Logo
×

Follow Us

ঈদ সংখ্যা

চরকার সনে আমার বড়রে পিরিতি

Icon

শফিকুল কবীর চন্দন

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৪, ১৯:০৫

চরকার সনে আমার বড়রে পিরিতি

১৯ শতকের ভারতীয় বয়ন শিল্প শ্রমিক। ছবি: সংগৃহীত

‘চরকা আমার ঘুরে রে 
ভন ভন ভন।
চরকা আমার বুহের লউ
সাত রাজার ধন।’

একদা ভারতবর্ষ যে দীর্ঘকাল পর্যন্ত শিল্প ও বাণিজ্যে জগতের শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করেছিল, তন্তু ও বয়নকার্যে নিপুণতাই তার প্রধান কারণ। পণ্যের মধ্যে বস্ত্রই ছিল প্রধান ও অধিকতর সমৃদ্ধির হেতু। বর্তমান পৃথিবীর বাণিজ্য-ক্ষেত্রে ইংল্যান্ড ও অন্যান্য তন্তু-শিল্পপ্রধান দেশসমূহ প্রবেশ লাভ করবার পূর্ব, অর্থাৎ বিগত দুইশ বৎসরেরও অল্পকাল আগে পর্যন্ত, ভারতবর্ষ তথা বাংলা জগতের বস্ত্রবাণিজ্যের প্রধান অধিকারী ছিল। চরকার সুতাই তার  মূল সম্বল ছিল। বাংলার তুলা, টাকু, সুতা, তাঁতি-তাঁত, বস্ত্র আলোচনায় চরকা ও সুতা কাটনি নারীর সূক্ষ্ম সুতা কাটার দক্ষতা আর তাদের উপার্জন ও ধনাংশের যে বাখান ইতিহাস ঐতিহ্যের কথকতায় আছে, তার কিছুমাত্র  এই নিবন্ধে তুলে  আনা হয়েছে।

বাংলার পল্লী সমাজে চরকা কাটার যে অবদান ছিল একদা চিরন্তন ও সর্বব্যাপী তা আজকের জামানা দিয়ে বুঝা সম্ভব নয়। কাটনির মুখে চরকার গানের মধ্যে তার সচ্ছলতার কথা ধ্বনিত হয়-

‘কোন সজনী বলে রে ভাই চরখার নাইক নোরা-
চরখার দৌলতে আমার দোরে বাঁধা ঘোড়া।’

ভারতে গান্ধীবাদী জাতীয়বাদ কেবল ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতাই করেনি তা বিকাশের পশ্চিমী তত্ত্বটাকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল সেদিন। তাই ‘চরকা’ গান্ধীর কাছে নিছক সুতা কাটার যন্ত্র কেবল ছিল না। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে (অসহযোগ পর্বে) তার বিখ্যাত বিতর্কে গান্ধী জানিয়েছিলেন ‘চরকা’ হলো গ্রামীণ সারল্যের (যা পশ্চিমী জটিল যন্ত্র সভ্যতার বিপরীত) প্রতীক। তাই প্রাক জাতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় ভারতের ‘চরকা’ শিল্পযন্ত্রের বিরোধিতায় বিশেষ গুরুত্ব পেলেও স্বাধীন ভারতে পশ্চিমী অর্থে শিল্পোন্নয়নই হয়ে ওঠে গুরুত্বের কেন্দ্রভূমি, আর গান্ধী তাঁর দর্শন সমেত হারিয়ে যান।

‘চরকা আমার ভাতার পুত চরকা আমার নাতি; 
চরকার দৌলতে আমার দুয়ারে বাঁধা হাতি ॥’ 

বয়নশিল্পে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ যে সুনাম অর্জন করেছিল এখানকার ঘরে ঘরে প্রচলিত চরকাই ছিল তার প্রধান কারণ। চরকা ছিল এখানকার মেয়েদের হাতের অস্ত্রস্বরূপ। একদা নিতান্ত নিঃস্ব নারী থেকে শুরু করে রাজ মহিষী পর্যন্ত সুতা কাটতে সংকোচ বোধ করত না। ষোড়শ শতাব্দীতে সুষঙ্গ দূর্গাপুরের রানী কমলা রাজা জানকীকে তাঁর প্রেমের তাজ গড়ার জন্য যে নির্দেশ দেন তাতে এ উক্তির সত্যতা প্রমাণ করে। “আমি সাত দিন সাত রাত ধরিয়া এক টাকিয়া সুতা কাটিব। সেই সুতা যতটা দীর্ঘ হইবে সেই মাপে তুমি আমার জন্য একটি দীঘি কাটাইয়া দিবে-তাহার নাম রাখিবে ‘কমলা সাগর’।”১

অন্য একটি লোকগানে আছে-
‘চলগো যাই সে মহাজনে 
তার নাম সাধু বেনে।
তার দোকানের সুতো ভালো।
কম দেয় না ওজনে,
ও দিদি কাঁদিসনে, কাঁদিসনে,
কাটনা ছাড়িস না।
কাটবি সুতো অবিরত 
রবি সুতোর কারণে ॥’২

বাংলাদেশের প্রাচীন সাহিত্য, ছড়া, প্রবচন, লোককথা, প্রবাদে ও এখানকার অর্থনৈতিক জীবনে চরকার গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। ‘চরকা আমার ভাতার পুত, চরকা আমার নাতি, চরকার দৌলতে আমার দরজায় বাঁধা হাতি’ কিংবা ‘চাঁদের মা বুড়ি চরকা কাটে’ ইত্যাদি চরকার ব্যবহার্য তারই প্রমাণ দেয়।

‘চরকা আমার নাতি পুতি 
চরকা আমার প্রাণ 
চরকার দৌলতে আমার 
গোলাভরা ধান।’২ক

একদা বস্ত্রবয়নে ছিল পুরুষের একচেটিয়া অধিকার তেমনি সুতা কাটায় মেয়েদের। ফলে নিন্দনীয় হয় পাছে পুরুষের হাতে চরকা ঘুরতো না। তাই বয়ন ও সুতা কাটার কাজে পারিবারিক এক প্রকার শ্রম বিভাগ ছিল। কথিত যে, মসলিনের সূক্ষ্ম সুতা কাটার কাজটি নারীরা তো করতই এমনকি তারা ছিল কিশোর বয়সী। 

“চরকা মোর গো মাতা পিতা 
চরকা মোর গো পুত 
চরকার দৌলতে মোর গো 
আসি কোঠা সুখ।”

‘রেশমের গায়ে যখন গুটি ধরে তখন বিভাবতীর অসম্ভব আনন্দ হয়। তাঁতির ঘরের মেয়ে সে। .... বিভাবতীর বাবা তল্লাটের নামি রেশম চাষি। ...নয় বছরের বিধবা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বাবা সত্যচরণ বললেন, এখন থেকে এই রেশমের কাজে হাত দে মা। মন দিতে পারলে ভালো সুতা কাটুনি হতে পারবি। সেই শুরু। ধীরে ধীরে রেশমের সঙ্গেই যেন বিয়ে হল বিভাবতীর। তার সব মন জড়িয়ে গেল রেশমের বহুবর্ণ সুতায়।’৩ 

‘সুতা কাটনী’ বলে মেয়েরাই পারদর্শী ও পরিচিত ছিল। ফলে চরকায় সুতা কাটতে কাটতে গাওয়া ও রচিত গানগুলোও তারই সাক্ষ্য দেয়।

‘গুনগুনানি লো সই চরকার গুনগুনানি
সবাই শুইনা যা-লো 
আমার সাধের চরকার গুনগুনানি
চরকাতে সুতা কাটি আমি সুতা কাটুনি
রাইত জাগিয়া সুতা কাটি ননদী হয় সঙ্গী
গুনগুনানি লো সই চরকার গুনগুনানি
চরকা আমার সাধের নাগর আমার পরান পাখি
সোয়ামীরে দিয়া ফাঁকি রাতভর সুতা কাটি
গুনগুনানি লো সই চরকার গুনগুনানি
এই সুতায় তানা বানা এই সুতাতে খেই
নকশা ওঠে আচলা ভইরা জুড়ি যে তার নাই
গুনগুনানি লো সই চরকার গুনগুনানি
আমার সাধের চরকার গুনগুনানি।’

(নিজস্ব সংগ্রহ)

একদা ভারতের জাতীয় আন্দোলনের উদ্দীপনা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খদ্দরের জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পেয়েছিল। বিলাতি পণ্য বর্জন এবং মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে বিলাতি বস্ত্র পোড়ানোর আন্দোলন, চরকায় কাটা সুতায় দেশি তাঁতে বোনা খদ্দরের চাহিদা ও উৎকর্ষ ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে তুলেছিল।

ভারতবর্ষে সেই ইংরেজ শাসনবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের সময় গ্রাম-গঞ্জে ‘সুতা কাটা কংগ্রেস’-এর পতাকা মিছিলে গান হতো-

‘আমরা যুগাই শিমুল কার্পাস ভারে ভারে ধান
অত্যাচার আর লাঠির গুতা তারই প্রতিদান
তোদের এই কিরে বিধান।’৪ 

তাঁতি ঘরের বৌ-ঝিরা সাংসারিক কাজের ফাঁকে অবসরে একত্রে সুতা কাটতে বসত। কেউবা নলীতে সুতা ভরত, কেউ চরকা টাকুতে সুতা কাটতে কাটতে নানা গালগল্প ছড়া গানে কাজের সময়টা পার করত।

‘সরু করে কাট সুতা বনাইব শাড়ি
সেই শাড়ি পিন্দি নাচে যত ব্রজনারী।’৫ 

বলা বাহুল্য সুতা কাটার সময় কাটনীদের মানসিকভাবে উৎফুল্ল থাকার প্রয়োজন ছিল। কেননা অস্থির চিত্ত, অথবা দুঃখ দৈন্য তাদের সূক্ষ্ম সুতা কাটার প্রধান অন্তরায়। দুই মাস নিয়মিত সুতা কাটলে এক তোলা সূক্ষ্ম সুতা তৈরি করতে পারত মাত্র। 

নারীর অর্থ রোজগারের জন্য সুতা কাটা পেশা আকর্ষণীয় ছিল। ফলে এই চরকা টাকুকে তারা বন্ধুই মনে করত। 

চরকা প্রিয় মিত্র আমার-
তুলোর পাঁজা বকের পাখা,
কোথায় লাগে তোমার কাছে 
সোনার মোহর, রূপোর টাকা।
আবার অন্যত্র আছে- 
চরকা চাকায় বাসছি ভালো সইছে না কি প্রাণে?
সতীন তোমার ডাকছে ওগো! ডাকছে নানান ভানে।

‘ঢাকার সুতা কাটুনীরা অত্যন্ত পটু ছিল। এর জন্য সুতা কাটুনীদের আঙ্গুলের ডগার অত্যাশ্চর্য চেতনা শক্তির প্রয়োজন ছিল এবং ঢাকার কাটুনীরা এর জন্য বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল।

ঘর ঘর ঘর চরকা ঘোরে জাগে সুতোর বাণ,
রাত জাগিয়া চরকা কাটি বেলায় ভাঙি ধান।
চরকা চাকায় ঘোরে আমার দুঃখ সুখের রাতি,
চরকা আমার স্বামীপুত চরকা আমার নাতি।’

  অনেক ইউরোপীয় লেখক ঢাকাই মসলিনের সুতা কাটুনীদের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তাদের মতে এরূপ সূক্ষ্ম ও মিহি সুতা তৈরি এবং তাও হাত চালিত একটি সামান্য টাকুর সাহায্যে, একমাত্র পাক ভারতীয়দের দ্বারাই সম্ভব। তারা বিনাদ্বিধায় স্বীকার করেছেন যে, কোনো ইউরোপীয় তাঁতি এরূপ অসামান্য নিপুণতার অধিকারী হতে পারেনি। কারণ তাদের মতে ঢাকার প্রস্তুত সুতা, ম্যানচেস্টারের কলে প্রস্তুত সূক্ষ্মতম সুতার চেয়েও সূক্ষ্ম ছিল। 

দওগো তোমরা জাননি, কি মজা লাগে আমার চরকার গ্যানগ্যানি।’ 

সাধারণত গ্রামের মেয়েরা যখন বসে বসে চরকার সাহায্যে সুতা কাটত, তখন তাদের উদ্দেশে ছেলেরা ঠাট্টাচ্ছলে কিছু বললে তার উত্তরে মেয়েরা গানের মধ্য দিয়ে তার জবাব দিত।

‘ওলো সুজনী
এ্যাত রাইতে কিসের কর তোরা 
চক্ড়ার গুনগুনি
কোন খোয়ারী বলছেরে মোর
চক্ড়ায় নাইরে হোঁড়া
(ওরে) হ্যেইয়ানা চক্ড়ার দৌলতে আমার
দরজায় বান্দা গোড়া।
ও নাগরালী কুমকুম সাপরালী কুমকুম
আক্কুম বাক্কুম আড়া দেই আর সাড়া দেই
ওককায় টানে নৈচায় কুড়কুড়ি
দুই জালে বলছে লো সুজনী
এ্যাত রাইতে কিসের কর তোরা 
চক্ড়ার গুনগুনি
কোন খোয়ারী বলছেরে মোর
চক্ড়ায় নাইরে পাতি
(ওরে) হ্যেইয়ানা চক্ড়ার দৌলতে আমার
দরজায় বান্দা আতি।
ও নাগরালী কুমকুম সাপরালী কুমকুম
‘ওলো সুজনী
এ্যাত রাইতে কিসের কর তোরা 
চক্ড়ার গুনগুনি ॥’৬ 

(এ গানটি পটুয়াখালী জেলার খলিসাখালী এলাকায় প্রচলিত) 

শাড়িতে নীলাম্বরীর নকশা বোনায় পারদর্শী পঞ্চানন তাঁতির ভাষায়-

‘পুরুষ বোনে তাঁত
বধূরা ঘুরায় চরকা।
তার সঙ্গে জোগান দিতে
আরো একজনের ধাক্কা।
পুরুষের মাকু টানা সকাল থেকে সন্ধ্যা।
মেয়েদের হেঁশেল ঠেলা, কাপড় কাচা তার ওপর চরকা।’৭ 
চরকা হইতে মন ছাড়াইলে সুতা কাটে টনাটন 
সুতা কাটুনীর মনের স্থিরতা সূক্ষ্ম সুতা কাটার পূর্ব শর্ত। তাই বলা হয় চরকা হইতে মন ছাড়াইলে সুতা কাটে টনাটন। 

‘মৈমনসিংহ গীতিকা’য় মলুয়া পালায় উল্লেখ আছে-

‘সুতা কাটে ধান বানে শাশুড়িরে লইয়া।
এইমতে কাটে দিন দুঃখ যে পাইয়া ॥’ 

চরকা আমার ভাতার পুত, চরকার দৌলতে আমার দুয়ারে হাতি বাধা প্রভৃতি অর্থ-বাচক প্রবচন এখনও পাড়াগায়ের মেয়েদেব মুখে মুখে শোনা যায়। মেয়েরা চরকার ভাবে এতটা অভিভূত ছিলেন যে, চাদের কলঙ্কটাকে “চাঁদের মা বুড়ি চরকা কাটিতেছে।” এই ব্যাখ্যা করিয়া ছেলেদের বুঝাইতেন। চরকার সুতা এত সরু হইত। যে এখনও তাহার যে নমুনা পাওয়া যায়, তাহাতে আশ্চর্য্য হইতে হয়; অথচ চরকার ব্যবহার তো এযুগে প্রায় উঠিয়া গিয়াছে। এখনো বিক্রমপুরের বামুণের মেয়েরা চরকার সুতায় এরূপ সূক্ষ্ম পৈতা তৈরী করেন যে, চার দণ্ডী পৈতার চার পাঁচটা একটা বড়-এলাচের খোসার মধ্যে অনায়াসে পুরিয়া রাখা যায়। আমি যখন ঢাকা কলেজে পড়িতাম, তখন আমার এক বিক্রমপুর-নিবাসী সহপাঠী বড়-এলাচের খোসার মধ্যে পূরিয়া তাহার মাতার হাতের কাটা চারিটি পৈতা আমাকে উপহাব দিয়াছিলেন; সেই চারিটি পৈতায় ২৪০ হাত সুতা ছিল। সেই সুতা মাকড়সার জালের মতো সূক্ষ্ম হইলেও বেশ শক্ত ছিল, আমি তাহা বহুদিন ব্যবহার করি যাছিলাম। বাংলার চরকা ও বাংলার সূতা বাংলার গৃহগুলোর এরূপ অপরিহার্য্য অঙ্গীয় উপকার হইয়া পড়িয়াছিল যে, লোকে কথাবার্ত্তা, উপমা দেওয়া প্রভৃতি সমস্ত বিষয়েই এই চরকা ও সুতার উত্থাপন করিত। এমন সব ব্যাপারে সুতার বাংলার সুতার ব্যবসায়। এমন সব (উল্লেখ ও উপমা দেওয়া হইত, যাহা এখন অদ্ভুত ঠেকে; কিন্তু সেইভাবের প্রয়োগ দ্বারা বুঝা যায়, বাঙ্গলার সুতার কারবারটা কত প্রিয় ও বহুল পরিমাণে প্রচলিত ছিল।৮ 

নরসিংদী অঞ্চলে প্রচলিত পডি ঘরে সুতা কাটুনীর গীত 

‘আমি সাবধানে ঘুরাই গো নাটা
না জানি যায় সুতা ছিড়া
যদি ছিড়া যায় সুতা 
ফেলতাম না তা এক ফোটা।
নাটায় আছে গো আমার মন আটা 
যদি যায় গো ছিড়া সুতা আমার, তুলিব তা কলে বলে
চিন্তা কি তায় অতশত, জট পাকিলে রাঙা সুতায়
আমি ফেলতাম না তার এক ফোটা।
এমনি ছাড়াই যত জটাপটা
নাটাইয়া সব করতে পাটা 
শেষে বাইন্যায় তাঁতি মাকু মাইরা
তানা বানায় প্রেম রসের মাড় লাগাইয়া।
আমি সাবধানে ঘুরাই গো নাটা
নাটায় আছে গো আমার মন আটা।’

(নিজস্ব সংগ্রহ)

চরকা নামের এই একটি বস্তুর মাধ্যমে সাম্য ভাবনাকে অসংখ্য সাধারণ লোকের জীবনে একটি বাস্তব সত্য হয়ে উঠতে সহায়ক হলো। চরকার দৌলতে দুয়ারে হাতি বাঁধা না থাকলেও গ্রাম-ঘরের অভাবগ্রস্ত পরিবারগুলোতে এইটেই যে বেঁচে-বর্তে থাকার একটা মস্তবড় নির্ভরযোগ্য উপকরণ ছিল, সে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই। চরকা ক্রমশ একটা ধর্মানুষ্ঠানের রূপ নিতে থাকলো। চরকা ধ্যান, চরকা জ্ঞান, চরকাই মুক্তি, এই হল নব নামপ্রচার। স্বদেশী চেতনার প্রতিফলন “বউমা আমার সেয়না মেয়ে চরকা কিনেছে ঘরের কোনে আপন মনে সুতো কেটেছে।’ 

চরকা কাটা ছিল রাজনীতিতে মাথা গলাবার পাসপোর্ট। ‘চরকার গান’ গান্ধীজীর চরকা আন্দোলনকে উপলক্ষ করে রচিত। নজরুল একদা গান্ধীজীর চরকা প্রবর্তন ব্যবস্থাকে হিন্দু- মুসলমানের সৌভ্রাত্র এবং মিলনসূত্র বলে মনে করেছিলেন। এই চরকার কথা কত গান, কত রূপকথা, গাথাসাহিত্য-প্রতি যুগের সাহিত্যে দেখা গেছে। বাংলাদেশে অর্থাৎ অখণ্ড ভারতবর্ষে ইংরেজ রাজত্বের পূর্ব পর্যন্ত চরকা, তাঁত বাংলার বস্ত্রশিল্পের প্রধানতম সম্বল ...হাতের কাজ ছাড়াও বাংলার তাঁতের প্রয়োজনীয় সুতোর বেশিরভাগ মহিলারাই সরবরাহ করত। চরকা ও  লাটুতে গৃহকর্মের ফাঁকে ফাঁকে সুতো কাটা চলত। এজন্য তাঁতীরা অগ্রিম টাকা দিত বা তুলো সরবরাহ করত।

‘আমাদের দেশে পূর্বে যখন চরকার প্রচলন ছিল, তখন কেহ অন্নের জন্য রাস্তায় রাস্তায় হাহাকার করে বেড়ায়নি। চরকা দেশবাসীর বস্ত্রের সমাধান করত, চরকা দেশবাসীকে কাজ দিত, চরকা দেশবাসীর আলস্য দূর হইত।’৯ 

কুষ্টিয়ার মহিন শাহ বাউলের কণ্ঠে চরকার গান-

‘সজনী লো সজনী
এত রাইতে শুইনা যা লো
চরকার গুনগুনি।
চাক্কুম চুক্কুম
তানায়ম তুনায়ম
নাইল খান পচা ফেন
মাকুর বুনভুনি।
এত রাইতে শুইনা যা লো
চরকার গুনগুনি।
বরিশাইল্যা চরকা আমার
চরকা আমার হিয়া
চরকার দৌলতে আমার
সাতখান বিয়া লো সজনী
এত রাইতে শুইনা যা লো
চরকার গুনগুনি।।
চরকা আমার ছেলে মেয়ে
চরকা নাতি পুতি
চরকার দৌলতে আমার
দরজায় বান্ধা হাতি লো সজনী
এত রাইতে শুইনা যা লো
চরকার গুনগুনি ॥’১০

ছড়া, প্রবাদ প্রবচনেও চরকা ও সুতা কাটুনীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়-

‘চলনেতে নারী চিনি বেশর মিলন
সুতায় কাটুনী চিনি পদেতে কুলীন।’১১ 

নরসিংদী এলাকায় প্রচলিত গ্রাম্য ছড়া-

‘চরকা আমার সোয়ামী পুত
চরকা আমার নাতি
চরকার দৌলতে আমার দুয়ারে বান্দা হাতি ॥’১২ 

বাংলার সুতা কাটুনী নারীদের  চরকার দৌলত, চরকার সঙ্গে সখ্য, চরকার জন্য তার ধন বৃদ্ধি, সংসারে সমৃদ্ধি, সম্পদ প্রাপ্তি ইত্যাকার ইতিবাচক অভিজ্ঞতার বয়ান লক্ষ করা যায় বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলের লোককথা, লোকগীতির মধ্যে। চরকা নিয়ে মূল বক্তব্য একই রেখে প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রায় সমধর্মী নানা শব্দে বাক্যে আঞ্চলিক ভাব প্রকাশের উদাহরণ প্রত্যক্ষ করা যায়। এখানে চরকা নিয়ে মানে চরকার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বাংলাদেশের নানা অঞ্চলের ভাষ্য উল্লেখিত হয়েছে।

চরকা আমার ভাতার পুত        চরকা আমার নাতি, 

চরকার দৌলতে আমার           দুয়ারে বান্ধা হাতি ॥

চরকা আমার আশয় বিষয়       চরকা আমার হিয়া,

চরকার দৌলতে আমার          সাত পুতের বিয়া ॥১৩ 

চরকা গুনগুন চরকা গুন গুন 
চরকা গুন গুন থোরা  
চরকার দৌলতে আমার 
থানে বান্ধা ঘোড়া। 
চরকা গুনগুন, চরকা গুন গুন 
চরকা গুন গুন ভাই 
চরকার দৌলতে আমার 
থানে বান্ধা গাই।১৪ 

চরকার দৌলতে আমার সাতটি বেটার বিয়া, চরকার দৌলতে আমার থানে বান্ধা গাই, চরকার দৌলতে আমার দুয়ারে বাঁধা হাতি, চরকার পশ্চাদে আমার স্বামী দৌড়ায় ঘোড়ালো, চরকায় ভাত কাপড় পরি, জোড়ায় জোড়ায় শাঁখা, চরকার দৌলতে আমার দোরে বাঁধা ঘোড়া।’ গ্রামীণ সমাজে গৃহস্থ কারিগরের বাড়িতে দুধেল গাই গরু, হাতি, ঘোড়া, কাটনির হাতে শাঁখা এ সব সুতা কাটার রোজগারে ঐশ্বর্যের প্রতীক হয়ে নানা অঞ্চলে প্রবাদ প্রবচনে লোক কোথায় উদ্ধৃত হয়েছে-

চরকা আমার নাতিপুতি, 
চরকা আমার হিয়া, 
চরকার দৌলতে আমার 
সাড়ে সাত ব্যাটার বিয়া। 
স্বজনী লো শুইন্যা যা 
এত রাত্রে চরকার ঘ্যানঘ্যানি।১৫
এত রেতে চরকার ঘরঘরানি
চরকা আমার ভাতার-পুত, 
চরকা আমার নাতি 
চরকার দৌলতে আমার 
দুয়ারে বাঁধা হাতি 
সজনী লো এত রেতে চরকার ঘরঘরানি!১৬ 

ওগো তোমরা জাননি,
কি মজা লাগে আমার চরকার গ্যানগ্যানি।
চরকা আমার ভাতার পুত চরকা আমার নাতি 
চরকার দৌলতে আমার দুয়ারে বাঁধা হাতি।১৭ 

ওলো সই, তোরা সব শুইন্যা যা  
আমার চরকার গুনগুনানি,
গুনগুনানি লো সই গুনগুনানি 

চরকায় কাটি সুতা, আমি নলী ভরনী 
রাত জেগে কাটি সুতা, পাশে বসে ননদিনী 
গুনগুনানি লো সই গুন গুনানি 

চরকা মোর ভাতার পুত চরকা মোর নাতি 
চরকার দোয়াতে মোর দুয়ারে বাঁধা হাতি।

চরকা আমার মনের নাগর, আমার পরাণ পাখি 
সোয়ামিরে ফাঁকি দিয়ে কাটি সুতা কাটি।
গুনগুনানি লো সই গুনগুনানি।১৭ক

চরকা আমার ভাতার পুত, চরকা আমার নাতি। 
চরকার দৌলতে আমার দোরে বাঁধা হাতি ॥

“গুন্ গুন্ গুন্ গুন্ সাগরালি বাও 
বাকুম বাকুম করেলো আমার চরকার রাও 
কোন ভাই কয় আমার চরকার কামোই থোরালো 
চরকার পশশাদে আমার স্বামী দৌড়ায় ঘোড়ালো।”১৮ 

‘চরকা আমার পুত পৈতা, চরকা আমার নাতি 
চরখার দৌলতে আমার দোয়ারে বাঁধা হাতি।’১৯ 

সুতা প্রস্তুত বস্ত্র বয়ন সম্বন্ধে একজন লেখক হিন্দু নারী ও তন্তুবায়গণের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন, “হিন্দু মহিলারাও তন্তুবায়গণের জন্য তক্রু দ্বারা সূক্ষ্ম সূত্র এবং চরকা দ্বারা সূত্র প্রস্তুত করেন। ভারতের মসলিন শিল্পের প্রাচীন আদর্শ উৎকর্ষের কারণ সেই অঞ্চলের বাসিন্দাদের দেহমনের অতি সুন্দর গঠন ভঙ্গিমা। এই বিশেষত্বের বহির্বিকাশ এইরূপভাবে দৃষ্ট হয়- জীবনের সাধারণ কার্যে অতিমাত্রায় অভিমানবোধ, নমনীয় শিরা ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, নরম ও মসৃণ চর্ম, করুণ দৃষ্টি, ইন্দ্রিয়াদির ব্যবহারে সদা সতর্কভাব, এবং অতি সামান্য কারণে জীবন্ত উত্তেজনা। হিন্দু এই সব গুণ সমন্বিত হওয়ায় বহু সহস্র বৎসর ধরিয়া সূক্ষ্ম কার্পাসশিল্পে একচেটিয়া অধিকার রাখিতে সমর্থ হইয়াছে। হিন্দুরা তাঁত হইতে উৎপন্ন দ্রব্যসমূহে যে সম্পূর্ণতা দেখাইতে সমর্থ হইয়াছে তাহা প্রকৃতই অবর্ণনীয়। উৎপন্ন কার্পাসজাত দ্রব্যের সূক্ষ্মতা ও সৌন্দর্য-সম্পাদনে হিন্দুর সহিত কোন জাতির তুলনা হইতে পারে না। এ বিষয়ে হিন্দুর নৈপুণ্যের কারণ অনেকগুলি-তাহার জলবায়ু ও জমি প্রচুর কাঁচা দ্রব্য-উৎপাদনের পক্ষে অনুকূল; উক্ত কার্য স্থিতিশীল শান্ত প্রকৃতির উপযোগী; তাহার অপরিসীম ধৈর্য আছে; এ কার্যে শারীরিক শক্তির অল্প প্রয়োগই প্রয়োজনীয় হয়; তাহার দূর্বল ও ক্ষীণজীবী শরীরে স্পর্শেন্দ্রিয়ের অতুলনীয় প্রাখর্য এবং অঙ্গুলীর অত্যাশ্চর্য নমনীয়তা তাহার সহায়ক; এবং তাহার হস্তের গঠনের যে কৌশল সে প্রদর্শন করিতে সক্ষম তাহা কেবল তাহারই নিজস্ব।”২০

‘চরকা মোর ভাতার পুত, চরকা মোর লাতি,
চরকার কল্যাণে মোর দ্বারে বাঁধা হাতি।’২১ 

‘চরকা আমার পিতা মাতা 
চরকা বন্ধু সখা,
চরকায় ভাত কাপড় পরি, জোড়ায় জোড়ায় শাঁখা,
চরকা প্রাণের সখা।’২২ 

‘ঘরে ঘরে নারী লোকে চরকা কাটে 
সুতা শুকায় আর দেয় পাড়ি 
তারা পরে ঐ মেশিনের শাড়ি আর পরে 
হিমানী পাউডার, আর পরে আলতার বড়ি
মন বলে স্বর্গ হতে, আইল সব পুষ্পরথে যত, হুরপরি 
সারাদিন তাঁত বুনায়ে সন্ধ্যায় যায় বাড়ি 
ঘরের বউকে ডাইক্যা কয় বিছানা দাও পারি।’২৩ 

শ্রমিক ও শ্রমিক-চাষিদের গান-বাজনার দল। পশ্চিম-বাংলায় এই ধরনের দলকে বলে-  ছাঁচ্ড়ার দল। কয়েকটি সুকণ্ঠ ছেলে ধুয়া ধরিয়া গান গাহিতেছিল, মূল গায়েন ইট-পাড়াইয়ের ঠিকাদার ওসমান-মূল গানটা গাহিয়া চলিয়াছে। বাংলাদেশের বহু প্রাচীন কলের গান। ছেলেগুলি ধুয়া গাহিতেছে

‘সজানি লো-দেখে যা-এত রেতে চরকায় ঘরঘরানী-সজনি-লো-!

ওসমান গাহিয়া চলিয়াছিল-

কোন সজনি বলে রে ভাই চরখার নাইক হিয়া-
চরখার দৌলতে আমার সাতটি বেটার বিয়া।
কোন সজনি বলে রে ভাই চরখার নাইক পাঁতি-
চরখার দৌলতে আমার দোরে বাঁধা হাতি।
কোন সজনি বলে রে ভাই চরখার নাইক নোরা-
চরখার দৌলতে আমার দোরে বাঁধা ঘোড়া।’২৪

‘লেগেছে আপন কাজে যার যা নিচ্ছে মনে 
মায়ের কৃপায় পেলাম ফিরে চরকা হেন ধনে-
তাই রেখেছি আমি অতি সযতনে আমার চরকা ধনে 
চরকা আমার মাতা পিতা চরকা বন্ধু সখা;
চরকায় ভাত কাপড় পরি জোড়ায় জোড়ায় শাঁখা।’২৫

বেলা শাহ্ ফকীর অনন্য উপস্থাপনায় গেয়ে ওঠেন-

‘চরকার সনে আমার বড়রে পিরিতি
চরকার সনে ভুলে রইলাম
না ভজিলাম পতি
চরকার সনে আমার বড়রে পিরিতি।’ 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫