Logo
×

Follow Us

ঈদ সংখ্যা

প্রেমিকপ্রবর

Icon

ম্যাক্সিম গোর্কি

প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২৪, ১৭:৪১

প্রেমিকপ্রবর

প্রেমিকপ্রবর। প্রতীকী ছবি

ম্যাক্সিম গোর্কি (১৮৬৮-১৯৩৬) : ‘মাদার’ (১৯০৬) উপন্যাসটির হাত ধরে তিনি জগৎজোড়া খ্যাতি পেলেও তার সাহিত্য জীবনের হাতেখড়ি কিন্তু ছোট গল্প দিয়ে। ১৮৯৫ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গের একটি নামি পত্রিকায় ‘চেলকাশ’ গল্পটি প্রকাশের পরই রুশ সাহিত্য জগতে সাড়া ফেলে দেন তিনি। এই পর্বে লেখা ‘টোয়েন্টি সিক্স মেন অ্যান্ড গার্ল’ গল্পটিকে তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে মনে করা হয়। তিন খণ্ডে লেখা তার আত্মজীবনী ‘মাই চাইল্ডহুড’ (১৯১৩), ‘ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ (১৯১৫), ‘মাই ইউনিভার্সিটি’ (১৯২৩) রুশ তথা বিশ্বসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। তার ‘হার লাভার’ গল্পটির অনুবাদ এটি, ‘প্রেমিকপ্রবর’। এ গল্পটি পাওয়া গেছে ম্যাক্সিম গোর্কির আন্তর্জাল মহাফেজখানা থেকে। অনুবাদ : মিরন মহিউদ্দীন।

আমার পরিচিত একজন কথায় কথায় গল্পটি বলেছিল। তার বয়ানেই গল্পটি হুবহু তুলে দিলাম :

মস্কোতে পড়াশোনা করতাম সেই সময়। এক ফ্ল্যাট বাড়িতেই আমার আস্তানা। ওখানেই আমার পড়শি ছিলেন এক মহিলা। নাম টেরেসা। তার স্বভাব-চরিত্র নিয়ে নানা কথা কানাকানি করত লোকে। ওর বাড়ি নাকি পোলেন্ডে। তার মহিলার ছিরি-ছাদের কথা আর না বলাই ভালো...না আছে কোনো লাবণ্য...না কোনো কমনীয়তা। ইয়া লম্বা শিড়িঙ্গে চেহারা। কুচকুচে কালো চুল। রুক্ষ ধ্যাবড়া মুখটাতে কালো কুতকুতে দুটো চোখ। তার ওপর আবার দুটো লোমশ ভুরু। যেন কুড়াল দিয়ে পাথর কুঁদে বানানো এক মূর্তি। আর চোখ দুটোতে সারাক্ষণ যেন একটা ধিকিধিকি আগুন। পশুর মতো হিংস্র চাউনি। গলার স্বর তো নয়, যেন মেঘের গর্জন। ওই পেশি ফোলানো, হিড়িম্বার মতো চেহারাটা যেন লরি ড্রাইভারের সিটেই মানায় ভালো; নয়তো জেলে পল্লিতে জেলেনির সাজে। 

ওকে দেখলেই ভয়ে সিঁটিয়ে যেতাম আমি; কিন্তু আমার কপালটাই এমন যে ওর চিলেকোঠার ঘরটা আমার ঠিক উল্টো দিকেই। আমি থাকতাম ঠিক ওপরের তলায়। এড়িয়ে যাবার কোনো উপায় নেই। ওই মহিলা যতক্ষণ ঘরে থাকতেন আমি ভুলেও দরজা খুলতাম না। তবে ঘরে উনি থাকতেন খুব কম। এটাই যা বাঁচোয়া! সিঁড়িতে বা বাইরের লনে মাঝে মাঝে এক ঝলক দেখা হয়ে যেত। আমার দিকে এক চিলতে বাঁকা হাসি ছুড়ে দিয়ে সটকে পড়তেন। কখনো আবার দেখতাম আকণ্ঠ গিলে টলতে টলতে মেমসাহেব ফিরছেন, চোখ দুটো ঘোলাটে... চুল উষ্কখুষ্ক। আর সেই সঙ্গে পাগলের মতো হো হো হাসি। ... উফফ কী বীভৎস! এমন মত্ত অবস্থায় আমাকে দেখলেই গায়ে পড়ে গালগল্প জুড়ে দিতেন, ‘এই যে ছাত্র মহাশয় আছেন কেমন শুনি?’

বোকা বোকা দেঁতো হাসিটা দেখে আপাদমস্তক জ্বলে যেত আমার। মাঝখানে তো ঠিকই করে ফেলেছিলাম আমার ঘরটা বদলে নেব, যাতে অন্তত ওই মহিলার মুখদর্শন করতে না হয়। তারপর ঠান্ডা মাথায় ভাবলাম : কোনো এক উটকো আপদের জন্য আমার এমন আরামের ঘরটা ছাড়তে যাব কেন? ছোট হলেও ঘরটা বেশ ছিমছাম। জানালা দিয়ে বাইরেটা বেশ সুন্দর দেখায়। রাস্তা ভারি নির্জন। কোনো কোলাহল শোরগোল নেই। মহিলাকে তাই একরকম সহ্যই করে নিলাম। 

সেদিন একটু বেলা অবধি বিছানায় গড়াচ্ছিলাম। একটা আলসেমিতে পেয়ে বসেছিল। ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার একটা ছুতো খুঁজছিলাম মনে মনে। হঠাৎই ধড়াস করে ঘরের দরজা খোলার আওয়াজ। কিছু বোঝার আগেই চৌকাঠ থেকে টেরেসার ওই মার্কামারা বাজখাঁই গলা, ‘তারপর বলুন মশাই শরীরটরীর ভালো তো?’

‘কী চাই আপনার?’

ভালো করে চেয়ে দেখলাম ওর চোখে মুখে কেমন যেন একটা দ্বিধার ছাপ। মনে হলো কোনো অনুরোধ নিয়ে এসেছেন। ভারি অদ্ভুত তো! মহিলার অমন ভেজাবেড়াল গোছের হাবভাব দেখিনি তো কখনো আগে!

‘একটা আর্জি নিয়ে এসেছি আপনার কাছে। আপনি কি আমার ছোট্ট উপকার করে দেবেন?’

কোনো জবাব দিলাম না আমি। মনের জোর আনবার চেষ্টা করলাম। ভাবলাম কী আর এমন ব্যাপার হতে পারে... দেখাই যাক না। 

ততক্ষণে কাকুতি মিনতিজুড়ে দিলেন মহিলা, ‘আসলে বাড়িতে একটা চিঠি পাঠাতাম... আর বিশেষ কিছু নয়।’ 

‘জাহান্নামে যাও’জ্জমনে মনে আর না-বলে পারি না। তবে মুখে কিছু না বলে তড়াক করে টেবিলের সামনে চেয়ারটা টেনে বসলাম। কাগজ কলম নিয়ে তৈরি হয়ে মহিলাকে ডাকলাম, ‘আসুন আসুন সামনে বসুন। চিঠিতে কী লিখতে হবে বলে দিন।’

আড়ষ্ট পায়ে এগিয়ে এলেন তিনি। অতি সাবধানে চেয়ারটা টেনে বসলেন। আহা ভাবখানা দেখো! যেন সিঁধ কাটতে এসে হাতেনাতে ধরা পড়া চোর। ঢং দেখে আর বাঁচি না। 

আমি চুপ করে থাকতে পারলাম না। 

‘আচ্ছা, চিঠিটা আপনি লিখবেন কাকে?’

‘মি. বোলেস্লাভ কাশপুট... ওয়ারশ রোড... পোস্ট সিয়েন্টজিয়ানা...।’

‘ঠিক আছে। এবার আসল বক্তব্যটা বলুন।’

‘প্রিয় বোলেস...লক্ষ্মী সোনা... প্রিয়তম আমার... ঈশ্বর তোমাকে রক্ষা করুন... ভালো রাখুন। আমি জানি তোমার অন্তর কতটা পবিত্র। তোমার টেরেসা... তোমার ফুটফুটে ছোট্ট মুনিয়া পাখিটা যে দিনরাত কেঁদে ভাসাচ্ছে তার খবর কি রাখো! কতদিন চিঠি লেখো না তুমি।’

এদিকে আমার অবস্থা তো সঙ্গিন। হাসি চাপতে গিয়ে পেট ফেটে যাওয়ার জোগাড়। ‘ফুটফুটে ছোট্ট মুনিয়া পাখি!’ উফফ আর পারা যায় না। একটা আয়নাও নেই নাকি মহিলার ঘরে? ওই তো তালগাছের মতো ঢ্যাঙা... ধুমসি। হাতের মুঠোর ওজন অন্তত এক এক কেজি। মুখে তো যেন কেউ ভুসো কালি লেপে দিয়েছে। আহা রে বেচারা মুনিয়া! চিমনিতেই বোধহয় এ জীবনটা কেটে গেল। মুখ ধোয়ার জন্য সাবানও জুটল না। 

যা-ই হোক কোনোমতে হাসি চেপে জিগ্যেস করি, ‘তা এই মি. বোলেস্টটা কে জানতে পারি?’

‘ওহু ছাত্র মশাই... বোলেস। ওর নাম বোলেস...আমার ছোট্ট সোনা বর গো।’

নামটা ভুলভাল বলায় মহিলা একটু চটেছেন মনে হয়। তারপর এসব বরটর কী বলে রে বাবা! আমি তো হাঁ।

‘এত আকাশ থেকে পড়বার কী আছে শুনি? আমার বয়সটাইবা এমন কী? আমি তো একটা মেয়েমানুষ... আমার একটা জোয়ান বর থাকতে নেই?’

‘মেয়েমানুষ! বেশ তবে তাই। যা-ই হোক একটু ব্যঙ্গের সুরেই বলি, ‘থাকবে না কেন? সবই সম্ভব। তা কদ্দিন হলো আপনারা বর-বউ হয়েছেন?’

‘ছ বছর।’

‘বাব্বা।’জ্জনিজের মনেই বলি। তবে এ নিয়ে আর কথা বাড়াই না। কাজটা মেটাতে পারলেই শান্তি।জ্জ‘বেশ বেশ। আপনার চিঠিটা আগে শেষ করা যাক।’

তবে আমার একটা সোজা-সাপটা কথা... টেরেসার বদলে অন্য যে কোনো মহিলা...মানে দৈর্ঘ্য-প্রস্থে অন্তত এক ছটাক কম হলেই এই মি. বোলেসের জায়গাটা নিতে আমার কোনো আপত্তি ছিল না। এই সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই টেরেসার ডাকে সংবিৎ ফিরল। 

‘অনেক উপকার করলেন আমার। কী বলে যে ধন্যবাদ জানাব... যদি আপনার কোনো কাজে লাগতে পারতাম!’

‘না না তার কোনো দরকার নেই, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’

‘মানে... বলছিলাম কী আপনার শার্ট... প্যান্টে যদি রিপু-টিপু করবার দরকার হয়... ’

উফফ এ মহিলা তো বড্ড জ্বালায় দেখছি। চোখের সামনে প্রকাণ্ড এই জলহস্তিনীকে বেড়ালের মতো মিউমিউ করতে দেখে তো অস্বস্তিতে পড়লাম। একদম কড়াভাবে জানিয়ে দিলাম ওর কোনো রকম সাহায্যের দরকার নেই। 

আপদ বিদায় হলো তখনকার মতো। 

দু-এক হপ্তা কেটে গেল। সেদিন সন্ধেবেলা ঘরে জানালার ধারে বসে আপনমনেই শিস দিতে দিতে আকাশ পাতাল ভাবছিলাম। মনটাও ভালো ছিল না। চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি এই শরীরের খোলসটা ছেড়ে মনটা যেন অনে...ক দূরে কোথাও যেতে চাইছিল। শরীরজুড়ে অবসাদ। বসে থাকতে থাকতে অসহ্য লাগছিল। আকাশের অবস্থা একদম ভালো নয়। 

রাস্তা-ঘাট জল-কাদায় মাখামাখি। এই অবস্থায় বাইরে বেরোনোটাও বিরক্তিকর। তাই চুপচাপ বসে মনের ভেতর ডুব দিয়ে নিজের মনের খবর নেওয়ারই একটু-আধটু চেষ্টা করছিলাম। নিজেকেও তো চিনতে হয়, জানতে হয়। তবে এ কাজে কোনো মজা নেই। মনের ভেতরটা আরও তিতকুটে হয়ে যায়। অন্য কোনো কাজে মনও বসে না। এমন সময় দরজা খোলার শব্দ। কেউ এলো বোধ হয়। বাঁচলাম বাবা। একা একা হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। 

‘এই যে ছাত্র মশাই, বিশেষ কোনো জরুরি কাজে ব্যস্ত আছেন কি?’

কিন্তু, এ-যে আবার সেই টেরেসা! ‘না না...এবার কী দরকার?’

‘আমার আরেকটা চিঠি লিখে দেবেন?’

‘দেব। মি. বোলেসকে তো?’

‘না না, এবারে বোলেসের হয়ে।’

‘মানে?জ্জচোখ কপালে তুলি আমি। ভারি তাজ্জব ব্যাপার!’

‘ইয়ে মানে...আমি মাঝে মাঝে বন্ধুর মতো কথা বলে ফেলি। মানে আমি বলছিলাম কী আমার বন্ধু...ঠিক বন্ধুও নয়...ওই পরিচিত এক ভদ্রলোক আছেন। তারও আমার মতো এক প্রেমিকা আছে এখানে। তার নামও কিন্তু টেরেসা। আমার ওই পরিচিত মানুষটির হয়ে টেরেসাকে একটা চিঠি লিখে দেবেন আপনি?’

সব কিছু যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ভালো করে চেয়ে দেখলাম মহিলার দিকে। চোখে মুখে অস্থিরতা। হাতের আঙুলগুলো কাঁপছে। শেষমেশ জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল ব্যাপরটা। মাথায় আগুন জ্বলে গেল আমার। 

‘দেখুন ম্যাডাম, বেশ বুঝতে পারছি কোনো বোলেস আর টেরেসার গল্প নেই এখানে। আর আপনি আমাকে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে বলে আসছেন। ছি! আর কোনোদিন চোরের মতো আমার ঘরে ঢুকবেন না। আপনার বন্ধু-বান্ধবকে নিয়েও বিন্দুমাত্র মাথা ঘামানোর ইচ্ছে নেই আমার, বুঝেছেন?

নিমেষের মধ্যে ওর মুখটা ভয়ে সাদা হয়ে গেল। আচমকা এই আঘাতে রীতিমতো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছেন মনে হয়। কী করবেন নিজেও যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। ছুটে পালাতেও পারছেন না। শুধু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ধুপধাপ করে পা ফেলছেন আর বিড়বিড় করে কী যেন সব বলে যাচ্ছেন। কিছু একটা বলতে চাইছেন কিন্তু সব দিক সামাল দিতে ঠিক পেরে উঠছেন না, -তোতলাচ্ছেন। দৃশ্যটা যে মজার কোনো সন্দেহ নেই। তবে মনে হলো তিনি কিছু বলতে চান। দেখাই যাক কোথাকার জল কোথায় গড়ায়। তবে ওর সঙ্গে এতটা রূঢ় আচরণ হয়তো না করলেও চলত। পরে নিজেরই খারাপ লাগছিল আমার। আমাকে দিয়ে কোনো খারাপ কাজ করানোর বদ মতলব হয়তো সত্যিই ওর ছিল না। হয়তো অন্য কোনো কারণ ছিল। যেটা একদম আলাদা। বুঝে উঠতে পারছিলাম না। 

‘শুনুন ছাত্র মশাই’...এতক্ষণে মহিলা মনে হয় একটু ধাতস্থ হয়েছেন। দেখাই যাক কী গল্প শোনান উনি। কিন্তু ওই একটাই কথা। আর কিচ্ছুটি না বলে দরজার দিকে ফিরে মহিলা হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন। মনটা তেতো হয়ে গেল। মিনিট কয়েক পর ওর ঘরের দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। মনে হয় খুব রাগ করেছেন উনি। আমার একবার ওর কাছে যাওয়া উচিত। মনের সব দ্বিধা ঝেড়ে ঠিক করলাম তার ঘরে যাব। আর বলবজ্জআমার ঘরে চাইলে উনি আসতে পারেন...উনি যা চান সব লিখে দেব আমি। 

ওর ঘরে গেলাম। চারপাশটা তাকিয়ে দেখলাম। একটা টেবিলের ওপর কনুই দুটো রেখে দুই হাতের মধ্যে মাথাটা ঢেকে বসে রয়েছেন তিনি। আলতো করে ডাকলাম, ‘এই যে শুনছেন!’

গল্পটা আমি অনেক আগেই বলেছি। কিন্তু গল্পের এই মাঝামাঝি এসে আমার সবসময়ই নিজেকে ভীষণ অপ্রস্তুত আর বোকা বোকা লাগে। হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম। ভদ্রমহিলার ঘরে তো এলাম। আরও একবার ডাক দিলাম, ‘শুনেছেন কি?

তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন তিনি। জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে এসে হাত দুটো রাখলেন আমার কাঁধে। তারপর ওর ওই কর্কশ গলায় ফিসফিসিয়ে বললেন, দেখুন আর কোনো লুকোচুরি করতে চাই না। বোলেস আর টেরেসা বলে কেউ কোথাও নেই। তাতে কি খুব কিছু যায় আসে আপনার? কাগজ-কলম নিয়ে দুটো কথা লিখে দিতে খুব কষ্ট হয় আপনার? ওহ হবেই তো...দুগ্ধ পোষ্য শিশু বলে কথা! তাই আবারও বলছি কোনো বোলেস নেই টেরেসাও...শুধু আমি আছি। এবার হয়েছে তো শান্তি? কৌতূহল মিটেছে?

আমার অবস্থা শোচনীয়। কিছুই মাথায় ঢুকছে না। এমন অভ্যর্থনা পাওয়ার কথা ভাবিনি তো!

‘আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না। আপনি বলছেন বোলেস নামে কেউ নেই?’

‘ঠিক তাই।’

‘টেরেসাও নেই’

‘না নেই। আমি টেরেসা।’

আবার আমার মাথার মধ্যে সব গুলিয়ে যায়। আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমাদের মধ্যে কার মাথাটা যে খারাপ হয়েছে সেটাই ভাবতে থাকি। তিনি আবার টেবিলের কাছে গিয়ে এটা সেটা ঘাঁটতে শুরু করে দিলেন। একটু পরেই রাতে একটা কাগজ নিয়ে আমার কাছে ফিরে এলেন...‘সেদিন বোলেসের কাছে চিঠিটা লিখতে খুব কষ্ট হয়েছিল তাই না? এই নিন আপনার চিঠি। চিঠি লিখে দেওয়ার জন্য অনেক লোক আছে।’ রাগে, অভিমানে ওর গলা বুজে আসে। 

ওর হাতে সেদিনকার সেই চিঠি। যেটা আমি লিখে দিয়েছিলাম। এ কী কাণ্ড!

‘শোনো টেরেসা, এ সবের মানে কী? আমি তোমার চিঠি লিখে দিছি। তুমি আবার অন্যদের দিয়ে লেখাবে কেন? আমি সেই কবে লিখে দিয়েছি তোমাকে, এখনো চিঠিটা পাঠাওনি কেন?’

‘কোথায় পাঠাব?’

‘কেন, মি. বোলেসের কাছে।’

‘ওই নামে কেউ নেই।’

আর কিছু বলার মতো মনের অবস্থা ছিল না আমার। কিছু না বলে চুপচাপ চলে আসাই উচিত ছিল। ভাগ্যিস করিনি সেটা। সেদিনই অভিমানী টেরেসা সব কথা খুলে বলেছিল আমাকে। ‘বললাম তো বোলেস নামে কেউ নেই...ছিলও না কোনো দিন।’ ওর মুখটা দেখে ভারি মায়া হলো আমার। অদ্ভুত এক অভিব্যক্তি ছিল ওর চোখে মুখে ও যেন বলতে চেয়েছিল, এমন কোনো মানুষ কেন থাকবে না ওর জন্যে।...‘বোলেস নামে কেউ নেই। কিন্তু আমি চাই...আমি যে ভীষণভাবে চাই সে থাকুক। আমিও তো তোমাদের মতো একটা মানুষ। আমি জানি...আমি জানি আমার অনেক দোষ...কিন্তু কাউকে আমি যদি চিঠি লিখি তাহলে এ পৃথিবীর কার কী এসে যায়!’

‘কিন্তু কাকে চিঠি লিখবে?জ্জআর না বলে পারি না আমি। 

‘কেন বোলেসকে।’

‘সে মানুষটার তো কোনো অস্তিত্বই নেই।’

‘তাতে কী? কী এসে যায় তাতে? সে মানুষটার অস্তিত্ব নেই কিন্তু থাকতেও তো পারত। আমার কাছে সে আছে। তাই আমি তাকে চিঠি লিখি। আমিই ওর টেরেসা। আমাকে ও চিঠি লেখে। তার জবাবে আমি আবার ওকে চিঠি পাঠাই।’

এতক্ষণে বুঝলাম ব্যাপারটা। কষ্ট হলো মেয়েটার জন্য। নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছিল। কী ধরনের মানুষ আমরা! আমার ঘরের ঠিক তিন গজ দূরে একটা মানুষ একা পড়ে থাকে...দুনিয়ার কেউ তার সঙ্গে দুটো মিষ্টি কথা বলে না...কাছে ডাকে না। নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে কাটাতে মেয়েটাকে তাই কাল্পনিক বন্ধু খুঁজে নিতে হয়!

টেরেসার কথা আর থামে না। 

‘তুমি যে ওই দিন চিঠিটা লিখে দিলে...ওটা পড়ে দেওয়ার জন্যে আরেকজনের কাছে গেলাম...শুনে শুনে মনে হলো বোলেস তো সত্যিই আছে...আমার খুব কাছেই রয়েছে সে। তারপর আবার তোমাকে ধরলাম বোলেসের হয়ে আমাকে চিঠি লেখার জন্যে। এর আগে অন্যদের দিয়ে এরকম চিঠি লিখিয়েছি, চিঠি পড়িয়েছি। ওর যখন বোলেসের চিঠি পড়ে তখন মনটা আরও হালকা হয়। মনে হয় চাইলেই বোলেসকে ছুঁতে পারি। বোলেস না থাকলে এই দুঃসহ জীবনটা কাটাতাম কী করে বলো তো?’

আর কোনো কথা জোগায় না আমার মুখে। আমি নেহাতই একটা মূর্খ। এতদিনেও মানুষ চিনতে পারলাম না। 

তারপর থেকে হপ্তায় অন্তত দুদিন বোলেসকে আর বোলেসের হয়ে টেরেসাকে চিঠি লিখতাম। বোলেসের হয়ে চিঠিগুলো মনে হয় ভালোই লিখতাম। টেরেসা খুব মন দিয়ে শুনত ওর চিঠির জবাব। শুনতে শুনতে ওর দু-চোখ বেয়ে জলের ধারা নামত। আবার কখনো বাজখাঁই গলায় হাউ হাউ করে ছেলেমানুষের মতো কান্নায় লুটিয়ে পড়ত। কাল্পনিক বোলেস এমন জলজ্যান্ত মানুষের মতো আবেগঘন চিঠি লিখে তার চোখে জল আনবে এমনটা বোধহয় টেরেসা আশাও করেনি। তারপর থেকেই ও আমার কোনো না কোনো কাজে লাগার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কোনো ওজর-আপত্তিই শুনল না। আমার শার্ট, মোজা, ট্রাউজার্সের সব ফুটোফাটা তালি দেয়া, রিফু করবার দায়িত্ব একদম নিজের হাতে তুলে নিল। মাস তিনেক ভালোভাবেই চলছিল সব। একদিন হঠাৎ পুলিশ ধরে নিয়ে গেল ওকে। সঠিক কারণটা জানি না। ওরা ওকে গারদে পুরল। এতদিনে সে বোধ হয় আর বেঁচে নেই। 

দুই

গল্পটা শেষ করে আমার সেই পরিচিত ব্যক্তি একটু দম নিলেন। সেই ফাঁকে আঙুলের টোকায় সিগারেটের ছাইটাও ঝেড়ে নিলেন একবার। থমথমে মুখে আকাশের দিকে চাইলেন। তার বোধ হয় আরও কিছু বলার আছে।

জীবনে যারা শুধু কষ্ট পায়...যন্ত্রণায় দগ্ধে দগ্ধে মরে...একটু সুখ একটু আনন্দের জন্যে তাদের কী প্রাণপণ চেষ্টা! এখন অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পারি। আর আমাদের মতো ভদ্রতার মুখোশ পরে সব ভণ্ড সমাজের মাথা সেজে বসে থাকি। নিজেদের মর্জি মতো মানুষের বিচার করি। খেয়ালখুশিমতো এর ওর চরিত্রের বদনাম রটিয়ে রসিয়ে রসিয়ে মজা লুটি...নিজেরা যেন সব ধোয়া তুলসী পাতা!

যে দিন মিথ্যের সব আবরণ ভেদ করে আসল সত্যিটা বেরিয়ে পড়ে তখন ভাগ্যবিড়ম্বিত ওই মানুষগুলোর জন্যে ভীষণ কষ্ট হয়। ভাগ্য ওদের নিয়ে এমন নিষ্ঠুর খেলা কেন খেলে? ওরা নাকি পতিত। সমাজে ওরা ব্রাত্য। ভদ্র মানুষের চৌহদ্দিতে ওদের কোনো ঠাঁই নেই। কিন্তু কেন? ওদেরও কি একই রক্ত, মাংস, হাড়ের শরীর নয়? ওদের স্নায়ুতন্ত্রে কি আমাদের মতো সুখ-দুঃখের অনুভূতি হয় না? তাহলে সেই যুগ যুগ ধরে যে সাম্যের কথা, মানবতার বাণী শুনে এসেছি সে কি বিফলে গেল? আমাদের সব শিক্ষা আসলে পুঁথির পাতাতেই রয়েছে...জীবনের কাজে লাগেনি। তাই আমাদের মনেও কোনো আলো জ্বলেনি। নিজেদের আত্মম্ভরিতার গভীর অন্ধকারে আমরাও সব পতিত শ্রেণি বটে। আমি...আপনি...হ্যাঁ...হ্যাঁ...সমাজে নৈতিকতার বুলি কপচানো সব বড়ো মানুষের দল...সব্বাই তাই। এসবই আসলে সেই আদ্যিকাল থেকেই ঘটে আসছে। ওই পাহাড়টার মতোই প্রাচীন কাহিনি সব। এত প্রাচীন যে বারবার বলতে নিজেরই লজ্জা হয়। 

তবু...বলে যেতে হয় বারবার।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫