
রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা স্বপ্নবাজ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ফাহিম সালেহের খুনি টাইরেস ডেভোন হাসপিলকে (২১) গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কৃষ্ণাঙ্গ এই তরুণ এক সময় ছিলো নিহত সালেহের সাবেক ব্যক্তিগত সহকারি। টেরেস ডেভোন হ্যাসপিল নিজেকে ‘উদ্যোক্তা’ হিসেবেও পরিচয় দিতেন।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে কোনো অপরাধী গ্রেফতার হলে সঙ্গে সঙ্গে তার বিস্তারিত পরিচয় জানানো হয় না। হ্যাসপিলের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম অনেকটা বজায় রাখছেন পুলিশ সদস্যরা।
এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তা থেকে বোঝা যাচ্ছে ২১ বছর বয়সী হ্যাসপিল রীতিমতো প্রতারক চরিত্রের ছেলে। তিনি ফাহিমের ১ লাখ ডলার চুরি করেছেন বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম থেকে জানা গেছে। কিন্তু ফাহিম তার কাছে আরো অনেক ডলার পেতেন।
স্থানীয় সময় শুক্রবার সন্ধ্যায় এনওয়াইপিডি-এর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান রডনি হ্যারিসন বলেন, চুরি করা অর্থের পাশাপাশি হ্যাসপিল আরো বড় অঙ্কের অর্থ ভুক্তভোগীর থেকে ধার নিয়েছিলেন বলে আমরা ধারণা করছি।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হ্যাসপিল লং আইসল্যান্ড হাইস্কুল থেকে গ্রাজুয়েশন করেছেন। ডেইলি নিউজের একটি প্রতিবেদনে আবার বলা হয়েছে, এই গ্রাজুয়েশন শেষ করতে পারেননি হ্যাসপিল।
ফাহিমের সঙ্গে তিনি কাজ করার সুযোগ পান একটি প্রতিযোগিতা থেকে। ২০০৯ সালে প্র্যাঙ্ক ডায়াল নামের একটি মজার ওয়েবসাইট তৈরি করেন ফাহিম। সেই ওয়েবসাইটে কাজ করার জন্য ওয়েব ডিজাইনের প্রতিযোগিতায় টিকে যাওয়া হ্যাসপিলকে নিয়োগ দেন ফাহিম।
এবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হ্যাসপিল ফাহিমের অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানিতে চিফ অব স্টাফ হিসেবেও যোগ দেন। এর পাশাপাশি ব্যক্তিগত সহকারি হিসেবে কাজ করছিলেন।
নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের লোয়ার ইস্ট সাইডে নিজের বিলাসবহুল বাসায় স্থানীয় সময় মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে খুন হন ফাহিম। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার হওয়া হ্যাসপিলকে ‘সেকেন্ডে ডিগ্রি মার্ডারে’ অভিযুক্ত করা হয়েছে।
ফাহিম প্রযুক্তি জগতে নিজের পথচলা শুরু করেন ওয়েব ডেভেলপার হিসেবে। এরপর ধীরে ধীরে নিজেকে ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত পাঠাওয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
ফাহিমের ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্ট থেকে লাখ ডলার চুরি করেছিল এই হ্যাসপিল। বিষয়টি জেনেছিলেন ফাহিম। সেই অর্থ ফেরত দেয়ার একটি সমঝোতা করে হ্যাসপিল ফাহিমের ফার্ম ছেড়েছিল। তবে পরবর্তীতে হ্যাসপিল চুরি করা অর্থ ফিরিয়ে দেয়ার অঙ্গীকার পালন করেনি।
তদন্ত কর্মকর্তারা উল্লেখ করেছেন, ফাহিমকে অনুসরণ করে নিনজা স্টাইলে কালো পোশাকে যে ব্যক্তি ওই ভবনের এলিভেটর দিয়ে ফাহিমের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে পর্যন্ত গিয়েই আঘাত করেছে বলে সিসিটিভিতে দেখা গেছে, সেই ব্যক্তি অর্থাৎ ঘাতকটি হচ্ছে হ্যাসপিল। আর্থিক ফায়দা হাসিলের জন্যই ফাহিমকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে তদন্ত কর্মকর্তারা মনে করছেন। তবে এমন নৃশংসতার নেপথ্যে কারও মদদ রয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এদিকে ফাহিমের লাশ আজকের মধ্যে পাওয়া গেলে কাল দাফন করা হবে।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত ব্যক্তিগত সহকারী হিসাবে ফাহিমের এপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে ব্যাক্তিগত জীবনের অনেক তথ্যই হয়তো জানা ছিলো টাইরেসের। এমনকি হয়তো সিঁড়িপথের বিশেষ চাবিও ছিলো তার কাছে। যে কারণে পালিয়ে যাওয়ার সময় লিফটের পরিবর্তে খুব সহজেই সে সিঁড়িপথ ব্যবহার করতে পেরেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তদন্তকারীর ঘটনাস্থল থেকে জব্দকৃত আলামতের ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে সেখানে টাইরেসের উপস্থিতির নিশ্চিত প্রমাণ পেয়ে গেছেন।
এদিকে গ্রেফতার হওয়া টাইরেস ডেভোন হাসপিলের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো তৎপরতার চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে না। ফাহিমকে খুনের পরিকল্পনার অংশ হিসাবে ইচ্ছে করেই সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের অ্যাকাউন্টগুলো বন্ধ করে রেখেছে কিনা সেটা জানার চেষ্টা করছে পুলিশ।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের জনপ্রিয় রাইডশেয়ারিং কোম্পানি পাঠাও’র অন্যতম সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহ’র খণ্ড-বিখণ্ড মৃতদেহ গত মঙ্গলবার বিকালে তার ম্যানহাটনের এ্যাপার্টমেন্ট থেকে উদ্ধার করে নিউ ইয়র্কের পুলিশ। এর আগে ফাহিমের খালাতো বোন মীরান চৌধুরী ৯১১ নম্বর কল করে ফাহিমকে খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে পুলিশের সাহায্য চান। মীরান সোমবার থেকে অনেকবার টেলিফোনে চেষ্টা করেও ফাহিমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে মঙ্গলবার দুপুরের পর সরাসরি তার এ্যাপার্টমেন্ট ভবনে গিয়ে হাজির হন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তিনি ফাহিমের এ্যাপার্টমেট থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাননি।
এরপরই তিনি পুলিশের সাহায্য চেয়ে ফোন করেন। ওইদিন বেলা সাড়ে ৩টার দিকে এনওয়াইপিডি’র প্রিসিঙ্কট (থানা বা পুলিশ স্টেশন) ০০৭ এর একটি দল ওই এপার্টমেন্টে গিয়ে ফাহিমের মৃতদেহ আবিষ্কার করে। এরপর ভবনটির সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, ফাহিম সর্বশেষ গত সোমবার দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে তার এ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করেন।
শর্টস ও টি-শার্ট পরিহিত ফাহিম যখন নিচতলা থেকে লিফটে চড়েন তখন কালো পোশাকে আবৃত ও কালো মাস্ক পরা আরেক ব্যক্তিও তার সঙ্গে লিফটে ওঠে। তার হাতে ছিল ব্রিফকেস টাইপের একটি বাক্সো। ফাহিমকে সন্দেহের দৃষ্টিতে ওই আগন্তুকের দিকে তাকাতেও দেখা গেছে।
সিসি ফুটেজে আরো দেখা যায় যে, সন্দেহভাজন লোকটি সপ্তম তলায় ফাহিমের সঙ্গেই নেমে পড়ে এবং এক পর্যায়ে ফাহিম তার এ্যাপার্টমেন্টের দরজা খোলামাত্রই তাকে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে ফেলে সে। লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এর পরের দৃশ্য আর ফুটেজে আসেনি।
মেধাবী এই প্রযুক্তি-উদ্যোক্তার নৃশংস খুনের ঘটনা বিশ্বজুড়েই বড় সংবাদ হিসাবে স্থান পায় সকল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। নিউ ইয়র্কের পুলিশ ডিপার্টমেন্টও এই মামলাটিকে নেয় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের তালিকায়। নানা রকম তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ফাহিমের সাবেক ব্যাক্তিগত সহকারী টাইরেস হাসপিলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বৃহস্পতিবার প্রথমে পুলিশের হেফাজতে নেয়া হয়। এরপর ফরেনসিক পরীক্ষার রিপোর্ট এবং জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তদন্তকারী নিশ্চিত হয় যে, ২১ বছর বয়েসী এই কৃষ্ণাঙ্গ তরুণই খুন করেছে তার সাবেক বসকে। এরপরই তাকে গ্রেফতারের ঘোষণা দিয়ে সেটা গণমাধ্যমের সামনে প্রকাশ করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুস্যাটসের বেন্টলি ইউনিভার্সিটিতে ইনফরমেশন সিস্টেমের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি নেয়া ফাহিম সালেহ বাংলাদেশের মতো নাইজেরিয়াতেও গোকাডা নামের আরেকটি মোটরসাইকেল ট্যাক্সি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তার বাবা, মা ও বোন নিউ ইয়র্ক শহর থেকে ৮০ মাইল দূরের ছোট্ট শহর পুকেপসিতে বসবাস করেন। তার বাবা সালেহ আহমেদের বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে।