Logo
×

Follow Us

ঈদ সংখ্যা

বুললেই তো বুলবেন, বুলচি...

Icon

অর্ণব সান্যাল

প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৩, ১৫:৩৫

বুললেই তো বুলবেন, বুলচি...

প্রতীকী ছবি

মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, নিজের জিহ্বাকে সংবরণ করা। সেটা যেমন কথা বলার ক্ষেত্রে, তেমনি গলাধঃকরণের ক্ষেত্রেও সত্য। এই দুই প্রক্রিয়ায় জিভটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই দেখবেন জীবনটা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল জীবনের ক্যান্টিনের পাতলা ডালের মতো সহজপাচ্য। সেটি একদিকে যেমন তৃষ্ণাও মেটাবে, অন্যদিকে কিছুটা পুষ্টিও দেবে!

জিভ মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের একটির প্রতি অনুগত। গলাধঃকরণের সঙ্গে স্বাদের গুরুতর সম্বন্ধ আছে। খাবার আর স্বাদ অবশ্যই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তবে কথারও কিন্তু স্বাদ থাকে। থাকে কথা গিলে ফেলা বা গলাধঃকরণের বিষয়টিও। আর এসবেই জড়িয়ে আছে আমাদের পাতলা ডালের মতো স্বচ্ছ জীবনের চাবিকাঠি।

প্রথমে না হয় ডালের কিচ্ছাই হোক। একটু স্মৃতিচারণ হবে, সহ্য করে নেবেন দয়া করে। এ জীবনে কত কিছুই তো সহ্য করেন, আমারটাও না হয় একটু করলেন। প্রথম যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাল দেখেছিলাম, সেদিন একটু চমকে গিয়েছিলাম বটে। মনে হয়েছিল জলের মধ্যে হয়তো বেশি আয়রন আছে। পরে বুঝলাম, ওতে কিছুটা পেঁয়াজ-রসুনের ছিটে এবং বেশ খানিকটা গোটা ডালও আছে। সিনিয়ররা জানালেন, এসব খেয়েই কত কত ধানুশ (সিনেমায় অভিনয়ের শুরুর দিককার) নাকি হয়ে গেছে আরনল্ড শোয়ার্জনেগার! ভাবি আর অবাক হই। সত্যিই? আহা, টারমিনেটর হওয়ার আমার কতই না শখ ছিল। কঠিন ও খরুচে ডায়েট না মেনে শুধু হলের স্বচ্ছ ডাল খেয়েই যদি ওমনটা হয়ে যায়, মন্দ হয় না!

সেই থেকে হলের ডালের প্রতি আমার সুনজর জন্মালো। কয়েক মাস তো ভাতের কম-বেশি হলেও, ডালের হতো না। কিন্তু শেষ বেলায় দেখলাম, শোয়ার্জনেগারের বডি আর আমার তনুমনে ট্রান্সফার হলো না। বরং বেশি ডাল খেয়ে পাকস্থলীতে অরাজকতা সৃষ্টি করে ধানুশের আরও ছোটবেলার পটকা চেহারায় ফিরে যাওয়ার জোগাড়! যাক গে। সব আশা ছেড়ে দিয়ে এরপর ভেবে নিলাম, ধানুশও তো আর পর্দায় কম পেটায় না! ওটি হলেও চলে যাবে দিব্যি। 

পেটানোর শখ যদিও ওভাবে ছিল না। দৈহিক গড়ন ও মননে পুরোপুরি নিম্ন-মধ্যবিত্ত হওয়ার কারণে স্বপ্নে নায়ক থাকলেও, ঘুম ভাঙার পর আমাদের মতো মানুষেরা নায়কের বন্ধুই থেকে যায়। সেই বন্ধুও আবার ছবিতে নায়কের ডান বা বাম পাশের একেবারে কোনায় গাছে হেলান দিয়ে ডালের ফাঁক দিয়ে শুধু মাথাটা দেখাতে পারে। ওই মাথাতেই মুখের ভেতর জিভ থাকে বটে। কিন্তু সেখানেও চলে আসে সংবরণের প্রশ্ন।

ধরুন, ডালের প্রতি যথেচ্ছাচার প্রদর্শন না করলে হয়তো একটি দীর্ঘমেয়াদি বুনিয়াদি কার্যক্রমে তনুমন ঢেলে দেওয়া যেত। কিন্তু জিভ সংবরণ করতে না পারায় সবকিছুই ঘেঁটে ঘ হয়ে গেল।

ঠিক এভাবেই জিভ নিঃসৃত কথাতেও সংবরণ ধর্ম ধারণ করানো খুবই জরুরি একটি বিষয়। যে কথা বলা স্বাভাবিক কিন্তু বললেই অঘটন ঘটে যায়, সেসব কথা বলার আগেই জিভকে মানিয়ে ফেলাই হলো জিভের সংবরণ ধর্ম। চোখের সামনে সুস্বাদু খাবার পেলে যেমন খেয়ে ফেলার লোভ সামলানো কঠিন, তেমনি কথা বলে ফেলার সুযোগ পেলে নিজের জিভ-ঠোঁটকে আটকে রাখা বেজায় দুরূহ। 

তবে সেটি করতে পারলেই কিন্তু কেল্লা ফতে! তখন একটি শান্ত-নিরুপদ্রব জীবনে পা রাখতে পারবেন যে কেউ।

কথার ক্ষেত্রে জিভ সংবরণের সুফল সম্পর্কে কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নেওয়া যাক। এটা অনেকটা বাংলা সিনেমার নায়কের রিকশা চালাতে চালাতে লটারি পেয়ে বড়লোক হয়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার। ওসব দেখেই তো আমরা ভাগ্য বদলানোর স্বপ্ন দেখি কিনা!

প্রথমে এক সহকর্মীর অভিজ্ঞতা নিয়ে বলি। তিনি একদিন বলছিলেন, দেশের এক বিখ্যাত ও গণ্যমান্য স্বঘোষিত ফেসবুকীয় কবি ও বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে তার ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব ছিল। বন্ধুত্বের শুরুটা খারাপ ছিল না। বেশ ইন্টারেকশন হতো। কিন্তু একসময় দেখা গেল, ওই ব্যক্তির স্ট্যাটাস পড়লেই তার ফেসবুকের মন্তব্যের ঘরে বিপরীত সুরের কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে। এবং ওই স্বঘোষিত কবি কোনোভাবেই ছেড়ে দেওয়ার চরিত্রের নন এবং প্রয়োজনে পায়ে হাত বেঁধে ডুগডুগি বাজিয়ে ঝগড়া করতে পারদর্শী।

কিন্তু আবার কথা না বলেও থাকা যায় না। এক পর্যায়ে এহেন হুজ্জত এড়াতে আমার সহকর্মী বেচারা দিলেন বুদ্ধিজীবীকে ব্লক। কারণ তার ভাষায়, ‘কিছু না বলেও থাকা যাচ্ছিল না, মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছিল। আবার কিছু বললেও ঝামেলা। শেষটায় এভাবেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলো, বুঝলেন।’

এটিই হলো সত্যিকারের সংযম। এমনটা আমিও করছি এখন, ফলও পাচ্ছি। এই ধরুন বাজারের কথা। বাজার করতে গেলেই আমার দৃষ্টি এখন শূন্য হয়ে যায়। পকেটে যা-ই নিয়ে যাই না কেন, ঠিকই কম পড়ে যায়। সেদিন তো প্রথমবারের মতো সাহায্যপ্রার্থী এক ব্যক্তিকে উপেক্ষা করে মানিব্যাগে থাকা শেষ ২০টি টাকা দিতে হলো সবজিওয়ালাকে, চর্মবটুয়া একেবারে খালি করেই। নইলে যে দেনা-পাওনার হিসাব মিলছিল না।

তো এমন অবস্থায় বিক্রেতাকে কিছুর দাম জিজ্ঞেস করাই এক যন্ত্রণা হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করলে, যদি আবহাওয়া খারাপ থাকে তবে দাম বাড়ার কারণ হিসেবে দেবে আবহাওয়ার দোষ। রোদ বেশি থাকলে দোষ রোদের, বৃষ্টি হলে বৃষ্টির। এই তালিকায় লোডশেডিং থেকে শুরু করে পেট্রলের দাম, কিছুই বাদ যায় না। বুঝি সবই, কিন্তু মন তো মানে না। মেজাজ খিঁচড়ে যায়, শুরু হয় বাদানুবাদ। শাকসবজি থেকে ডিম-মুরগি, সবখানেই একই দশা। হয়তো কখনো শুনতে হবে মুরগির মন খারাপ ছিল, তাই ডিম কম পেড়েছে। আর যেহেতু অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী চাহিদা বেশি ও জোগান কম থাকলে দাম বাড়বেই, সেহেতু হালিতে বেড়েছে ডিমের দাম।

এসব কারণে এখন জিভ সংবরণ করতে শুরু করে দিতে হয়েছে। কিছু জিজ্ঞেস করাই বন্ধ করেছি এখন। বরং মোট অঙ্কের ওপর দাম কমিয়ে মানিব্যাগ খালি করে দিয়ে হলেও বাজার করে ঘরে ফিরছি। বলতেই পারেন, তাতে লাভটা কী হচ্ছে শুনি? হ্যাঁ, অর্থক্ষয় মেটানো যাচ্ছে না বটে। তবে মেজাজ বিগড়ে যাওয়া এড়ানো যাচ্ছে। অর্থক্ষয়ের হতাশা, আর মুলোমুলির পরও সেই অর্থক্ষয়ের হতাশাতেই নিমজ্জিত হওয়ার মধ্যে কিছুটা হলেও পার্থক্য আছে। আপাতত ওটিই বোনাস। জিভ সংবরণেই (কথা ও গেলা-দুই ক্ষেত্রেই) তো এমন উপহার মিলল, তাই না?

এ তো গেল বাজারের কথা। পারিবারিক ও পেশাগত জীবনেও এই প্রক্রিয়ার সুফল ব্যাপক। পারিবারিক জীবনে যখন ক্যাঁচাল লাগে, তখন মুখ বেশি খুললে কথা বেশি ছড়ায়। বরং চুপ করে থাকলে দেখবেন ধীরে ধীরে থিতিয়ে যায় সব উত্তেজনা। কথা বলবেন তো ঝামেলা আরও ছড়াবে। কথা না বললে আপনার ওপর বিরক্ত হয়েই বিপরীত পক্ষ চুপ করে যাবে। তবে সেক্ষেত্রে কিছু বাক্যবাণ আপনার বিনা বাক্য ব্যয়ে হজম করে নিতে হবে, এই যা!

পেশাগত জীবনেও ঊর্ধ্বতনের সঙ্গে বেশি আলাপে গেলে আপনার ফেঁসে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। এক শুভাকাঙ্ক্ষী জানিয়েছিলেন যে, তিনি তার বসকে সম্প্রতি অফিসের একটি প্রকল্পের কিছু দুর্বলতা নিয়ে অবহিত করেছিলেন এবং কী করা উচিত তা নিয়ে হালকার ওপর ঝাপসা একটা লেকচার দিয়েছিলেন। ফলাফল, তাৎক্ষণিক ঝাড়ি এবং বসদের জ্ঞানী মস্তিষ্কের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের অভিযোগ। শেষে যদিও ওই প্রকল্পে সমস্যা হয়েছিল, এবং আমার শুভাকাক্সক্ষীর দেওয়া পথেই সমাধান হয়। কিন্তু ততক্ষণে সমাধানের প্রবক্তা হয়ে দাঁড়ালেন বস একাই!

কিন্তু যদি চুপ থাকা যেত, তবে এই সমস্যার মোকাবিলাই করতে হতো না। বরঞ্চ ঝোপ বুঝে কোপ মারার বাঙালি স্বভাবটি আয়ত্ত করতে পারলেই আমার ওই বন্ধুটি আজকে হয়ে যেতেন এমপ্লয়ি অব দ্য মান্থ!

জাতীয়ভাবেও এখন চুপ থাকাই শ্রেয়। মুখে স্কচটেপ মেরেও তো কিছুদিন আগে রবীন্দ্রনাথ এ দেশে মাথাটাই খুইয়ে ফেললেন। আর আপনি কী থেকে কী বলবেন, তখন যুদ্ধ লেগে যাবে ফেসবুকে। ওহ্, মার্ক জাকারবার্গের দুনিয়াতেও তো আবার কথায় কথায় দিয়ে দেয় রেস্ট্রিকশন। ধরুন, বন্ধুর ফাজলামিতে আপ্লুত হয়ে বাৎসল্যের আতিশয্যে কোনো ফেসবুকীয় বাতচিতে দিয়ে দিলেন পশ্চাৎদেশে লাথি মারার হুমকি। ব্যস হয়ে গেল! খেয়ে যাবেন কমিউনিটির স্ট্যান্ডার্ড ভেঙে ফেলার শাস্তি। মানুষ ছাড়া কোনো কম্পিউটার যে বন্ধুর পেছনে লাথি মারার রস আস্বাদনে অক্ষম!

সুতরাং কথা বলার ঝক্কিটা না হয় এখন থেকে চ্যাটজিপিটির ওপরই ছেড়ে দিন। কারণ পরিস্থিতি এখন ‘বুললেই তো বুলবেন, বুলচি...’ ঘরানার। মুখ আছে বলেই বেশি কথা বলতে হবে, তার তো কোনো মানে নেই। বরং স্বল্পাহার ও মিতভাষে আয়ুও বাড়ে বলে জনশ্রুতি আছে। তাহলে বেশিদিন বেঁচে থাকার এই খুল্লামখুল্লা সুযোগটা নেবেন না কেন? 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫