জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম বাতিলের নেপথ্যে

আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে ব্যালট পেপারে ভোট নেয়া হবে। রাজনৈতিক ঐকমত্য না থাকা আর ইভিএমের জন্য অর্থ বরাদ্দ না থাকায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. জাহাংগীর আলম।

দেশের পাঁচ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনী তফসিল এবং আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম নিয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে আজ সোমবার (৩ এপ্রিল) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে বৈঠকে বসে হাবিবুল আউয়াল কমিশন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সব কমিশনার। 

বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. জাহাংগীর আলম সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন। এ সময় তিনি জানান, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনেই ব্যালট পেপার এবং স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ হবে বলে কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ইসির হাতে আছে লাখ খানেকের কিছু বেশি ইভিএম। যা মেরামত করতে কমিশন ১২০০ কোটি টাকা চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিলো। কিন্তু সেই টাকা পাচ্ছে না কমিশন। সে সঙ্গে দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার পক্ষে মত দিয়েছে।

সাংবাদিকদের সে কথাই জানিয়ে ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম বলেন, রাজনৈতিক ঐক্যমত না হওয়ায় এবং ইভিএম মেরামতে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান না হওয়ায় ৩০০ আসনেই ব্যালট পেপারে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। 

তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইভিএম  ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু ইভিএম মেরামতের জন্য সরকারের কাছে এক হাজার ২৪০ কোটি টাকা ইসির পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই টাকা পাওয়ায় অনিশ্চতা সৃষ্টি হওয়ায় ইসি সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী নির্বাচন ৩০০ আসনেই স্বচ্ছ ব্যালট পেপারে অনুষ্ঠিত হবে।

ইসি সচিব বলেন, ঘোষিত রোডম্যাপে ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত ছিলো। সেক্ষেত্রে কমিশন আট হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়। কিন্তু প্রকল্পটি প্ল্যানিং কমিশন থেকে অনুমোদন দেয়া হয়নি। পরবর্তী সময়ে গাজীপুর মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির সঙ্গে কমিশন যোগাযোগ করে। তখন জানানো হয় আগের মেশিনগুলো মেরামত করতে হবে। এক্ষেত্রে পুরাতন ১ লাখ ১০ হাজার ইভিএম নির্বাচনে ব্যবহার উপযোগী করতে হলে ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, পরবর্তীতে ১ লাখ ১০ হাজার ইভিএম মেরামত তরে ব্যবহার উপযোগী করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছিলো। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ১ লাখ ১০ হাজার মেশিন মেরামতের জন্য ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। তবে নির্বাচনের জন্য অন্যান্য ব্যয় পাওয়া যাবে বলে কমিশন নিশ্চয়তা দিয়েছে।

ইসি সচিব জানান, ১ লাখ ১০ হাজার ইভিএম মেরামত করে চালু করার জন্য পর্যাপ্ত সময় ও অর্থ এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনের হাতে নেই। এগুলো অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ। পাশাপাশি কিছু কম্পোনেন্ট বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। ফলে সংসদ নির্বাচনের জন্য হাতে যে সময় রয়েছে, সেই সময়ের মধ্যে মেশিন মেরামত করাও সম্ভব নয়। 

এছাড়াও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থের নিশ্চয়তা না পাওয়া এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে ঐকমত্যের অভাব রয়েছে। এসব কিছু বিবেচনা করে হয়ত কমিশন আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। 

৫০ থেকে ৬০টি আসনের ইভিএম ব্যবহারের সক্ষমতা রয়েছে বারবার এমন কথা বলার পরেও কেন ৩০০ আসনে ব্যালটে নির্বাচন? এমন প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, আমাদের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সব পর্যায়ে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। 

শুধু টাকার কারণেই কি জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম থেকে সরে আসছেন নাকি অন্য কোনো কারণ ছিল- এমন প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, কমিশনের সচিব হিসেবে ইসির সিদ্ধান্ত জানানোর আইনি অধিকার আমার রয়েছে। তবে কমিশনের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে কী ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল সেটি কমিশন থেকে জানাটি যুক্তিসঙ্গত হবে। 

উল্লেখ্য, এক-এগার সরকারের সময়কার ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন ভোটে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যে ইভিএমের প্রচলন শুরু করে। সে সময় তারা বুয়েটের কাছ থেকে মেশিন তৈরি করে নেয়। ওই কমিশনের পরিকল্পনা ছিল স্থানীয় নির্বাচনে মেশিনটি ব্যবহার করে জনপ্রিয়তা অর্জনের পর ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের।

শামসুল হুদা কমিশনের পর কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশন এসে বুয়েটের তৈরি সেই মেশিন আর সফলভাবে ব্যবহার করতে পারেনি। ২০১৫ সালে রাজশাহী সিটি নির্বাচনে একটি মেশিনে সমস্যা দেখা দিলে ব্যাপক বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তাদের। ফলশ্রুতিতে বুয়েটের তৈরি ওই মেশিন নষ্ট করে আরও উন্নতমানে ইভিএম তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। 

পরবর্তীতে কে এম নূরুল হুদার কমিশন এসে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১০০ আসনে মেশনটি ব্যবহারের লক্ষ্যে বিএমটিএফের কাছ থেকে প্রায় ২০ গুণ বেশি দামের দেড় লাখ ইভিএম তৈরি করে নেয়। এরই মাঝে সেই মেশিনগুলোর মধ্যে ৪০ হাজার একেবারে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।

এছাড়া বাকি এক লাখ ১০ হাজার মেশিনেরও রয়েছে নানা ত্রুটি। এ ত্রুটি সারিয়ে এবং নতুন দুই লাখ মেশিন কিনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করতে চেয়েছিল বর্তমান আউয়াল কমিশন। কিন্তু তাদের দেয়া কোনো প্রস্তাবেই সাড়া মিলল না সরকারের তরফ থেকে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হয়ে যাবে আর সাত মাস পর। ভোটের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোও গুছিয়ে এনেছে নির্বাচন কমিশন। এরইমধ্যে নির্বাচনী আইন সংস্কার, সীমানা পুননির্ধারণ, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন, গণমাধ্যমকর্মী নীতিমালার কাজ এগিয়ে চলছে। 

ভোটের আগেই পাঁচ সিটির নির্বাচন সারতে প্রস্তুতি নিচ্ছে কমিশন। সোমবারের সভায় পাঁচ সিটি করপোরেশন গাজীপুর, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা ও বরিশালের ভোটের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। একই সঙ্গে প্রতিটি নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা রাখাসহ ইভিএমে ভোটগ্রহণ করা হবে বলেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

ইসি সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, গাজীপুর সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২৫ মে। খুলনা ও বরিশাল সিটির ভোট হবে ১২ জুন। আর রাজশাহী ও সিলেটে ভোটগ্রহণ করা হবে ২১ জুন।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

Ad

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //