-61a0a4022f5ba-6295cf4dc1cf0.png)
সাইফুল হক
দেশের নানাবিধ সংকটের মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক সংকটও ক্রমে আরো ঘনীভূত হচ্ছে। সরকার ও সরকারি দল নিজেদের ছক ও পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো অভিনব সব কৌশলে একতরফা ও তামাশার নির্বাচন যে মঞ্চস্থ করা যাবে না, এটুকু উপলব্ধি তাদের রয়েছে। ফলে এবার তাদের ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। এই কৌশলের প্রধান দিক হচ্ছে নিজেরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে আরো একবার নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়া এবং ক্ষমতা প্রলম্বিত করা। ক্ষমতায় থেকে তারা যদি আরো একটি নির্বাচন করতে পারেন তাহলে বিদ্যমান রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় তারা যে বিপুলভাবে বিজয়ী হবেন রাজনীতি সচেতন যে কেউই তা বলতে পারবেন।
আর ঠিক এ কারণেই রাজপথের বিরোধী দলসমূহের অবস্থান নির্বাচনের পূর্বে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার বা নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার। এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের কোনো অবকাশ নেই। দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রয়োজন হয়, রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে যে ধরনের পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও সৌহার্দ্যময় সম্পর্কের দরকার হয় বাংলাদেশে তা এখন তলানীতে। কেবল তাই নয় শাসকশ্রেণির রাজনীতি মধ্যে, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল বিরোধীদের দমন ও প্রতিশোধাত্মক রাজনীতির যে বিষবাষ্পকে ক্রমান্বয়ে বিস্তৃত করে চলেছে তার মধ্যে তাদের ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অবকাশ নেই।
সরকারের দিক থেকে প্রধান যুক্তি হচ্ছে সরকার তো নির্বাচন করে না, নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন কমিশন চাইলে ভালো নির্বাচন করা সম্ভব। কাগজে কলমে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সন্দেহ নেই। নির্বাচন কমিশনের বেশ কিছু ক্ষমতা ও এখতিয়ার রয়েছে। বাস্তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর উপযুক্ত প্রয়োগ নেই। তাদের রয়েছে বড় দাগের সীমাবদ্ধতা।
বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আওয়াল স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘মাঠ পর্যায়ে আসলে নির্বাচন করে জেলা প্রশাসক, এসপি, ওসিসহ প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যবৃন্দ।’
সরকার ও সরকারি দলের নির্দেশনার বাইরে ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের দায়িত্ব পালনের সুযোগ নেই। নির্বাচন কমিশনের চেয়ে সরকারের নির্দেশনামূলক পরামর্শ তাদের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর দেশের সরকার, গোটা প্রশাসনসহ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে যে চরম কর্তৃত্ববাদী চেহারায় গড়ে তোলা হয়েছে তাতে এর অন্যথা হবার প্রশ্ন নেই।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারি প্রশাসনকে বলা হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করতে। এই ‘সহযোগিতা’ প্রদানের বিষয়টি তেমন স্পষ্ট নয়।
আর একটি বড় সংকট হচ্ছে বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থার কার্যকারিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে দেয়া হয়েছে; প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনি ব্যবস্থা বলেও তেমন কিছু নেই। ভোটের গণতান্ত্রিক অধিকার অস্বীকৃত হওয়ায় নির্বাচনের প্রতি এক ধরনের গণঅনাস্থা তৈরি হয়েছে। যে দেশের মানুষ নির্বাচনকে অনেকটা উৎসব হিসাবে দেখে সেদেশের জনগণের নির্বাচনের প্রতি এই গণহতাশা খুবই বিপজ্জনক ও আত্মঘাতী। নির্বাচন এখন এখানে সরকারি দলের ক্ষমতা প্রলম্বিত করার লোক দেখানো আইনি ব্যবস্থা মাত্র। এ জন্য এই ব্যবস্থা ও কাঠামোর গুণগত কোনো পরিবর্তন ব্যতিরেকে এখানে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আশা করা যায় না।
তদুপরি সমগ্র নির্বাচন এখানে টাকার খেলায় পর্যবসিত হয়েছে; এছাড়া রয়েছে গুণ্ডামী, মাস্তানী, জবরদখল, সন্ত্রাস, প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ ও কারসাজি, সাম্প্রদায়িকতা প্রভৃতি। নির্বাচনকে এখন বাণিজ্যেও পরিণত করা হয়েছে। এ কারণে নির্বাচনি ব্যবসায় এখন বিত্তবান আর কালো টাকার মালিকরা নেমে পড়েছে। নির্বাচনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এদের মধ্যে একজনকে বেছে নেওয়া ছাড়া মানুষের আর গত্যন্তর থাকে না। বিত্তবান, কালোটাকার মালিক আর রাজনৈতিক মাফিয়াদের প্রধান প্রণোদনা দেশসেবা নয়, বরং রকেট গতিতে আরো অর্থ-বিত্ত গড়ে তোলা। জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানে এখন এদেরই আধিপত্য কায়েম হয়েছে। এই ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে না পারলে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে সত্যিকারের কোনো প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে না। গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা এই সত্যকেই তুলে ধরছে।
আগামী জাতীয় নির্বাচন দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত দুটি জাতীয় নির্বাচনের মতো আর একটি ব্যর্থ নির্বাচনের বোঝা এদেশের মানুষ নিতে পারবে না। আগামী জাতীয় নির্বাচনও যদি অকার্যকর ও ব্যর্থ হয় তাহলে দেশ, জনগণ ও দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ যে অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের মুখে পড়বে এই আশঙ্কা অমূলক নয়।
এমনিতেই বৈশ্বিক রাজনৈতিক-অর্থনীতির বহুমাত্রিক নেতিবাচক অভিঘাত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, দেশের অর্থনীতির নানা সূচকের উদ্বেগজনক প্রবণতায় আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের চলা স্বস্তিদায়ক হবে না বলেই আশঙ্কা। এর মধ্যে নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘাত-সহিংসতা পরিস্থিতির অস্বাভাবিক অবনতি ঘটাতে পারে, এরকম অবস্থা নিশ্চয় কাঙ্ক্ষিত নয়।
এ কারণে সময় ফুরিয়ে যাবার আগেই সরকার, সরকারি দল ও রাজনীতিকদের এখন প্রজ্ঞার পরিচয় দেওয়া জরুরি। নির্বাচনকেন্দ্রিক সংকট উত্তরণে বিশ্বাসযোগ্য রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণও আবশ্যক। নির্বাচনের আগে সরকার কীভাবে পদত্যাগ করবে ও কীভাবে অবাধ নির্বাচনের জন্য তদারকি সরকার গঠিত হবে-এসব জরুরি প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের সাথে আলোচনা করে সম্মানজনক পথ বের করা দরকার। তা নাহলে বিরোধী দল ও জনগণের জন্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাজপথে নেমে আসা আর বিকল্প কী থাকে!
সাইফুল হক
সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশের বিপ্লবী
ওয়ার্কার্স পাটি