
প্রতীকী ছবি
অভিমান! শব্দটা আজকাল খুব মাথার ভেতর ঘোরে মজনুর। আগে ঘুরত না। বলতে বাধা নেই, তার নিজের সাথে এই শব্দকে কখনোই সে জুতসই ভাবতে পারত না। অভিমান হবে তিথির। তিথি অভিমান করে রাতে ভাত না খেয়ে বারান্দার রকিং চেয়ারটাতে দোল খাবে। লাগোয়া হাসনাহেনা থেকে আসা অদ্ভুত গন্ধ তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে রাখবে। দূর থেকেই বুঝতে পারা যাবে এ বাড়ির একজনের খুব মন কেমন করছে।
এ সবকিছু ঠিক ঠিক জানার পরও মজনুর আজকাল খুব অভিমান হয়। তিথির সাথে বিয়ে হয়েছে বলেই কি? হবে হয়তো!
মজনুর সাথে তিথির বিয়েটা বলাবাহুল্য প্রত্যাশিত নয়। তবু ভাগ্যের ফেরে হোক আর তিথির সম্পূর্ণ নির্দোষ তবু একটু গোলমেলে ইতিহাসের জন্যই হোক, কাণ্ডটা ঠিক ঘটে গেল। আর তারপর থেকেই এই বিপত্তি। প্রায়ই তার মনে হয় রাতে বাড়ি ফিরে না গেলে কেমন হয়? একটা রাত বজলু মিয়ার দোকানের এই বেঞ্চের ওপর দিব্যি সে কাটিয়ে দিতে পারবে। ছাত্রাবস্থায় কতবার এমন করেছে। মেসের গেট বন্ধ হয়েছে ১০টায়। সে গিয়ে পৌঁছেছে দশটা দশে। কেউ এসে গেট খুলে দেয়নি। অগত্যা গোটা রাত পার্কের বেঞ্চে কয়েকজন বন্ধু মিলে কাটিয়ে দেওয়া। বেশ ছিল সেই দিনগুলো। হঠাৎ কোত্থেকে জীবন যে কেমন হয়ে গেল।
চাকরি পাওয়ার পরপর দুঃসম্পর্কের মামা বাহাদুর খানের বাসায় সে উঠে আসে। সে মেসেই থাকতে চেয়েছিল, তবু মামা জোর করলেন। বললেন ‘আরে আমার কোম্পানিতে চাকরি করছিস! আমার বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা থাকার পরও মেসে কেন পড়ে থাকবি গাধা!’
এ ব্যবস্থায় অবশ্য মামি আসমা খান খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তার একমাত্র মেয়ে তিথিকে নিয়ে তাদের তিন জনের ছোট্ট সংসার। এর মধ্যে বাইরের একটা ছেলেকে এনে ওঠানোর যুক্তিটা কী?
যুক্তির ব্যাখ্যা না দিয়ের মামা মজনুকে তাদের বাড়ির ছাদের রুমটায় থাকার ব্যবস্থা করে দেয়।
তিথির সঙ্গে তার দেখা হতো কালেভদ্রে। হলেও কথা হতো না। সে কথা তেমন কারোর সাথেই বলত না। মজনু যতবার তাকে দেখেছিল প্রতিবারই তাকে বড় বিষণ্ণ মনে হয়েছিল মজনুর। সেই বিষণ্ণতার কারণ সকলে জেনে যায় এক সন্ধ্যায়। যে সন্ধ্যায় ছোট একটা চিঠি লিখে তিথি বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।
চিঠিতে লেখা ছিল ‘মা, আহির ভাইকে তোমরা চেনো। তার প্রতি আমার মনের অবস্থা আর কেউ না জানলেও তুমি নিশ্চয়ই জানো। মা, আমি যে ডাকের অপেক্ষায় এত বছর ছিলাম সে ডাক আজ পেয়েছি। সেই ডাক উপেক্ষা করার কোনো উপায় আমার নেই।’
সেই রাতে তিথি ঢাকা থেকে চলে গিয়েছিল নারায়ণগঞ্জ রেল স্টেশনে। সেখানেই আসার কথা ছিল আহিরের। আহির আসেনি। সময় নষ্ট না করে যে বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত-এ বুদ্ধি তিথির মাথায় আসতে আসতে বড় দেরি হয়ে যায়। কিংবা প্রকৃতি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিল যে দুর্ঘটনা আসবেই।
তিথিকে পাওয়া যায় পরের দিনই। স্থানীয় লোকজন তাকে কাছাকাছি একটা হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। বাহাদুর খান তার মেয়েকে সেখান থেকেই বাসায় ফিরিয়ে আনেন।
কিছুটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে ফিরতে দু-বছর কেটে যায়। দু-বছর পরের এক বিকালে বাহাদুর খান তার মেয়ের সাথে মজনুর ঘরোয়া কাবিন করিয়ে দেন।
তারপর থেকেই মজনুর জীবনে এই অভিমানের অসুখ চলছে।
‘ভাইজান বাড়ি যাইতেন না?’
পেছনে তাকিয়ে দেখে বজলু প্রবল বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
‘বজলু, আজকের রাতটা যদি তোমার এখানে কাটিয়ে দেই অসুবিধা হবে?’
‘কী কন ভাইজান! অসুবিধা তো হইবই। আমি বাড়িত যামু না?’
ঠিকই, তাই তো! বজলু মিয়ার তো ঘর আছে। তাকে তো সেখানে যেতে হবে। তার তো আর মজনুর মতো মান-অভিমানের ফালতু ব্যাধি হয়নি। তার ঘরে তো তিথিদের বসবাস নেই।
মজনু নিজের চিন্তা ভাবনায় নিজেই বিরক্ত হলো। এখানে বসে থেকে লাভ নেই। বাড়ির দিকেই হাঁটা শুরু করা যাক। দেরি দেখে না-ই বা দিল তিথি তাকে কোনো ফোন, তাতে কীইবা এমন হলো? তিথির ফোন পাওয়ার আশা করার মতো বাহুল্য সে ক্রমাগত কেন করে যাচ্ছে! এর চেয়ে বাড়ি ঢুকে চুপচাপ নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়বে। যেমন আগে করত, ঠিক সেরকম।
বাড়ির কাছাকাছি এসে মজনু দেখল দোতলার বারান্দায় লাইট জ্বলছে। সেখানে তিথি দাঁড়িয়ে আছে।
চোখের ভুল না, উইশফুল থিংকিং বলেও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, মজনু স্পষ্ট দেখল তিথির চোখে মুখে প্রবল উৎকণ্ঠা! মজনুর দিকে দৃষ্টি পড়ার সাথে সাথেই সে উৎকণ্ঠা মিলিয়ে গেল। তিথির মুখটা কি একটু হাসিহাসি হলো? সেটাই মুহূর্তে লুকিয়ে সে কি আবার আগের কাঠ কাঠ চাহনিতে ফিরে গেল!
তিথি আর বারান্দায় দাঁড়িয়ে নেই। ঘরের ভেতর ঢুকে গেছে। বোকা গরিব মজনু আরও বোকা হয়ে কি চোখের জল আড়াল করছে? সে এত বোকা আর নিঃস্ব হয়ে কেন জন্মাল!