Logo
×

Follow Us

ঈদ সংখ্যা

আষাঢ়ে গপ্পো

Icon

সৌগত রায় বর্মণ

প্রকাশ: ০৭ মে ২০২৩, ১৪:৫০

আষাঢ়ে গপ্পো

গল্প। প্রতীকী ছবি

এক

-লাস্ট ট্রেনটা বোধ হয় আর পাবেন না। লেট হয়ে গেছে।

-এখন ১১টা। চল্লিশ মিনিট হাতে আছে। না পাওয়ার তো কোনো কারণ দেখছি না।

-না। পাবেন না। যা বৃষ্টি পড়ছে। বাস এতক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। 

-আশ্চর্য! আমি রোজ এই সময়েই এখান থেকে বাসে উঠি। দিব্বি পেয়ে যাই।

-ভুল বললেন। রোজ আপনি এই সময়ে এখানে আসেন না। কাল ও পরশু এসেছিলেন ৮টা ৫০ মিনিটে। তার আগের দিন ৮টা ৫১ মিনিটে। তারও আগের...

-দাঁড়ান দাঁড়ান। আগে বলুন আপনি কে? আমার টাইম টেবিল মুখস্থ রেখেছেন? কেন?

-ছি ছি, আমাকে কি আপনি খোচর ভেবেছেন নাকি?

-তা নয় তো কী? আমি কটার সময় বাস ধরতে এই স্টপেজে আসি, সেটা আপনি মুখস্থ রেখেছেন! কেন? আমার ব্যাপারে নাক গলানোর আপনি কে?

-আরে না না। সে রকম কোনো উদ্দেশ্য আমার নেই। আসলে ওই যে পান-বিড়ির দোকানটা দেখছেন। ওটা আমার। আজ আর খদ্দের আসবে না বলে ঝাঁপ ফেলে দিয়েছি। বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম। আপনাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম।

-আমাকে আপনি চেনেন?

-না, তেমনভাবে নয়। তবে রোজ দেখি তো তাই মুখ চেনা হয়ে গেছে। আজ কিন্তু আপনি খুব লেট করে ফেললেন! ট্রেন ধরার জন্য একটু আগে আসা উচিত ছিল। যা বৃষ্টি নেমেছে! আপনার ব্যাগে তো ছাতা আছে। আশ্চর্য! ছাতা ব্যাগে রেখে কেউ প্লাস্টিক মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে?

-ছাতাটা ছেঁড়া। মাই গড! কে আপনাকে আমার পেছনে লাগিয়েছে! নইলে এই প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে আমাকে ফলো করার আর কী কারণ থাকতে পারে!

-লজ্জা দেবেন না স্যার! প্রত্যেকেরই একটা মানসম্মান আছে। আমাকে কেউ লাগাতে পারে না। আমি নিজেই লাগি।

-যেমন আমার পিছনে লেগেছেন?

-আবার লজ্জা দিলেন! আচ্ছা এই বৃষ্টিতে একা একা দাঁড়িয়ে থেকে কী করতেন বলুন তো ? অযথা দুশ্চিন্তা বাড়াতেন! তার চেয়ে এই যে দুজনে গপ্পো মারছি, সেটা আপনার ভালো লাগছে না ? আপনি বড্ড বেরসিক মশাই!

-আপনাকে আমার অসহ্য লাগছে। যেখানে যাচ্ছিলেন সেখানেই যান না। আমার পেছনে কেন পড়ে রয়েছেন?

-পড়ে থাকব কেন? সঙ্গ দিচ্ছিলাম। ট্রেন তো পাবেন না! বাড়ি ফেরাও হবে না। তখন তো কারোর না কারোর খোঁজ করবেন! তাই আপনাকে ছেড়ে যেতে পারছি না। আরে মশাই দেখবেন যাকে এখন অসহ্য মনে হচ্ছে তাকেই তখন কাজে লাগবে!

-আমাকে রেহাই দিন ভাই। আপনাকে আমার কোনো কাজেই লাগবে না।

-আপনি কি জ্যোতিষী নাকি যে বলে দিলেন আমাকে আপনার কোনো কাজে লাগবে না! লাগতেই পারি!

-আপনি বড় নাছোড়বান্দা তো! কী করলে আমাকে মুক্তি দেবেন ভাই? পায়ে ধরব?

-ও কাজটি করবেন না। কারোর পায়ে ধরা মোটেই সম্মানজনক কাজ নয়। তার চাইতে আমাকে সহ্য করে নিন, দেখবেন আপনার ভালোই হবে। আমি খারাপ লোক নই।

-সত্যি কথা বলতে কী, এখন আমি কথা বলার মুডে নেই। তাই দয়া করুন। আপনি প্লিজ যান।

-আমি তো যেতেই পারি। কিন্তু আপনার কী হবে?

-আমার ব্যবস্থা আমিই করব। আপনাকে করতে হবে না।

-তা কি হয় নাকি? একে আপনি ট্রেন মিস করে ফেলেছেন। 

মাথায় বৃষ্টি। যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। এই অবস্থায় আপনাকে ফেলে আমি চলে যাব? বাঙালির কালচার বলে কিছু নেই? এবার আমিই আপনার পায়ে ধরছি, আমাকে থাকতে দিন। আপনার একটা ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত আমি কোথাও যাচ্ছি না। ব্যস।

একটা কালো গাড়ি হুশ করে পাশ দিয়ে জোরে বেরিয়ে গেল। ছেটানো জলে ভিজে গেল দুটো মানুষ। তারপর সব নিস্তব্ধ। শুধু অঝোরে বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। কালো রাস্তা। দুটো মানুষ। চারদিক চুপ।

দুই

-আপনি চুপ মেরে গেলেন কেন?

-কী করব? আপনি বিরক্ত হবেন, তাই কিছু বলছি না।

-আসলে ট্রেনটা মিস করে গেলাম। বৃষ্টি থামারও কোনো লক্ষণ নেই। কোথাও একটু বসা যায় না? আচ্ছা আপনার কাছে কোনো সিগারেট আছে? আমারগুলো সব ভিজে গেছে।

-আজ্ঞে আছে, তবে সিগারেট নেই। বিড়ি। চলবে?

-হ্যাঁ হ্যাঁ চলবে। ভিজে যায়নি তো?

-না। প্লাস্টিকে জড়িয়ে রেখেছিলাম। একটা দেশলাইও আছে। দেখি জ্বলে কি না!

-আমার কাছে লাইটার আছে। দিন একটা বিড়ি দিন।

-বেশ কড়া আছে স্যার! গলায় লাগতে পারে। সাবধানে টান মারবেন।

-এ কী বিড়িতে গাঁজার গন্ধ? গাঁজা পুরে রেখেছেন নাকি?

-কেন? গাঁজা খান না? খুব ভালো নেশা স্যার। এই বৃষ্টিতে দেখবেন কেমন জলপরি হয়ে আকাশে উড়ছেন!

-আপনি যাচ্ছেতাই লোক মশাই! গাঁজা পোরা আছে সেটা আগে বলবেন তো?

-বললে কী হতো? খেতেন না। মিস করতেন স্যার। মিস। বিপদের সময় শিব হয়ে যান। মাথা পরিষ্কার হয়ে যাবে। বলুন কেমন লাগছে?

-আপনার কি ধারণা, আমি গাঁজা খাইনি?... বাঃ মাথাটা বেশ ফাঁকা হয়ে আসছে। ভালো লাগছে ভাই, ভালোই লাগছে।

-কী বলেছিলাম তো স্যার! কে যে কখন কোনো কাজে লাগে তা কি আগে থেকে বলা যায়? আপনি তো আমাকে সহ্যই করতে পারছিলেন না।

-আমি লোকটা একটু অদ্ভুত। কাউকেই ঠিক বিশ্বাস করতে পারি না। কিছু মনে  কোরো না ভাই। তোমাকে আমি ভুল বুঝেছিলাম।

-ছি ছি, এভাবে বলবেন না স্যার! আমি আবার বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে মাথা ঘামাই না। যা মনে আসে বলে ফেলি! তবে আপনাকে একটা ব্যাপারে সাবধান করে দিই, নেশার ঝোঁকে আমাকেও কিছু বলবেন না। আসলে আপনি তো আমাকে ঠিক চেনেন না তাই।

-ঠিক বলেছ। তবে তোমাকে চিনি বা না চিনি, তুমি লোক খারাপ নও। নইলে এত রাতে আমার সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজবে কেন? এত রাতে জলে দাঁড়িয়ে আমাকে সঙ্গ দেবেই বা কেন?

-ওটাই আমার দোষ স্যার। কেউ বিপদে পড়েছে দেখলেই আমি পাশে গিয়ে দাঁড়াই। চেষ্টা করি তাকে সাহায্য করতে। এই যেমন আপনি।

-ঠিক করনি ভাই। আমার মতো অচেনা অজানা একটা লোকের সঙ্গে এতক্ষণ থাকাটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি।

-আমি একটু বোকাই স্যার। লোকে তো তাই বলে।

-মোটেই তুমি বোকা নও। আচ্ছা আমার বাস ধরার টাইম টেবিল তুমি জানলে কী করে? 

-লক্ষ করে। আমার দোকানটা তো আপনি দেখেইছেন। রাত বাড়লে খদ্দের কমে যায়। তখন বাসস্টপের দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোকে লক্ষ করি। এত রাতে লোকগুলো কোথায় যায়? কার বাড়ি কত দূর? কেউ রোজ ঠিক সময়ে আসে। কেউ এলোমেলো। টাইমের ঠিক থাকে না। আপনি কিন্তু গত চার দিনে চারটে টাইমে এসেছেন। আজ বড্ড রাত করে ফেললেন। তাই যেচে আলাপ করতে এলাম। ও মাই গড! ভিজে যে একেবারে ন্যাতা হয়ে গেছেন!

তিন

২টার সময় দুটি পুলিশের গাড়ি দূর থেকে ছুটে আসছে। বৃষ্টির দাপট ক্রমশ বেড়েই চলেছে। নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান। 

-স্যার পুলিশের গাড়ি। এই পাড়ায় নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে। এত রাতে কী এমন ঘটতে পারে বলুন তো? ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। আসুন ওই দেওয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়াই।

-কী ঘটেছে বল তো?

-কী আর ঘটবে, খুনখারাপি হবে।

-খুন?

-অবাক হয়ে গেলেন যে? 

-না না অবাক হবো কেন? খুনখারাপি তো হামেশাই ঘটছে। তুমি জানো নাকি ঠিক কী ঘটেছে?

-স্যার দেখুন দেখুন! পুলিশের গাড়ি সামনের গলিতে ঢুকে গেল। ওই গলিতে আপনার বন্ধুর বাড়ি না? ভদ্রলোকের নাম সত্যব্রত। বেশ কয়েক মাস আগে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। যে চলে গেছে তাকে নিয়ে ভাবার কিছু নেই। কষ্ট হয় উনার স্ত্রীর জন্য। এই বয়সে বিধবা হওয়াটা খুব বেদনার।

-তুমি এত কথা জানলে কী করে?

-এখন ওসব কথা বলার সময় নেই। তাড়াতাড়ি আড়ালে যেতে হবে। আসুন, সামনেই একটা ঠেক আছে। ওখানে জামা-কাপড় শুকিয়ে নিয়ে চায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এই বৃষ্টির মধ্যে গরম চা আর স্পেশাল বিড়ি তো আগে খাওয়া যাক। তারপর অন্য কথা ভাবা যাবে।

দুজনে ফুটপাতের অন্ধকার আড়াল নিয়ে একটু দূরে চলে গেল।

চার

-এই আমার ঠেক। মাঝে মাঝেই আসি। আপনি ওই কাঠের বাক্সটার ওপর আরাম করে বসুন। জামা খুলে দড়িতে টাঙিয়ে দিন। ফ্যান চালিয়ে দিই। ঠান্ডা লাগলে, বিছানার চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নেবেন। আমি চায়ের জল চড়িয়ে দিচ্ছি।

-কিন্তু তুমি।

-সব কথা পরে হবে স্যার। আগে গুছিয়ে নিই। গরম গরম চা খান। শরীর তাজা তারপর আমরা কথা বলব।

-আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। তুমি আমার বন্ধুর কথা কতটুকু জানো?

-কে সত্যদা? না না তেমন কিছুই জানি না। আমার দোকানে মাঝে মাঝে আসতেন। কড়া জর্দা দেওয়া পান খেতেন। দামি সিগারেট নিতেন। এই আর কী! বৌদিও আসতেন। মাথায় লাল টিপ পরলে বেশ ভালো লাগত। বৌদিকে সুন্দরী বলা যেতে পারে। আরে এই দেখুন কথা বলতে বলতে চায়ের জলই চাপানো হয়নি। 

-চুপ! চা পরে হবে। সুনন্দার সঙ্গে তোমার আলাপ ছিল? কথা হতো?

-আরে আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? এক পাড়াতে থাকি, তার উপর আমি দোকানদার, আলাপ থাকবে না? বৌদি মিষ্টি পান খেতেন। জর্দা দিয়ে নয়।

-সুনন্দা তোমাকে আর কী কী বলেছে?

-বৌদির নাম যে সুনন্দা, তা তো আজকেই শুনলাম। আপনার কাছ থেকে। সুনন্দা বৌদির সঙ্গে আপনার মানে ইয়ে মানে ওই আর কী ইয়ে টিয়ে ছিল নাকি স্যার?

-শাট আপ! বেয়াদপ! সুনন্দাকে আমি বন্ধুর বৌ হিসেবেই দেখতাম। আর কিছু নয়।

-তাহলে রেগে যাচ্ছেন কেন? বুঝতেই তো পারছেন, এই বৃষ্টির রাতে আপনাকে একটু উত্তেজিত করছিলাম। আচ্ছা একটা কথা, সুনন্দা বৌদির নাম শুনলেই আপনি এত তেড়েফুঁড়ে উঠছেন কেন বলুন তো? আমি তো কোনো খারাপ ইঙ্গিত করিনি।

-আলবাত করেছ। সুনন্দার সঙ্গে আমার সম্পর্ক নিয়ে আজেবাজে প্রশ্ন করেছ?

-শুধু আমি না স্যার! এ পাড়ার অনেকেই আপনার কথা বলাবলি করে। আপনাকে চেনে। অবশ্য না চেনার কোনো কারণ নেই। আপনি তো প্রায়ই আসেন। সে যাকগে। কিন্তু আজ রাতে এত দেরি করে বেরোলেন কেন? রোজের থেকে প্রায় তিন ঘণ্টা বাদে?

-মেরে মুখ ভেঙে দেব বাস্টার্ড! 

-এই তো আবার মাথা গরম করে ফেলছেন! আরে বাবা আমি কি ভুল কিছু বলছি? যখন সুনন্দা বৌদির ঘরে আসেন তখন বাজে ৬টা। সাধারণত ৮টার মধ্যে, বড়জোর ৯টার পর বেরিয়ে যান। স্বাভাবিক। ট্রেন যাত্রীরা টাইম মেন্টেন করে। কিন্তু আজ ১১টা বেজে যাচ্ছে। আপনি বেরোচ্ছেন না দেখে বেশ চিন্তায় পড়ে গেছিলাম। দেরিতে বেরোনোর ফল তো পেলেন। টাইম ঠিক রাখতে পারলেন না! কখন যে কোথায় কী ঘটে যায় কে জানে! 

-কী ঘটে যায়?

-তা তো জানি না। আপনি জানেন?

-আমি? আমি কী জানব?

-দাঁড়ান চা হয়ে গেছে। চায়ে আদা দিয়েছি। এক চুমুক মারলে মন তাজা হয়ে যাবে। সঙ্গে স্পেশাল বিড়ি।

-তুমি সুনন্দার কথা কী যেন বলছিলে?

-বলব বলব। যা হবার তা তো হয়েই গেছে এখন আর তাড়াহুড়ো করবেন না। নিন চা খান। আর বিড়ি ধরিয়ে দিলাম, ইচ্ছেমতো টান দিন। দেখবেন মাথাটা ফুরফুরে লাগছে। আর আমি যখন আছি তখন চিন্তা করবেন না।

-সুনন্দার কী হয়েছে? বেঁচে আছে?

-না। গলা টিপে কে যেন বৌদিকে খুন করেছে। তবে আপনার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। ঘটনাটা ঘটেছে আপনি ঘরে ঢোকার ঠিক সাড়ে ৪২ মিনিট আগে।

-কী করে বুঝলে?

-খবর নিয়ে। আমি একবার যাকে চোখে দেখেছি ও মনে রেখেছি, তার ওপর নজর রাখাটাই আমার কাজ।

বাইরে বৃষ্টির ছাট বেড়েই চলেছে। ভাঙা জানালা দিয়ে ঘরে জল ঢুকছে। 

পাঁচ

-কি ভয় কেটেছে তো? আর একটু হলেই ফেঁসে যেতেন।

-ভাই তুমি তখন কোথায় ছিলে?

-সিসি ক্যামেরা চেক করতে গিয়েছিলাম। 

-ওই অ্যাপার্টমেন্টে সিসি ক্যামেরা আছে?

-আলবত আছে। একটা-দুটি নয়। আটটা। কি ভয় পেয়ে গেলেন নাকি? চিন্তা করবেন না স্যার, ওই ক্যামেরাই আপনাকে বাঁচিয়ে দিল।

-মানে?

-খুব সিম্পল। আপনি যখন গেট দিয়ে ঢোকেন তখন ৮টা ২৫। যখন লিফটে ওঠেন তখন ৮টা ২৭। লিফটে চার তলায় উঠতে ঠিক বাইস সেকেন্ড সময় লাগে। তার মানে ৮টা ২৭ মিনিট ২২ সেকেন্ডে আপনি বৌদির ঘরের সামনে দাঁড়ান। একটু সময় নেন। দেখেন দরজা খোলাই আছে। আপনি ঘরে ঢোকেন। সময় তখন ৮টা ২৮ মিনিট ৯ সেকেন্ড। অন্তত সিসি ক্যামেরা সেই তথ্যই দিচ্ছে। সুনন্দা বৌদিকে যখন হত্যা করা হয়, আমার অনুমান আপনি তখন লিফটে। 

-তুমি তখন কোথায় ছিলে?

-কেন? জানালায়। সিসি ক্যামেরা ঠিক করছিলাম।

-আমাকে দেখতে পেলে?

-নিশ্চয়ই। আপনি সুনন্দা বৌদির নাড়ি দেখলেন। পেলেন না। বডি তখন শক্ত হয়ে গেছে। তার মানে মৃত্যু হয়েছে আরও আগে। এটাও আপনার বেঁচে যাওয়ার আরেকটা কারণ। আপনি কী করবেন বুঝতে না পেরে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। আমিও আপনার পিছু পিছু গেলাম। আপনাকে উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছিল। স্বাভাবিক। এত বড় একটা অপরাধ চোখের সামনে দেখলে মনের উপর চাপ পড়ে। আপনি চা খেলেন। সিগারেট খেলেন তারপর রাস্তা দিয়ে এলোমেলো ঘুরে বেড়ালেন। অনেকটা পথ ঘুরে আবার চলে আসলেন সুনন্দার ফ্ল্যাটে। রাত তখন ১০টা ৭। আপনি লিফটে ওপরে গেলেন। দরজা খোলা। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখে নিলেন কেউ আছে কিনা। বিছানায় পড়ে আছে সুনন্দার মৃত শরীর। তখন বৃষ্টি নেমে গেছে। প্রবল। আপনি ক্লান্ত পায়ে বাসস্ট্যান্ডে এলেন। এতটাই অন্যমনস্ক ছিলেন যে ছাতাটাই খুলতে ভুলে গেলেন। স্বাভাবিক। ছাতা ব্যাগে রেখে ভিজতে ভিজতে দাঁড়িয়ে রইলেন ঠায়।

-সুনন্দাকে কে মারল তাহলে?

-কেউ একজন এসেছিল। সাড়ে ৬টা নাগাদ।

-সে কে? চেনা?

-জানি না। সিসিটিভি চেক করতে হবে। তবে ওটা এতক্ষণে পুলিশের জিম্মায়। আমার কিছু করার নেই। আচ্ছা, ওই সময় আপনি কোথায় ছিলেন?

-আমি? মানে কোথায় ছিলাম? ট্রেন ধরতে স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

-আসছিলেন কোথায়?

-এখানেই। সুনন্দা আসতে বলেছিল। কী একটা জরুরি কথা আছে।

-কথা হলো?

-না, তার আগেই তো সব শেষ হয়ে গেল! 

-সুনন্দা কী বলত তা আপনি জানেন?

-না। কী করে জানব?

-সুনন্দার সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা ঠিক কী ধরনের? প্রেমের?

-তোমাকে সেটা বলতে আমি বাধ্য নই। এটা আমার ব্যক্তিগত বিষয়।

-আরে রেগে যাচ্ছেন কেন। পুলিশ যাতে আপনাকে ফাঁসাতে না পারে আমি সেই চেষ্টাই করছি। কিন্তু আমি যদি সাক্ষ্য না দেই, তবে তো ফেঁসে যাবেন।

-খুন তো আমি করিনি। তুমিই বলেছ। দেশে আইন বলে কিছু নেই? বিচারক তা দেখবেন না?

-দেখলেই ভালো। আসলে আমার যেটা খটকা লাগছে তা হলো সুনন্দার ঘরে সাড়ে ৬টার সময় কে এসেছিল?

-বললাম তো আমি নই। অন্য কেউ হবে।

-প্রশ্নটা তো সেখানেই। সে কে?

বাইরে বৃষ্টি মনে হচ্ছে আরও বেড়ে গেল। 

ছয়

-রাত শেষ হয়ে আসছে। অনেকক্ষণ অনেক আষাঢ়ে গপ্পো হলো, এবার আসল কথায় আসি। আপনি কি সুনন্দাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন?

-এর মধ্যে কোনো অন্যায় নেই। সুনন্দা বড় একা। দোকা হলে ক্ষতি কী?

-কিচ্ছু ক্ষতি নেই। সত্যদা সুনন্দার নামে মোটা টাকার পলিসি করে গেছিলেন। ফ্ল্যাটের মালিকানাও সুনন্দার নামে। আপনি নাকি নমিনি হওয়ার জন্য তাকে চাপে রেখেছিলেন।

-তাতে তোমার কী? সুনন্দা আমার প্রেমিকা। তার সম্পত্তি কে নেবে আমি ছাড়া? তুমি?

-নিতেও পারি। সুনন্দাকে আমি বিয়ে করেছি রেজিস্ট্রি করে। এই কথাটা বলার জন্যই ও আপনাকে ডেকেছিল।

-ইউ বাস্টার্ড! লায়ার। সুনন্দাকে আমি বিয়ে করেছি। 

-আপনার আরেকটা বিয়ে আছে। স্ত্রী জীবিত। সুনন্দাকে সে কথা বলেননি। কোর্টে সে বিয়ে নাকচ হয়ে যাবে।

-শাট আপ!

-চিল্লাবেন না। ফ্ল্যাট, টাকা এখন সব আমার। আর আমার বদলে পুলিশ আপনাকেই খুঁজছে। আমি সাক্ষী না দিলে ফাঁসি আপনার সুনিশ্চিত। আমি পুলিশকে ফোন করেছি, এই এলো বলে।

বাইরে ভারী বুটের আওয়াজ। ঠিক দরজার বাইরে। বাঘের মতো স্যার ঝাঁপিয়ে পড়ল ভাইয়ের ওপর। ব্যাগ থেকে একটানে বার করে আনল ছাতাটা। ছাতার সুচালো মাথাটা ভাইয়ের বুকে গেঁথে দিতে যেতেই গর্জে উঠল পুলিশের রিভলবার। গুলি চলে গেল স্যারের মাথার একপাশ থেকে আরেকপাশ ফুঁড়ে। 

সাত

-থ্যাংক ইউ অফিসার। তবে গুলি না চালালেই পারতেন। অপরাধীর সঙ্গে অপরাধও ফাইলের অন্তরালে চলে গেল।

-উপায় ছিল না স্যার! আপনাকে প্রায় গেঁথে দিয়েছিল ছাতার মাথা দিয়ে।

-অত সহজে পারত না। তবে ভালোই হয়েছে। এই কেস আদালতে দাঁড়াত না। লোকটা ছাড়া পেয়ে যেত।

-কেন স্যার?

-কোথায় সিসি ক্যামেরা? সব তো আষাঢে গপ্পো! আলতু ফালতু টাইম বলে লোকটাকে ঘাবড়ে দিয়েছিলাম। লোকটা তো বর্ন ক্রিমিনাল নয়। সেরকম হলে কাবু করতে পারতাম না। একেবারেই এলেবেলে। ধরা পড়ার ভয়ে আমার কথাগুলো বিশ্বাস করেছিল। এবার অলিতে গলিতে সিসি ক্যামেরা লাগানোর চেষ্টা করো। নইলে ক্রিমিনালদের ধরা আমাদের কম্ম হবে না। বুঝলে?

-আচ্ছা স্যার, সুনন্দা দেবী কি আপনার পরিচিত?

-হ্যাঁ, আমার মাসতুতো বৌদি। সত্যব্রত মারা যাওয়ার পর এই লোকটা বৌদিকে খুব বিরক্ত করছিল। সত্যদার কলিগ ছিল। সুনন্দা বৌদির একাকিত্বের সুযোগ নিয়ে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিল। সুতরাং বুঝতেই পারছ খুনের মোটিভ কী? বৌদিকে সরিয়ে দিতে পারলে ফ্ল্যাট ও বীমার টাকা লোকটার হাতে চলে আসবে। মোটিভ আর বেনিফিসিয়ারি কে চিহ্নিত করতে পারলেই খুনিকে ধরা সহজ হয়ে যায়।

-আপনি এই লোকটার সম্পর্কে এত কিছু জানলেন কী করে?

-সুনন্দা বৌদিই বলেছিল। আমার সাহায্য চেয়েছিল। বৌদি লোকটাকে সহ্য করতে পারত না। তাই লোকটাকে আমি চোখে চোখে রাখতাম। ওই বাড়ির দারোয়ানকে ফিট করে রেখেছিলাম, লোকটা আসলেই যেন আমাকে ফোন করে। আজ সাড়ে ৬টায় দারোয়ানের ফোন পেয়েই চলে আসি। কিন্তু রাস্তায় বড্ড দেরি হয়ে গেল হে! আমি আসার আগেই লোকটা যা করার করে ফেলেছে।

-স্যার একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। লোকটা সুনন্দা বৌদিকে খুন করতে গেল কেন? ওদের তো বিয়েই হয়নি?

-ওসব কথা পরে তোমাকে বুঝিয়ে বলব। এখন বডি পাহারায় রেখে গাড়িতে ওঠ। আর বেশিক্ষণ ভিজলে নির্ঘাত নিউমোনিয়ায় ধরবে।

হুটার বাজিয়ে সাদা গাড়ি কালো অন্ধকার ভেঙে থানার দিকে রওয়ানা হলো।

তিন মাস বাদে

-হ্যালো! কাজ কতদূর?

-হ্যাঁ স্যার আপনার কেসটাই প্রসেস করছিলাম। কাল আপনার কাছে আসছি। ম্যারেজ সার্টিফিকেটের অরিজিনালটা আছে তো? ওটা মোস্ট ভাইটাল।

-আমি একজন পুলিশ অফিসার। কোনো কিছুই ভুলে যাই না। কাজ নিখুঁতভাবে করাই আমার কাজ। সব কিছুই রেডি করা আছে। টাকা কবে আমার অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার হবে? 

-এই মাসেই হয়ে যাবে স্যার। চিন্তা করবেন না স্যার, একটা কথা বলব? শুনলাম ওই ফ্ল্যাটটা নাকি বিক্রি করে দেবেন?

-হ্যাঁ তাই ভাবছি। খদ্দের আছে?

-খুব ভালো আছে স্যার। মালদার পার্টি।

-তাহলে খোঁজ লাগাও। তাড়াতাড়ি। আর একটা কথা, মাল ভালো পেলে তোমার ফিসটা না হয় একটু বাড়িয়ে দেব।

-সে আপনার ইচ্ছে। আচ্ছা আপনার কেসটা লাস্ট মোমেন্ট একটু মিলিয়ে নিই। আপনার মৃতা স্ত্রীর নামটা যেন কী?

-সুনন্দা রায়।

-কজ অব ডেথ?

-অপঘাত। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫