Logo
×

Follow Us

ঈদ সংখ্যা

শৈশবের ঈদে আয়োজন কম ছিল, আনন্দ ছিল বিশাল

Icon

মামুনুর রশীদ

প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৩, ১২:৩২

শৈশবের ঈদে আয়োজন কম ছিল, আনন্দ ছিল বিশাল

মামুনুর রশীদ। ছবি: সংগৃহীত

মামুনুর রশীদ। একজন দেশবরেণ্য নাট্যাভিনেতা, নাট্যকার বা লেখক-এসব অভিধায় তার পরিচিতিকে সীমাবদ্ধ করা যাবে না। তিনি একদিকে একজন মুক্তিসংগ্রামী, অন্যদিকে একজন রূপান্তরের সমাজ সংগঠক। তার কাজের মধ্যে সমাজ বিপ্লবের চেতনার ছাপ রয়েছে। কোনো নির্দিষ্ট দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তিনি তার চর্চাকে নিজের মতো করে রেখেছেন।

মুক্তভাবে চলে তার লেখালেখি, নাটক এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনে তার চিন্তা বিনিময়। সাম্প্রতিক দেশকালের ঈদ সংখ্যায় তিনি বলেছেন তার শৈশবের ঈদ নিয়ে। গ্রন্থনা করেছেন দীপংকর গৌতম।

আজকের ঈদের সঙ্গে তখনকার ঈদের তুলনা করা যাবে না। আজকের সমাজ ও সামাজিকতার সঙ্গে সেদিনের ঈদের পার্থক্য বিশাল। এই পার্থক্য নিরূপণ করতে গিয়ে দেখি সেদিনের সমাজের সঙ্গে আজকের সমাজের বিশাল পার্থক্য রয়েছে এবং তা হলো-একটি সরল স্বাভাবিক সমাজ অন্যটি ভোক্তা সমাজ। আমাদের সরল সহজ স্বাভাবিক সমাজ তখন, আজকের মতো এত চাকচিক্য, এত গ্ল্যামারসর্বস্ব ছিল না। আমার শৈশব কেটেছে গ্রামে। তখনকার গ্রামীণ সমাজ এত সরল-সহজ ছিল যে আজ তার বর্ণনা করাও কঠিন। গ্রামীণ সেই সমাজে ঈদের আনন্দে এত বেশি সমারোহ বা ঘনঘটা কোনোটাই ছিল না। ২৯ বা ৩০ দিনের রোজা পালনের পর আকাশে যখন বাঁকা চাঁদ দেখা যেত তখন আনন্দের জোয়ার বইত সহজ-সরল গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে। 

চাঁদ দেখা গেছে শোনার পরে আমাদের আনন্দেরও সীমা থাকত না। ওই দিনের ইফতার হতো অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু আলাদা। শিশু-কিশোরদের হাতে থাকত নতুন জামা-জুতা। এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যাওয়া আসার মধ্য দিয়ে আনন্দের প্রবাহটা ছুটতে 

থাকত। বিশেষ করে কোনো না কোনোভাবে ঈদটা যদি মামাবাড়িতে হতো আর সময়টা যদি থাকত শীতকাল-সেই আনন্দটা হতো ঈদের সেরা উপহার। তখন টেলিভিশন ছিল না। তবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো, বিশেষ করে নাটক। ঈদের ছুটিতে শহর থেকে সবাই গ্রামে আসত। রোজার মাঝামাঝি থেকে হারিকেন জ্বালিয়ে রিহার্সেল শুরু হতো স্কুলঘরে। সাধারণত ঈদের পরের দিন নাটক মঞ্চায়িত হতো। ওটাই আমাদের জন্য ছিল প্রধান উত্তেজনা।

ঈদের দিন নতুন জামা-কাপড় পরে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়া এবং কোলাকুলি করা ছিল আনন্দের আরেক ধাপ। ঈদের দিন আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি গিয়ে হইহুল্লোড় করে, সেমাই, পোলাও, কোর্মাসহ নানা খাবার খেয়ে বিকেলে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। রাতের খাবারের আকর্ষণটা আর থাকত না। 

ঈদকে কেন্দ্র করে শুধু নাটকই নয়, নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। গানের অনুষ্ঠান তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এলাকার শিল্পীরা এই অনুষ্ঠানে গান করত। সেখানে মুখ্য গান ছিল নজরুল সংগীত-‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। 

৫০-এর দশকে আজকের মতো গ্রাম্যজীবনে অর্থের প্রাচুর্য আসেনি। বিত্তবান মানুষের সংখ্যা ছিল কম। মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত এবং একেবারে সম্বল বিত্তহীন মানুষ গ্রামে বসবাস করত। তখন অর্থের এত প্রাচুর্যের কথা চিন্তাই করা যেত না। কিন্তু মানুষের জীবন ছিল প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা। তখনকার সময় নিম্নবিত্তের মানুষেরা সারা বছর ধরে এই ঈদের জন্য অপেক্ষা করত। ঈদ উদযাপনের জন্য প্রস্তুতিও নিত। জামা-কাপড়-শাড়ি হাট-বাজার থেকে আগেই কিনতে হতো। পরে ভিড় হবে এই ভেবে। আবার অনেক সময় বিক্রি হয়ে গেলে শেষের দিকে পাওয়াও হতো কষ্টসাধ্য। এর মধ্যেও কেউ কেউ বাজার থেকে ঈদের আগের দিনও কিনত। তখন একেবারে বিত্তহীন মানুষের হাহাকার লক্ষ করা যেত। কিন্তু ঈদের নামাজে এই পার্থক্য মোটেও লক্ষণীয় ছিল না। 

ঈদের দিন বা তার পরদিন বিকেলে গ্রামে গ্রামে শুরু হতো সালিশী বিচার। নিজেদের মধ্যে যত বিরোধ তা মিটিয়ে ফেলা হতো। এসব বিরোধের অধিকাংশই ছিল জমিজমাসহ বিভিন্ন ধরনের ঝামেলা। অর্থাৎ বছরের নানান ধরনের জঞ্জাল এই সময় মিটিয়ে ফেলা হতো। সব ধরনের ঝামেলা-মনোমালিন্য মিটিয়ে দিয়ে বেশ একটা আনন্দ নিয়ে সমাপ্য হতো ঈদ। অর্থাৎ ঈদকে কেন্দ্র করে আনন্দ থাকত কানায় কানায় পরিপূর্ণ। একদিকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ভালো-মন্দ খাওয়াদাওয়া, অন্যদিকে ঝামেলা-ঝঞ্ঝাটহীন এক দারুণ গ্রামীণ আবহ বিরাজ করত তখন। 

ঈদের এই উৎসব আরও বর্ণাঢ্য ও মনোহর হতো যদি ঈদ বর্ষাকালে হতো। বর্ষাকালে সারাটা এলাকার পথঘাট সব ডুবে যেত। চারদিকে থৈথৈ করত পানি। আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যেতে হতো নৌকায়। সবার বাড়ি এভাবে নৌকায় যেতে যেতে একটা চমৎকার ভ্রমণ হয়ে যেত। এমনি বেড়াতে যাওয়াকে লক্ষ করে সেই ছোটবেলায় আমরা সাইকেল চালাতে শিখেছিলাম।

সেই সময়ে ঈদ উদযাপনে ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ ছিল না। ঈদের দিনে আমরা নামাজ পড়েই ছুটতাম বন্ধুদের বাড়ি, হিন্দু বন্ধুরাও বাদ পড়তো না। অবলীলায় তারাও চলে আসত আমাদের বাড়িতে। একইভাবে পূজা-পার্বণেও আমরা যেতাম। একসঙ্গে আনন্দ উপভোগ করতাম সম্প্রদায় বর্ণ নির্বিশেষে। বিশেষত দুর্গাপূজায় আমরা যেতাম বন্ধুদের বাড়ি, আর সরস্বতী পূজায় যেতাম। যেমন স্কুলের মিলাদে হিন্দু বন্ধুরা সানন্দে অংশ নিত। এসব ব্যাপারে তখন একেবারেই কোনো প্রশ্ন ছিল না। কে কোন ধর্মের এসব নিয়ে কথা বলার মানসিকতাও কারও ছিল না। ঈদেও তাই এমনি করে একটা অসাম্প্রদায়িক পরিবেশের মধ্যে কেটেছে আমাদের শৈশব-কৈশোর। 

প্রতিবছর ঈদে আমাদের নতুন বন্ধু তৈরি হতো। বৈরিতার কথা আমাদের মনস্তত্ত্বে তখন ছিলই না। এক কথায় বলা যায় আমাদের শৈশবের ঈদ উৎসবে আয়োজন ছিল কম। কিন্তু আনন্দ ছিল বিশাল।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫