
রূপকথা। প্রতীকী ছবি
ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ কালো মানুষের দেশ-পূর্ব আফ্রিকার সোমালিয়া। শান্তি ও সমৃদ্ধিতে যে দেশ ছিল আফ্রিকার সুইজারল্যান্ড, আজ সেই দেশ এক বিভীষিকার নাম। সোমালিয়ার নাম শুনলেই সবার চোখে ভাসে যুদ্ধবিগ্রহ আর জলদস্যুদের কথা। অথচ রাজধানী শহর মোগাদিসুর রয়েছে বর্ণাঢ্য ইতিহাস। সোমালিয়ার পশ্চিমে ইথিওপিয়া, উত্তর-পশ্চিমে জিবুতি, উত্তরে এডেন উপসাগর, পূর্বে ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ-পশ্চিমে কেনিয়া। মালভূমি, সমভূমি ও উচ্চভূমি নিয়ে সোমালিয়া গঠিত।
দেশটির আবহাওয়া মূলত উষ্ণ, কদাচিৎ বৃষ্টি হয়। সোমালিরা মূলত মুসলিম ধর্মাবলম্বী। সুদূর অতীতে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল এটি। মধ্যযুগে বেশ কয়েকটি সোমালি সাম্রাজ্য আঞ্চলিক বাণিজ্যের নেতৃত্ব দিত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এখানে উপনিবেশ স্থাপন করে ব্রিটেন ও ইতালি। ১৯৬০ সালে বেসামরিক সরকারের অধীনে স্বাধীন সোমালি প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়। ‘আধুনিক সোমালিয়া’ প্রতিষ্ঠা লাভ করার পর ষাটের দশকে এর ছিল স্বাধীনতা, সমৃদ্ধি ও গণতন্ত্রের ইতিহাস; কিন্তু সোমালিয়ায় একসময় সামরিক স্বৈরাচারী অপশাসন এসে সেখানকার মানুষের জীবন বিপন্ন করে ফেলে। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় দেশটির সমাজ। লাখ লাখ মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে আশ্রয় নেয় উদ্বাস্তুশিবির অথবা প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশে।
এতকিছুর মধ্যেও এদেশের রয়েছে লোকগল্পের সমৃদ্ধ ইতিহাস। সোমালিয়ার জলদস্যুদের গল্প সকলেরই জানা রয়েছে যেমন, তেমনই এই অঞ্চলের দারিদ্র্যের ইতিহাসও জানা রয়েছে। এদেশের মানুষের মূল লড়াই অনাহারের সঙ্গে। তবে শুধু খিদে নয় নিজেদের ভাষাগত ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্য সোমালিয়ার মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাদের লোকগল্পগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এখানকার পাথুরে মাটি, সাভানা অঞ্চল, গুবান মরুভূমি, উপকূলীয় অঞ্চল সোমালিয়ার মানুষকে অস্তিত্বের জন্য সর্বদা লড়াইয়ে প্রস্তুত করে নিয়েছে। সংগ্রামের স্পৃহায় এখানের লোকগল্পগুলো বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়। এই সোমালিয়ায় গোষ্ঠীর প্রচলন চোখে পড়ে খুব। দারদ, ঈশাক, হাউয়ে, ধীর প্রভৃতি নানান গোষ্ঠীর বসবাস।
গত শতকের কয়েক দশক ধরে বিশেষজ্ঞ-গবেষক এবং উৎসাহীরা সোমালি ভাষার রূপকথা সংগ্রহের চেষ্টা করছিল। ১৯৭০-এর দশকে সোমালিয়ান বিদ্যালয়ের পাঠ্য বইয়ে অনেক লোককাহিনি প্রকাশ পায়। পরবর্তী সময়, সোমালি ভাষার লোককাহিনির দ্বিভাষিক বিশেষ সংগ্রহ প্রকাশিত হয়, যেমন আহমেদ আরতান হাংহে-এর দ্বিভাষিক গল্প সংকলন। সাম্প্রতিক সময়ে সোমালি ভাষার পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে অনেকগুলো লোককথাও রয়েছে। এ গ্রন্থের গল্পগুলো সোমালি সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেয়। এখানে তিনটি গল্প ভাষান্তর করা হলো। গল্প তিনটি ‘মিনেসোটা হিউম্যানিটি সেন্টার’-এর দ্বিভাষিক প্রকল্পে লিখিত আকারে প্রকাশ হয়েছে।
হায়েনা আর শেয়াল
যাযাবর বস্তিতে একটি শেয়াল দারুণ বিড়ম্বনা শুরু করে। প্রায়শই শেয়ালটি বস্তির ছাগল আর ভেড়া ধরে ধরে খেত। এই সমস্যা সমাধানের জন্য বস্তির লোকেরা এক জায়গায় হলো। কীভাবে তারা এই ঝঞ্ঝাট শেয়ালকে হত্যা করতে পারে, তা নিয়ে তারা আলোচনা করল; তারা বুদ্ধি আঁটল ফাঁদ পাতবে।
শেয়ালটি তাদের তৈরি ফাঁদে একদিন আটকা পড়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে লোকেরা এসে তাকে একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে দিল। বস্তির লোকজন শেয়ালটিকে আগুনে পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নিল।
শেয়ালটি যেখানে বাঁধা ছিল সেখানেই তারা একটি গর্ত খুঁড়ল। তাতে কাঠ রাখল এবং আগুন জ্বালিয়ে দিল। তারপর তারা বলাবলি করতে লাগল, ‘চলো, আমরা ফের আসব; যখন আগুন প্রস্তুত হবে তখন ওকে আগুনে ফেলে দেব।’
লোকজন চলে যাওয়ার পরপরই সেখানে ক্ষুধার্ত একটি হায়েনা এসে হাজির হলো।
সে শুনতে পেল শেয়ালের ঘেঙানি।
হায়েনাটি ওর খাবার চুরি করতে পারবে সেই আশায় ওর কাছে গেল; কিন্তু হায়েনাটি খুবই অবাক হলো-সে দেখল শেয়ালটি একটি গাছে বাঁধা আছে।
‘কী হয়েছে?’-হায়েনা জানতে চাইল।
শেয়াল উত্তর দিল-‘আমার চাচা আমাকে এখানে বেঁধে রেখেছেন। আমার চাচা সত্যিই আমাকে খুব ভালোবাসেন। তিনি আমাকে এই গাছের সঙ্গে বেঁধেছেন। কারণ আমি রোগা আর দুর্বল। তিনি এখন রান্না করার জন্য ছাগল মারতে বেরিয়েছেন। এই যে আগুন জ্বলছে, এতে সেই ছাগল রান্না হবে। তা খেয়ে আমি আবার মোটা হতে পারব; কিন্তু জানো আমার খিদে নেই এখন, কারণ আমি ইদানীং অনেক মাংস খাচ্ছি। তাই আমি যখন পালানোর চেষ্টা করি, তখন আমার চাচা আমাকে ধরে ফেলেছে। আর এখানে আমাকে বেঁধে রেখেছে। সে আমাকে আরও মাংস খেতে বাধ্য করবে। আমি যতবার খাই, আমার পেটটায় ব্যথা করে। এখন ভয় হচ্ছে চাচা আমাকে মাংস না খেতে পারলে মেরে ফেলবে।’
হায়েনাটি তখন তার মুখ হাঁ করে বলল-‘চর্বিঅলা মাংস আমার খুব পছন্দের খাবার।’
শেয়াল বলল-‘তবে আমাকে খুলে দাও, এই গাছে তোমাকে বেঁধে রাখি। তারপর তুমি মন মতো তোমার পছন্দের মাংস খেতে পারবে।’
হায়েনা শেয়ালের বুদ্ধিতে রাজি হয়ে গেল। সে শেয়ালকে খুলে দিল। তারপর শেয়াল হায়েনাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে দিল।
একটু পর লোকজন সেখানে ফিরে এলো। তারা শেয়ালের জায়গায় হায়েনাটিকে গাছের সঙ্গে বাঁধা দেখতে পেল।
তারা অবাক হয়ে বলল-‘হায়েনা কেন! কোথায় সে শেয়াল?’
তখন হায়েনা বলল-‘আমি তাকে খুলে দিয়েছি। সে চলে গেছে। শেয়াল বলল তার পেটে ক্ষুধা নেই। তার হয়ে আমিই তোমাদের আনা মাংস খাব।’
সব শুনে লোকজন হায়েনাটিকে আগুনে ফেলে দিল। আর তখন লোভী ও বোকা হায়েনাটি আগুনে পুড়ে মারা গেল।
সারকথা: তুমি যদি অতিলোভী হও তবে তোমাকে শাস্তি পেতে হবে।
বোকা লোক আর চোরের গল্প
অনেক দিন আগেকার কথা-এক চোর রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, লোকেদের বাড়িতে চুরি করার জন্য। সেই সময়ে এক ব্যক্তির সঙ্গে তার দেখা হলো। যে তার পরিবারের লোকজন নিয়ে কাছাকাছি একটি ছোট বাড়িতে থাকত। চোর লোকটির কাছে জানতে চাইল-সে কাছের ওই বাড়িটিতে থাকে কিনা। লোকটি বলল-হ্যাঁ, সে ওখানে থাকে। চোর তখন বলল ‘আমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে চলো। আমি আজ রাতে তোমার পরিবারের সঙ্গে থাকতে চাই।’ লোকটি চোরকে বলল-‘তুমি যদি আমার বাড়িতে যাও, তাহলে আমার বাড়ির আশেপাশে যে জিনিসপত্র লুকিয়ে রেখেছি তা যেন তুমি চুরি কোরো না।’ বোকা লোকটি তারপর চোরকে সমস্ত জিনিস লুকানোর জায়গাগুলো বলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বোকা আরও বলল-‘দয়া করে আমার সমস্ত মূল্যবান জিনিস নিয়ে যেও না। তুমি যদি আমার জিনিসগুলো নিয়ে যাও, তবে তোমাকে ফিরে আসতে বলব-যাতে আমি তোমার কাছ থেকে আমার সমস্ত জিনিস ফিরিয়ে নিতে পারি। তারপর আমি আশেপাশের মানুষদের ডাকব তোমাকে মেরে ফেলার জন্য।’
তারপর চোর বোকা লোকটির বাড়িতে গেল। আর তার বাড়ি থেকে সবকিছু নিয়ে গেল। চোর তখন বলল-‘আমি চাই যে চুরি করার জন্য এমন একজন বোকা লোক আমার কাছে সবসময় থাকুক।’
সারকথা: তুমি বিশ্বাস কোরো না যাকে, তার নিকট তোমার গোপন কথা বোলো না।
ইঁদুর
অনেক দিন আগেকার কথা। কিছু ইঁদুর খুব সুন্দর একটি বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। কিছু বেড়ালও সেখানে বসবাস করত। বেড়ালরা খাবারের সন্ধানে বেরিয়েছিল, এই সুযোগে ইঁদুরের দল ঘরে ঢুকে পড়ে। একটি ইঁদুর দেখল বেড়ালদের মেকআপের জন্য বিভিন্ন রঙ রয়েছে।
তখন একটি ইঁদুর তার মুখে সোনার মেকআপ লাগিয়ে নিল। তারপর সে আয়নায় তাকাল এবং ততটা সময় ধরে সে সাজল যেভাবে নিজেকে দেখতে সে কল্পনা করত। সে নিজেকে সোনার তৈরি ভাবতে থাকে। ঠিক তখনই অন্য ইঁদুররা দেখল বেড়ালগুলো ঘরে আসছে। বাইরে খাবার না পেয়ে বেড়ালগুলো ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘরে ফিরল।
ইঁদুর ডাকল, ‘চলো যাই! বেড়াল আসছে!’ সোনার ইঁদুর তার বন্ধুদের কথা শোনেনি। সে নিজেকে আয়নায় দেখতে থাকল। সে তার নতুন রূপ দেখতে থাকল। এর মধ্যে বেড়ালগুলোও ঢুকে পড়ল। সোনার ইঁদুরটিকে তারা সহজেই ধরে খেয়ে ফেলল। বেড়ালগুলো বলল-‘আমরা সারাদিন ইঁদুর খুঁজছিলাম, আর বাড়িতে এসে দেখি একটা ইঁদুর আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।’
সারকথা: নিজের পরিবার এবং কাছের মানুষদের পরামর্শ অনুসরণ করো। যদি তাদের কথা না শোনো, তবে তুমি সোনার ইঁদুরের মতো সমস্যায়ও পড়তে পারো।
ভূমিকা ও ভাষান্তর: এহসান হায়দার
তথ্যসূত্র: আহমেদ আরতান হাংহে, (সোমালিয়ার লোককাহিনি: নর্ডিক আফ্রিকা ইনস্টিটিউট, ১৯৮৮)।