
আনওয়ার আহমদ। ছবি: সংগৃহীত
১৯৯৮ সালের ডিসেম্বর মাস।
তখন আমি ভৈরবে একটা প্রজেক্টের কাজে ১ মাসের জন্য আছি। সারাদিন মাঠঘাট দাবড়ে এক সন্ধ্যায় ডেরায় পৌঁছে দেখি-উদ্ভ্রান্ত চঞ্চল বসে আছে। তার থমথমে মুখ দেখে চমকে উঠি। সবার সঙ্গে পরিচয় পর্ব শেষ করে পাশের মাঠে গিয়ে দুজন বসলাম। এর কিছুদিন আগেই আমরা বিয়ে করেছি, পরিবারকে না জানিয়ে। যদিও সংসার শুরু করতে পারিনি, চিঠিতে পরস্পর স্বপ্ন বুনে চলি কেবল। বেকার চঞ্চল কাজের খোঁজ করে যাচ্ছে, আমিও এটাসেটা করে নিজেকে গোছাতে চেষ্টা করে চলেছি, কিন্তু একদম বিনা নোটিশে তার আসাটা আমাকে ভাবাচ্ছে।
চঞ্চল আমার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিল, বলল-পড়। দেখলাম, সম্পাদক, প্রকাশক, কবি আনওয়ার আহমদকে লেখা আমার একটা চিঠি। এই চিঠি তার হাতে কেন ভাবতে ভাবতে পড়তে শুরু করি; কিন্তু চিঠি পড়ে তো এবার আমার বেদিশা। কারণ তাতে হাবিজাবি বহু কিছু কথার সঙ্গে সাদা কাগজে কালো কালিতে স্পষ্ট করে লেখা আছে, ‘আমি যে তোমাকে বিয়ের কথা বলেছিলাম, তা কিন্তু ইয়ার্কি না। সত্যিই। তুমি বিষয়টাকে সিরিয়াসলি নাও প্লিজ।’ চঞ্চলের জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেওয়ার কিছু খুঁজেই পাচ্ছিলাম না। নিজের হাতের লেখা, আমার সামনে। একে অস্বীকার করি কোন যুক্তিতে? কিন্তু এ রকম কোনো স্মৃতিও তো মনে পড়ছে না, যেখানে আনু ভাইকে আমি বিয়ের প্রপোজ করেছি! আসলে কী ঘটনা? এ রকম কিছু মনে পড়ছে না কেন? এটা তো আমারই লেখা! শুধু বললাম, অদ্ভুত, এ রকম কিছু কবে ঘটল, আমার কিছু মনে পড়ছে না কেন!
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হয়তো তালগোল হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিছুক্ষণ নিঃশব্দ বসে থাকি আমরা। আকস্মিকতার ধাক্কাটা কেটে গেলে ধীরে ধীরে ফ্ল্যাশব্যাকের মতো কয়েকটা দৃশ্য একের পর এক মনে পড়তে লাগল।
তখন আমি রাবির তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। পাঠক ফোরামের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কাজে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশ কজন ছেলেমেয়ে আমরা ঢাকায় এসেছি। সেই সময় আমি আর লায়লা পর পর দুদিন গেলাম আনওয়ার ভাইয়ের লালমাটিয়ার বাসায়। তখন খুব সম্ভব আমি ২২-২৩ আর আনওয়ার ভাই ৫৩-৫৪। সম্ভবত প্রথম দিন, আনওয়ার ভাই তার নিঃসঙ্গ জীবনের যন্ত্রণার কথা যখন বলছিলেন, বললাম, আপনি বিয়ে করেন। এত কষ্ট করে থাকার কী দরকার। আনু ভাই এরপর বলে বসলেন-আমাকে কে বিয়ে করবে, বুড়ো হয়ে গেছি, তুমি করবে? আমি তাৎক্ষণিক জবাব দিলাম হ্যাঁ, করব তো। উনি হাসতে হাসতে বললেন-তাই নাকি, তাহলে চলো। সবাইকে খবর দেই। আমিও হাসতে হাসতে উত্তর করি হ্যাঁ হ্যাঁ চলেন। তারপর আমরা নানাবিধ গল্পে, রসিকতায় ওই প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে ঢুকে পড়ি। আনু ভাইয়ের বিবাহ প্রসঙ্গ চাপা পড়ে যায়।
রাজশাহীতে আসার পর আমার মন খারাপ হতে থাকে। একজন নিঃসঙ্গ মানুষের খাবার কষ্ট, মনের কথা বলার কষ্ট, অসুখে বিসুখে একটুখানি পরিচর্যার অভাবের কষ্ট। আহা কত কষ্ট! আমি তাকে বলতে যাই, আপনি বিয়ে করেন। বিয়ে বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নেন। আর একা থাইকেন না; কিন্তু আমি লিখি, ‘আমি যে তোমাকে বিয়ের কথা বলেছিলাম, তা কিন্তু ইয়ার্কি না, সত্যি। তুমি বিষয়টাকে সিরিয়াসলি নাও প্লিজ’ (চিঠিতে তাকে তুমি করেই বলতাম)। ৫-৬ দিন পর আনু ভাই চিঠি লেখেন। তিনি বিস্মিত। তার মতো বয়সী একজনকে আমি সিরিয়াসলি বিয়ে করতে চেয়েছি! বার বার ভাবতে বলেছেন। আবেগপ্রবণ হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে নিষেধ করেছেন।
... বুঝতে পারি, আনওয়ার ভাই ভুল বুঝেছেন। পরের চিঠিতে, তার সে ভুল শুধরে দেই। লিখি... আমি স্বয়ং বিয়ে করব, এটা বলতে চাইনি। বরং তাকে বিয়ে ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিয়ে কোনো একজনকে বিয়ে করতে বলেছি। এবার তিনি ভুল বুঝতে পারেন। পরের চিঠিতে লেখেন, যাক বাঁচালে। আমি তো চিন্তায় পড়ে গেছিলাম...। ভুল বোঝাবুঝির অবসান হলে বিষয়টা নিয়ে আমরা মজাও করেছি। আর ব্যাপারটার ওখানেই সমাপ্তি ঘটায় মাথা থেকেও উবে যায় এই ঘটনা...।
কিন্তু এতদিন পর কেন হঠাৎ আগে পরের কোনো চিঠির যোগসূত্র ছাড়া এ চিঠি তিনি চঞ্চলকে দিলেন! যেখানে তিনি নিজেই জানেন প্রকৃত ঘটনা, তারপরও চঞ্চলকে কেন ভুল বুঝতে দিলেন, সে প্রশ্নের উত্তর আমার অজানা। সেই ব্যাখ্যাও আমার কাছে নেই। হয়তো মজা করতে চেয়েছিলেন, দুষ্টুমি করেছিলেন। তবে এই ঘটনার শেষ হয় তার সঙ্গে তীব্র এক ঝগড়ার মাধ্যমে। চঞ্চলকে নিয়ে আমি তার মুখোমুখি হই। এই চিঠির পরের চিঠিটা বের করতে বলি, যেখানে তার ভুল ভেঙে দিয়েছি। এরপর চঞ্চলকে নিয়ে সেই যে বেরিয়ে আসি, আর কখনো তার সামনে যাইনি, মৃত্যুদিনটি ছাড়া। এই ছেলেমানুষি দুষ্টুমির কারণে তার প্রতি আমার অভিমান ছিল বহু, বহুদিন। আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু চঞ্চলের সঙ্গে তার আমৃত্যু পিতা এবং সন্তানের শ্রদ্ধা-স্নেহের সম্পর্ক ছিল। আমি আগে ভাবতাম, উনি আমাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন; কিন্তু অবাক হয়ে দেখেছি, চঞ্চলের প্রতি তার কী অগাধ স্নেহ।
এটাই আনওয়ার ভাই। এই রকম অপ্রত্যাশিত, অদ্ভুত, খেয়ালি, ক্ষ্যাপা এবং কোনোরকম ব্যাখ্যা ছাড়া নানা ঘটনার জন্ম কেবল তিনিই দিতে পারেন; কিন্তু এর বাইরে, বাংলা সাহিত্যের যে কী অসামান্য ঋণ এই মানুষটির কাছে! সাহিত্যের কত গুরুত্বপূর্ণ কাজই না তিনি করেছেন! বাংলাদেশের কত প্রথিতযশা কবির আবির্ভাব এবং বিকাশ যে তার হাতে ঘটেছে! এখনকার সাহিত্য সমাজ কতটুকু মনে রেখেছে তাকে?
ষাটের দশকে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন আনওয়ার আহমদ। কবি হিসেবে তিনি ছিলেন রোমান্টিক। ব্যক্তিগত দুঃখ, শূন্যতা হাহাকার ছিল তার কবিতার প্রধান উপজীব্য। ষাটের দশকে কবিতাচর্চা শুরু করলেও মূলত ৮০-এর দশকে তিনি কবিতা এবং ছোটগল্পে পূর্ণমাত্রায় নিজের সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর রাখেন। ‘রিলকের গোলাপ’ ‘মানবসম্মত বিরোধ’; ‘নির্মাণে আছি’; ‘হঠাৎ চলে যাব’; ‘নীল কষ্টের ডাক’; ‘শেষ সম্বল শেষ দান’; ‘অটল থাকা ধীর সন্ন্যাস’; ‘উড়ো খই গোবিন্দ নমঃ’; ‘ঊনষাটের পদাবলী’; ‘ষাটের প্রান্ত ছুঁয়ে’ ইত্যাদি কবিতাগ্রন্থে তার নিঃসঙ্গতা, প্রেম, শূন্যতাবোধ ইত্যাদি ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ তিনি করেছেন। কবিতায় তিনি মূলত রোমান্টিক হলেও কখনো কখনো বাস্তবতাবাদী চেতনা, সমকালীন নানা প্রসঙ্গ এতে উঁকি দিয়েছে। অবশ্য গল্পে তার বাস্তবতাবাদী সত্তাটাই প্রধান। তার সতর্ক প্রহরা নামের গল্পগ্রন্থটি সমকালীন সাহিত্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ বলে বিবেচিত।
আনওয়ার আহমদ একাধারে কবি, গল্পকার, সম্পাদক ও প্রকাশক। তবে কবি অভিধায় যত পরিচিত, তার চেয়ে বেশি সম্পাদক হিসেবে। আনওয়ার আহমদ মানেই সম্পাদক আনওয়ার আহমদ। সম্পাদক হিসেবে তিনি আবির্ভূত হন কবিতাবিষয়ক পত্রিকা কিছুধ্বনির মধ্য দিয়ে। ১৯৬৬ সালে এই পত্রিকাটির শুরু। তিনি বরাবরই বাংলাসাহিত্যের প্রথিতযশা অগ্রগণ্য সাহিত্যিকদের মূল্যায়নে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই মৃত অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবি ও কথাসাহিত্যিকদের নিয়ে যেমন সংখ্যা করেছেন, তেমনি জীবিত লেখকদের মূল্যায়নেও যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন। কবি শামসুর রাহমান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কায়েস আহমেদ, চঞ্চল আশরাফ সংখ্যা এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। লেখা সংগ্রহের ক্ষেত্রে তার মতো তৎপর সম্পাদক দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া কঠিন। সুশান্ত মজুমদারের একটি কথা প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। দূর থেকে আনওয়ার আহমদকে দেখলেই, তার সামনে কোনো লেখক থাকলে বলতেন পালাও, আনওয়ার আসছেন। কারণ লেখক দেখামাত্রই তার কাছে থেকে লেখা চাওয়া তার একটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল।
নতুন যে লেখা শুরু করেছে তার কাছেও লেখা চাওয়া তো বটেই, তার বাসা বা কার্যালয়ের ঠিকানা দিয়ে বলতেন আসবেন। বারংবার তাগাদা দিতেন লেখা সংগ্রহের জন্য। তার তাগাদা দেওয়ার ধরনটা কেমন ছিল একটা উদাহরণ দেই। আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। তিনি কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের লেখা চেয়ে তাকে বেশ কিছু চিঠি ডাকযোগে পাঠিয়েও উত্তর পাচ্ছিলেন না। এরপর তিনি আমার খামে হাসান আজিজুল হকের কাছে লেখা চিঠি পাঠিয়ে বলেন, আমি যেন এই চিঠি তাকে দেই এবং তার মৌখিক উত্তর নিয়ে আসি। তিনি কবে লেখা দেবেন, এটা না শুনে যেন আমি না আসি। যথারীতি স্যারকে চিঠি দিতেই তিনি হেসে ওঠেন। বলেন এই অভিনব তাগাদার পর লেখা না পাঠিয়ে তো আমার উপায়ই থাকল না।
এই হচ্ছেন আনওয়ার আহমদ। সাহিত্যের জন্য এই যে তীব্র ভালোবাসা, লেখা সংগ্রহের জন্য এরকম মরিয়া হয়ে ওঠা এরকম সম্পাদক এখন আর কই? আনওয়ার আহমদ একদিকে যেমন নিজে সাহিত্যচর্চায় ব্যাপৃত থেকেছেন, অন্যদিকে তেমনি সমকালীন সাহিত্যিকদের বিকাশ এবং পরিচর্যায় অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। বহু নতুন লেখককে তিনি সাহিত্য অঙ্গনে তুলে এনেছেন এবং তাদের বিকাশের ক্ষেত্রে অভিভাবকতুল্য ভূমিকা রেখেছেন। তার হাত দিয়েই অনেক বিখ্যাত লেখকের প্রথম গ্রন্থটি প্রকাশ হয়েছে। যেমন নাসরীন জাহানের ‘বিচূর্ণ ছায়া’, সুশান্ত মজুমদারের ‘ছেড়াখাড়া জমি’ ইত্যাদি।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ এবং আড্ডাবাজ। তার বাসা কাম সম্পাদনার কার্যালয়টি ছিল তৎকালীন কবি, লেখক, সাহিত্যানুরাগীদের এক আড্ডাখানা। হুমায়ুন আজাদ থেকে শুরু করে আল মাহমুদ, সেই সময়ের তরুণ টোকন ঠাকুর থেকে ব্রাত্য রাইসু কে না যেতেন সেখানে? কখনো কখনো তিনি ছিলেন খেয়ালি প্রকৃতির এবং অভিমানীও বটে। রেগে যেতেন, কিন্তু রাগ পুষে রাখতেন না। তার চমৎকার একটা হৃদয় ছিল। যার পরিচয় তার সময়ের বাংলা সাহিত্যের বহু লেখক পেয়েছেন।
এটা আমাদের জন্য গৌরবের যে বাংলাদেশে এ রকম একজন সাহিত্য অন্তপ্রাণ মানুষ জন্মেছিলেন। তেমনি বেদনারও কেননা জীবদ্দশায় তো নয়ই, এমনকি মৃত্যুর পরও আমরা তার মূল্যায়ন করতে পারিনি। এত এত পুরস্কার রাষ্ট্রীয়ভাবে দেওয়া হচ্ছে, অথচ তিনি ছোট কাগজ ‘কিছুধ্বনি’ এবং গল্পবিষয়ক ‘রূপম’ সম্পাদনা করেছেন টানা ৩৮ বছর। সম্পাদনা করেছেন সাহিত্যের চিঠি, সাহিত্য, সাহিত্য সাময়িকী ও মিউস নামের আরও ৪টি পত্রিকা; কিন্তু তার কাজের স্বীকৃতির জন্য কোনো পুরস্কার বা পদক আজ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। জাতি হিসেবে আমরা আসলেই হতভাগা। যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মাবেন কী করে?
আনওয়ার আহমদ আমৃত্যু সাহিত্য চর্চা করে গেছেন, এটা নিয়ে কখনো তার কোনো বৈষয়িক লাভ ছিল না। বরং নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে তিনি পত্রিকা বের করতেন। বলা হয়ে থাকে ঢাকা শহরে এমন কোনো অসচ্ছল লেখক নেই, যার পকেটে আনওয়ার আহমদের টাকা ঢোকেনি। কিন্তু আজ কেউ নেই তাকে মনে করার। মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি একটি বই লিখেছিলেন হঠাৎ চলে যাব। এবং সত্যিই তিনি ২০০৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর সাহিত্যের সেবা করতে করতেই চলে গেছেন লোকান্তরে।