
মার্জিহে মেশকিনি। ছবি: সংগৃহীত
মার্জিহে মেশকিনির জন্ম ১৯৬৯ সালে ইরানের রাজধানী তেহরানে। তিনি হলেন বিখ্যাত ইরানি চলচ্চিত্র পরিচালক মহসীন মখমলবফের স্ত্রী। তিনি মখমলবফ ফিল্ম স্কুলে চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘দ্য ডে আই বিকেম আ ওম্যান’। এটা ছিল তিন পর্বের একটি চলচ্চিত্র। যেখানে তিনি এক চিত্রপটের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছিলেন ইরানের নারী সমাজের তিনটি প্রজন্মের কথা এবং ইরানি নারীদের জীবনধারণের ইতিবৃত্তকে।
‘দ্য ডে আই বিকেম আ ওম্যান’ ইরানের লঘু হাস্যরস, বিদ্রুপাত্মক সামাজিক রীতি এবং চমৎকার নাটকীয়তার সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে। এখানে নারীবাদী ও পুঁজিবাদ বিরোধী বিশ্বদর্শনের দিকে প্রাধান্য দিয়ে ধর্মের অন্ধকারাচ্ছন্ন অনুশাসনকে কড়াভাবে নিন্দা করা হয়েছে।
চলচ্চিত্রটির প্রথম পর্বে ছোট্ট হ্যাভা নামের মেয়ে শিশুটিকে তার খেলার সাথি হাসানের সঙ্গে খেলতে বাধা দিয়েছিল তার পিতামহী ও মা। এর একমাত্র কারণ হলো শিশুটি ৯ বছরে পদার্পণ করেছে। সামাজিক মতে সে এখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে। ফলে ছেলেদের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করা তার এই বয়সে শোভা পায় না। বড়রা শিশুটিকে নির্দেশ দিয়েছেন বোরখা, হিজাব পরার জন্য। তারা হ্যাভাকে বুঝিয়েছেন তার নারী জীবন শুরু হবে আকাশে দিনের আলো ফোটার সময় থেকেই; কিন্তু শিশুটির মা ও পিতামহী দুপুর পর্যন্ত তাকে নিষ্কৃতি দিয়েছিল। তারা উঠানে লাঠি পুঁতে বলেছিলেন-ছায়া উধাও হতেই তার মেয়েবেলা সমাপ্ত হবে। দুপুর হওয়ার আগে ঘরে না ফিরলে আল্লাহ তাকে কখনো ক্ষমা করবেন না। সেই জন্য ছোট্ট হ্যাভা তার ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে ছায়া মাপে।
দ্বিতীয় পর্বে দেখানো হয়েছে-এক তরুণ বিবাহিত নারীকে। তিনি অন্য নারীদের সঙ্গে সাইকেল প্রতিযোগিতা করছেন। পরনে তাদের কালো রঙের ঢিলাঢালা বোরখা, যা ইরানের মতো ধর্মীয় অনুশাসনে আবদ্ধ দেশগুলোতে দেখা যায়; কিন্তু স্থানীয় ধর্মীয় নেতা, গ্রামবাসীরা, এমনকি তার স্বামী, স্বামীর পরিবারের সব সদস্য তার বিরোধিতা করেছিল। তারা নারীটিকে হুমকি দিয়েছিল সে যদি এই প্রতিযোগিতা থেকে নিজেকে গুটিয়ে না নেয়, তবে তারা তাকে বর্জন করতে বাধ্য হবে।
আবার তৃতীয় পর্বে দেখা যায়, চাকাওলা কেদারায় বসা এক বৃদ্ধাকে। স্বপ্ন দেখছেন সেই জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাপনের, যা বিবাহিত জীবনে তিনি কখনো অর্জন করতে পারেননি।
মার্জিহে মেশকিনি বলেছেন মানুষের কথা। সাম্য প্রতিষ্ঠায় ফিনিক্সের মতো জ্বলে উঠে যিনি চলচ্চিত্রকে রূপান্তর করছেন প্রতিবাদের ভাষায়, সেই মার্জিহে হলেন প্রথম ইরানি নারী পরিচালক। ২০০০ সালে তার নির্মাণ করা চলচ্চিত্রটি ৫৭তম ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সমালোচনা সাপ্তাহিক বিভাগে অংশ নেয় এবং তিনি তিনটি পুরস্কার পেয়েছিলেন। সেগুলো যথাক্রমে‘ সিনেমাভেনিয়ার অ্যাওয়ার্ড’, ‘ইসভেমা অ্যাওয়ার্ড’, ‘ইউনেসকো অ্যাওয়ার্ড’।

এছাড়াও তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন ২০০০ সালে বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। শিকাগো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সিলভার হুগো’ সম্মানে, নানটেস থ্রি কন্টিনেন্ট ফেস্টিভ্যালে মনোনীত হয়েছিলেন ‘গোল্ডেন মন্টগোলফায়ার’-এর জন্য। তার ঝুলিতে ‘অডিয়েন্স অ্যাওয়ার্ড’, ‘স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ড’, ‘ইয়াং অডিয়েন্স অ্যাওয়ার্ড’। এছাড়াও অসলো চলচ্চিত্র উৎসবে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমালোচক সংঘ পুরস্কৃত করেছে এই চলচ্চিত্রটি। এছাড়াও পুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পায় এটি এবং সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সিলভার স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ড’-এর জন্য মনোনীত হয়েছিল।
প্রথম চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে তিনি ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছেন দেসালোনিকি চলচ্চিত্র উৎসবে। একই বছর টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘ডিসকভারি অ্যাওয়ার্ড’ পান, যা তার খ্যাতিকে আরও প্রসারিত করেছিল।
মেশকিনির দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘স্ট্রে ডগস্’-২০০৪ সালে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের তালিকায় মনোনীত হয় এবং একাধিক পুরস্কার অর্জন করে। তিনি অর্জন করেছেন সমগ্র বিশ্বের বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার। এছাড়াও সহযোগী নির্দেশক হিসেবে কাজ করেছেন সমীরা মখমলবফের সঙ্গে ‘দ্য অ্যাপেল’, ‘দ্য ব্ল্যাকবোর্ডস’, ‘অ্যাট ফাইভ ইন দ্য আফটারনুন’, ‘টু লেগড্ হর্স’ চলচ্চিত্রে।
বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে ‘ক্রিস্টাল বিয়ার’ পুরস্কার পাওয়া হানা মখমলবফের নির্দেশিত ‘বুদ্ধা কোলাপসড আউট অব শেম’ চলচ্চিত্রটির পাণ্ডুলিপির লেখক ছিলেন মেশকিনি। এই চলচ্চিত্রটিকে কেন্দ্র করে ইরানের ঝুলিতে ছিল সান সেবাস্তিয়ানের ‘গ্র্যান্ড জুরি অ্যাওয়ার্ড’ এবং হংকং চলচ্চিত্র উৎসবে মনোনীত হয়েছিল এশিয়ার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে।
‘মার্ঘে অ্যান্ড হার মাদার’ (২০১৯), ‘দ্য প্রেসিডেন্ট’ (২০১৪), ‘স্ট্রে ডগস্’ ছবির পাণ্ডুলিপি মেশকিনি নিজের হাতেই লিখেছিলেন। ২০০৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দ্য ম্যান হু কেম উইথ দ্য স্নো’ সিনেমাটিতে মহসীন মখমলবফের সঙ্গে যৌথভাবে নির্দেশনা দিয়েছিলেন তিনি। এই চিত্রনাট্যের রূপকারও এই মখমলবফ দম্পতি। এছাড়াও ২০০৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সেক্স অ্যান্ড ফিলোসফি’ সিনেমাটির নির্দেশনায় ছিলেন মেশকিনি; কিন্তু পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন মহসীন মখমলবফ।
ইরানের চলচ্চিত্র জগতের বহুল চর্চিত তার প্রথম সিনেমা নিয়ে ফিল্ম ইন্টারন্যাশনালকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন মার্জিহে। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ হয়েছিল ২১ ডিসেম্বর, ২০০০ সালে। ইরানি সিনেমা জগতের এই গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রকর্মী, পরিচালক ও সাহসী মানবী মার্জিহে মেশকিনির সাক্ষাৎকারটি মখমলবফ ফিল্ম হাউসের ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করে সাম্প্রতিক দেশকাল ঈদ সংখ্যার জন্য ভাষান্তর করেছেন লেখক ও অনুবাদক সুদেষ্ণা ঘোষ।
নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার জন্য কি কোনো নির্দিষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন?
পুরুষরা তো বটেই, এমনকি নারীদের মধ্যেও অপর নারীর প্রতি স্বল্প বিশ্বাস পোষণ করার প্রবণতা দৃঢ়ভাবে লক্ষ করা যায়। তারা বিশ্বাস করেন শুধু কিছু সংখ্যক মানুষের মধ্যেই এই শিল্পসত্তা বিদ্যমান রয়েছে এবং তারা হলেন পুরুষ শ্রেণি। বিশ্বের সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে-নারীদের তুলনায় পুরুষেরাই বেশি চলচ্চিত্র তৈরি করছে। নারী পরিচালকদের সংখ্যা পুরুষ পরিচালকদের ১০ শতাংশেরও কম। চলচ্চিত্র উৎসবে উপস্থিত চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে প্রায় এক শতাংশ পরিচালক নারী।
বর্তমানে ইরানে পুরুষ চলচ্চিত্র পরিচালকের সংখ্যা ৫০০ জন এবং নারী চলচ্চিত্র পরিচালকের সংখ্যা ১০ জন, অর্থাৎ পরিসংখ্যানগত দিক থেকে মোট পরিচালকের মধ্যে মাত্র দুই শতাংশ। চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে একজন নারীর মুখ তেমনই সমাজের কাছে একটি সমস্যাপূর্ণ বিষয়। যেমন আজ পর্যন্ত আমাদের দেশে কোনো নারী প্রধানমন্ত্রীর পদে স্থান পায়নি। এটাই হলো আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ফল। প্রকৃতপক্ষে পুরুষদের প্রতি নারীদের অগাধ বিশ্বাস সর্বক্ষেত্রেই বিদ্যমান। শুটিং চলাকালে চলচ্চিত্রকর্মীদের সামনে আমাকে প্রমাণ করার জন্য একজন পুরুষের চেয়েও দ্বিগুণ দক্ষতার প্রমাণ দিতে হয়েছিল।
এত বাধার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও ইরানি চলচ্চিত্র কীভাবে সফলতা অর্জন করতে পারে, এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?
আমি মনে করি, বাস্তবিকপক্ষে ইরানি আর্টফিল্ম বর্তমান বিশ্বের সৃষ্ট চলচ্চিত্রগুলোর থেকে পৃথক এক সত্তা, যা হলিউড প্রযোজনাগুলোর অধীনে রয়েছে এবং বেশিরভাগ চলচ্চিত্রই তৈরি হচ্ছে হলিউড চলচ্চিত্রকে অনুসরণ করে।
রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আপনি কি কোনো সরকারি সহায়তা পেয়েছিলেন?
না, ‘দ্য ডে আই বিকেম আ ওম্যান’ নির্মাণে কোনো সরকারি সহায়তা পাইনি। চলচ্চিত্রটির প্রযোজনা করেছিল মখমলবফ ফিল্ম হাউস। আমরা বাজেটের কিছু অংশ সংগ্রহ করেছিলাম ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে। বক্স অফিস থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে এই ঋণ শোধ করার বিষয়ে আমরা আশাবাদী ছিলাম।
চলচ্চিত্র নির্মাণের বিষয়টি কীভাবে আপনার মধ্যে আগ্রহের সঞ্চার করেছিল?
আমি চলচ্চিত্র তৈরি করতে পছন্দ করি। ইরানে এমন অসংখ্য নারী আছেন, তাদের যদি সুযোগ দেওয়া হতো, তবে তারাও চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী হতো। আমি হলাম সৌভাগ্যবানদের মধ্যে একজন। সেই সুযোগ আমি পেয়েছি। চার বছর ধরে আমি মখমলবফ ফিল্ম স্কুল থেকে প্রায়োগিক ও ধারণাগত প্রশিক্ষণ নিয়েছি। সমীরার সব চলচ্চিত্রেই আমি সহযোগী কর্মী হিসেবে কর্মরত ছিলাম।
এছাড়াও মহসীনের ‘দ্য সাইলেন্স’ এবং ‘দ্য ডোর’ চলচ্চিত্রে সহযোগী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছি। প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ চলাকালে আমি তিন পর্ব বিশিষ্ট চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলাম। এটাই ছিল আমার স্নাতকের প্রকল্প।
এই চলচ্চিত্র শিক্ষায়তনের যাত্রা কীভাবে শুরু হয়েছিল?
সমীরা যখন বিদ্যালয় ছেড়ে চলচ্চিত্র সম্পর্কে পঠন-পাঠন করার সিদ্ধান্ত নিল, তখন তার বাবা মহসীন এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করলেন তার মেয়েকে নিজের তদারকিতে রাখার জন্য। দেশের বিদ্যমান চলচ্চিত্র মহাবিদ্যালয়গুলোর ওপর তার বিন্দুমাত্র আস্থা ছিল না। আমি ও আরও কয়েকজন এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করি এবং সেই শিক্ষায়তনে ভর্তি হই। প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ছিল কঠিন; কিন্তু উল্লাসপূর্ণ।
সেই সময়ে প্রতিদিন ৮ থেকে ১৬ ঘণ্টা শিক্ষায়তনেই আমাদের সময় কাটত। আমরা সেখানে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে পঠন-পাঠন করতাম। যেমন-বিদেশি ভাষা, চলচ্চিত্র বিশ্লেষণ, ইতিহাস, গান, কবিতা, ছবি আঁকা, চলচ্চিত্র সম্পাদনার প্রয়োগভিত্তিক কাজ, শব্দধারণ ও অভিনয়ের সময়সূচির তালিকা প্রস্তুত, এমনকি সাঁতার ও গাড়ি চালনাও।

সমীরা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
তিনি প্রচুর পরিশ্রম করেন। সমীরা হলেন বুদ্ধিমান, প্রতিভাবান ও প্রগতিশীল ব্যক্তিত্বের একজন নারী।
সমীরার সাফল্যের জন্য তিনি বাবার কাছে কতটা ঋণী বলে আপনি মনে করছেন?
তিনি মেয়েকে চার বছর ধরে চলচ্চিত্র সম্পর্কে শিক্ষাদান করেছিলেন। মেয়ের ছোটবেলা থেকেই তিনি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে শুটিংয়ের জায়গায় যেতেন। আপনি বলতে পারেন তিনি সমীরার কাছে ছিলেন একজন যথাযথ পরামর্শদাতা। সমীরা যখন পরিচালনার কাজ করতেন তখন তার বাবা কোনোভাবেই মেয়ের কাজে হস্তক্ষেপ করতেন না। সমীরা বলেন-তার বাবা তাকে চলচ্চিত্র তৈরির কাজ এত ভালোভাবে শিখিয়েছে যে, যদি কখনো তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ ভুলেও যান তবে সমীরা তা শিখিয়ে দিতে পারবেন।
কোনদিক থেকে তিনি আপনার চেয়ে আলাদা?
এটা অযৌক্তিক তুলনা। আমি সবসময়ই আমার মতো হওয়ার চেষ্টা করি এবং সমীরা হলেন সমীরার মতোই।
‘দ্য অ্যাপল’ এবং ‘দ্য ব্ল্যাকবোর্ডস’-এ সহযোগী পরিচালক হিসেবে আপনার কাজ কী ছিল?
পরিকল্পনা প্রস্তুতিতে, পেছনের সারির অভিনেতাদের নির্দেশনা প্রদানে আমি সাহায্য করতাম। আবার কখনো কখনো আমি মঞ্চ সজ্জাতেও অংশগ্রহণ করতাম।
মহসীন মখমলবফের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?
তিনি ছিলেন আমার শিক্ষক। চার বছর ধরে তিনি আমাকে শিখিয়েছেন। ‘দ্য সাইলেন্স’ এবং ‘দ্য ডোর’ নামের দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণে আমি তার সহকর্মী হিসেবে কাজ করেছিলাম। এখন আমরা ছয় বছর ধরে বিবাহ জীবন অতিবাহিত করছি।
একজন নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার জন্য স্বামীকে কেন্দ্র করে আপনি কোন সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হয়ে থাকেন?
আমাদের সমস্যা হলো, আমরা একে অপরের প্রতি ভীষণভাবে ভালোবাসায় আবদ্ধ।
আপনার স্বামী যদি চলচ্চিত্র পরিচালক না হতেন তাহলে কি চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে পারতেন?
ইরানে ১০ জন নারী নির্দেশক আছেন এবং তাদের মধ্যে কেউ কোনো চলচ্চিত্র পরিচালককে বিয়ে করেননি। কোনো নারীকে চলচ্চিত্র নির্মাতা রূপে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে চলচ্চিত্র নির্দেশককে বিয়ে করা আবশ্যক নয়; কিন্তু আমি যদি কোনো চলচ্চিত্র নির্মাতাকে বিয়ে না করতাম তবে চলচ্চিত্র সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার থেকে বের হতে আমার আরও বেশি সময় লাগত। হয়তো তখন আমি অগ্রসর হতাম শিল্প দ্যোতনার দিকে। যেমন ছবি আঁকা অথবা গালিচা বুনন, আবার হতে পারে ইরানিদের ঐতিহ্যবাহী শিল্পের দিকে। অন্যদিকে এই ঘটনাও সত্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নারী চলচ্চিত্র নির্মাতারা পরিচালককে বিয়ে করেছেন; কিন্তু এই প্রশ্নটি ফাঁস করে দিয়েছে নারীদের প্রতি বিশ্বাসের ঘাটতির বিষয়টিকে।
মহসীন আপনাকে চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন নাকি এটা আপনার ইচ্ছা ছিল?
চলচ্চিত্র তৈরি সম্পর্কে সব জ্ঞান আমি মহসীনের কাছ থেকেই পেয়েছি। আমার এটা জানানো উচিত রান্নাঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে জীবন কাটানো এমন কোনো নারীর পাশে তিনি দাঁড়াতে পারতেন না।
আপনার চলচ্চিত্র নারীকেন্দ্রিক হওয়ার কারণ কী?
যেহেতু আমি একজন নারী। ফলে নারীদের সমস্যাগুলো আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আমি বিশ্বাস করি, সামাজিক ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে আমাদের উচিত সমান অধিকার আদায়ের দাবিতে সোচ্চার হয়ে তাদের সাহায্য করা।
চলচ্চিত্রটির স্ক্রিপ্ট কে লিখেছিলেন?
স্ক্রিপ্টের সাধারণ খসড়া তৈরি করেছিলেন মহসীন। সংলাপ ও দৃশ্যের খুঁটিনাটির সংযুক্তিকরণ করেছি আমি। স্ক্রিপ্টের কিছু অংশ তৈরি হয়েছিল শুটিং চলাকালে।
আপনি কি মনে করেন ৯ বছর বয়সী ইরানি মেয়েরা প্রকৃতপক্ষেই বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে?
বুনিয়াদি সম্প্রদায় এটা করে; কিন্তু শহরে এটা হয় না। আইনগতভাবে মেয়েরা সাবালিকা হয় ৯ বছর অতিক্রম করার পর এবং অপরাধ করে বিচারালয়ে দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের প্রাপ্তবয়স্ক বলে গণ্য করা হয়; কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে বিষয়টা অন্যরকম।
এটা কি ইসলামের নিয়ম?
কিছু ধর্মীয় বিশেষজ্ঞরা এই নিয়মের বিরোধিতা করেন। মেয়েদের তারা সাবালিকা হিসেবে বিবেচনা করেন জৈবিক বয়ঃসন্ধিকালকে। তাদের মতাদর্শ আইনি ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি।
প্রথম পর্বে দৃশ্যমান পিতামহী কেন মেয়েটির বাড়ি থেকে বাইরে বের হওয়ার বিপক্ষে ছিলেন?
কারণ পুরুষদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কর্তৃত্ব স্থাপনের বিষয়টিকে নারীদের মন আগ্রাসন করে নিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মেয়েদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অন্যায় ও নির্যাতনকে তারা সমর্থন করে। দেখা যায় তারা পুরুষদের চেয়েও বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ।
চিরাচরিত একই সমাজগোষ্ঠীতে বসবাস করা সত্ত্বেও কেন মায়ের প্রতিক্রিয়া পিতামহীর প্রতিক্রিয়া থেকে ভিন্ন দেখানো হয়েছে?
চলচ্চিত্রটি মূলত প্রস্ফুটিত করেছে নারীদের তিনটি প্রজন্মকে-বৃদ্ধ বয়স, মধ্য বয়স ও তরুণ বয়সকে। আজকালকার তরুণীরা চায় স্বাধীনতা। সাধারণত তারা তাদের মন ও বুদ্ধি উভয়কেই অনুসরণ করে চলে। তাদের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা নেই। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা অর্জন করতে শেখেনি। এরপর আমরা শ্রেণিবদ্ধ করেছি মধ্যবর্তী প্রজন্মকে। এদের চিহ্নিত করা হয়েছে মধ্যবয়স্ক মানুষ হিসেবে।
তারা স্বাধীনতার কথা কল্পনা করে বেশ উত্তেজিত হলেও একই সময়ে তারা ভীত হয়ে যায় প্রাচীনকালের চিরাচরিত প্রথা এবং রীতিনীতির কথা মনে করে। দুই প্রজন্মের মধ্যবর্তী পর্যায়ে অবস্থান করে তারা অস্থিরতায় জীবন কাটাচ্ছে। বৃদ্ধ প্রজন্মের খুঁটি হলো প্রথাগত পুরনো রীতিনীতি। এর সঙ্গে ভবিষ্যতের কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের সবকিছুই প্রথাগতভাবে পূর্বনির্ধারিত। একই বাড়িতে থাকা তিন প্রজন্মের মধ্যে আধুনিকতার বিরুদ্ধে প্রথাগত রীতিনীতির যে বিরোধ সেই দৃশ্যই তুলে ধরা হয়েছে এই চলচ্চিত্রটিতে।

চলচ্চিত্রে দুজন বৃদ্ধাকে দেখানো হয়েছে। এদের মধ্যে একজন কিছুতেই বাড়ি থেকে বাইরে বের হন না এবং তার নাতনিকেও বাইরে বের হতে দেন না। আর তৃতীয় অংশে একজন বৃদ্ধা, যিনি আধুনিক জিনিসপত্র কেনার স্বপ্ন দেখার মতো দুঃসাহস করেছিলেন। এই দুজনের ভাবনার মধ্যে পার্থক্যের কারণ কী?
চলচ্চিত্রের প্রথম পর্বের বৃদ্ধ নারীটির জীবন অতিবাহিত হয়েছে গ্রামাঞ্চলে এবং তৃতীয় পর্বের অপর বৃদ্ধাটির জীবন কেটেছে শহরে। তবুও উভয়ের জীবনের সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু একইসমাজে আত্মপ্রকাশের সমস্যা। তৃতীয় পর্বে প্রদর্শিত আধুনিক সরঞ্জাম কিনতে তৎপর বৃদ্ধাটি বলেন কাচের কেটলি ব্যবহার করা হলো লজ্জাহীনদের কাজ। তার মতে, এটা নিজেকে প্রদর্শন করা হিসেবে গণ্য হয়। তিনি আরও বলেন, এ ধরনের কেটলি বর্জন করার মুখ্য কারণ হলো-এই বস্তুর মধ্য দিয়ে অন্যরা দেহের অংশ দেখতে পাচ্ছে। চেতনাহীন সহ্যক্ষমতা তৈরি হয়েছে চিরাচরিত প্রথার মধ্য দিয়ে।
গ্রাম ও শহরের বৃদ্ধপ্রজন্ম অথবা আজকের দিনের প্রজন্ম পূর্বে ছিল প্রথাগত রীতিনীতিতে আবদ্ধ। মধ্যবয়স্ক ও তরুণ প্রজন্মের ওপর বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি রূপে চাপানোর চেষ্টা করা হচ্ছে এই চিরায়ত রীতিনীতিকে। একদিকে আধুনিক প্রযুক্তিতে উৎপাদিত দ্রব্যগুলোকে প্রবীণ প্রজন্ম খুব সহজেই গ্রহণ করেছেন; কিন্তু অন্যদিকে সেই দ্রব্য ব্যবহার করতে গিয়ে তাদের চিরায়ত প্রথার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করতে হচ্ছে। অন্যভাবে বলা যায়, বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিকে অগ্রাহ্য করে প্রবীণ প্রজন্ম আধুনিক দ্রব্য ব্যবহার করছেন।
মানুষের ওপর আমার বিশ্বাস আছে, বিশেষত সাধারণ মানুষের ওপর। তারা মনের মধ্যে দৃঢ়ভাবে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছে। এত সহজে তারা এটাকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারবে না। এই ভাবনা ইরানের গণতন্ত্রের বিলম্বিত প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটি অনন্য দৃষ্টিকোণ তৈরি করেছে। প্রবীণ প্রজন্মকে নিজের মতো জীবন কাটাতে দেওয়ার বিষয়ে তরুণদের সম্মতি দেওয়া উচিত। তারপর তারা এই জীবন ত্যাগ করে সম্মানের সঙ্গে চলে যাবেন, বিশ্ব মতাদর্শের সঙ্গে সম্পৃক্ত পরিবর্তন আনার আগেই। দেশে গণতান্ত্রিক বনাম স্বৈরতন্ত্রের যুদ্ধটি ঠিক যেন মায়ের সঙ্গে মেয়ের অথবা বাবার সঙ্গে ছেলের যুদ্ধ।
চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত ওড়না এবং পিপাগুলো প্রতীক হিসেবে কি কোনো বিশেষ কিছুকে ইঙ্গিত করেছে?
ইরান হলো তেল উৎপাদনকারী দেশ। বিশেষত দেশের দক্ষিণাংশগুলোতে বেশিরভাগ ভ‚গর্ভস্থ তেল সংরক্ষণাগার রয়েছে। তেলের পিপা সর্বত্রই দেখা যায়। শিশুদের জন্য এই পিপাগুলো শেষ পর্যন্ত খেলনায় রূপান্তর হয়েছে। পিপা নিয়ে শিশুরা নানা খেলা খেলে। ফলে বলা যায়, এটা বিভিন্ন চিহ্ন হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করে। আমার চলচ্চিত্রে পিপা স্বীকৃতি পেয়েছে প্রাচুর্যের প্রতীক হিসেবে এবং ওড়না হলো ইরানি নারীদের চিহ্ন। যদি এই দুটি বস্তু সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায় তবে আমরা স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করতে পারব। সাধারণভাবেই ব্যক্তিবিশেষে প্রত্যেকেরই নিজস্ব প্রতীকী ধারণা রয়েছে।
কোন দলের সঙ্গে কাজ করা আপনার পক্ষে তুলনামূলক সহজ?
পেশাদার ও অপেশাদার উভয় অভিনেতাদের সঙ্গেই আমি কাজ করেছি। প্রথম ও তৃতীয় পর্বের উভয়েই ছিলেন অপেশাদার; কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে ছিলেন তিনজন পেশাদার অভিনেতা। তারা হলেন-যাজক, স্বামী ও মুখ্য নায়িকা। তিনি একজন মঞ্চ অভিনেত্রী। আমার সঙ্গে কাজটি ছিল তার জন্য চলচ্চিত্র জগতের প্রথম অভিজ্ঞতা। কিছু সময় মনে হয় একক চলমানচিত্রই (ঞধশব) এই কাজের জন্য যথেষ্ট; কিন্তু একটা সময়ে দেখা যেত ১০টিরও বেশি চলমানচিত্র পেয়ে যেতাম। এই সবকিছু নির্ভর করছে আসলেই তুমি কী অর্জন করতে চাও-তার ওপর। যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য অনেকবার আমাকে একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি করতে হয়েছিল। আবার কখনো বা মনে হয়েছিল অভিনেতাদের মধ্যে কোথাও যেন সেই আবেগ অনুপস্থিত রয়েছে।
অভিনেতাদের সঙ্গে আপনার কাজ করার পদ্ধতি কেমন ছিল?
পেশাদার অভিনেতাদের আমি পুরো বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, চরিত্রের সঙ্গে একেবারে মিশে যাওয়ার জন্য বিষয়টিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তাদের সামনে তুলে ধরা উচিত। অপেশাদারদের জন্য আমি অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলাম। সে ক্ষেত্রে এমনভাবে আমি দৃশ্য তৈরি করতাম তা দেখলে মনে হবে যেন আমরা কোনো খেলায় অংশগ্রহণ করেছি। এমন এক দৃশ্য যেখানে তারা আচার আর লজেন্স খাচ্ছিল। আমি তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম এটা একটি প্রতিযোগিতা। এখানে তাকেই বিজয়ী মনে করা হবে যে এই আচার আর লজেন্সগুলো আয়েশ করে খেতে পারবে।