
জাতীয় পার্টির লোগো। ছবি: সংগৃহীত
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী
লীগ সরকারের পতনের পর ‘বড় বিপাকে’ পড়েছে আওয়ামী
লীগের কিংস পার্টিখ্যাত জাতীয় পার্টি। দলের মধ্যে বাড়ছে বিভেদ। এ ছাড়া সংস্কারের লক্ষ্যে
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করলেও সেখানে
ডাক পড়েনি জাতীয় পার্টির। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে জাতীয় পার্টি এখন উপেক্ষিত।
দলটির বিরুদ্ধে অভিযোগ- সংসদীয় পদ্ধতির
সুযোগ কাজে লাগিয়ে জাতীয় পার্টি আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে কাজ করেছে। দলটির সুবিধাভোগী
অবস্থানের কারণে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ দীর্ঘায়িত হয়েছে। যখন রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি
নির্বাচন বর্জন করেছে, তখন জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের নির্বাচনি কৌশলকে সমর্থন দিয়ে
ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে কাজ করেছে। তারা একইসঙ্গে বিরোধীদলে থেকেছে আবার সরকারেও থেকেছে।
কেন ডাক পায়নি জাতীয় পার্টি? আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে খোলসা করেছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম। তিনি ঢাকার এক অনুষ্ঠানে বলেন, জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের ফ্যাসিজমের নীরব সমর্থন করে গেছেন। তারা অবৈধ নির্বাচনে অংশ নিয়ে সেগুলোর বৈধতা দিয়েছেন। এজন্য আমরা জাতীয় পার্টিকে আপাতত রাখছি না।
তিনি
বলেন, ‘তাদের বিষয়ে সরকার অবস্থান পর্যালোচনা করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর
সঙ্গে আরও আলোচনা-পর্যালোচনার ভিত্তিতে এটি হবে। এটি সরকার একা সিদ্ধান্ত নেবে না।
তারা যে ফ্যাসিবাদের দোসর ছিল এবং গণহত্যার পক্ষে অবস্থান ব্যক্ত করেছেন এবং
জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে গতকাল শনিবার
১০টি দল ও জোটের সঙ্গে সংলাপ করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ
ইউনূস। কিন্তু সেই তালিকায় জাতীয় পার্টি ছিল না।
সরকারি সূত্র জানিয়েছে, অভ্যুত্থানের ছাত্র
নেতৃত্ব গত তিন সংসদের বিরোধী দলটিকে আওয়ামী লীগের দোসর মনে করায় ডাকা হয়নি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে সমর্থন
করেছিল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রতিষ্ঠিত জাপা। তিন বছর পর জোট করে বিএনপির সঙ্গে বেরিয়ে
যায় এক বছরের মধ্যেই। ২০০৬ সালে যোগ দেয় আওয়ামী লীগের মহাজোটে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন
জোট ২৯ আসন ছাড়ে এরশাদের জাপাকে। ২০০৯ সালে গঠিত হাসিনা সরকারে মন্ত্রী ছিলেন জি এম
কাদের। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিএনপিবিহীন নির্বাচন এরশাদ বর্জনের ঘোষণা দিলেও, রওশন
এরশাদের নেতৃত্বে একাংশ অংশ নেয়। দলটি সেই বিতর্কিত নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়
২৩টিসহ মোট ৩৪ আসন নিয়ে প্রধান বিরোধী দল হয়। আবার জাপার তিন এমপি হাসিনা সরকারের মন্ত্রী
হন। এতে গৃহপালিত বিরোধী দলের তকমা পায় জাপা।
২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জাপাকে
২৭ আসন ছাড়ে আওয়ামী লীগ। রাতের ভোটখ্যাত সেই নির্বাচনে ২২ আসন পেয়ে ফের প্রধান বিরোধী
দল হয় জাপা। দলটির এমপিরা সংসদে শেখ হাসিনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকতেন। ২০১৯ সালে জি
এম কাদের জাপার নেতৃত্বে আসার পর দলটি লাগাতার সরকারের সমালোচনা করে। কিন্তু গত বছরের
আগস্টে ভারত থেকে ফেরার পর অনেকটা চুপ হয়ে যান।
ডামি নির্বাচনখ্যাত ৭ জানুয়ারির ভোটে আওয়ামী
লীগের কাছ থেকে ২৬ আসনে ছাড় পায়। নির্বাচনের প্রচারে জাপার প্রার্থীরা পোস্টারে শেখ
হাসিনার ছবি দিয়ে ভোট চেয়েছিলেন। দ্বাদশ সংসদে ১১ আসন পেয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে বিরোধী
দল হয় জি এম কাদেরের জাপা।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর সেনাসদর
ও বঙ্গভবনে ডাক পেয়েছিল জাপা। কিন্তু অতীত ভূমিকার কারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের
দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম এবং হাসনাত আবদুল্লাহ জাপাকে সংলাপে ডাকার প্রকাশ্য বিরোধিতা
করেছেন।
জাপা সূত্র জানিয়েছে, জুলাই গণহত্যা ও
আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার অভিযোগে জাপা নেতাদের বিরুদ্ধে ৩৮টি মামলা হয়েছে। এতে বরাবর
সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সখ্য রেখে চলা জাপা বিপদে পড়েছে। কোনো দলই সমর্থন-সহানুভূতি
দেখাচ্ছে না।
জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক বলেন, ‘সরকার হয়তো জাতীয়
পার্টির মতামত নেওয়া প্রয়োজন মনে করছে না, সে কারণে আমাদের সংলাপে ডাকেনি। এ নিয়ে আমাদের
কিছু বলার নেই।’
সংস্কারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে
শনিবার বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনায় বসেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা
ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই দফায় গণফোরাম, এলডিপি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দল, জাতীয়
মুক্তি কাউন্সিল, লেবার পার্টি ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) আলোচনায় অংশ নেয়।
এর আগে বিএনপিসহ পাঁচটি দল ও তিনটি জোটের
সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সংলাপ হয়েছে ৫ অক্টোবর। মাঝে পূজার ছুটির কারণে সব দলের সঙ্গে
আলোচনা শেষ হয়নি। শনিবার বাকি দল ও জোটগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসছেন প্রধান উপদেষ্টা। এখন
সরকার তৃতীয় দফায় এই সংলাপ করছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার শাসনের
পতনের পর গত ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। অন্তর্বর্তী সরকার
গঠনের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সংলাপ হয়। সেই সংলাপে
জাতীয় পার্টিকে ডাকা হয়। তবে এ দফায় এখনো দলটিকে আলোচনায় ডাকা হয়নি।
তবে আওয়ামী লীগের শাসনে সহযোগিতা করার
অভিযোগ অস্বীকার করে বক্তব্য দিচ্ছেন জাপা নেতারা। দলটির নেতারা বলছেন, তাঁরা আওয়ামী
লীগের দোসর ছিলেন না। তাঁদের দলের একটি অংশকে আওয়ামী লীগের পুরো শাসন আমলেই সুযোগ-সুবিধা
দিয়ে হাতে রাখা হয়েছিল। যখনই জাপা সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করত, তখনই
ওই অংশকে ব্যবহার করে দল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা হতো।
জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক বলেন, দলকে ধ্বংসের
হাত থেকে বাঁচাতে বাধ্য হয়ে তাঁদের যে ভূমিকা নিতে হয়েছিল, সে ব্যাপারে তাঁরা ব্যাখ্যা
দিয়েছেন।
সংলাপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রয়োজন মনে করে ভবিষ্যতে উপদেশ দেওয়ার জন্য
ডাকলে উপদেশ দিব। যদি প্রয়োজন না পড়ে তাহলে ডাকবে না, উপদেশ দিব না, সোজা হিসাব।
চুন্নু আরও বলেন, প্রথম ডাকছে, তখন আমরা
উপদেশ দিয়েছি, এখন হয়তো আমাদের উপদেশ প্রযোজন হয় নাই, তাই ডাকে নাই। ডাকতে হবে বা আমাদের
যেতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নাই।
বিগত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সরকারে
এবং সংসদে বিরোধী দলের আসনে থাকা জাতীয় পার্টি (জাপা) সব কূলই হারাচ্ছে। দলের এমন অবস্থায়
সাম্প্রতিক দেশকালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জাপার চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, আমি ২০২৪-এ (৭
জানুয়ারি) নির্বাচন করতে চাইনি। কিন্তু আমাকে বলা হলো, আপনারা নির্বাচনে না গেলে আপনাদের
অন্য গ্রুপ অংশ নেবে। এ ধরনের হুমকির মুখে আমাকে বলতে হলো, ঠিক আছে, নির্বাচন যাতে
সুষ্ঠু হয়, সেটি নিশ্চিত করেন। তখন আমাকে নেগোসিয়েশনের (দর-কষাকষি) কথা বলতে হয়েছিল।
২০২৪ সালে যখন আমরা নির্বাচন বর্জন করতে চেষ্টা করলাম, সেই বিভক্তিকে কাজে লাগিয়ে পরোক্ষ
চাপ দেওয়া হলো, যদি তোমরা নির্বাচনে না আসো, রওশন এরশাদকে দিয়ে নির্বাচন করানো হবে।
তিনি বলেন, অবশেষে আমরা বললাম, নির্বাচনে
যাব। তবে নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার গ্যারান্টি দিতে হবে। আমরা কিন্তু কোনো ছাড় চাইনি।
নির্বাচনি ব্যবস্থা নিরপেক্ষ করার জন্য বলেছিলাম। যখন দেখলাম সেটি হয়নি, তখন আমি না
জানিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সকালে দেখলাম ওরা খবর পেয়ে গেছে।
জোর করে, আমার অফিস ঘিরে ফেলে, সব পথ বন্ধ করে দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী,
র্যাব, পুলিশ, এসবি, ডিজিএফআই, এনএসআই সবাই মিলে জোর করে আমাদের নির্বাচনে নেওয়া হয়েছে।
২০০৯ সাল থেকেই জাপা মাঠের রাজনীতিতে নেই।
এর সঙ্গে সরকারের সঙ্গে থেকে গুটিকয়েক কেন্দ্রীয় নেতার সুযোগ-সুবিধা পাওয়া নিয়ে ক্ষোভ-অসন্তোষে
নেতা-কর্মীদের বড় অংশের নিষ্ক্রিয়তা, গৃহবিবাদ, বিভক্তিতে দিনে দিনে দলটি জনবিচ্ছিন্ন
হয়েছে।
গত ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে
ভরাডুবির পর সরকারের সমালোচনা করলেও সংসদ বিরোধী দলের আসনে বসে আস্থা আরও হারিয়েছে।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির কট্টর সমালোচক বনে গিয়েও এবারের সংলাপে
ডাক না পাওয়া গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপার ঘুরে দাঁড়ানোর আশা
ফিকে করে দিচ্ছে।
জাপার নেতারা বলেছেন, দলকে ঢেলে সাজানোর
প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১২ অক্টোবর দশম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল করার সিদ্ধান্ত হলেও চলমান
পরিস্থিতির কারণে তা সম্ভব হয়নি। তবে আপাতত দল গোছানো জোরালো করাই মূল লক্ষ্য।
সম্মেলনের চেয়ে দল সংগঠিত করাই এ মুহূর্তে
বেশি জরুরি বলে মনে করছেন জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুও। তিনি বলেন, দেশের পরিবেশ-পরিস্থিতি
বিবেচনা করে সম্মেলনের বিষয়ে পরে চিন্তা-ভাবনা করা হবে। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্তমান
কমিটির মেয়াদ আছে।
এদিকে ৫ আগস্টের পর অনেকটাই নিষ্ক্রিয়
রওশনপন্থী জাপা। জাপা বিভক্তির সময় তাঁর সঙ্গে দলের কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা,
কাজী ফিরোজ রশীদসহ পাঁচ শতাধিক নেতা যোগ দেন।
রওশনপন্থী অংশের মহাসচিব কাজী মামুনুর
রশীদ জানান, নভেম্বরের প্রথম দিন নির্বাহী কমিটির সভা হবে। ওই সভায় সারা দেশে সংগঠনকে
শক্তিশালী করার বিষয়ে আলোচনা হবে। তবে জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপার সঙ্গে তারা
কোনো আলোচনায় যাবেন না।