসে ভরা কার্ট। এই কো-অপারেটিভে সবসময়ই বেশি বেশি জিনিসপত্র থাকে; কিন্তু আজ সেটা একরকম খালি। 

বের হওয়ার জায়গায় আরেকটা লাইন। সেটা রক্ষার দায়িত্বে থাকা, লুট করতে থাকা সৈন্যদের কুনজর। চাপা কান্না শোনা যাচ্ছে. এক শিশু ভিক্ষা করছে : আমাকে কিছু চকলেট দাও, কিছু মিষ্টি, কিছু চুইং গাম।’

কিছু ইচ্ছার প্রবাহ : মিষ্টি, চা, চিনি, দুধ। কে জানে কাল কী ঘটবে? আমি আমার সামনের কার্টের দিকে তাকাই। কিটক্যাটের কিছু গলে যাওয়া বার। সাহস সঞ্চয় ক’রে জিজ্ঞেস করি : চকলেটটা কোথায় পেলেন? 

তিনি আমাকে সোহাগভরে দুটো বার দিতে চাইলেন : ‘এই যে, নিন।’

সেগুলো ছোট্ট দুই বাচ্চার মুখে পুরে দিতে ইচ্ছে করলেও আমি ফিরিয়ে দিলাম। 

‘না, ঠিক আছে। ওগুলো আপনার। কোথায় পাওয়া যাবে একটু বলুন।’

‘পাবেন না। কাজেই নিন, খান।’

যে মুখগুলো অল্প বয়সে তিক্ততার স্বাদ পেয়েছে সেই মুখে যা পুরে দেবার স্বপ্ন দেখি তাই চট ক’রে নিয়ে নিলাম। দেখলাম নারী পুরুষ জিনিস অদলবদল করছে। আমার বিষণ্ণতা সত্ত্বেও এমন একটা মুহূর্তে মানুষকে উদার হওয়ার সক্ষমতা দেখে আমাকে অবাক করে। সবারই সব কিছু দরকার, কিন্তু তারপরও তারা ভালো বেসে এবং সহজেই একে অন্যকে নানা জিনিস দিতে চাইছে। আমার মনে হয়, আমরা একটাই পরিবার, যে কথাগুলো আগে ফাঁপা ছিল। সেই ঘৃণ্য দখলদারিতার প্রথম দিনগুলোতে এই মনোভাবটাই মূর্ত হয়ে উঠেছে। 

নিজেকে শক্তিশালী বলে মনে হয় আমার। আমি আমার অবমাননার অনুভূতিগুলো দুমড়ে ফেলে আমার মানুষদের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। একে অপরের বোঝা বইতে সাহায্য করতে করতে যেখানে গাড়িগুলো দাঁড় করানো ছিল সেখানে চলে আসি। টেলিফোন নম্বর আর ঠিকানা আদান-প্রদান করলাম, আর প্রত্যেকেই প্রত্যেককে দাওয়াত দিতে থাকলাম।

‘যদি কিছু আপনাদের দরকার হয়।’

‘ওগুলোকে জবাই করা দরকার।’

ভীতি

‘শশশ! কুকুরের কান ওদের।’

এই অগ্নিপরীক্ষা আর শোক সত্ত্বেও তরুণদেরকে বেশ উৎফুল্ল বলে মনে হয়। পদদলিত হওয়ার আগে নতুন আশাগুলো ব্যানারের মতো পতপত করে উড়তে থাকে। লাইন আর ভয়ার্ত অপেক্ষার চার ঘণ্টা আমি ভুলে যাই। কিনে আনা জিনিসগুলো গাড়ির ট্রাংকে ভরার সময় আমি কিটক্যাট রাখা ছোট্ট থলিটা আলাদা করে রাখি আতঙ্ক সত্ত্বেও বাচ্চাদের সুখী মুখগুলো কল্পনা ক’রে। ইস্পাতের চুল্লিটার ভেতরে ঢুকে রওনা হয়ে গেলাম।

*****

দুটো ব্যারিকেড। তিনটে। প্রশ্নব্যূহটা সহ্য করে গেলাম। আমি স্রেফ ওখানে যেতে চাই, কিন্তু সামরিক বাহিনীর একটা বাহন রাস্তা আটকে রেখেছে। থেমে গেলাম। দুজন পুরুষ বেরিয়ে এলো। তাদের একজন আদেশ করল :

‘ট্রাংকটা খুলুন।’

আমার দম বন্ধ হয়ে গেল। আদেশ অমান্য করতে পারলাম না। রিলিজ বোতামে চাপ দিলাম। ট্রাংকটা খুলে গেল, এবং একটা কর্কশ গলা শুনলাম : ‘কুত্তার বাচ্চাদের কাছে সব কিছুই আছে।’

দুজনেরই মাথা ট্রাংকের ভেতর। আনন্দোল্লাস। সশব্দ হাসি। পাশের আয়নাগুলো দিয়ে দেখলাম ওরা ব্যাগগুলো নিয়ে গেল। উত্তেজিত হয়ে আমি দরজা খুলতেই ওদের একজন তার অস্ত্রটা নাচাতে নাচাতে বাহন থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল। দরজাটায় একটা লাথি মেরে আমার পা প্রায় ভেঙেই দিচ্ছিল।

‘কোথায়?’

আমার শক্তি উবে গেল, এবং আমার অবমাননা ফিরে এলো। 

‘দেখুন, এই জিনিসগুলো আমার পরিবারের জন্য।’

‘খড় খাও, আর একদম নড়াচড়া কোরো না।’

আমার বুকের ভেতর দিয়ে আগুনের একটা তরঙ্গ বয়ে গিয়ে চোখ দিয়ে অগ্নিশিখা হয়ে বেরিয়ে এলো।

ট্রাংকের ঢাকনাটা দড়াম ক’রে বন্ধ করে দিল সে। আমি দোয়া করলাম লোকটা যেন কিটক্যাটের ব্যাগটা না দেখে। লোকটা গাড়ির পেছন দিকে সজোরে চাপড় মারল। 

‘যাও। গাড়ি ছাড়ো। 

গাড়ি চলতে থাকল, হতাশার কারণে ধীরে ধীরে। রিয়ারভিউ মিরর দিয়ে ওদের দিকে তাকালাম। ওদের একজন কিটক্যাটের একটা বার নাড়ছে আর মুখে পুরছে। আমি আমার রাগ দমন ক’রে সেটা এক্সিলেটরের ওপর চাপিয়ে দিলাম। বাড়ি ফেরার আগে পাঁচটা ব্যারিকেড পার হলাম। আমার প্রত্যাবর্তনের ভয়ার্ত চোখগুলোতে আনন্দ দেখা দিল। ছোট্ট দুজন আমার ওপর আছড়ে পড়ল : ‘চকোলেট এনেছ আমাদের জন্য?’

‘ওরা সব নিয়ে গেছে।’

আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম। 

ওরা আমার দুপাশে এসে দাঁড়াল। নিজেদের হৃদয় দিয়ে ওরা আমার বিষণ্ণতাকে আলিঙ্গন করল। আর ওদের আলিঙ্গনে আমি মুহূর্তের মধ্যে সেই বালিকা হয়ে গেলাম যার পুনর্জন্ম ক্যান্ডি দিয়ে উদ্যাপিত হচ্ছিল। 

-

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh