
গ্রাফিক্স: সাম্প্রতিক দেশকাল
আধখানা চাঁদ ঝুলে আছে শিরীষ ফুলের মাথায়। মায়ের বাসাটি ছোট হলেও চারিদিকে কেমন এক ঘোরলাগা সবুজ। মনে হয় সবুজের মাঝখানে ভেসে ওঠা একটি ছোট্ট দ্বীপ। মা খুব যত্ন করে বাড়িটি করেছেন। আব্বা কখনো এগিয়ে এসেছেন কখনো বিরোধিতা করেছেন। নোমান ঘরে শুয়ে গান শুনছে ‘আমি যে গান গেয়েছিলেম, জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়, অনাদরে অবহেলায়!’...
অনাগত শিশুর নড়াচড়া হঠাৎ টের পায় বীথি। পেটের ওপর বাম হাত দিয়ে, ডান হাতে বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ভাবে, ‘যে আসছে তাকে এ কোন পৃথিবীতে আনছি। গত মাস থেকে লকডাউন। নোমান সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা করে। এক মুহূর্ত চোখের আড়াল হতে দেয় না। এমন পরিস্থিতি যে প্রতি মাসের চেকআপ করাও সম্ভব হচ্ছে না। আগামী মাসেই ডেট; কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর স্থান এখন হাসপাতাল। যেখানে বাঁচতে যায় মানুষ আর সেখান থেকেই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে এই করোনায়। ভয় করছে। ভীষন ভয়। কী হবে আমাদের সন্তানের? কী অদ্ভুত! মেঘটা চাঁদটা নিয়ে এমন খেলছে কেন! এককবার ঢেকে দিচ্ছে, আবার সরে যাচ্ছে! গুমোট লাগছে চারিদিক; মেঘ-চাঁদের এই খেলা দেখতে দেখতে হঠাৎ হাসির শব্দ শুনতে পেল বীথি।
-কে, কে ওখানে! কে হাসছে? কাতর হয়ে জানতে চাইল বীথি!
-আমি আম গাছ, দেখছ না আমার গা ভর্তি মুকুল, কচি কচি আম ধরেছে কত মুকুল থেকে।
-আম গাছ, কী করে কথা বলছ তুমি? তো কী হয়েছে তোমার গায়ে এত মুকুল? কী করবে তুমি? বীথি অস্থির হয়ে জানতে চাইল।
-হা হা হা! আমাদেরই তো দিন। এখন গ্রীষ্মকাল প্রকৃতির দিকে চেয়ে দেখো, তোমার মতো আমরা সবাই গর্ভবতী। কয় দিন পরেই সবাই প্রায় সন্তান জন্ম দেব? মানুষ কী বোকা জাতি! ওরা গাড়ি চালিয়ে, বায়ু দূষণ করে আমাদের কষ্ট দেয়। তোমরা এখন গৃহবন্দি। বেশ হয়েছে। আমার গায়ে ঢিল ছুড়ে আমার সন্তানকে মারতে পারছ না!
-নিম গাছ বলে উঠল, কী হচ্ছে আম? এটা কী ধরনের কথা, মানুষের দূর্দিনে তাকে সাহস দাও, টিপ্পনী কাটছ কেন? হ্যাঁ, এটা ঠিক এই করোনা ভাইরাসের জন্য এবার আমাদের সন্তানেরা নির্বিঘ্নে জন্ম নেবে।
-কলা বউ মাথা নাড়তে নাড়তে বলে উঠল, উফ এবার যা হচ্ছে না, আমার খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে। ইটের ভাটার জ্বালায় আমি তো কোথাও জন্মাইতেই জায়গা পাই না, বলেই নাচতে শুরু করল।
বীথি কলা বউয়ের নাচ দেখে ভয়ে শিউরে উঠল। সত্যি নাচছে কলা গাছ?
-শিরীষ গাছ একটু কেশে নিয়ে বলল, আমার ফুল এমনিতেই বাতাসে ঝরে যায়, যা অবশিষ্ট থাকে তাও মানুষের জন্য টেকে না। এবার আমি অনেক সন্তান জন্ম দেব। মানুষের ঘনবসতিতে আমার তো বংশ উপড়ে ফেলার দশা। আমাকে কেটে তারা আগুনে পোড়ায়, খাট-পালঙ্ক বানায়।এবার বুঝুক।
চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে যেন শিরীষ ফুলেরা। খুশিতে হাসছে।
-সজনে গাছ লিকলিকে ডাঁটা নিয়ে ফিকফিক করে হেসে উঠল, আরে আমার কী হয় জানিস, ফুল অবধি ঠিক আছে, যেই না এই কচি সজনে হয় বাড়ির মালিক কচি কচি বাচ্চাগুলো পেড়ে বাজারে দেয়, বল ভাই কেমন লাগে? ওদের একটু বড় হতে দে! আমার জানটা তখন ছিঁড়ে যায়! এবার বুঝুক মজা মানুষ! বের হতে পারছে না ঘর থেকে। আমি এবার আমার সন্তান বড় করব। ওদের থেকে বীজ করব। নাতিপুতির মুখ দেখব।
-কৃষ্ণচূড়া, সোনালু, জারুল একসাথে হেসে উঠে বলল-এবার শান্তিতে দোল দোলাব। কলকারাখানা বন্ধ। আমার আবার ধোঁয়ায় আর ধুলোয় অ্যালার্জি!
-একটু দূরে ছিল জামরুল গাছ, যেন চিৎকার করে বলছে ওরে তোরা থাম, আমাকে দ্যাখ এবার কেমন ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে আমার শরীর। কোথাও কোনো দূষিত বায়ু নেই। কাল রাতে বর্ষায় ভিজেছি আনন্দ করে। আহা! কী মধু মধু! এবার আমাদেরই দিন। কী বলিস তোরা?
ওদের সবার কথা চুপ করে শুনছিল কাঁঠাল গাছ, আর বীথিকে দেখছিল, বেচারা বীথি ছটফট করছে যেন। গম্ভীর হয়ে বলল-তোমরা চুপ করো। তোমরা এমন উল্লাস করলে তো, কুকুরের পায়ে কামড় দেবার কবিতার মতো হয়ে যাবে? মানুষের কাজ, মানুষ করেছে, তা করা কি গাছেদের শোভা পায়! আমার শরীরে কাঁঠালের বিচি পক্ব না হতেই এঁচোড় রেঁধে খাবে বলে কেটে নেয়, তোমরা কি জানো আমার তখন কেমন লাগে? তবু আজ আমরা মানব সন্তানকে এই পৃথিবীতে আসতে কষ্ট দিতে পারি না। তাদের কষ্টে পাশে থাকাই আমাদের কাজ।
-বীথি কেঁদে ওঠে। সব গাছ ওর কাছে এগিয়ে আসে।
-তুমি ভেবো না বীথি। আমাদের মতো তোমার সন্তান ও এই পৃথিবীতে নিরাপদে আসবে। দেখো আমরা পৃথিবীকে কেমন সবুজ করে দিয়েছি! তুমি সুন্দর এক পৃথিবীতে তোমার সন্তান আনবে। আমাদের মতোই খুশি থাকবে। মাতৃত্ব অপার আনন্দের। সবুজ একটি পৃথিবীতে আসুক নতুন, সবুজ সব প্রাণ। হাসো বীথি, হাসো! বলেই সবাই একসাথে হেসে উঠল।
একটা নির্মল দমকা বাতাস যেন বীথিকে ছুঁয়ে গেল। ছুঁয়ে গেল ওর অনাগত সন্তানকে।
-বীথি, বীথি, মা ডাকছে।
বীথি সংবিৎ ফিরে পেতেই দেখে নোমান ওর কাঁধে হাত রেখেছে, কী হলো চলো বীথি, ঠিক আছ তো?
মা খাবার দিয়েছে, ঘরে চলো।