Logo
×

Follow Us

ঈদ সংখ্যা

যখন পূবালী হাওয়া বয়: গ্রাজিয়া ডেলেড্ড্যা

Icon

ওয়াহিদা নূর আফজা

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২৩, ১৫:২৩

যখন পূবালী হাওয়া বয়: গ্রাজিয়া ডেলেড্ড্যা

গ্রাজিয়া ডেলেড্ড্যা। ছবি: সংগৃহীত

[জন্ম: ২৭ সেপ্টেম্বর ১৮৭১, নুওরো, সার্ডিনিয়া, ইতালি। মৃত্যু : ১৫ আগস্ট ১৯৩৬, রোম, ইতালি। গ্রাজিয়া ডেলেড্ড্যা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান ১৯২৬ সালে। এই গল্পটি ১৯০৫ সালের দিকে লেখা। গ্রাজিয়া জন্মগ্রহণ করেন সম্ভ্রান্ত কৃষক পরিবারে। বাড়ির বৈঠকখানায় গল্পের আসর বসত, কিশোরী গ্রাজিয়া গোগ্রাসে তার স্বাদ নিতেন। সে সময়ের ইতালির নিয়মানুযায়ী মেয়ে হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পেয়েছিলেন চার বছরের। বাড়িতে গৃহশিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় মাত্র ১৩ বছর বয়সে পত্রিকায় প্রথম লেখা পাঠান। সহমর্মিতা ও গভীর অন্তর্দৃষ্টি তাকে পারিপার্শ্বিক সামাজিক পরিবেশ এবং মানুষের অনুভ‚তি বুঝতে সাহায্য করেছে।] 

একটি প্রাচীন সার্ডিনিয়ান কিংবদন্তি অনুসারে, যারা বড়দিনের আগের দিন জন্মেছে, মৃত্যুর পর শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত তাদের দেহ অক্ষত থাকবে, ধুলায় মিশে যাবে না। এমন একটি বিষয় নিয়ে সম্ভ্রান্ত কৃষক ডিদ্দিনু ফ্রাউয়ের (যাকে সবাই ডিদ্দিনু চাচা বলেই ডাকে) বাড়িতে কোনো একদিন আলাপ হচ্ছিল। তবে এতে আপত্তি ছিল তার হবু জামাই প্রেডু তাসকারের-‘কিন্তু কোন উদ্দেশ্যে? মরে গেলে এ শরীরের আর কি প্রয়োজন আছে?’

‘হুম’ ডিদ্দিনু চাচা বললেন, ‘শেষ বিচারের দিন ভাঙাচোরা অবস্থার থেকে একেবারে অক্ষত দেহে থাকতে পারাটা কি বেশি সম্মানের নয়?’ প্রেডুর ছিল তারুণ্যের অহংকার। চাচার কথাকে অত আমল দেবে কেন! সে বলল, ‘এটি কি সত্যিই তেমন বড় কিছু?’ 

‘জামাই, চলো আমরা এই বিষয় নিয়ে একটা কবিগানের আসর বসাই।’ এখানে বলে রাখা ভালো যে ডিদ্দিনু চাচা একজন বেশ ভালো কবিয়াল। বংশানুক্রমিকভাবে বাপ-দাদার আমল থেকে এই পরিবারে কবিয়ালের প্রতিভা বইছে। প্রতিভা সবসময় প্রকাশের সুযোগ খোঁজে। তাই চাচা একটা অজুহাত পেলেই কবিগানের আসর বসাতে চায়। বিশেষ করে যখন দেখেন যে আশপাশে তার থেকে আর তেমন ভালো কবিয়াল নেই। মারিয়া ফ্রাঞ্জিসকা এতক্ষণ চুপ করে সব দেখছিল। এবার তার হবু বরের সপক্ষে বলল, ‘এরকম একটা মন খারাপ করা বিষয় নিয়ে গান না করলে হয় না?’ ‘তুমি এখানে কী করছ? যাও ভেতরে যাও।’ বাবার কণ্ঠস্বর যথেষ্টই রুক্ষ ছিল।

একজন কবিয়াল হলেও পরিবারের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে ডিদ্দিনুর স্বভাবটা ছিল এর সম্পূর্ণ উলটো, একদম দয়ামায়াহীন। বিশেষ করে কন্যারা খুব ভালো করেই জানে তাদের বাবা কতটা কঠোর হতে পারে। কাছের মানুষেরা একজন পরিবার-প্রধান হিসেবে তাকে সম্মান করত ঠিকই, কিন্তু তার থেকেও বেশি করত ভয়। বাবার উপস্থিতিতে মারিয়া তার হবু বর প্রেডুর থেকে একটু দূরত্ব বজায় রাখছিল।

অবশ্য তখন এটাই ইতালিতে সামাজিক প্রথা ছিল। বিয়ে ঠিক হলেও হবু বর-কনেরা একজন আরেকজনের সঙ্গে অত ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করতে পারত না। তাই বলে বাগদত্তারা যে একদম নিষ্ক্রিয় থাকত তা নয়। আকর্ষণীয় পোশাকে তারা নিজেদেরকে মোহনীয় করে তুলত। একটু দূর থেকে নানান দেহভঙ্গিমার মাধ্যমে প্রেমিকের মনে দোলা লাগানোর চেষ্টা চালাত। সেদিন মারিয়াও তাই করছিল। সে পরেছিল ফুলেল কারুকার্যময় লাল রঙের একটি কটি।

মুখমণ্ডল আবৃত করেছিল লেসের ঘোমটায়। কারণটা ছিল নিজেকে আরও রহস্যময়ী করে তোলা। কিছুটা আড়াল রেখেই মারিয়া তার নীল-সবুজাভ চোখের দৃষ্টি কিছুক্ষণ পরপর প্রেডুর দিকে নিক্ষেপ করছিল। সময়টা ছিল বড়দিনের আগের সন্ধ্যাবেলা (ক্রিসমাস ইভ)। সে দিনটি ছিল ধূসর। অনুভবে পরশ দিয়ে যায় মৃদুমন্দ পূবালী হাওয়া। এর সঙ্গে মিশে ছিল দূরবর্তী মরুভূমির উষ্ণতা আর পুব দিককার সাগরের সুবাসের আর্দ্রতা।

উপত্যকার কাজুবাদামের গাছগুলো পূবালী হাওয়ার ক্রমাগত দুলছে। তার থেকে খসে পড়ছিল আধ ফোঁটা কলির কিছু সাদা পাপড়ি। সেসব আবার দূরের পাহারের সবুজ ঢালে ভেসে বেড়ানো কুয়াশার মধ্যে মিশে গিয়ে এমন এক সুপ্ত আগুন কুণ্ডলীর আবহ তৈরি করছিল, যার ধোঁয়া তখনো দেখা যায়নি; কিন্তু উষ্ণতা অনুভব করা যায়। পাহাড়ের মাথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে মেঘেদের মেলা। তারা যেন পাখা মেলে দিয়েছিল পুরো আকাশ জুড়ে। ঠিক যেন সেই অদৃশ্য আগুনের ধোঁয়া।

শহরে তখন ভোজের ঝংকার শুরু হয়ে গিয়েছিল। লেভেন্টাইন বাতাসের মতো মানুষ জড়ো হচ্ছিল পথে পথে, বাড়িতে বাড়িতে খ্রিষ্টের জন্ম উদযাপন করার জন্য। পরিবারগুলোর মধ্যে উপহার বিনিময় শুরু হয়ে গেছে, তারা মেতে উঠেছে আস্ত শূকর ভাজা, শরতের ভেড়ার মাংস, মিষ্টি, কেক আর শুকনো ফলের সমাহারে। গোয়ালারা নিয়ে এসেছে তাদের বাছুরদের মুখের প্রথম দুধ। খালি পাত্র লেনদেনে গাভীদের অমঙ্গল হয়। তাই গৃহিণীরা দুধ ঢেলে সেসব খালি পাত্রে শাক-সবজি বা অন্যকিছু দিয়ে ভরাট করে তা ফিরিয়ে দিচ্ছে।

প্রেডু তাসকারের ছিল এক পাল শূকর। রীতি অনুযায়ী সে তার সর্বশ্রেষ্ঠ শূকরটিকে জবাই করে সেটিকে একটি ঝুড়িতে ভরে। সেই ঝুড়িটি আবার শূকরের রক্ত দিয়ে রঞ্জিত করে লিলি ফুল দিয়ে সাজিয়ে তার বাগদত্তাকে ভেট হিসেবে দিয়েছিল। বিনিময়ে মারিয়া সে ঝুড়িটি ফেরত পাঠিয়েছিল মধু আর বাদামের কেক বানিয়ে। সেই সঙ্গে যে মহিলা এই ঝুড়িটি নিয়ে এসেছিল তাকে পারিতোষিক হিসেবে দিয়েছিল পাঁচ লিরা মূল্যমানের রৌপ্যমুদ্রা।

আবার সন্ধ্যার দিকে প্রেডু ফ্রাউয়ের বাড়িতে এসে মারিয়ার হাত নিজের প্রশস্ত হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল। এক ঝলক বিদ্যুৎ তরঙ্গ মারিয়াকে আবিষ্ট করল। সে শিহরিত হলো, আবার লজ্জাও পেল। খুব দ্রুতই প্রেডুর হাতের বন্ধন থেকে নিজের হাত দুটোকে ছাড়িয়ে নিল। তারপরও সেই অবশ-করা স্পর্শ তাকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখল। এখানেই শেষ নয়, তার জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল।

প্রেডু ইতিমধ্যে তার হাতের তালুর ভেতর একটি স্বর্ণমুদ্রা গুঁজে দিয়েছিল। এরপর মারিয়া সেখানে আর থাকেনি। সে ব্যস্ত হয়ে উঠল অন্দরমহলের সবাইকে তার সদ্য পাওয়া উপহারটি দেখাতে। বাইরে তখন ঘণ্টাধ্বনির ঐকতান। পুবের হাওয়ার  সঙ্গে জুড়ে গেল ধাতব শব্দ। ক্রমশ গ্রাস করল কিছুটা উষ্ণ ও বিষণ্ন সন্ধ্যার নিস্তব্ধতাকে। প্রেডু সে এলাকার জাতীয় পোশাকে আচ্ছাদিত ছিল।

সেই মধ্যযুগ থেকে এটি প্রচলিত। নীল মখমলের বেষ্টনী, সূক্ষ্ন কারুকার্যময় কালো উলেন কোট, কোমরে অলঙ্কৃত চামড়ার বেল্ট এবং সঙ্গে সোনার তারের বোতাম। জলপাই তেলে আচ্ছন্ন সযত্নে আঁচড়ানো লম্বা কালো চুল দিয়ে সে তার কান ঢেকে রেখেছিল; এবং যেহেতু ইতিমধ্যে সে কিছুটা ওয়াইনের স্বাদ গ্রহণ করেছিল-তার চোখ দুটি ছিল মদির, কালো দাড়ির মধ্যে লাল ঠোঁটগুলো যেন জ্বলছিল। ভরাট কণ্ঠস্বরের সুদর্শন প্রেডুকে অনেকটা স্থানীয় দেবতা বলে মনে হচ্ছিল।

‘বোনাস টারদাস’ আগুন পোহাবার মেঝেতে, যেখানে তখনো একটি কাঠের গুঁড়ি জ্বলছিল, শ্বশুরের কাছাকাছি বসে প্রেডু বলল, ‘প্রভু আপনাকে আরও একশটি ক্রিসমাস উপহার দিক! কেমন আছেন?’ 

‘সেই বৃদ্ধ শকুনের মতো যার থাবার আর কোনো জোর নেই,’ বুনো বয়স্ক কৃষকের উত্তরটি ছিল এমনই। এরপর তিনি সেই বিখ্যাত শ্লোকটি বললেন, ‘বৃদ্ধ হয়ে গেলে মানুষ অদরকারি হয়ে পড়ে।’ এরকম টুকরো টুকরো কথাবার্তার মধ্যে দিয়েই তারা এক সময় বড়দিনের আগের সন্ধ্যায় জন্মগ্রহণকারীদের অক্ষত দেহের সেই কিংবদন্তি গল্পে এসে পৌঁছায়। ‘চলো সমাবেশের দিকে যাই,’ ডিদ্দিনু কাকু বললেন। ‘ফিরে আসার পর, প্রথমে সবাই মিলে ভোজ উপভোগ করব, তারপর আমরা গান গাইব!’ 

‘যদি আপনি চান আমরা আগেও গান গাইতে পারি।’ 

‘এখন না!’ পাথরের মেঝেতে লাঠি দিয়ে আঘাত করে ডিদ্দিনু চাচা বললেন। ‘এই পবিত্র সন্ধ্যার স্থায়িত্বকালটুকুকে আমাদের সম্মান করা উচিত। এসময় মা মেরী প্রসব যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছিলেন, মাংস খেয়ে বা গান গেয়ে আমরা তা উদযাপন করতে পারি না। ওহে, শুভ সন্ধ্যা, মতিয়া পোর্টোলু! অনুগ্রহপূর্বক বসে থাকুন এবং যারা আসবেন তাদের বলুন, মারিয়া ফ্রাঞ্জিস্কা ভালো আপ্যায়ন করবে! ভেড়ার পালকে কিছু পান করতে দেওয়া হোক।’  


একটু ঝুঁকে পড়ে রুবির মতো ঝকঝকে গ্লাসে মারিয়া প্রেডুকে পানীয় পরিবেশন করার সময় সে আরও মাতাল হয়ে গেল মারিয়ার হাসি আর আড়চোখের দৃষ্টিতে। ইতিমধ্যে আরও কিছু নিমন্ত্রিতরা এসে পৌঁছেছে। আগুন পোহাবার মেঝেটা চারটি পাথর দিয়ে ঘের দিয়ে হেঁশেল থেকে আলাদা করা ছিল। এর একপাশে পুরুষেরা গল্প-গুজব করছিল আর আরেক পাশে মহিলারা রাতের নৈশভোজ তৈরিতে ব্যস্ত ছিল।

প্রেডুর পাঠানো শূকরটিকে একটি বড় পাত্রে চড়িয়ে ভেজে কষানো হচ্ছিল। এটির রান্না তখনো মাঝপথে। আর তাতেই ম-ম গন্ধে চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল। এবার দুজন বৃদ্ধ আত্মীয় আসলেন। এ দুজন ছিল আপন দুই ভাই, যারা সম্পত্তি ভাগাভাগির ঝামেলা এড়ানোর জন্য কখনোই বিয়ে করেননি। ঝাঁকড়া বাবরি চুল আর সাদা সফেদ দাঁড়ির সমন্বয়ে তাদেরকে দেখতে গোত্রপ্রধানের মতো লাগছিল।

এরপর একজন অন্ধ তরুণ আসল। করবী গাছের সরু লাঠিতে ভর দিয়ে মেঝেতে ঠকঠক করে একটু একটু করে সামনে এগোতে লাগল। সেই দুই বৃদ্ধ ভাইয়ের একজন মারিয়ার কোমর ধরে প্রেডুর দিকে ঠেলে দিলেন আর বললেন, ‘কী হয়েছে তোমাদের? স্বর্গের নক্ষত্রের মতো দুজন দুজনের থেকে এত দূরে অবস্থান করছ কেন? একজন আরেকজনের হাত ধরো, জড়িয়ে ধরো...’ সত্যিই তখন এই হবু দম্পতি দুজনের মধ্যে কামনার স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠল; তখন ডিদ্দিনু চাচা গর্জে উঠলেন, ‘বুড়ো রামছাগল! ওদেরকে শান্তিতে থাকতে দাও। ওদের তোমাদের পরামর্শের কোনো দরকার নেই।’

‘সেটা জানি, এবং আরও জানি যে তাদের তোমার পরামর্শেরও কোনো দরকার নেই! ওরা নিজেরাই নিজেদের গুরু।’ 

‘যদি তাই হতো,’ ডিদ্দিনু বললেন, ‘তাহলে অনেক আগেই আমি এই যুবককে একটি ভীমরুলের মতো তাড়িয়ে দিতাম। মারিয়া ফ্রাঞ্জিস্কা, আমার গ্লাস পূর্ণ করে দাও।’ কিছুটা অপদস্থের মতো তরুণী সেই বৃদ্ধের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। নিজের পশমের টুপিটি ঠিক করে নিয়ে হাস্যচ্ছলে প্রেডু বলল, ‘আচ্ছা, আমরা এখন খেতে পারব না, গান গাইতে পারব না, এমনকি কিছুই করতে পারব না... পান করতে তো পারব?’ 

‘তুমি যা চাও তাই করতে পারো, কারণ স্রষ্টা মহিমান্বিত,’ হবু জামাইয়ের পাশে বসা অন্ধ লোকটি বিড়বিড় করে বলে উঠল। ‘স্বর্গে ঈশ্বরের মহিমা আর পৃথিবীতে শান্তি বর্ষিত হোক সব মহিমান্বিত মানুষের কাছে!’

এভাবেই তারা ক্রমাগত পান পাত্রের মদিরতায় ডুবে যাচ্ছিল। প্রেডু তার গ্লাসে ছোট ছোট চুমুক দিতে থাকল। বাইরে তখন ঘণ্টাধ্বনি বাজছে। হাসি-কান্না মিশ্রিত আনন্দের উৎফুল্লতা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ১১টার দিকে সবাই মধ্যরাতের প্রার্থনায় জড়ো হলো। বাড়িতে রইল শুধু বৃদ্ধা দাদিমা, তিনি তার অল্প বয়সে জেনেছিলেন যে এই পবিত্র সন্ধ্যায় মৃত আত্মারা তাদের আত্মীয়দের বাড়িতে ফিরে আসে। এই কারণে প্রাচীন রীতি অনুযায়ী মৃতদের জন্য একটি পাত্রে কিছু খাবার সাজালেন আর একটি মাটির জগ মদে পূর্ণ করলেন।

এখন পর্যন্ত এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি। বাড়ি খালি হওয়া মাত্রই তিনি দ্রাক্ষারস এবং খাবারের পাত্র বাড়ির বাইরে একটি সিঁড়ির উপর রেখে আসলেন। সিঁড়িটি উঠান থেকে দোতলার কামরা পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল। একজন গরিব প্রতিবেশী, যিনি বৃদ্ধার এই অভ্যাসটি জানতেন, তিনি খামার বাড়িটির ঘোরানো দেয়াল বেয়ে সেই খাবার আর দ্রাক্ষারস খালি করে দিয়ে আসলেন। প্রার্থনা থেকে ফিরে আসার পর তরুণ-বৃদ্ধ সবাই খুব উৎসাহ নিয়ে ভোজের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। বসলেন মেঝেতে বিছানো বড় বড় পশমের গদির উপর। এসব গদি ঘরে বোনা কাপড় দিয়ে মোড়ানো ছিল।  

 লাল-হলুদ মাটির পাত্রে ধূমায়িত ম্যাকারনি করা হলো। প্রেডু খুব দক্ষতার সঙ্গে একটি তক্তার উপর ভাজা শূকরটি ছড়িয়ে দিল। সবাই মেঝেতে বিছানো মাদুর আর গদির উপর বসে পড়ল, ঘর-উনানের প্রদীপ্ত শিখা পটপট করে জ্বলে উঠল; অতিথিদের মুখে এর লালচে আভার ঢেউ আছড়ে পড়ল; দৃশ্যটি যেন হোমারীয়। তারা এখন সুরাপানে ব্যস্ত। ভোজের পর কর্তার ইচ্ছায় মহিলাদের অন্দরমহলে চলে যেতে হলো। পুরুষেরা এবার মেঝের চারপাশে আরাম করে বসে গাইতে শুরু করল। তাদের মুখ ছিল রক্তিম, আর চোখগুলো ছিল অবসন্ন কিন্তু দীপ্তিমান। এবার কৃষক কর্তা গানের লড়াই শুরু করে দিলেন, ‘ওহে আমার হবু জামাই বলো তো কোনটা বেশি ভালো, মাত্র তিন ছটাকের ধুলোবালি নাকি শেষ বিচারের দিনের অক্ষত হাল?’

নিজের টুপি ঠিক করে নিয়ে প্রেডু এবার উত্তর দিল, ‘তারপরও আমরা গান গাই এটি জেনেই যে বিষয়টি খুব গভীর ভাবনার; আমাদের নৈবেদ্য প্রেম, আনন্দ আর সৌন্দর্যের কিংবা মাধুর্য বা নান্দনিকতার।’

কৃষককর্তা ছাড়া আর সবাই এই প্যাগান স্তবকে উচ্ছ¡সিত হয়ে উঠল। প্রবীণ কবি কিছুটা বিরক্তি নিয়ে ছন্দে ছন্দে জবাব দিলেন যে তার প্রতিপক্ষ উত্তর দিতে চায় না কারণ সে নিজেকে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে মোকাবিলা করার যোগ্য বলে মনে করে না। আবারও প্রেডু তার টুপিটি ঠিক করে নিয়ে পুরোটাই সার্ডিনিয়ান শ্লোকে উত্তর দিল, ‘ঠিক আছে, কর্তার ইচ্ছায়ই কর্ম। স্পর্শকাতর হওয়ায় এই বিষয়টি আমাকে অতটা আকর্ষণ করে না; আজকের এই আনন্দময় সময়ে আমি জীবনের কথা ভাবছি, মৃত্যুর কথা নয়।

তারপরও তুমি চাচ্ছ বলে বলছি, আমাদের দেহ ধূলিসাৎ হবে নাকি অক্ষত থাকবে তা আমার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। মরে গেলে আমরা আর কী? কিছুই না। অপরিহার্য হলো জীবিত দেহটিকে সুস্থ ও সতেজ রাখা যাতে আমরা কর্মক্ষম থাকতে পারি এবং জীবনকে উপভোগ করতে পারি। আমার আর এর থেকে বেশি কিছু চাওয়ার নেই।’ 

প্রৌঢ় কৃষকও উল্টোদিকে তির্যকবাণ মারতে থাকলেন। প্রেডুও খুব ধীর-স্থিরভাবে আনন্দের সঙ্গেই তা বার বার প্রতিহত করে গেল। প্রৌঢ় দুই ভাই খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, অন্ধলোকটিও সমর্থন জানিয়ে গেল। বাইরে বাইরে একটু রাগান্বিতের ভান করলেও নিজের হবু জামাইয়ের কবি-প্রতিভা দেখে ডিদ্দিনু ভেতরে ভেতরে বেশ গর্ববোধ করতে লাগলেন। এটি এখনই বলে দেওয়া যায় যে এই পরিবারের মহিমান্বিত ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। দেহ আর ভোগের অসারতাকে গুরুত্ব দিলেও ডিদ্দিনু চাচা নিজেও খুব পান করছিলেন আর অন্যদেরকেও তা করতে উৎসাহিত করছিলেন। ভোর ৩টার দিকে সবাই প্রায় নেশাগ্রস্ত, শুধু দুজন ছাড়া। অন্ধলোকটি পান করে না আর প্রেডু তার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়নি।

কিন্তু প্রেডু তখন গানের নেশায় বুঁদ হয়েছিল, সময় যতই গড়াচ্ছিল, মারিয়া ফ্রাঞ্জিস্কাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা মনে করে ততই সে পুলকিত বোধ করছিল। ধীরে ধীরে সব গায়কের কণ্ঠ স্তিমিত হতে থাকল; বৃদ্ধের কণ্ঠ তো পুরোপুরি জড়ানো; যুবকেরা ঘুমের ভান করে পড়ে রইল। অবশেষে সব ঘুমিয়ে গেল, শুধু অন্ধলোকটি বসে বসে তার ছড়ির মধ্যে কোথায় অসমতা আছে তা আঙুল দিয়ে পরখ করতে লাগল। হঠাৎ গৃহপ্রাঙ্গণ থেকে মোরগ ডেকে উঠল। প্রেডু চোখ খুলে অন্ধলোকটিকে দেখতে পেল।

‘সে তো আর আমাকে দেখতে পাচ্ছে না, এমনটাই ভেবে নিয়ে খুব সন্তর্পণে উঠে দাঁড়িয়ে ভেতরের দিকে চলে গেল। মারিয়াও খুব চুপিসারে মই দিয়ে নিচে নেমে এসে প্রেডুর বাহুর মধ্যে নিজেকে সঁপে দিল। অন্ধলোকটি কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারল কেউ একজন এখান থেকে উঠে গিয়ে ভেতরের দিকে গেছে; এবং সেটি নিশ্চিত প্রেডু। একই জায়গায় ঠায় বসে থেকে সে শুধু বিড়বিড় করে বলল, ‘স্বর্গে ঈশ্বরের মহিমা আর পৃথিবীতে শান্তি বর্ষিত হোক সব মহিমান্বিত মানুষের কাছে!’  বাইরে তখনো সফেদ মেঘের আড়ালে চাঁদ জেগে রয়েছে, এবং এই রুপালি রাতে সাগরের ঘ্রাণ আর মরুভূমির উষ্ণতার মিশেলে পূবালী হাওয়া বয়ে চলছে। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫