Logo
×

Follow Us

ঈদ সংখ্যা

নাগাল্যান্ড অভিযান, জুকোভ্যালি ট্রেক!

Icon

সজল জাহিদ

প্রকাশ: ০১ মে ২০২৩, ১৫:৪৫

নাগাল্যান্ড অভিযান, জুকোভ্যালি ট্রেক!

নাগাল্যান্ড। ছবি: সংগৃহীত

ঘটনাবহুল ও বিধ্বস্ত একটি দিন আর ভীষণ ক্লান্তির একটি রাত্রির পরে, টানা ঘুমে দুপুর গড়িয়ে, এখন একটু বিলাসী সময় উপভোগ করছি! এয়ারপোর্টের আভিজাত্যপূর্ণ স্কাই লাউঞ্জের নরম সোফায় বসে, প্রিয় ওয়াইনের চকচকে গ্লাসে ঠোঁট ডুবিয়ে তার রঙ, রূপ, রস আর মাদকতায়ময় গন্ধ উপভোগ করছি তারিয়ে তারিয়ে। 

ব্যাপারটা অনেকটা এরকম-আমি যতই সাধারণ, সাদাসিধে জীবন কাটাতে চাই, কিন্তু পরিস্থিতি কখনো কখনো নিজেকে স্পেশাল ভাবতে বাধ্য করে বৈকি! অস্বীকার করার কিছু নেই যে মাঝে মাঝে, জীবনের ঠুনকো বিলাসিতা অবশ্যই উপভোগের। কিন্তু তারপরও নিজেকে আমার এসব জায়গার চেয়ে, নন এসি ট্রেনে, লোকাল বাসের ছাদে, সাধারণ শোভন চেয়ার বা লঞ্চের ডেকে দেখতে বেশ লাগে।

তাই তো, যেতে চেয়েছিলাম একদম লোকাল বাহনে, জ্যাম ঠেলে, কম খরচে বেশি গল্প বুনব বলে; কিন্তু পরিস্থিতি আমাকে তার বদলে এয়ারের মতো বিলাসিতা, বহু খরুচে বাহনে আর তার সঙ্গে বনেদি স্কাই লাউঞ্জে এনে বিমানের জন্য অপেক্ষা করাচ্ছে! 

অথচ আগের ২৪ ঘণ্টা কত ঘটনাবহুলই না কেটেছে। ঢাকার গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে, বাসের জন্য রাত ২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে, ভোর ৪টায় কাঁচপুর পেরিয়ে, সারারাত-সকাল প্রায় নির্ঘুম কাটিয়ে সিলেট যখন পৌঁছাই তখন প্রায় ১০টা! এরপর আবারও প্রায় ১০০ কিলোমিটার আর তিন ঘণ্টা রাস্তার ঝাঁকুনি খেতে খেতে দুপুর ১টায় যখন জকিগঞ্জ পৌঁছাই তখনো জানি না যে একটু পরে আমার জন্য কী দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। 

শুরুতে ভাষার জটিলতায় পাশেই বর্ডার রেখে ১০ কিলোমিটার দূরে চলে যাওয়া আবার ফিরে আসা। এরপর কুশিয়ারা নদীর তীরে যখন রোমাঞ্চ নিয়ে পৌঁছলাম, তখনই স্থানীয় মানুষদের মাধ্যমে জানতে পারলাম এই পোর্ট বন্ধ! পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে গিয়েও যখন কোনো উপায় পাওয়া গেল না তখন বাধ্য হয়েই আর দেরি না করে ফেরার পথ ধরলাম বিধ্বস্ত মন আর শরীর নিয়ে।

এদিকে আমার আপডেট দেখে এক বড় ভাই এয়ার টিকেট দিতে চাইলেন! তখনই মাথায় এটা খেলে গেল। সেই বড় ভাইয়ের কাছ থেকে না নিলেও, এক ছোট ভাইকে দিয়ে এয়ার টিকেট করিয়ে নিলাম সন্ধ্যার। টিকেট পেতেই দ্রুত ব্যাগ রেডি করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তারপর বের হলাম, এয়ারপোর্টে ফকিরের বনেদি হালে! শুরু হলো নতুন করে জুকোভ্যালি অভিযানে পথ চলা। 

স্কাই লাউঞ্জে তো বেশ আয়েশ করে খেয়েদেয়ে, সময়মতো প্লেনে উঠে পড়লাম। কিন্তু তখনো গৌহাটি যাওয়ার উপায় করা হয়নি। কলকাতার এক দিদি এয়ার টিকেট পাওয়ার জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন। বিমান ছাড়ার পর পর, তিনি হোয়াটসঅ্যাপে এয়ার টিকেট আর বোর্ডিং পাঠিয়ে আমাকে চিন্তামুক্ত করে দিলেন! দিদিকে বিশাল একটা ধন্যবাদ। 

বিমান সঠিক সময়েই কলকাতা ল্যান্ড করল। আমিও এয়ার ক্রুদের বলে সবার আগে প্লেন থেকে নেমেছি দেড় ঘণ্টা পরেই আমার আর একটা ফ্লাইট আছে বলে। 

এতে কেউ ঝামেলা করেনি। সবার আগে বেরিয়ে ইমিগ্রেশন গিয়ে দেখি বিশাল লাইন! ইমিগ্রেশন লাইন ম্যানেজ করছে এমন একজন অফিসারকে আমার আর একটা ফ্লাইট আছে বললে, তিনি আমাকে লাইন ভেঙে সবার আগে ইমিগ্রেশন অফিসারের সামনের লাইনে নিয়ে গেলেন। সেখানে দাঁড়ানো পারিবারিক একটা সিরিয়ালে আমার পরের ফ্লাইটের কথা বললে তারা আমাকে তাদের আগে ইমিগ্রেশন করতে সহায়তা করেন। তাদেরকে ধন্যবাদ দিতেই হবে। 

কোনোমতে পড়িমরি করে বোর্ডিং শেষ করে, ব্যাগ চেক ইন করিয়ে সিকিউরিটি শেষ করে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। আমার নির্ধারিত গেটে গিয়ে সিম রিপ্লেস করার জন্য একটা পিন খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু অন্তত ৫০ জনকে জিজ্ঞেস করেও সিম রিপ্লেস করার পিন বা এমন কিছু খুঁজে পেলাম না। এদিকে হঠাৎ শুনি মি. ইসলাম, জাহিদ নামে ঘোষণা আসছে! দ্রুত দৌড়ে গেটে যেতেই আমাকে জিগ্যেস করা হলো-চেক-ইন ব্যাগে কী আছে? কোনো পাওয়ার ব্যাংক বা এই জাতীয় কিছু? আমি হ্যাঁ বলাতেই আমাকে নিয়ে ছুটল। ওটা বের করে আনতে হবে। 

তিন রকমের সিকিউরিটি, চারটা গেট, দুটি লিফট পেরিয়ে ব্যাগের কাছে পৌঁছে পাওয়ার ব্যাংক বের করা হলে আগের চেয়েও জোরে দৌড়ে গেটে এলাম এয়ারের সহকারীসহ। ততক্ষণে বোর্ডিং শেষের পথে। আমার জন্য প্রায় ১০ মিনিট ফ্লাইট দেরি হচ্ছে! যা আমার পরের গন্তব্যের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ! কারণ রাত ১১.৩০-এ গৌহাটি থেকে ডিমাপুরের ট্রেন। এয়ারপোর্ট থেকে স্টেশন ২০ কিলোমিটার দূরে। হাতে সময় পাব মাত্র এক ঘণ্টা! 

এমন ঝুঁকি জেনেও টিকেট করেছি। কারণ যেতে পারলে ওদিক থেকে দেখে গৌহাটি থেকে অরুণাচলের চেষ্টা করব। আর যদি যেতে না পারি তাহলে কালকেই অরুণাচল অনুমোদন নেওয়ার চেষ্টা করব-এটা প্ল্যান করে রেখেছি। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা। 

এখন এয়ারে বসে আছি, ল্যান্ড করার পরে ট্রেন ধরতে পারব কি পারব না সেই অভিযানে নামার জন্য। এখনো যে কত রোমাঞ্চ বাকি আছে কে জানে? আপাতত এয়ারপোর্ট থেকে স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরার যুদ্ধ শুরুর অপেক্ষায়!

রুদ্ধশ্বাস বাইক জার্নির গল্প

গৌহাটি বিমানবন্দরে যখন প্লেন ল্যান্ড করল তখন ঠিক ১১টা। এয়ারপোর্ট থেকে স্টেশন ২০-২৫ কিলোমিটার দূরে। আগেই আমাকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, গাড়ি না নিয়ে যেন বাইক নেই। তাহলে কিছুটা তাড়াতাড়ি আসার সুযোগ পাওয়া যাবে। 

কিন্তু এয়ারপোর্টের আশেপাশে দৃষ্টিসীমায় কোনো বাইকের দেখা পাওয়া গেল না। একজনকে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি ভিন্ন পথ দেখালেন। সেই পথে ছুটলাম বাইক পেতে। কিন্তু সেদিকে গিয়ে যে বাইকগুলো দেখলাম সেগুলো স্টাফদের। ভাড়ায় চালিত নয়। একটা অটো পেয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করাতে সামনের এক মোড়ে পাওয়া যেতে পারে জানাল। উঠে পড়লাম অটোতে।

কয়েক সেকেন্ড এগোতেই একটা বট গাছের নিচে কয়েকটা বাইক দেখলাম। স্টেশন যাবে কিনা জানতে চাইলে, যাবে বলাতেই ১০ টাকা অটোকে দিয়ে নেমে পড়লাম। ততক্ষণে দুটো বাইক রেডি হয়ে গেছে। আমি তুলনামূলক ইয়াং আর ভালো বাইক যেটা মনে হলো সেটাতে উঠে পড়লাম। চালককে শুধু বললাম ভাই ১১.৩০-এ আমার ট্রেন, পারলে ধরিয়ে দিন। তিনি দেখা যাক বলে বাইক চালানো শুরু করলেন। শুরুতেই বাইকের গতি ৫০, ৬০, ৭০ ছাড়িয়ে ৮৫/৯০ ঘরে ওঠানামা করতে লাগল। হাতে সময় আছে মাত্র ২০ মিনিট! যেতে হবে ২০+ কিলোমিটার পথ। তাও অচেনা শহর, অচেনা রেলওয়ে স্টেশন। আমি হেলমেট পরে, সানগ্লাস লাগিয়ে আয়াতুল কুরসি পড়তে শুরু করলাম। ২০ মিনিট আর কিছুই মাথায় ছিল না। 

শুধু দোয়া পড়ে গেছি। যতটা না ট্রেন পাওয়ার আশায় তার চেয়ে বেশি সহিসালামতে বাইক থেকে নামার জন্য। যদিও প্লেনেই ভেবে রেখেছিলাম যে ট্রেন যেহেতু পাওয়ার সম্ভাবনা কম, তাহলে রাতে গৌহাটি থেকে পরদিন সকালে অরুণাচল অনুমোদন চেষ্টা করব।

রাস্তা আল্লাহর রহমতে একদম ফাঁকা ছিল। কিন্তু তারপরও ২০ মিনিটে ২০+ কিলোমিটার ভীষণ কঠিন পথ। মহাসড়ক ছেড়ে মূল শহরে ঢোকার পর লোকাল বাহনের জন্য মাঝে দুই-একবার গতি কমাতে হয়েছে। কিন্তু তারপরও এভারেজ গতি ৮০-এর নিচে নামেনি কখনোই। এদিকে মূল সড়ক ছেড়ে বাইক গলির মধ্যে ঢুকে পড়তেই, বুঝতে পারলাম স্টেশন কাছাকাছি। কারণ স্টেশনের চারপাশের পরিবেশ আমার চেনা। ততক্ষণে ভ্রমণসাথি হাবিব কল দিয়েছে। আর মাত্র ছয় মিনিট সময় হাতে আছে। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ৬-এ দাঁড়িয়ে আছে। যেটা আর একটা নতুন বিড়ম্বনা। 

দূর থেকে দেখে বুঝতে পারলাম স্টেশনের দিকে ঢুকছি। ওকে জানালাম, দেখা যাক এসে যেহেতু পড়েছি বাকিটা আল্লাহ ভরসা। বাইক থেকে যখন নামি তখন ১১টা ২৭ মিনিট। হাতে সময় তিন মিনিট। যেতে হবে ছয় নম্বর প্ল্যাটফর্ম, তাও অচেনা আর নতুন রেলওয়ে স্টেশন! আগে থেকেই বের করে রাখা টাকা বাইক চালকের হাতে দিয়ে, ধন্যবাদ দিয়ে ছুটলাম ছয় নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে। প্রথমে ভুল পথে গিয়ে পরক্ষণেই সঠিক পথে গিয়ে এক্সিলেটরে ওভার ব্রিজের ওপর দিয়ে ছয় নম্বর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছলাম। 

কিন্তু রোমাঞ্চ শেষ নয়! কারণ একই স্টেশনে দুটি ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে দুই দিকে মুখ করে। কোনটায় উঠব আমি, ফোনে হাবিবের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ট্রেন যখন নড়ে উঠল, তখন ওকে দেখতে পেয়ে লাফ দিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম। শেষ হলো এক রুদ্ধশ্বাস জার্নির গল্প...

মন ভরানো ট্রেন ভ্রমণ

একদম সত্যি বলছি...

স্লিপার ক্লাসের দরজায় দাঁড়িয়ে দুরন্ত ট্রেনের দোলায়, ট্রেনের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সময় হু-হু বাতাসে যে রোমাঞ্চের সুখ পাই, বিমানের এসি আসনে আমি তা পাই না।

দরজায় দাঁড়িয়ে দূরের ছোট ছোট পাহাড় যতটা উপভোগের, বিমানের জানালা দিয়ে দেখা পাওয়া মেঘেদের দল ততটা উপভোগ্য লাগে না। ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতে পাওয়া অচেনা নগর, মিটিমিটি আলো, স্লিপার ক্লাসের জানালা দিয়ে, হুট করে ঝরে পড়া বৃষ্টির জলের যে সুখানুভূতি, বিমানবালার অমায়িক হাসিতে সেই সুখানুভূতি পাওয়া যায় না।

একটা অসম্ভব লক্ষ্যে পৌঁছানোর আনন্দ উদযাপন করার জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে কানে হেডফোন গুঁজে দিলাম প্রিয় গান ফুল ভলিউমে চালিয়ে। সেই সঙ্গে মাঝে মাঝে নিজেও হেঁড়ে গলায় দুই-একবার গলা মেলালাম। প্রায় আধা ঘণ্টা একটানা চলার পর একটা স্টেশনে ট্রেন থামবে বলে গতি কমাতে শুরু করল। আমি ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিয়ে নেমে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। কারণ ভ্রমণসাথি কয়েকটা কামরা পরে তার নিজের আসনে বসে আছে। বাকি পথটুকু একসঙ্গে যাওয়া যাবে। 

ট্রেন থামতেই দৌড় দিলাম, যেন ছেড়ে দেওয়ার আগেই ওই কামরায় গিয়ে উঠতে পারি। টিকিট চেকারের কাছ থেকে কামরা কতদূরে জেনে নিয়ে ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার আগেই পৌঁছে পেয়ে গেলাম ভ্রমণসাথিকে। বেশ কিছু সময় দুজন মিলে গল্প করে কাটিয়ে দিলাম। এরপর একটা মিডল বাথ ফাঁকা পেয়ে সেটায় নিজেকে এলিয়ে দিলাম এই ভেবে যে অন্য কোনো স্টেশন থেকে যাত্রী উঠলে নেমে যাব।

গা এলিয়ে দিতেই সম্ভবত ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ঘুম ভেঙে গেল-তুমুল ঝড়বৃষ্টি আর প্রবল বাতাসে বৃষ্টির ছাট যখন মিডল বাথে এসেও ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। কী অদ্ভুত আনন্দ আর সুখের সময় যে ছিল সেটা বলে বোঝানো মুশকিল। বাইরে তুমুল ঝড়বৃষ্টি, ট্রেনের তুমুল গতিতে ছুটে চলা, ঢেউয়ের মতো দোল, জানালার ফাঁক গলে ছুঁয়ে যাওয়া বৃষ্টির ছাট, বিদ্যুৎ চমক, আর প্রকৃতির অবারিত সুরের মূর্ছনায় ভেসে যাচ্ছিলাম প্রতিটি মুহূর্ত।

এক সময় বৃষ্টি থেমে গেল, আমিও আবার ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভেঙে গেল ভোর ৪টায়। তখন ট্রেন নাগাল্যান্ডের গভীর অরণ্য ভেদ করে, মাথার সিঁথির মতো মেঠো পথে এঁকেবেঁকে ছুটে চলেছে ডিমাপুরের দিকে। আমি বাথ থেকে নেমে ট্রেনের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে পুরো নাগার আকাশ আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে। আবার শুরু হয়েছে রিমঝিম বৃষ্টি, নাগার অরণ্য আর রেল পথ তখন অন্য মাধুর্য নিয়ে ধরা দিয়েছে আমার কাছে!

সেই গল্প আলাদা করে বলতে হবে, আয়েশ করে...

ঝুম বৃষ্টি আর নতুন রাজ্যের রোমাঞ্চ

ঘুম ভাঙতেই লোয়ার বাথের জানালায় চোখ রেখে বুঝতে পারলাম সকাল না হলেও অন্ধকার আর নেই। মিডল বাথের আরামের বিছানা ছেড়ে বের হলাম, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে নাগাল্যান্ডের প্রাথমিক দর্শন করব বলে। দাঁড়াতেই একটা স্টেশনে ট্রেন থামল। স্টেশনে হেঁটে যাওয়া যাত্রীদের কাছ থেকে স্টেশনের নাম জানতে চাইলে ওদের উচ্চারণ বুঝতে না পেরে ডিমাপুর ভেবে আমিও ব্যাকপ্যাক নিয়ে নেমে যেতে চেয়েছিলাম একবার! আসলে আমার গন্তব্য ঠিক পরের স্টেশনে ডিমাপুর। আর এই স্টেশনের নাম ছিল ডিফুঁ! ডিফুঁকে ডিমাপুর ভাবাটা খুব দোষের কিছু নয়। সে যা-ই হোক ট্রেন ছেড়ে দিলে আমি দরজায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। 

ট্রেনের দোলা শুরু হতে স্টিলের হাতলে থাকা হাতের বেশ শীতল জলের স্পর্শ পেলাম কয়েকবার। শুরুতে ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি যে আসলে কিসের স্পর্শ। এরপর যখন ঘড়ি ভিজে যেতে চাইল তখন বুঝতে পারলাম এটা আসলে বৃষ্টির ফোঁটা! বৃষ্টি বুঝতে বুঝতে দেখি ট্রেন ঘন অরণ্যের মাঝে ঢুকে পড়েছে। এতটাই ঘন সেই অরণ্য যে গাছের ডালপালা দরজার ভেতরে পর্যন্ত ঢুকে বৃষ্টির জলে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। 

আমার প্রিয় ঘড়িটা খুলে পকেটে রেখে দরজায় বেশ আয়েশ করে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। ট্রেন তখন ঘন অরণ্যের মাঝে আষাঢ়ের ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ছুটে চলেছে এঁকেবেঁকে। তিন তিনটা প্রিয় জিনিস একই সঙ্গে পেয়ে, কোনটা ছেড়ে কোনটা উপভোগ করব-একটা হতবিহ্বল দশা! 

এক. ট্রেন এতটাই বাঁক নিয়ে চলছে যে একই সঙ্গে ট্রেনের ইঞ্জিন আর পেছনের শেষ বগি অবধি দেখা যাচ্ছে মাথা বের না করেই! 

দুই. ট্রেন চলছে নাগাল্যান্ডের নিখাদ ঘন, কালো আর গা ছমছমে অরণ্যের মাঝ দিয়ে। যে কোনো সময়েই এই পথে চলা ভীষণ গা ছমছমে আর রোমাঞ্চকর হবে বোঝাই যাচ্ছিল। 

তিন. বাড়তি বোনাস ছিল আষাঢ়ের রুমঝুম বৃষ্টির অবিরত ঝরে পড়া! কী এক অদ্ভুত অনুভ‚তিময় সকাল সে বলে বা লিখে বোঝানোর সাধ্য আমার নেই সত্যি!

একটা সময় বৃষ্টি একটু ধরে এলো, ঘন অরণ্য শেষ করে ট্রেন কিছুটা ফাঁকা পথে চারধারে ক্ষেত খামারের পাশ দিয়ে চলতে শুরু করল, ট্রেন তার গতি কমিয়ে দিল, ধীরে ধীরে লোকালয় দেখা দিতে লাগল। এরপর স্টেশনের আবছায়া। ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে গেলাম ২৮তম রাজ্যের একটা নতুন রেলস্টেশনে পা রাখার জন্য।

১০ মিনিটের মধ্যেই ট্রেন পৌঁছে গেল ডিমাপুর রেলওয়ে স্টেশনে। ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমেই চলে গেলাম শেষ মাথায়, নতুন প্রদেশের নতুন রেলস্টেশনের নতুন আর প্রিয় একটি ছবি তোলার জন্য। শেষ হলো একটি মনে রাখার মতো রোমাঞ্চকর আর স্মৃতিময় ট্রেন জার্নির স্মরণীয় গল্প! 

ডিমাপুর থেকে কোহিমা

স্টেশন থেকে একটা অটো নিয়ে ব্লু হিল এরিয়ায় গিয়ে পেয়ে গেলাম একটা লং রুট বাস, যা কোহিমা যাবে। বাস থেকে নেমেই কপাল গুণে পেয়ে গেলাম একটা অলটো কার। যেটার চালকের চমৎকার ড্রাইভে পরের এক ঘণ্টায় সকাল ঠিক ৯টায় জুকোভ্যালির এন্ট্রি পয়েন্টে! এন্ট্রি করে একটু সামনে এগিয়ে দিল আমাদের গাড়ি। সেখানে সকালের নাশতা করে ছবি তুলে হেলেদুলে সময় পার করতে না করতেই পেয়ে গেলাম একটা ফোর হুইলার, যা আগের দিনের যাত্রী আনতে যাচ্ছে। সেটাতে উঠে চলে গেলাম ট্রেকিং পয়েন্টে! সকাল তখন ১০টা ৩০ মিনিট।

নীল পাহাড় ও কল্পনা সত্যি হয়ে যাওয়া 

অনেক দিন থেকেই মনে মনে এমন একটা জায়গার কথা কল্পনা করছিলাম। যেখানে পাহাড় আকাশ ছুঁয়ে দেবে না, পাহাড় হবে সমতল আর আকাশের মাঝামাঝি এক বিশাল দেয়ালের মতো। যেখানে চারদিকে তাকালে শুধু পাহাড় আর আকাশ দেখা যাবে, তবে সেই পাহাড় অবশ্যই হতে হবে সবুজে মোড়ানো, ঘন অরণ্যে জড়ানো। সমতল দেখতে চাইলেও দেখা যাবে না। 

যেখানে পাহাড়ের গায়ে জড়িয়ে থাকবে আলতো মেঘেদের দল, পুরো শরীর জুড়ে তার থাকবে মিহি কুয়াশার চাদর আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় যেটা সেটা হলো সেই সাদা মেঘ, ধূসর কুয়াশায় ঢাকা থাকার পরও, পাহাড়ের নিজস্ব রূপ বোঝা যাবে স্পষ্ট করে। মেঘ কুয়াশা ভেদ করেও পাহাড়ের মোহময় নীল রূপ দেখা যাবে বসে বসে। অর্থাৎ দূরের যে পাহাড়ের দেয়াল দাঁড়িয়ে থাকবে তা হবে একদম নীল! মেঘ-কুয়াশায় মাখামাখি থাকবে অবিরাম! যেখানে পাহাড়ের কাছে আকাশ হয়ে যাবে গৌণ!

ঠিক সেই পাহাড়ের দেয়ালকে পিছনে রেখে আমি দাঁড়াব একটা টকটকে লাল টিশার্ট গায়ে চাপিয়ে, প্রিয় একটা জিন্সের হাফ প্যান্ট পরে, চোখে বর্ণিল সানগ্লাস দিয়ে খুশিতে টগবগ করতে করতে ছবির জন্য পোজ দেব। এক পাহাড়ের বারান্দায় বসে আর এক পাহাড়ে হেলান দিয়ে, দূরে আকাশের দেয়াল হয়ে থাকা নীল পাহাড়কে পেছনে রেখে একটা পুরোপুরি পাহাড়ময় ছবি হবে। যে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকেই মন ভালো হয়ে যাবে। যে ছবিটার স্মৃতি মন আনন্দে ভরে দেবে, যে ছবিটার কাছে আরও অনেক পাহাড়ের ছবি ম্লান হয়ে যাবে। 

আমার এমন কল্পনার পাহাড় আর সেই পাহাড়ের সঙ্গে একটা ছবি শুধু নেপালে গেলেই পাওয়া যেতে পারে। কারণ কল্পনার এমন সবকিছু মিলে যাওয়া ছবি শুধু যারা নেপালের বিভিন্ন রুটে ট্রেক করতে যায়, তাদের কাছেই দেখেছি। কিন্তু নেপাল যাওয়ার সৌভাগ্য আজও করে উঠতে পারিনি বিমান ভাড়ার ভয়ে। তাই কল্পনার পাহাড় দেখা আর সেই সঙ্গে নিজের একটা ছবি তোলার ইচ্ছাও পূর্ণতা পায়নি কিছুতেই। কিন্তু আমার চাওয়া অসম্ভব কিছু নয়-এমন কিছু আজ পর্যন্ত অপূর্ণ থাকেনি, বিধাতা আমাকে এতটা অপূর্ণ রাখেননি কখনো।

তাই তো এবার নাগাল্যান্ডের জুকোভ্যালি যাওয়ার শুরুতে, রেজিস্ট্রেশন পয়েন্ট থেকে দুই কিলোমিটার সামনে গিয়ে প্রথম বিশ্রাম পয়েন্টে সকালের নাশতা খাওয়ার ব্রেক দিতেই পেয়ে গেলাম এতদিনের কল্পনার রঙে রাঙানো, একদম মনের মতো এই পাহাড়ের বারান্দা, পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে, পেছনের নীল পাহাড়ের দেয়ালকে উপজীব্য করে নিজের জন্য, নিজের কাছে, নিজের প্রিয় এই ছবিটি। 

ট্রেকের শুরুতেই পানির অনিশ্চয়তা 

জুকোভ্যালির রেজিস্ট্রেশন কেন্দ্রে যখন পৌঁছাই তখন সকাল ৯টা। কোহিমায় বাস থেকে নেমেই একটা গাড়ি পেয়ে যাওয়ায় দেরি না করে উঠে পড়ি। এখানে চলে আসার আগে মাঝে একটু সময়ের জন্য গাড়ি থামিয়ে একটা ব্রাশ কেনার পাশাপাশি কিছু শুকনা খাবার, একটা পাউরুটি, বাটার, এক বোতল জুস কিনে নিয়েছিলাম। খুব দ্রুত এই কেনাকাটা করেছিলাম বলে পানিটা আর কেনা হয়নি। গাড়িতে উঠে ভেবেছিলাম যেখানে গাড়ি থেকে নামব সেখান থেকে পানি বা অন্যান্য কিছু কিনে নেওয়া যাবে। 

কিন্তু গাড়ি যেখানে গিয়ে থামাল আর আমাদের রেজিস্ট্রেশনের জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করলাম সেখানে এমন দোকানই নেই! এমনকি সামনেও আর কিছু নেই বলে জানানো হলো। পানি ছাড়া নাশতা, ট্রেইল বা ট্রেক কীভাবে করব? এমনকি সব সময় আমার কাছে ব্যাকআপ পানি সাধারণত থাকেই। কিন্তু আগের দিনের আর রাতের ভ্রমণ ক্যান্সেল হয়ে যাওয়াতে সব এলোমেলো হয়ে যাওয়ায় কিছুই আর তেমনভাবে গোছানো হয়নি। কোনোরকম বেরিয়ে এসেছিলাম। 

রেজিস্ট্রেশন শেষ করে পাহাড়ি ট্রেইল, ঝিরি, ঝরনার পানি পেতে পারি-এমন অনিশ্চয়তার মধ্যেই আমরা পাউরুটি, বাটার আর জুস দিয়ে প্রাথমিক নাশতা শেষ করেছিলাম। একটা ফোর হুইলার পেয়ে যাওয়াতে সেটাতে করে একদম ট্রেকিং পয়েন্টে পৌঁছে গিয়েছিলাম। যদিও শুরুতে আমাদের দুই-এক জনের মতামত ছিল যে রেজিস্ট্রেশন পয়েন্ট থেকে ট্রেকিং শুরুর পয়েন্ট পর্যন্ত হেঁটেই যাবে!

কিন্তু কেন যেন আমার মন কিছুতেই সায় দেয়নি এটা করতে। কারণ যে আট কিলোমিটার পথ ফোর হুইলারে যেতেই ১৫০০ রুপি ফিক্সড ভাড়া চায় সেই পথ কেমন হতে পারে সেটা আমি আঁচ করতে পারছিলাম। আর তাই হাঁটা শুরু করতে বেশ গড়িমসি করছিলাম। ভাগ্য পক্ষে ছিল বলেই একটা ফোর হুইলার পেয়ে গিয়েছিলাম মাত্র ৫০০ রুপির বিনিময়ে। কারণ সেই জিপটি তার আগের দিনের যাত্রীদের আনার জন্য যাচ্ছে।

গাড়িতে বসার পরে কয়েক মিনিটের মধ্যেই টের পেলাম কী ভয়ানক পথে যাচ্ছি আমরা। সরু, পাহাড় কেটে পাথর ফেলে দিয়ে কোনোরকমে গাড়ি হেলেদুলে রোলার কোস্টারের মতো করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও গাড়ির চাকা অর্ধেক কাদায় ডুবে গিয়েছে। মোট কথা সেই মাত্র আট কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতেই একটা ফোর হুইলারের এক ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছিল! আর এই পথে যদি হেঁটে আসতাম তো সারাদিন এখানেই চলে যেত! ভাবা যায়! 

গাড়ি তো নামিয়ে দিল, ট্রেকিং শুরুর কিছুটা আগে যেখানে নিজে ঘুরতে পারে। সেখান থেকে ট্রেকিং পয়েন্ট আরও প্রায় এক কিলোমিটার। তবে সেই রাস্তাটুকু বেশ চওড়া আর ভালো। কিন্তু গভীর অরণ্যের শুরু সেখান থেকেই। পানির দুশ্চিন্তাটা তখনো রয়েই গেছে। কারণ পথে এমন কোনো ঝিরি বা ঝরনা চোখে পড়েনি। জিপস্ট্যান্ডের দু-একজন জানালো সামনে ঝিরি পেতে পারি। সেখানে নতুন করে মূল ট্রেকের প্রস্তুতি নিয়ে শুরু হলো জুকোর উদ্দেশে ট্রেকের শুরু। 

এক কিলোমিটার পথ হালকা আপ হিল ওঠার পরেই পাহাড়ের পাশে একটা লোহার পানিবাহিত পাইপ দেখতে পেলাম। যেটা দিয়ে পাহাড়ি ঝরনা বা ঝিরির পানি নিচের দিকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার মানে এখানে আশেপাশে কোথাও পানির উৎস আছে নিশ্চিত হলাম। আরও কিছুটা এগিয়ে যেতেই একটা আলাদা প্লাস্টিকের পাইপ দেখা গেল যেটা লোহার পাইপের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। প্লাস্টিকের পাইপটা টেনে বের করতেই শীতল পানির স্পর্শ মনপ্রাণ শীতল করে দিল! হাত-মুখ ধুয়ে, পানি খেয়ে, বোতলে পানি ভরে, বিশ্রাম নিয়ে নতুন করে পথ চলা শুরু করলাম। শেষ বিকেলের মধ্যে জুকোর রেস্ট হাউসে গিয়ে পৌঁছাতে পারলেই হবে। 

পাথুরে পথের শেষ প্রান্তে গিয়ে দেখা মিলল জুকোভ্যালির। আগেই জানা ছিল এখান থেকে একদম খাড়া আপহিল ট্রেইল ধরে এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে হবে। যাতে সময় লাগবে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। 

একটা পাহাড়ের চূড়ায় উঠতেই দুই ঘণ্টা লাগবে। তারপর শুরু হবে জুকোর সমতল আর বুনো ট্রেইল, পাহাড়ের রিজ লাইন ধরে। কিন্তু সেটা যে এতটাই বুনো, প্রাচীন, খাড়া, ঝুঁকিপূর্ণ আর পিচ্ছিল সেটা ভাবনাতে ছিল না একদমই। 

দ্য ট্রেইল... 

একদম শুরুতেই অনেকটা খাড়া পাহাড়ি ট্রেইল। অনভ্যস্ততার কারণে হাঁপিয়ে গেলেও, দারুণ উপভোগ করছিলাম এমন নিখাদ প্রকৃতির মাঝে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়া। এই পাহাড়ি অরণ্যের মাঝে প্রকৃতির অদ্ভুত পরিবর্তন আমাদেরকে সবচেয়ে অবাক করে তুলছিল। অরণ্যের ফাঁক গলে দুপুরের তেজোদীপ্ত রোদ উঁকি দিয়ে যায়, তো কখনো ঘন কালো মেঘে পুরোটা অরণ্য আঁধারে ঢেকে যায়। একটু পরেই হয়তো মেঘ কেটে গিয়ে ঘন কুয়াশারা আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে যায়, আবার হয়তো টুপটাপ করে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পাহাড়ি আর পাথুরে পথকে ঝুঁকিপূর্ণ করে দিয়ে যেতে চায়। 

এমন অদ্ভুত রকমের প্রকৃতির পরিবর্তন কয়েক মিনিটেই দেখা হয়ে গেছে! এই পথে হাইকিং করতে করতে ঝড়, বৃষ্টি বা পাহাড়ি পাথুরে পিচ্ছিল পথের চেয়েও বেশি শঙ্কা জেগেছিল জোঁক নিয়ে। কারণ বর্ষার সময় এমন পাহাড়ি অরণ্যে জোঁকের রাজত্ব থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। তাই খুব সাবধানে গাছের লতাপাতা থেকে যতটা সম্ভব গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করছিলাম। প্রায় ৩০ মিনিট টানা উপরে ওঠার পরে উপর থেকে নিচে নেমে আসছে এমন একটা গ্রুপের সাথে দেখা হলো। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম আর কতটা উপরে উঠতে হবে? তারা জানাল, আরও এক ঘণ্টা অন্তত! 

যদিও আমরা জানতাম, তবুও পাহাড়ি ট্রেইলে ফিরে আসা অভিযাত্রীদের কাছ থেকে পথের দূরত্ব কমে আসার খবর শুনতে কেন যেন ভালো লাগে। তাদের কাছ থেকে আশার বাণী শোনাটা একটা টনিক হিসেবে কাজ করে। তাই পথের দূরত্ব আর সময়ের হিসেব জানা থাকার পরও আমরা জিজ্ঞাসা করি, অন্যরাও কম-বেশি করে থাকে। এই ট্রেইলের আর একটা মজার ব্যাপার ছিল ওঠানামার পথে যে কারো সঙ্গে দেখা হলেই হাই-হ্যালোর পাশাপাশি সেভ ট্রেকের জন্য একে অন্যকে শুভকামনা জানাচ্ছিল। এটা চমৎকার একটা ব্যাপার লেগেছে আমার কাছে। 

তো পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে উঠতে একটা সময় মনে হলো একটু বিশ্রাম নেই। কোথায় দাঁড়াব, কিছুটা সময় বসব-এই নিয়ে ভাবতে ভাবতেই বেশ কিছুটা উপরে একটু বেশি আলোময় টেবিলের মতো জায়গা আছে বলে আমার মনে হলো। কারণ চারদিকে ঘন জঙ্গলে তেমন একটা সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারছে না, পাশাপাশি ছিল মেঘ-কুয়াশার অবিরত লুকোচুরি খেলা, তাই উপরের দিকে তাকাতে তুলনামূলক একটু বেশি আলোময় জায়গাটায় গিয়ে প্রথম ব্রেক নেব বলে মনে মনে ঠিক করে উঠতে থাকলাম। 

মোটামুটি ১০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে দেখলাম আসলেই চমৎকার একটা বিশ্রামের জায়গা। একদম পাহাড়ি ঘন অরণ্যের মাঝে দিয়ে বাইরে বের হয়ে থাকা একটা ছোট্ট প্রাকৃতিক ব্যালকনি যেন। ব্যাকপ্যাক সেখানেই রেখে বসে গেলাম বাকি দুজনের জন্য অপেক্ষা করতে। টেবিলের তিনপাশে নানা রকম বড় বড় গাছের শিকড়ের উপরে ব্যাকপ্যাক রেখে কিছু সময় বিশ্রাম আর হালকা কিছু খাবার পানি দিয়ে এনার্জি গেইন করে নেওয়া হলো। প্রায় ১৫-২০ মিনিট বিশ্রাম নিয়েছিলাম সেই পাহাড়ি অরণ্যের কুয়াশা ঘেরা ব্যালকনিতে। তারপর আবারও খাড়া উঠে যাওয়া। 

তবে এবার আগের চেয়েও বেশি খাড়া মনে হলো পাহাড়ি সেই অরণ্যঘেরা ট্রেইলকে, কেন কে জানে? এই পথের আবার কোথাও কোথাও পাথরের পরিবর্তে শুধু মাটির পথও আছে, যা আরও বেশি ঝামেলার, ঝুরো মাটি জুতার তলায় লেগে থেকে পা ভারী করে ফেলে আর তাতে করে ট্রেকে কিছুটা হলেও সমস্যা হয়। হুট করেই সামনে চলে এলো একটা এমন জায়গা যেখানে উঠতে হবে একদম সোজাসুজি মাথায় উপরে। খুবই সরু একটা পথের পাশের পাহাড়ি গাছের ডালপালা আর শেকড় ধরে ধরে।

বেশ রোমাঞ্চকর, সেই সঙ্গে কিছুটা ভয়েরও। অবশ্য ভয় আর অনিশ্চয়তা আছে বলেই না সেটা রোমাঞ্চকর হয় বা লাগে। তবে আমার কাছে বেশ লাগছিল এজন্য যে সামনে খুব দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার তেমন তাড়া নেই আমার, হোক যতটা ধীরে কোনো সমস্যা নেই। কারণ মনের মধ্যে বিশাল যে আনন্দ ছিল সেটা হলো সাধারণত দুই দিনের পথ সেদিন আমরা একদিনে পাড়ি দিয়ে ফেলছি। সেটা কী রকম? 

অধিকাংশরাই ডিমাপুর থেকে কোহিমা এসে সাধারণত একদিন থাকে, থাকতেই হয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলতে আর সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ট্রেক শুরু করতে। কিন্তু ভাগ্য ভীষণ রকম সহায় ছিল বলে আমরা সময়ের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে, কোহিমা না থেকে সরাসরি ট্রেইলে চলে এসেছি ঝুঁকি নিয়ে আর সেটা কাজে লেগে যাওয়াতে, দুই দিনের পথ আমরা একদিনে এগিয়ে যেতে পারছি। যে কারণেই ট্রেকে আমাদের কোনো তাড়াহুড়া বা চাপ ছিল না। আর তাই কঠিন, ঝুঁকিপূর্ণ খাড়া পাহাড়ি ট্রেইলও আমাদের কাছে ছিল রোমাঞ্চকর আর উপভোগ্য। 

এভাবে গল্পে, কথায়, আড্ডায় কখন যেন ট্রেইলের শেষ প্রান্তে এসে গেছি বুঝতেই পারিনি। সামনে সরু আর একটা পাহাড়ি পথ এলো একদম মাথায় উপরে, হাঁ করে তাকিয়ে থেকে দেখে নিতে হয় এমন। কিন্তু এই পথটুকু ঝুরো মাটির আর গাছের শেকড়ের সহায়তায় পার হতে হবে। তবে আশার কথা এই যে উপরে বেশ আলোময় পরিবেশ দেখা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন কোনো একটা পাহাড়ি চূড়ার মতো আছে মাথার উপরের ট্রেইলটুকু উঠতে পারলেই। 

সেই অনুপ্রেরণায় গাছের শেকড়, ঝুরো মাটির পথ বেশ দ্রুতই উঠে গেলাম। হ্যাঁ, আসলেই তাই, উঠে গেছি সেই বেশ ঝুঁকিপূর্ণ, পাহাড়ি, পাথুরে আর পিচ্ছিল সেই পাহাড় চূড়ায়। আর তারপর যা পেলাম, যা দেখলাম, যে অনুভূতির মুখোমুখি হলাম তা অনেকটা এরকম; এই জায়গায় আসার জন্য, বসার জন্য, কিছুটা অলস সময় কাটানোর জন্য অমন আরও পাঁচটা পাহাড় বাইতে হলেও কোনো আফসোস হতো না। এতটাই স্বর্গীয় সুখানুভূতিতে আচ্ছন্ন করে ফেলার মতো একটা পাহাড় চূড়া! যার উল্টো পাশেই জুকোভ্যালি যাওয়ার মূল পাহাড়ি রিজ লাইনের সাইনবোর্ড। 

পাহাড়ে পা বিছিয়ে, কুয়াশার চাদর জড়িয়ে, মেঘেদের সঙ্গে কথা বলা

জীবনে যখন প্রচুর ভ্রমণ হবে, ভ্রমণে যখন বৈচিত্র্য আসবে, ভিন্ন ভ্রমণ লোকেশন যখন আপনাকে ঋদ্ধ করে তুলবে, সেই সময় কখনো কখনো এমন জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে, যা অন্যরকম, যা দেখে মনে হবে আসলেই ভ্রমণ করে জীবনে ভিন্ন কিছু পেয়েছি, যা পরবর্তী জীবনের জন্য গল্পের রসদ হয়ে রইল। এটা ঠিক এমন একটি জায়গা। 

খুব গভীরভাবে, একান্তে, নিজের সঙ্গে উপভোগ আর উপলব্ধি করার জায়গা। যেখানে চুপ করে বসে থেকে পায়ের নিচের পাহাড় আর সেই পাহাড়ের গায়ে গায়ে জড়িয়ে থাকা মেঘেদের দেখে অদ্ভুত সুখে পাগল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। একটা বেলা অনায়াসে শুধু মেঘ, পাহাড়, আর সবুজের পৃথিবীর দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে অদ্ভুত সুখে ভেসে যাওয়া। এক একবার ইচ্ছে হচ্ছিল মেঘেদের সঙ্গে, কুয়াশার সঙ্গে মিলিয়ে যাই, অরণ্যে বিলীন হয়ে যাই! পাহাড় থেকে একটা লাফ দিয়ে হারিয়ে যাই! উফ, কী যে অদ্ভুত রকমের এক একটা ইচ্ছা হয়েছিল সেদিন! 

বলছিলাম জুকোভ্যালি ট্রেক শুরুর পরে খাড়া পাহাড়ি অরণ্যে ঘেরা পাথুরে আর পিচ্ছিল ট্রেইলের শেষে যে পাহাড় চূড়াটায় উঠে অবাক বিস্ময়ে থ হয়ে গিয়েছিলাম। বলছিলাম আমার দেখা অন্যতম সুন্দর আর স্বর্গীয় এই পাহাড় চূড়ার কথা।

এখানে পাহাড় আছে পায়ের তলে, মেঘ এসে গায়ে পায়ে লেপটে যায়, কুয়াশারা বেখেয়ালেই ভিজিয়ে দিয়ে যায়, হিমেল হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায় আর সূর্যের মিষ্টি তাপ শরীরকে সুখে অবশ করে তুলে। এখানে বসে থেকে জাগতিক সব না পাওয়া ভুলে থাকা যায়। জীবনের কাছে নতুন কিছু চাইতে ইচ্ছে হয় না, কারও প্রতি কোনো অভিযোগ থাকে না, পৃথিবীকে বড় বিশুদ্ধ মনে হয়, জীবনকে ভীষণ নিষ্পাপ লাগে, কোথাও কোনো কলুষতা আছে বলে বিশ্বাস করতে মন চায় না। 

পাহাড়ের গায়ে গায়ে, গাছেদের ডালে ডালে, পাথরে পাথরে খোদাই করে এজন্যই বুঝি লেখা ছিল-পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখগুলো, অনেক কষ্টের পরেই ধরা দেয়।

সুখ পাহাড়ের গল্প!

জীবনের অল্প কিছু ভ্রমণে নানা রকমের পাহাড় দেখেছি। সবুজ থেকে সাদা, ন্যাড়া থেকে অরণ্যমোড়া, সাদা থেকে লাল, কালো থেকে ধূসরসব রকমের পাহাড়ই আমার কাছে ভীষণ ভালো লাগার, অনেক আনন্দের আর দারুণ উপভোগের। কিন্তু সত্যি বলতে কী এমন আদুরে, মন ভালো করে দেওয়া, অপলক তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করার মতো পাহাড় আগে দেখিনি। এই পাহাড় সারিগুলোর দিকে তাকাতেই কেমন যেন একটা সুখ সুখ অনুভ‚তিতে আচ্ছন্ন হয়ে যেত মন। এতটাই ভালো আর সুখানুভ‚তিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম যে এই পাহাড়ের আমি নাম দিয়েছি ‘সুখ পাহাড়’!

সেই সুখ পাহাড়ের ছোট্ট গল্পটা করি এবার। শুরুতে একটা ঘাস লতাপাতা দিয়ে আবৃত পাহাড়ের গা বেয়ে কিছুটা নিচে নেমে একটা ছোট্ট খাঁড়ি পার হয়ে অন্য একটি পাহাড়ে হাঁটা শুরু করতেই এতদিন ধরে অন্যের ছবিতে আর গুগলে দেখা অদ্ভুত মোহাচ্ছন্নতায় মোড়ানো সবুজের ঢেউ খেলানো পাহাড়ের ঢেউ দেখতে পেলাম। প্রথম দেখাতেই মুগ্ধতায় থেমে যেতে বাধ্য হলাম এবং ছবির সঙ্গে বাস্তবের এমন চমৎকার মিল পেয়ে কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম ঝটপট। এরপর অবাক চোখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো কিছু সময় তাকিয়ে ছিলাম সেদিকে। আর ঠিক তখনই একটা অদ্ভুত সুখানুভ‚তিতে আচ্ছন্ন হলাম। মনে হলো এই পাহাড়ের রিজ লাইন ধরে অনন্তকাল বুঝি হেঁটে যাওয়া যাবে ক্লান্তিহীন। 

আবারও হাঁটা শুরু করলাম। কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর পুরো পাহাড়ের ঢেউ খেলানো সবুজ সারির প্রায় পুরো ভিউ দৃষ্টিসীমায় যখন ধরা দিল, ব্যাকপ্যাক রেখে সেখানে বসে পড়লাম সেই পাহাড়ের সবুজ ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে প্রাণ ভরে উপভোগ করতে। কারণ তখন ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি যে এই ট্রেইলের পুরোটা পথই এমন সবুজের ঢেউ খেলানো পাহাড় সারি দিয়েই সাজানো আছে।

তাই বসে বসে দূরে ঢেউ খেলানো সবুজের মাঝে পাহাড়ের ঠিক মাঝখানে মাথায় সিঁথির মতো আঁকাবাঁকা একটা লাইন চলে গেছে এক পাহাড় থেকে এক পাহাড়ের মাঝে। তখনো বুঝতে পারিনি যে ওটাই আমাদের পুরো ট্রেকের পাহাড়ের ট্রেইল, অথচ তেমনই একটা ট্রেইলেই দাঁড়িয়ে আছি! যখন ওই পাহাড় ছাড়িয়ে একটু আগে ছবি তুলে রাখা পাহাড়ের ট্রেইলে গিয়ে পৌঁছলাম এবং পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম আরে যে ছবি একটু আগে তুলেছি, যে পাহাড়ের ট্রেইল দূর থেকে দেখে মুগ্ধ হয়েছি, সেই একই পাহাড় সারি, একই রকম ট্রেইল আর একই রকম সবুজের ঢেউ খেলানো পাহাড়েই হেঁটে এসেছি, কারণ পেছনে সেই একই দৃশ্য সামনের মতো হুবহু! 

তখনই প্রথম বুঝেছি পাহাড়ের মাঝের ওই সরু রেখাটাই আসলে আমাদের ট্রেক রুট, পাহাড়ের মূল ট্রেইল। এটা দেখা, বোঝা আর উপলব্ধি করার পর মুগ্ধতা যে আরও বেড়ে গেল। বিস্ময়ে আরও বেশি সুখে আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম, যেটুকু ক্লান্তি অনুভ‚ত হতে শুরু করেছিল, সেই ক্লান্তিটুকু দূর হয়ে সুখের নতুন একটা অনুভূতিতে হারিয়ে গেলাম। আর ঠিক তখনই সবুজের এই ঢেউ খেলানো পাহাড়, সবুজের এই ঢেউ, অদ্ভুত মোহময় এই পাহাড় সারির নাম দিয়েছি আমি ‘সুখ পাহাড়!’ 

জুকোভ্যালির বেস ক্যাম্পে...

ঢেউ খেলানো সুখ পাহাড়ে হেঁটে যখন অর্ধেক পথ শেষ করে ফেলেছি এক ঘণ্টা আগেই, দুই পাহাড়ের একটা জায়গায় কয়েকটা পাথরের মতো বেদি পেলাম, বসলাম একটু বিশ্রামের জন্য। একটু পানি আর দুটি খেজুর, একটু ঝালমুড়ি আর অল্প জুসের স্বাদ নিতে নিতে পাহাড় দেখছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম, প্রতিবার পাহাড়ে আসি ভীষণ তাড়া, অল্প সময়ে অনেকটা পথ এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে, পেছনে পড়ে থাকে ঘর-সংসার, বাচ্চাকাচ্চা আর কেরানিগিরির মতো শত রকম সামাজিকতা।

পাহাড়কে সেভাবে উপভোগ আর উপলব্ধিটা ঠিক করা হয়ে ওঠে না নানা রকম জাগতিক ব্যঞ্জনায়। এবারই শুধু তেমন কোনো চাপ ছিল না, অল্প সময়ে অনেকটা পথ এগিয়ে যাওয়ার তাড়া ছিল না, দ্রুত ঘরে ফেরার, দেশে ফিরে অফিসে পৌঁছানোর আর বাসায় গিয়ে সাংসারিক ব্যস্ততা ছিল না বলে সময়টা দারুণ কাটছিল, একদম নিজের মতো করে, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে, পাহাড়কে প্রাণ ভরে দেখে আর নিজের মতো উপলব্ধি করে।

আর এই কারণেই কিনা যেখানে ভেবেছিলাম জুকোর বেস ক্যাম্প বা রেস্ট হাউসে পৌঁছতে হয়তো সন্ধ্যা হয়ে যাবে। কিন্তু না, পাহাড়ের ভ্যালি, মুগ্ধ রিজ লাইন, সবুজে ঘিরে থাকা ট্রেইল, নল খাগড়ার জঙ্গল, ডাল-পাতাহীন শুকনো গাছের নিঃসঙ্গতা, কোথাও কোথাও একটু কাদাপানি, দু-একটা পাহাড়ি জলের ঝিরি, অন্ধকার পাহাড়ি বাঁক, মেঘ-সূর্যের লুকোচুরি, কুয়াশার আনাগোনা ভেদ করে কখন যে বেস ক্যাম্পের কাছে পৌঁছে গিয়েছি বুঝতেই পারিনি। 

এতটা তাড়াতাড়ি, ক্লান্তিহীন আর অল্প সময়ের মধ্যে যে সেদিনের ট্রেক শেষ হয়ে যাবে কিছুতেই বুঝতে পারিনি। মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে একটা ঝোপঝাড়ের ছাদের মতো ঘন অরণ্যের বাঁক পার হয়ে সামনে গিয়ে মাথা উঁচু করতেই দেখি বাঁশ দিয়ে বানানো গেটের মতো একটা স্বাগত জানানোর আয়োজন, যেখানে লেখা জুকোভ্যালিতে স্বাগত! যে গেটের দুই পাশের গাছপালা, অরণ্য ভেদ করে অদূরে তাকাতেই চোখে পড়ল দুইটা কটেজের মতো। তার মানে সত্যিই পৌঁছে গেছি। 

তখন সবেমাত্র বিকেল ৪টা! কটেজের খোলা আঙিনায় পৌঁছে ঘেমে যাওয়া কাপড় খুলে একটা কাঠের তক্তা দিয়ে বানানো বেঞ্চিতে সোজা হয়ে শুয়ে পড়লাম ব্যাকপ্যাক রেখেই। প্রায় ১৫ মিনিট চুপ করে শুয়ে থেকে আকাশ, পাহাড় আর মেঘ-কুয়াশার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কী যে একটা প্রশান্তি আর নির্ভার সময় ছিল সে বলে বোঝানোর মতো নয়। কোনো কাজ নেই জুকোর ঢেউ খেলানো পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া, কোনো ব্যস্ততা নেই, চোখে-মুখে ছুঁয়ে যাওয়া মেঘেদের জলের কণা মুছে ফেলা ছাড়া! 

যখন গায়ের ঘাম শুকিয়ে কিছুটা শীত শীত অনুভ‚তি হতে শুরু করল, ব্যাগ থেকে নতুন কাপড় বের করে চাপিয়ে দিতেই মনে হলো-শীত বুঝি জেঁকে ধরল মুহূর্তেই! এই সময়ে শীতকে প্রশ্রয় দিলে নিজেকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, তাই কটেজের বারান্দায় ব্যাকপ্যাক রেখে শীতের মধ্যেই বরফগলা জলে গা-মাথা ভিজিয়ে একটা জম্পেশ গোসল সেরে নিলাম পাশের পাহাড়ি ঝরনায় পাইপ লাগিয়ে পানির ব্যবস্থা করে রাখা কলে। 

গোসল শেষে ঝটপট ব্যাগের একদম নিচ থেকে গরম ট্রাউজার আর জ্যাকেট পরতে বাধ্য হলাম। সঙ্গে উলের মোজা, হাতে গ্লাভস আর মাথায় প্রিয় উলের বর্ণিল টুপিটা। এক মগ চা হাতে নিয়ে কিছুটা সময় নিজেকে এলিয়ে দিলাম গণরুমের কাঠের পাটাতনের শক্ত বিছানায়। কারণ আমার গোসল শেষ হতে হতে আরও দু-একজন এসে গিয়েছিল ট্রেকে যারা সঙ্গী ছিল। 

তারা রেজিস্ট্রেশন করে, আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে কটেজের নির্ধারিত জায়গায় বিছানা বরাদ্দ করে নিয়েছিল। এই সময়ে বেশ ক্লান্ত লাগছিল সত্যি। আগের দিন দুপুরের পর থেকে পরদিন বিকেল পর্যন্ত একটানা ২৪ ঘণ্টা জার্নি করার একটা স্বাভাবিক ক্লান্তি তো আছেই। যেটা ঝড়ের মতো ছুটে বেড়ানোর জন্য অনুভ‚ত হয়নি, কিন্তু ব্যাকপ্যাক ছেড়ে, গোসল করে ফ্রেশ হয়ে, বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতেই অনুভূত হয়েছিল। 

বেশ কিছুটা সময় শুয়ে থেকে শরীরকে আরাম দিয়ে উঠেছিলাম চায়ের খোঁজে। পাশের ডাইনিং বা রান্নাঘরে চায়ের ফরমায়েশ আর সন্ধ্যায় ডিনারের কথা বলে জুকোর উন্মুক্ত পাহাড়ের আঙিনায় গিয়ে বসলাম। তখন সেখানে বেশ কিছু দলের মিলনমেলা বসেছে। কেউ তাঁবু খাটিয়ে, কেউ স্লিপিং ব্যাগে নিজেকে ঢুকিয়ে রেখে, কেউ কটেজের ভাড়া করা টেন্টের ভেতরে আর কেউ কেউ দল বেঁধে বসে গানের আয়োজন করে চলেছে।

একদিকে গ্যাস স্টোভে রান্নার আয়োজন, অন্যদিকে নানা রকম সংগীতের একটা উদ্ভট মিশ্র সুরের সম্ভার পাহাড়ি নিস্তব্ধতাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। পাহাড়ের গিয়ে এসব আয়োজন, এত শব্দ, শত রকমের গানের সুর আমাকে শান্তি দেয় না, বরং কান ঝালাপালা করে তোলে বলে সেখানে বেশি সময় না থেকে নিজের কটেজের সামনের কাঠের বেঞ্চিতে এসে বসে চায়ে চুমুক দিলাম। 

চা শেষ হতে না হতেই মনে হলো শীতের প্রকোপ বোধহয় বেড়ে গেল। গ্লাভস পরে একটু সামনের দিকে হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে টের পেলাম, হেঁটে এখন ক্লান্ত না হয়ে বসে বসেই পাহাড় দেখা ভালো। কারণ হেঁটেই যা দেখা যাবে এখানে, শুয়ে বা বসেও তাই-ই। আলাদা কোনো কিছু দেখার সুযোগ তো নেইই; বরং শরীর ক্লান্ত করে এনার্জি লস করার কোনো মানে নেই। 

তাই আবারও বসে রইলাম সেখানে যেখানে প্রথম এসে বসেছিলাম। মুগ্ধ চোখে তাকিয়েছিলাম অনন্ত সময়, কাছে দূরের ঢেউ খেলানো জুকোভ্যালির দিকে, ক্ষণে ক্ষণে ছুটে চলা মেঘেদের দিকে তাকিয়ে, মাঝে মাঝে নিজেকে কুয়াশার চাদরে জড়িয়ে আর বিকেল শেষের একটা অলস সন্ধ্যা শেষে পাহাড়ি পূর্ণিমা দেখার অভিপ্রায়ে। 

কারণ সেদিন পূর্ণিমার ঠিক আগের দিন ছিল। আকাশে ভরা চাঁদ আর পাহাড়ের রুপালি জ্যোৎস্নার আয়োজনের সবরকম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল প্রকৃতি। সেই অপার্থিব পাহাড়ি জ্যোৎস্না দেখার অপেক্ষায় রুমে ঢুকে গেলাম আরাম করে বিশ্রাম নিয়ে রাতের পাহাড় আর রুপালি চারপাশ উপভোগের নেশায়।

ভ্যালি জুড়ে মুগ্ধতা, প্রতি বাঁকে মাদকতা! 

বেসক্যাম্প থেকে হাঁটা শুরু করতেই বেশ অনেকটা নিচে নেমে যেতে হয় ঘন ঘাসের সরু পথ মাড়িয়ে। যেতে যেতে একটা-দুটো পাহাড়ের খাদে গিয়ে অন্য একটা পাহাড়ে উঠতে হয় আগের চেয়েও উঁচুতে। শুরুর এই দুই পাহাড়ে নামা-ওঠাটাই এই ট্রেকের যা কষ্টের ব্যাপার। বাকি পুরোটা সময় শুধু মুগ্ধতা, মাদকতা আর মায়াবী পাহাড়ের মাঝে নিজেকে সঁপে দেওয়া। খাড়া পাহাড় বেয়ে নিচে নেমে আর একটা পাহাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে উঠেই পুরো জুকোভ্যালির সত্যিকারের আর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার মতো ভিউ পয়েন্ট।

বেশ অনেকটা সময় সেই পাহাড় চূড়ার বসেছিলাম একদম একা একা। আশেপাশে, কাছে-দূরে, দৃষ্টিসীমার মধ্যে কোনো প্রাণীর দেখা মেলেনি পুরোটা সময়। শুধু বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ, অনেক অনেক গভীরে দুই পাহাড়ের মাঝের কোনো একটা জায়গা থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম একটা অদেখা, অচেনা ঝরনাধারার বয়ে চলা জলের শব্দ। আবারও কিছু শুকনা খাবার ও পানি খেলাম আর চকলেট মুখে পুরে একটু পিছিয়ে এসে মূল ভ্যালিতে নেমে যেতে শুরু করলাম। 

সরু ট্রেইলের গা ঘেঁষা দূরত্বে বড় বড় নল খাগড়ার গাছ আর নানা রকম ঘাস। কোথাও কোমর সমান আবার কোথাও মাথা ছাড়িয়ে যায় প্রায়, দু-এক জায়গায় আবার হাঁটু সমান জঙ্গলের পথও মাড়িয়ে যাচ্ছিলাম। একটা পাহাড়ের পুরোটা প্রায় এমন পথেই নেমে গেছি কোনোদিকে না তাকিয়ে। শুধু পায়ের শব্দ, ঘাসের গন্ধ আর নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে। এই পাহাড়টা শেষ করে যখন সামনের ছোট্ট নদী পেয়ে গেলাম, তখন খুব ইচ্ছে হচ্ছিল একটু ভিজি, গোসল করি, সাঁতার কাটি, নয়তো চুপ করে নিজেকে ভাসিয়ে দেই সেই পাহাড়ি অচেনা নদীতে। হেঁটে আসা পথের দিকে অনেকটা সময় তাকিয়ে ছিলাম অবাক চোখে। কী অপূর্ব, কী মুগ্ধতা জড়ানো আর কী মায়াময় পথে হেঁটে এসেছি বুঝতে পারিনি এতক্ষণ। 

এরপর পায়ের জুতা খুলে নদী পার হয়ে, যখন নতুন আর একটা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করলাম তখন সেই পাহাড়ের সবটুকু রূপ-রস-গন্ধ-সুর-সংগীত আর পাহাড়ের মুগ্ধতা উপভোগ করতে শুরু করেছিলাম তারিয়ে তারিয়ে। নাম না জানা পাখির গান, অচেনা ফুলের ঘ্রাণ, মেঘ-কুয়াশার ছুঁয়ে যাওয়া, শীতল জলের স্পর্শ, কচি ঘাসের গন্ধ, পাহাড়ের নিখাদ রূপ, নীরব-নিস্তব্ধ ট্রেইল-সবকিছু এতটাই আকুল করে রেখেছিল যে, কখন যে সামনে আরও একটা পাহাড়ি ছোট্ট নদী এসেছিল এবং মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেটাও পেরিয়ে এসেছি বুঝতেই পারিনি। দ্বিতীয় নদীটা পেরিয়ে যখন পায়ে জুতা পরতে ভুলে গিয়ে অন্য আর একটা পাহাড়ের খাড়া ট্রেইলে চড়তে শুরু করেছিলাম, তখন পায়ের তলায় নুড়ি পাথরের আঘাত লাগতে লাগল, তখনই কেবল অনুভব করেছিলাম আমি খালি পায়ে। 

এরপর একটানা সেই মন পাগল করা মুগ্ধ পথে, পাহাড়ি খাড়া ট্রেইল বেয়ে উঠে গিয়েছিলাম দূর থেকে দেখা সেই সফেদ গির্জার আঙিনায়। এটা আর একটা পাহাড়ের ঠিক চূড়ায়। যেখান থেকে জুকোভ্যালিকে উপভোগ করা যায় আরও নতুন ও অদ্ভুতভাবে। অনেকটা সময় চড়া রোদে বসেছিলাম সেখানে। এরপর সেই একই পথে, মুগ্ধতা মেখে, মায়ায় জড়িয়ে, মিহি পথে পেরিয়ে এসেছিলাম জুকোভ্যালির পাগল করা ট্রেকে। জীবনকে সেদিন উপভোগ করেছিলাম সবটুকু আবেগ দিয়ে, সবটুকু ভালোলাগা আর ভালোবাসা দিয়ে, পাহাড়কে সেদিন উপভোগ করেছিলাম মন-প্রাণ আর হৃদয়ের সবটুকু সুখ দিয়ে! 

যে ট্রেক, যে ট্রেইল, যে পথ, যে পাহাড় বাকি জীবনের জন্য অন্যতম মন ভালো করার ছবি আর গল্প হয়ে গেছে আমার সুখ স্মৃতির বুক পকেটে! 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫