
গল্প। প্রতীকী ছবি
শহরের শেষ বিড়ালটি মারা গেল ঠিক সূর্যাস্তের সময়। প্রকৃতিতে প্রাণের সৃষ্টি বা বিলয় কোনো কিছুর জন্যই সূর্যের উদয়-অস্তের হেরফের হয় না। কিন্তু ২০৭৩ সালের একটি ঝোড়ো দিনের এই সূর্যটার কিছু একটা হলো। সারাদিন সে মেঘের আড়ালে ডুব দিয়ে ছিল। সন্ধ্যার একটু আগে ঝড়ের পাখা ঝাপটানিতে মেঘগুলো ছিঁড়েখুঁড়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ল।
ওই মুহূর্তে সূর্য তামাটে মুখটি বের করে দুনিয়ার গাছগাছালি, পাখপাখালি ও জীব-জানোয়ারকে এক নজর দেখল। তারপর ডুব দেওয়ার মুহূর্তে একটু থমকালো। আর এক টুকরো লালচে তাপ মুমূর্ষু বিড়ালটির গায়ের ওপরে বিছিয়ে দিল। প্রাণীটি শেষবারের মতো চোখের পাতা টেনে মেলে সেই তাপটুকু গ্রহণ করল। সূর্য টুপ করে পশ্চিমাকাশে অদৃশ্য হলো। অমনি বিড়ালটারও প্রাণবায়ু বের হয়ে গেল। তখনো সন্ধ্যার আঁধারঘেরা অস্ত আকাশের গায়ে একটুখানি লাল আভা লেগে রইল। তেমনি বিড়ালটার নিথর শরীরেও একটু তাপ রয়ে গেল। বিড়ালটিকে বুকে চেপে ধরে মালিক ওর গালে গাল ঠেকিয়ে পশ্চিমাকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।
পশ্চিমাকাশের এই রক্তিমাভা আর সূর্যের থমকে যাওয়ার ঘটনাটি কারো চোখে পড়ল না। হয়তো বিড়ালটির চোখেই পড়েছিল। কারণ এ শহরটি একটি অনুন্নত দেশের প্রধান শহর। তাই এখানে পুবাকাশ বা পশ্চিমাকাশে সূর্যোদয় বা গোধূলি কিংবা মেঘবৃষ্টি ব্যাপারগুলো সেই পুরনো নিয়মে ঘটে গেলেও এখন ট্রপোস্ফিয়ারও ধুলা আর ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে যাওয়াতে সব অস্পষ্ট।
কিন্তু উন্নত দেশের শহরগুলোর উদয়াচল মধ্যগগন আর অস্তাচলে সংযুক্ত আছে অতি স্বচ্ছ বহুবর্ণিল ফটোসিনথেটিক কাচের ঘেরাটোপ। সেখানে প্রয়োজনীয় মাত্রায় স্বর্ণালি আর বর্ণালি সব সময়ই প্রতিফলিত হয়। নাগরিকরা সকালে পুবদিকে পরিশ্রুত আলোর ঝলকের মধ্যে রৌদ্র রশ্মির প্রতিফলন দেখেন আর গোধূলিতে নানা রঙের বর্ণালি ভেসে যেতে দেখেন। কাচের ওধারে সূর্যগোলকটি মেঘ বা ধুলাঝড়, উল্কাভস্ম বা অ্যাসিড ধোঁয়াশা যার ভেতরই থাকুক না কেন, সুরক্ষিত নগরীতে তার প্রভাব পড়ে না।
অনুন্নত দেশের এই শহরটির মানুষ দিনরাত এত বেশি ধুলোময়লা কার্বন সিসায় ডুবে থাকে যে তাদের কাছে চন্দ্র-সূর্যের আচরণ বা আলোর কোনো বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে না। বিড়ালের মালিকের চোখেও আকাশের রক্তিমাভা ধরা পড়ে না। কিন্তু বিড়ালটির দেহের উষ্ণতা ধরা পড়ে। ও কি এখনো বেঁচে আছে! সে প্রাণীটিকে একবার চোখের সামনে উঁচু করে তুলে ধরে। তাতে ওর মাথাটা হোল্ডার থেকে বেরিয়ে আসা বাল্বের মতো ঝুলে পড়ে। সে আবার বিষণ্ন মনে বিড়ালটিকে বুকে চেপে ধরে।
বিড়ালের মালিক একজন কিশোর। তার বয়স ১৪ বছর। তাই তাকে আমরা কিশোর নামেও ডাকতে পারি। কিশোরের খুব প্রিয় বিড়াল ছিল এটি। বছর তিনেক আগে সে বিড়ালটিকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছিল। ও ছিল একটা ছোট্ট হুলো। কোনো দ্রুতগামী গাড়ি ওর পেছনের দুটি পায়ের ওপর দিয়ে চলে গিয়েছিল। দুটি পা-ই চ্যাপ্টা হয়ে গিয়েছিল। রাস্তার সঙ্গে পিষ্ট হয়ে আটকে ছিল ওর পশ্চাদ্দেশ।
তারপরও ছোট্ট মাথাটি তুলে সে দুর্বল গলায় আর্তনাদ করছিল। দুজন ভেটেরিনারি ডাক্তারের বহু চিকিৎসা আর নানারকম টোটকা ওষুধপথ্যের পর বিড়ালটা জানে বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু পা দুটি আর ফিরে পেল না। ছোট একটা ডলফিনের মতো সামনের দু পা কনুই পর্যন্ত বিছিয়ে দিয়ে, মাথাটা উঁচু করে হাঁটত হুলোটা। হাঁটার সময় পেছনের ল্যাংড়া পা দুটি আর শীর্ণ লেজটা মেঝেতে ঘষা খেতে থাকত। তাতে খস খস একটা শব্দ হতো।
ওর নাম ছিল মেকু। যদিও বাংলা ব্যাকরণে বিড়ালের আর একটি প্রতিশব্দ ‘মেকুর’। কিন্তু মেকু নামকরণের সঙ্গে বাংলা ব্যাকরণের কোনো সম্পর্ক নেই। স্রেফ আবেগের সম্পর্ক।
যেদিন কিশোর আহত বিড়ালটিকে রাস্তার ধুলোবালি থেকে তুলে নিয়েছিল, সেদিন ওর গলা দিয়ে ম্যাও ম্যাওয়ের বদলে ‘মেককুঁউউ মেককুঁউউ’ শব্দ বের হচ্ছিল। কিশোরের মনে হলো, একে মেকু নামেই মানায়। ওর বয়সও ছিল কম। মাত্র ছয় মাসের একটা বাচ্চা। রাস্তায় এই প্রাণীটি কোত্থেকে কীভাবে এলো সেটি এক আশ্চর্যের বিষয়। কারণ বহু বছর হলো এই শহরে কোনো বন্যপ্রাণী দেখা যায় না। আগে যেমন রাস্তায় কুকুর, বিড়াল, শেয়াল বা বেজি দৌড়ে বেড়াত-সেসব বহুদিন ধরে একেবারেই নেই হয়ে গেছে। এখন, এমনকি ভাগাড়েও কোনো শেয়াল ও কুকুর দেখা যায় না। যা কিছু প্রাণী, সবই এখন হয় পোষ্য। নয় পণ্য। কিশোর ওকে মেকু নামে ডেকে আদর করে কোলে তুলে সোজা বাসায় নিয়ে এসেছিল। মেকু হয়ে গেল কিশোরের পেট, পোষা প্রাণী। রাত জেগে কিশোর সেবা করত মেকুর।
রাতে কয়েকবার উঠে ফিডারে করে দুধ খাওয়াত। পায়ে ওষুধ লাগাত। নিয়ম করে ফিজিওথেরাপি দিত। মেকুর সঙ্গে নানারকম খেলা করত। কাজেই মেকুর মৃত্যুতে কিশোর গভীর দুঃখে মুষড়ে পড়ল। কিন্তু নিজে ছেলে বলে সে কাঁদতে পারছে না। তার খুব ইচ্ছে হচ্ছে বুক চাপড়ে কাঁদে। চোখের পানি দিয়ে বিড়ালটাকে ভিজিয়ে দেয়। কিন্তু ছেলে হওয়ার জন্য সেটা পারে না। ছেলেরা আবার কাঁদে নাকি!
মেকুকে প্রথমে কিশোরের পরিবার মেনে নেয়নি। রাস্তার একটা ল্যাংড়া বিড়াল। দেখতেও তেমন আহামরি কিছু না। চোখের কোলে সবসময় পিচুটি লেগে থাকে। মণি দুটো পুরনো মার্বেলের মতো ঘোলা। মুখটা ভাঙাচোরা। ভালোমতো মিয়াঁও বলে ডাকতেও শেখেনি। ডাকে মেককুঁউউ! বিড়ালের ডাক কখনো মেককুঁউউ হয়! লেজটা আবার ইঁদুরের লেজের মতো খ্যাংরাকাঠি। ওকে দেখলে মোটেও আদর করতে ইচ্ছে করে না। বরঞ্চ লেজমলা দিতে ইচ্ছে করে। এটাকে দুধ-কলা দিয়ে পুষে কী হবে! বরঞ্চ একটা অ্যালুমিনিয়ামের থালা দিয়ে ওকে রাস্তায় ভিক্ষে করতে বসিয়ে দিলে হয়।
অবশ্য ল্যাংড়া বিড়ালকে রাস্তায় বসে থাকতে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে রোবট পরিচ্ছন্নতা কর্মী লোহার থাবার ভেতর ওকে তুলে নিয়ে শহরের বাইরে আউটফলে ফেলে আসবে। মেকু দেখতে যেমনই হোক, কিশোর বিড়ালটিকে ছাড়ল না। সে সারাক্ষণ ওকে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে ঘোরে। কোলে নিয়ে আদর করে। মাথায় হাত বুলিয়ে দুধ-রুটি খাওয়ায়। শ্যাম্পু দিয়ে ফেনা করে গোসল করায়। মেকু খুব ভক্ত হয়ে ওঠে। রাতেও কিশোরের বালিশের কাছে বা পায়ের কাছে গুটিসুটি মেরে ঘুমায় মেকু।
ধীরে ধীরে মেকু আদুরে হয়ে ওঠে।
বাসার কেউ কেউ ওকে ভালোবাসতে শুরু করে।
পরে এলাকার অনেকেই মেকুর কথা জিজ্ঞেস করতে থাকে।
পরে শহরের সবাই মেকুর কথা নানাভাবে বলতে থাকে।
মেকু হয়ে ওঠে শহরের পোষা বিড়ালের অন্যতম প্রতিনিধি।
কারণ ইদানীং কোনো এক অজ্ঞাত কারণে প্রতিদিনই কারো-না-কারো পোষা বিড়াল মারা যেতে থাকে। বিড়ালদের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রবণতা দেখা দেয়। তারা কিছুতেই ঘরের ভেতর থাকতে চায় না। হাঁচড়পাঁচড় করে। মালিকের বিছানা, বালিশ, টেবিলক্লথ বা সোফার কভার আঁচড়ে কামড়ে ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার করে। বিড়ালের জন্য ঘরের ভেতরে যতই সুখশান্তির ব্যবস্থা করা হোক না কেন, সেসব ওরা অপছন্দ করতে শুরু করে। ওরা খাবারের থালা পা দিয়ে ঠেলে দেয়।
পায়খানা করার জন্য যে দামি সিলিকন বালুর পাত্র রাখা হয় সেটাকে উল্টে দিয়ে সারা ঘর ছত্রখান করে। টেরাসে সাজানো ফুলের টব, ভাঁজকরা জামাকাপড়, রান্নাঘরের হাঁড়িকুড়ি, সব লণ্ডভণ্ড করে। তারপর জিভ বের করে হাঁপাতে হাঁপাতে মরে যায়। কোনো কোনো বিড়াল উঁচুতলার ফ্ল্যাটের জানালা খোলা পেয়ে লাফিয়ে আত্মহত্যা করল। কোনো কোনো বিড়াল দরজা সামান্য খোলা পেয়ে বের হয়ে কোথায় চলে গেল কেউ খোঁজ পেল না। পরে দেখা গেল নগরের প্রান্তে কোনো আউটফলে বা নর্দমায় মরা বিড়ালের পচাগলা ফোলা দেহ আটকে আছে। মিউনিসিপ্যালিটিকে মৃত বিড়াল অপসারণের জন্য বিশেষ পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োগ দিতে হলো।
মেকু এখন মানুষের দুই রকম অনুভূতি পেতে লাগল। বেশিরভাগ মানুষই মেকুকে ভাবতে লাগল অভিশপ্ত প্রেত। এই ল্যাংড়া জীবটি উদয় হওয়ার পর অন্য সুস্থ বিড়ালগুলো মারা পড়ছে। এটি বিড়াল নামের অপদেবতা। শয়তান। এটাকে পয়জন ইনজেক্ট করে দ্রুত মেরে ফেলা হোক। অল্প কিছু মানুষ ভাবল, আহা, পুঁচকে ছোট্ট বিড়ালটা! প্রকৃতিই ওকে লালন করছে। মা নেই, বাপ নেই।
হোক ল্যাংড়া, হোক পঙ্গু, তবুও তো বেঁচে আছে! ওকে দেখে নিজেদের পোষা বিড়ালগুলোর কথা মনে পড়ে। কিশোর এসব কিছুই ভাবে না। সে বিড়ালটিকে বিড়ালের মতোই ভালোবাসে। ল্যাংড়া হলেও ওর পৃথিবীতে খেয়েপরে বেঁচে থাকবার অধিকার আছে। কিশোর মেকুর ল্যাংড়া পায়ে আদর বুলায়। চিমসে লেজটাকে তুলতুলে স্পর্শ দিয়ে টেনে দেয়।
দিনে দিনে মেকু বেশ তরতাজা হয়ে উঠল। পেছনের পা টেনে টেনে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে সে অদ্ভুত কায়দায় লাফাতে লাগল। এ ঘরে ওঘরে ছোটাছুটি করতে লাগল। একসময় সে রীতিমতো রাগী যুবকের মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে সারা ঘরে কী যেন খুঁজতে লাগল। মেকুকে তখন প্লাস্টিকের মাছ, রবারের ইঁদুর, তুলোভরা কাপড়ের ব্যাঙ এনে দেওয়া হলো। সেসব খেলনা নিয়ে বেশ কিছুদিন মনের আনন্দে খেলল মেকু। ইঁদুরকে ধরে আচ্ছাসে চিবোল কয়েক দিন।
একদিন প্লাস্টিকের মাছের মাথাটা মেকুর গলায় ঠেকে কঠিন অবস্থা হয়ে পড়ল। দম যায় আর কি। আবার ডাক্তার হাসপাতাল করতে হলো। ডাক্তার বললেন, এসব রিস্কি খেলনা ওকে দেবেন না। ওকে বাইরে নিয়ে যেতে হবে। ছুটোছুটি করে দৌড়াবে। মাটির গর্তে ইঁদুর, ব্যাঙ বা গিরগিটি পেলে ধরে খাবে। নদীর পাড়ে কাঁকড়ার পেছন পেছন ছুটবে। বালুমাটিতে গড়াগড়ি করবে। অন্য বিড়ালদের সঙ্গে মিশবে, খেলবে, তাহলে ঘোঁতঘোঁতানি কমবে।
কিন্তু শহরে এমন পরিবেশ পাওয়া গেল না। গত ৫০ বছর ধরে গত একশ বছরের সব দালানকোঠা আর প্রাচীন স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়েছে। তার জায়গায় উঠেছে আরও বড় আরও উঁচু আরও দানবীয় আরও পিরামিডীয় সব স্থাপনা। কিশোরের শহরে এখন মাটির গর্ত বলতে যা আছে সবই আবর্জনার ভাগাড়। পুরনো দালান ভাঙা ইটপাটকেল, সিমেন্টের চাঙড়, প্লাস্টিক বস্তা, পলিথিন আর লোহালক্কড় দিয়ে ঠাসা। নতুন অন্য বিড়ালও পাওয়া গেল না।
কোনো বেওয়ারিশ প্রাণী আর রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ায় না। শহরের মানুষ এখন খুব প্রাণবিক হয়ে উঠেছে। প্রত্যেক বাসাবাড়িতে নানা জাতের বিড়াল, কুকুর, খরগোশ আর পাখপাখালি পেট আছে। দোতলা, তিনতলা, দশতলা, বাইশতলা ও পঞ্চাশতলায় সুন্দর সাজানো ফ্ল্যাটের ভেতর বিড়াল কিংবা অন্য প্রাণীরা সুখে শান্তিতে থাকে। কাজেই মেকু কোনো বন্ধু পায় না। কিশোর তখন বুদ্ধি করে একটা বড় আয়না এনে ঘরের একপাশে রেখে দিল।
মেকু আয়না পেয়ে মহাখুশি। ওখানে ঠিক তার মতোই একজন বন্ধু আছে! সে বারবার আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজেকে দেখে মেককুঁউউ মেককুঁউউ করে আনন্দে চিৎকার করে। থাবা দিয়ে দিয়ে আয়নায় চিড়িক চিড়িক শব্দ তোলে। কয়েক দিনের মধ্যেই আয়না খেলায় মেকু ক্লান্ত হয়ে পড়ল। রাগের চোটে আয়নাটাকে ঠেলে ধাক্কিয়ে ওটাকে ফেলে গুঁড়ো গুঁড়ো করল। ল্যাংড়া পা নিয়ে কাচের টুকরোগুলোকে দুরমুশ করতে গিয়ে নিজেকেই কেটেকুটে একসা করল।
রক্তাক্ত মেকুকে নিয়ে কিশোর আবার ছুটল ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার ব্যবস্থাপত্র দিলেন। সেই সঙ্গে বললেন, মেকুর একজন গার্লফ্রেন্ড লাগবে। কিশোর গার্লফ্রেন্ডের মানে বুঝতে পারে। সে একটু লজ্জিত হয়। কী বলে রে! এই পিচ্চি বিড়ালটার আবার গার্লফ্রেন্ডও লাগবে! ডাক্তার বলেন, ও বড় হয়েছে। আর একা থাকতে চাইছে না। কিশোর মেকুর জন্য গার্লফ্রেন্ড খুঁজতে বের হয়। আর ভাবতে থাকে এই ল্যাংড়া বিড়াল-যুবককে কোন মেয়ে-বিড়াল পছন্দ করে বয়ফ্রেন্ড বানাবে! তবুও প্রতিদিন কিশোর একটি মেয়ে বিড়ালের খোঁজ করে যায়।
পেট দোকানে গিয়ে শোনে ব্যবসায়ীরা বিড়াল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ বিড়ালেরা আর খাঁচায় থাকছে না। খাঁচা আঁচড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আত্মহত্যা করছে। শহরেও ততদিনে বিড়ালদের আত্মহত্যা মড়ক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। উঁচু ভবন থেকে লাফিয়েই শুধু না, অনশন ধর্মঘট করে না খেয়েও বিড়ালেরা মরতে শুরু করল। কিছু বিড়াল সন্তর্পণে বাসা থেকে বেরিয়ে আর ফিরে এলো না।
তাদের ছিন্নভিন্ন দেহ পাওয়া গেল রেললাইনের ওপরে বা ষোলো চাকার ট্রাকের রুটে। জীবিত বিড়াল বলতে আছে কিশোরের এই মেকু। মেকু একা একা শুয়ে শুয়ে আরও ক্লান্ত আর বিষণ্ন হয়ে পড়ল। খাওয়া বন্ধ করল। ওষুধ বন্ধ করল। চোখের পাতাও খুলতে চায় না। কাচে কেটে যাওয়া জায়গাগুলোতে ঘা হয়ে পচন ধরল। তারপর সেদিন সূর্য ডোবার মুহূর্তে কিশোরের হাতের ওপরে শুয়ে মেকু শান্তভাবে মরে গেল।
মৃত বিড়ালকে ভাগাড়ে ফেলে দেয়াই দস্তুর। কিন্তু কিশোর মেকুকে ভাগাড়ে ফেলতে নারাজ। পরিবারের লোকজন বলল, তাহলে মিউনিসিপ্যালিটিকে খবর দিই। ওদের ক্লিনার এসে নিয়ে যাক পচা বিড়ালটিকে। এর মধ্যেই ও ঘরে গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে। কিশোর ঘরে স্যানিটাইজার স্প্রে করে মেকুকে সুন্দর কাপড়ে জড়িয়ে শুইয়ে দিয়ে বলল, ওকে ক্লিনারদের কাছে দেব না। ওকে মাটিতে কবর দেব।
কিন্তু শহরে তো বিড়ালের জন্য কোনো কবরখানা নেই! মানুষের কবরখানা বানাতেই এখন জায়গার আকাল পড়েছে। এক কবরের ওপর হাজার মানুষের কবর হতে থাকে। প্রতিটি কবরের গর্ত আসলে মৃতদেহের ভাগাড় হয়ে যাচ্ছে। কিশোর মেকুর শিয়রে বসে থাকে। সে বলে, কবরখানা লাগবে না। যে কোনো ফাঁকা জায়গায় মাটি খুঁড়ে মেকুকে কবর দেবে। তারপর সেখানে একটি নামফলক বসিয়ে দেবে। ফলকে লেখা থাকবে, বেচারা মেকু। খোঁড়া হয়েও সুন্দর করে বাঁচতে চেয়েছিল।
বাইরে তখন জোর ঝড় আর বৃষ্টি চলছে। কিশোরের পরিবার একটা বাচ্চা ছেলের নির্বোধ আবেগকে প্রশ্রয় দেওয়ার কোনো যুক্তি খুঁজে পায় না। তারা মিউনিসিপ্যালিটির ওয়েবসাইটে যোগাযোগ করে পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে কনট্রাক্ট করল। অল্পক্ষণের মধ্যেই প্লাস্টিকের অ্যাপ্রনে দেহ মুড়ে ক্যাচার নবস্টিক আর ভিসেরা ব্যাগসহ ক্লিনার টিম এসে হাজির হলো। কিন্তু তখন কিশোর আর মেকুকে ঘরে পাওয়া গেল না।
আশেপাশের বাসা, অ্যাপার্টমেন্ট রিসিপশন, সিকিউরিটি কেউ বলতে পারল না কিশোরের কথা। কেউ দেখেনি কিশোরকে বেরিয়ে যেতে। বের হবেই বা কেমন করে! তখন আকাশভাঙা বৃষ্টি নেমেছে! পাগলা হাওয়ার সঙ্গে বিশ্রী বাদল ঝরছে। নোংরা আবর্জনালিপ্ত পানিতে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে শহর।
অনেক রাতে মেঘ কেটে গেল। আকাশে একটা ক্ষয়াটে চাঁদ উঠল। তার মরা জোছনা শুকনা বালুর মতো ঝরে পড়ল। চারপাশ কেমন ভুতুড়ে হয়ে উঠল। কিশোরকে দেখা গেল মৃত মেকুকে বুকে আঁকড়ে ধরে শহরের রাজপথ দিয়ে একটানা হেঁটে যেতে। ওদের ছায়া প্রগাঢ় হয়ে রাত্রির প্রচ্ছায়াকে আরও ভুতুড়ে করে তুলছে।
মধ্যরাত পর্যন্ত হেঁটেও মেকুকে কবর দিতে শহরের কোথাও একটু মাটি খুঁজে পায় না কিশোর। সারা শহর ইট, সিমেন্ট, কংক্রিট আর খোয়ায় ঢাকা। পচা আলকাতরার মতো অন্ধকার গলা আকাশ। কিশোর দেখে আকাশেও ইট আর সিমেন্টের চাঙড় ঝুলছে। মাথার ওপর সিমেন্টের তৈরি অজস্র অ্যানাকোন্ডা হিসহিস শব্দ করে উড়ছে। তার ওপর দিয়ে চলছে যানবাহনের সারি। তার ওপর দিয়ে আবার লোহা।
আবার ইট, আবার সিমেন্ট। আবার স্টিল। আবার উঁচু ভবন। স্তরে স্তরে সবকিছু আবার! সবাই মিলে গপ গপ করে আলকাতরামাখা আকাশ খাচ্ছে। কিশোর ভয় পেয়ে মেকুকে নিয়ে কবরস্থানের দিকে দৌড় দেয়। শহরের বিখ্যাত দু-একটি কবরস্থানের কথা সে জানত। কিন্তু সেখানেও মেকুকে কবর দেওয়ার একটু মাটি পায় না কিশোর। কবরখানার ওপর দিয়ে অনেক ঝুলন্ত ভবন আর বড় বড় বায়োগ্যাস ফ্যাক্টরি নির্মিত হয়েছে। মানুষের মৃতদেহ কি এখন আর মাটি খুঁড়ে রাখা হয় না! কিশোর ভাবে নিশ্চয়ই বিশাল আন্ডারগ্রাউন্ড গ্রেভইয়ার্ডে ইলেকট্রিক ক্রেনে করে নামিয়ে দেওয়া হয় ডেডবডি। ওগুলো অটোমেটিক কোনো খোপের মধ্যে ঢুকে যায়। সেখান থেকে উৎপন্ন বায়োগ্যাস প্রক্রিয়াজাত হয়ে নানা সার্ভারে ঢুকে যায়। ওপরের ভবন বা বিপণিকেন্দ্রগুলোতে কবরস্থানে মৃতদেহের এ ধরনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার শব্দ-গন্ধ-স্পর্শ কোনো কিছুরই খবর যায় না।
কিশোর মেকুকে নিয়ে হাইওয়ে ধরে দৌড়াতে থাকে। একসময় সে গ্রামের রাস্তায় নেমে পড়ল। একটু মাটির জন্য আকুল হয়ে সে চারপাশে তাকায়। এখানে আকাশ কিছুটা পরিষ্কার। বৃষ্টি হওয়াতে গাছের কাণ্ডগুলোও ভিজে কালো হয়ে চকচক করছে। এবার কোনো একটা গাছের গোড়ায় নরম মাটি খুঁড়ে সে তার প্রিয় মেকু বেচারাকে যত্ন করে কবর দেবে। কিন্তু একটু পরেই কিশোরের ভুল ভাঙে। যেগুলোকে গাছের কাণ্ড ভাবছিল সেসব আসলে ইটভাটার চিমনি।
শতসহস্র অযুত-নিযুত চিমনি চারদিকে প্রেতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। নিচে আদিগন্ত বিস্তৃত কবরখানার মতো বিছিয়ে আছে অজস্র ইটের পাঁজা। ইট ভাটার বিশাল চুল্লিগুলো বৃষ্টির জন্য নিভন্ত ছিল। বৃষ্টি কমতেই ওগুলোর ভেতরে আবার ধেই ধেই করে জ্বলে উঠল আগুন। কিশোর দেখে প্রত্যেকটা চুল্লির কাছে একটা করে সাইনবোর্ড। জাহীম ইটভাটা, হুতামাহ ইটভাটা, হাবিয়াহ ব্রিক ফিল্ড। কিশোর বুঝে যায়, এর পরের নামগুলো থাকবে লাযা, সাঈর, সাকার, আন-নার। কিশোর মেকুকে বুকে আঁকড়ে ধরে পালাতে থাকে। পেছন পেছন ধেয়ে আসে ইটের দোজখের আগুনের লকলকে শিখা। কিশোর আরও জোরে দৌড় লাগায়। হাঁপাতে হাঁপাতে আবার সে মহাসড়কে উঠে আসে।
ততক্ষণে সকাল হয়ে আসছে। কচি ডাবের পাতলা লেইয়ের মতো ভোরের হালকা আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। সেই আলোতে দূর থেকে আর একটা মিছিল এগিয়ে আসতে দেখা যায়। মিছিলে কোনো স্লোগান নেই। কোনো বজ্রকণ্ঠ নেই। কোনো ব্যানার বা ফেস্টুনও নেই। অনেক মানুষের নীরব আর ধূসর একটা মিছিল। তারা প্রত্যেকে কিছু একটা বহন করে নিয়ে আসছে। তারা চলছে আবার যেন চলছে না। তারা স্থবির হয়ে আছে আবার যেন থামছে না।
কাছে আসতেই দেখা গেল ওদের প্রত্যেকের হাতে রয়েছে তাদের আদরের পোষা প্রাণী। ওরা মৃত। কারো হাতে একটা খইরঙা পাতিহাঁস, কারো হাতে লম্বা গ্রীবার রাজহাঁস বা ঝলমলে রঙিন পালকের মুরগি। কারো হাতে বড় বড় কানওয়ালা খরগোশ। এখন কান দুটো দু টুকরো ন্যাতার মতো ঝুলে আছে। আছে ছাগল। স্প্রিংয়ের মতো শিং বাঁকানো ভেড়া। গাল তোবড়ানো হাড় জিরজিরে কৃষকরা তাদের গোয়ালের পরিশ্রমী গরুগুলোকে পরম মমতায় বুকে আঁকড়ে ধরে মিছিলে পথ চলছেন।
আহা, বলদটা খুব জমিতে লাঙল টানতে চেয়েছিল। জমিই নেই। কোথায় লাঙল টানবে। গোয়ালে বাঁধা থেকে থেকে হাঁপ ধরে মরে গেল। হাটের বোঝাটানা ঘোড়াগুলো না খেতে পেয়ে মুখে ফেনা উঠে শুয়ে পড়েছিল। মাঠ নেই, ধান নেই, রবিশস্য নেই। ঘোড়াদের দানাপানিও নেই। শুধু নুনপানি সামনে দিলে ওরা তা মুখে নেয়নি। মিছিল দীর্ঘ হতে থাকে। মিছিলের মানুষেরা প্রিয় প্রাণীদেরকে কিছুতেই ভাগাড়ে নিক্ষেপ করবে না। ওদের জন্য মাটি চাই। কবর চাই। মালিকেরা একসময় ক্লান্ত হয়ে পিচঢালা মহাসড়কের ওপরে শুয়ে পড়ে। তারা নিজেদের বুকের ওপর রেখে দেয় তাদের প্রিয় মৃতপ্রাণীগুলো। মানুষ তো নাকি মাটিরই তৈরি!
দিনের আলো ফুটে উঠতেই দূরদূরান্ত থেকে আসা শহরমুখো যানবাহনগুলো মহাসড়কে রাতারাতি গজিয়ে ওঠা একটা কবরখানার সামনে থেমে যায়।