রাজনৈতিক সংস্কৃতির নিম্নমানই নির্বাচনি সহিংসতার মূল

মাহমুদ সালেহীন খান
প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১২:১০

গত ১৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কালিহাতী পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে আটজন আহত হয়। ফাইল ছবি
গোলাগুলি, বোমা বিস্ফোরণ, সংঘাত, হতাহত, ভোট বর্জন, ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা, এজেন্ট বের করে দেয়া, ইভিএম নষ্ট, প্রার্থী আটকসহ নানা অভিযোগের মধ্য দিয়ে শেষ হলো দেশজুড়ে পর্যায়ক্রমে চতুর্থ ধাপের পৌরসভা নির্বাচন।
কার্যত দেশের যেকোনো পর্যায়ের নির্বাচনকে ঘিরেই রাজনৈতিক সহিংসতা থামানো যাচ্ছে না। এবারের পৌরসভা নির্বাচনেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
ক্ষোভ প্রকাশ করে বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনকে ঘিরে মূলত সরকারি দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব ভয়াবহভাবে উন্মোচিত হয়েছে। বস্তুত রাজনৈতিক সংস্কৃতি চর্চার নিম্নমানই নির্বাচনি সহিংসতার মূল কারণ বলে তারা উল্লেখ করেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘সব নির্বাচনই উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে- এটিই সুনাগরিকদের চাওয়া ও প্রত্যাশা। নির্বিঘ্ন পরিবেশে নিশ্চিন্ত মনে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট প্রদান করতে পারলে তা গণতন্ত্রের সৌন্দর্যকেই প্রকাশ করে। কিন্তু দুঃখজনক হলো- আমাদের দেশের নির্বাচনগুলো শতভাগ সহিংসতামুক্ত হতে পারছে না। নির্বাচনি পরিবেশ যেন শান্তিপূর্ণ থাকে, এটা নিয়ে এখন আমাদের মনোযোগী হতে হবে। সেজন্য রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতাদের সংযত আচরণ করতে হবে। প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকদেরও নির্বাচনি আচরণবিধি মেনে চলতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এবারের নির্বাচন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, নির্বাচনি সহিংসতা হয়েছে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে। স্থানীয় পর্যায়ের সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান অথবা প্রভাবশালী নেতারা কাউন্সিলর পদে নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচনে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আর তাতেই তৈরি হয়েছে সংকট। নিজ প্রার্থীকে বিজয়ী করতে গিয়ে নির্বাচনি প্রচারণায় অতি উৎসাহ জন্ম দিচ্ছে সহিংসতার।’
এই সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সবার আগে রাজনৈতিক মানসিকতা উন্নত করতে হবে। তাহলেই ধীরে ধীরে এটি কমে আসতে পারে।’
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) নেতা রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ‘নির্বাচনে সহিংসতা কীভাবে থামাবেন? এই সহিংসতা তো বিরোধীদের মধ্যে হচ্ছে না। নিজেদের মধ্যেই হচ্ছে। ইসির ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকলেও তারা রাখছে না। পেশি শক্তির কাছে সুস্থ নির্বাচন বন্দি হয়ে আছে। ক্ষমতার লোভ আর পেশি শক্তির আধিপত্য যতদিন না কমবে ততদিন এই সহিংসতা কমবে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘শুধু পৌরসভা নির্বাচন নয়, সামনের দিনগুলোয় অনুষ্ঠেয় স্থানীয় পর্যায়ের বাকি ধাপের নির্বাচনগুলোও যাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হতে পারে, সেদিকেও রাজনৈতিক দলগুলোকে বিশেষ নজর দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে একটি সুষ্ঠু ও বিতর্কমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। বস্তুত নির্বাচনের সব অংশীজনকেই উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিচয় দিতে হবে। দেশজুড়ে এসব নির্বাচনী সহিংসতার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ভোটারদের ওপর। যে কারণে ভোটাররা এখন ভোট দিতেও অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘নির্বাচনি পরিবেশ বলে একটি কথা আছে। যে পরিবেশ নির্বাচন পূর্বকালীন সময় থেকেই ভালো থাকার কথা। আমাদের সব নির্বাচনেই তো কিছু না কিছু ঘটনা ঘটে; কিন্তু এবার এক ধরনের ত্রাসের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতি সামাল দেয়া বা নিয়ন্ত্রণ করা নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতার বাইরে। অথচ নির্বাচন কমিশন সবসময় বলে আসছে একটি নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার দরকার, তার সবই তারা নিচ্ছেন। নির্বাচন কমিশন কী বলছে, সেটি বড় কথা নয়। আপনি-আমি কী দেখছি, সাধারণ মানুষ কী দেখছেন- সেটিই বড় কথা। সহিংসতার লাগাম টানতে যদি নির্বাচন কমিশন কঠোর ভূমিকা না নিতে পারে, তাহলে সব নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং সেই প্রভাব ভোটারদের ওপর পড়বে।’
ফলে ভোটাররা নির্বাচন-বিমুখ হয়ে পড়ছেন বলে তিনি মনে করেন।
এদিকে চতুর্থ ধাপে দেশের ৫৫টি পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর এই নির্বাচন নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রশ্ন তুলেছেন ‘আলোচিত’ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তার প্রশ্ন এই নির্বাচন পূর্বনির্ধারিত কি-না! নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য না হলে কোনো বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র আপন মহিমায় বিকশিত হতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘পৌরসভা নির্বাচনের ফল দেখে আমার ধারণা হচ্ছে, নির্বাচন নির্বাসনে যেতে চায়। নির্বাচন অর্থ অনেকের মধ্য থেকে ভোটের মাধ্যমে বাছাই; কিন্তু সে অবস্থা আজকাল পরিলক্ষিত হয় না। প্রশ্ন জাগে নির্বাচন কি এখন পূর্বনির্ধারিত?’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘কোনো ধরনের সহিংসতা ছাড়া আমাদের এখানে নির্বাচন কল্পনাও করা যায় না। ক্ষমতাসীনদের লক্ষ্যই থাকে কীভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে ভোটারদের মাঝে আতঙ্ক আর উদ্বেগ ছড়ানো যায়। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই ধরনের সহিংসতা বন্ধের জন্য প্রশাসন, নির্বাচন কমিশনকে চাপ দিচ্ছি; কিন্তু দুঃখজনক হলেও নির্বাচন কমিশনই এখন অসহায় হয়ে পড়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যের মাধ্যমেই তা প্রকাশ হয়েছে। আসলে একার পক্ষে এই ধরনের সহিংসতা কমানো যাবে না। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের দায় রয়েছে অনেক; কিন্তু তাদের সে দায়বোধ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই।’