বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংস্কৃতির পঞ্চাশ বছর

বেলায়াত হোসেন মামুন
প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৪:৪২

এফডিসি। ছবি: সংগৃহীত
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংস্কৃতির কথা বলতে হলে আমাদের সময়ের যাত্রাবিন্দু নির্ধারণ করতে হয় ১৯৭১-এ; কিন্তু ‘সংস্কৃতি’ এমন এক প্রবহমান স্রোত যা সময়ের এই সীমানার বিষয় নয়। এই ভূখণ্ড যা পূর্বে ‘পূর্ব-বাঙলা’ এবং তারপর ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামে পরিচিত ছিল, তা কখনো ভাষার মানচিত্রের কারণে চিহ্নিত হয়েছে অথবা কখনো চিহ্নিত হয়েছে ‘পাকিস্তান’ নামক এক রাজনৈতিক অস্তিত্বের কারণে।
এই দুই নামকরণের আগে অথবা পরেও এই ভূখণ্ড আরও ভিন্ন নামে পরিচিত ছিল বা হয়েছে। তাই কেবল নামকরণের মধ্য দিয়ে একটি ভূখণ্ডের মানুষের সংস্কৃতির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ পরিমাপ করা যায় না। এ সত্য মেনে নিয়ে যদি আমরা আলোচনায় প্রবেশ করি তবে আমাদের আজকের আলোচনার যে নির্ধারিত শিরোনাম তার মাঝে আমরা প্রবিষ্ট হতে পারব।
চলচ্চিত্র আমাদের এই ভূখণ্ডে নিয়মিত নির্মিত হতে শুরু করেছে গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকে। মূলত, ১৯৫৭ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এর নিয়মিতকরণ সম্ভব হয়। এর আগে আমাদের এই ভূখণ্ডের যে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে তার কারিগরি সব কাজ নিজস্ব সক্ষমতায় ঢাকা বা পূর্ব-বাংলায় সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল না। কারণ আমাদের এখানে চলচ্চিত্র নির্মাণের মুদ্রণ ও পরিস্ফুটনের কাজ করার মতো অবকাঠামো ছিল না। ছিল না চলচ্চিত্র সম্পাদনাসহ চলচ্চিত্রের শুটিং পরবর্তী কাজগুলো করার পরিবেশ বা যোগ্য, দক্ষ মানুষ।
ফলে ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল যখন প্রাদেশিক আইন পরিষদে সে সময়কার যুক্তফ্রন্ট সরকারের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ‘পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন বিল ১৯৫৭’ উত্থাপন ও পাস করিয়ে নিলেন তখন ঢাকায় আমাদের নিজস্ব চলচ্চিত্র নির্মাণ স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলো (হায়াৎ, ১৯৮৭)। আর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এ স্টুডিও প্রতিষ্ঠার কারণে ঢাকায় চলচ্চিত্র নির্মাণের যাবতীয় কাজ করার অবকাঠামো প্রস্তুত হতে শুরু করলো।
১৯৫৭ সালের পর থেকে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পর্যন্ত সময়কালটাকে যদি আমাদের চলচ্চিত্রের ‘পাকিস্তান আমল’ বলি তবে ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ থেকে আজকের দিন পর্যন্ত সময়কে বলব ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রামল’। সময়কে এইভাবে ভাগ করার প্রয়োজন আছে কারণ এটি একটি ভূখণ্ডের স্বাধীনতা ও পরাধীনতার সময়কে প্রতিনিধিত্ব করে। পাকিস্তানের প্রায় ২৪ বছরের ঔপনিবেশিক শোষণের ভেতরে পূর্ব-বাংলার মানুষের যে স্বাধীনতা ও মুক্তির লড়াই তা আমাদের তৎকালীন সংস্কৃতিচর্চার সকল ক্ষেত্রকে লড়াকু করে তুলেছিল। সেই লড়াইয়ের অবসান হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর।
কারণ আমার তখন আমাদের নিজস্ব ভূখণ্ডের মালিকানা বুঝে নিয়েছিলাম। আমরা বুঝে নিয়েছিলাম আমাদের রাষ্ট্র। আজ সেই স্বাধীন ও মুক্ত রাষ্ট্রের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের মাইলফলকের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা আমাদের চলচ্চিত্র সংস্কৃতির আমলনামা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারি।
এক
জনযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া একটি রাষ্ট্রের জনগণ নিজেদের স্বপ্ন ও অঙ্গীকার দিয়ে নিজেদের শাসনতন্ত্র তৈরি করে। বিজয়ী জাতি সামষ্টিকভাবে প্রস্তুত করে তাদের আজ ও আগামীর রূপরেখা। স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তার আগামীর রূপরেখা কেমন হবে তা কি নির্ধারণ করতে পেরেছিল ১৯৭১-এর বিজয়ী বাংলাদেশের মানুষ?
এই প্রশ্ন আজ খুব জরুরি। এর উত্তর খোঁজাও খুব জরুরি। কেননা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে এবং রণাঙ্গনের বিভিন্ন ফ্রন্টে এই জাতির সংস্কৃতিলগ্ন মানুষের যে অবদান তা রাজনীতিবিদ ও সামরিক বাহিনীর মানুষদের অবদানের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। বরং এ তো সর্বজনবিদিত যে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনই ‘বাংলাদেশ’-এর জন্মের বীজ বুনেছিল বাংলার ভূমিতে। আর ভাষা আন্দোলনের ‘আন্দোলন’ যতটা রাজনৈতিক বক্তৃতা, মিটিং বা মিছিলে ছিল তারচেয়ে অনেক বেশি ছিল এই বাংলার সংস্কৃতি ও শিল্পচর্চার মানুষের তৎপরতায়।
এ তৎপরতা অব্যাহত ছিল ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের অন্তিমমুহূর্ত পর্যন্ত। আর এই তৎপরতার খেসারত বুকের রক্ত দিয়ে এই বাংলার সংস্কৃতি-শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্রের মানুষজন দিয়েছে ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর অথবা পুরো একাত্তর জুড়ে। শুধু তাই নয়, মুক্ত স্বাধীন দেশে পরাজিত হায়েনাদের চতুর আক্রমণে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি খুন হয়েছিলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অভিভাবক জহির রায়হান।
এত রক্ত এত আত্মাহুতির পরও কি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মানুষের সাংস্কৃতিক মুক্তির অঙ্গীকার নিশ্চিত হয়েছিল? এই প্রশ্নের আলোকে আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বিচার করা উচিত। এই বিচারের ভার সংস্কৃতি-শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্রের প্রতিটি অঙ্গনকে পৃথক পৃথকভাবে করতে হবে। আজ আমরা সংক্ষিপ্ত পরিসরে স্বাধীন দেশে চলচ্চিত্রের ৫০ বছরের হিসাবটুকু করে উঠতে চাই।
দুই
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ যখন মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে তখন বাংলাদেশে একটি রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত আধুনিক চলচ্চিত্র স্টুডিও ছিল। বিএফডিসি বা বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন। ছিল সারাদেশে ২০৮টি সিনেমাহল (কাদের, ১৯৯৩ : ৩৯৭)।
রাষ্ট্রীয় চলচ্চিত্র স্টুডিও এফডিসিকে কেন্দ্র করে ছিল চলচ্চিত্র নির্মাণ-বিতরণ ও প্রদর্শনের একটি মোটামুটি চলমান ব্যবস্থা। এফডিসিতে ছিল প্রচুর চলচ্চিত্র ‘তারকা’ ও নির্মাতা-কুশলীর তৎপরতায় সরগরম একটি অঙ্গন। কিন্তু তখনো দেশে কোনো ফিল্ম আর্কাইভ ছিল না। ছিল না চলচ্চিত্র ইনস্টিটিউট। তখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলচ্চিত্র ‘অধ্যয়ন’ করার সুযোগ ছিল না। আদতে চলচ্চিত্র যে ‘পড়তে’ হয় এটাই তখনো আমাদের রাষ্ট্রে বা সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছিল না। তখন দেশে গুটিকয় চলচ্চিত্র সংসদ ছিল। যাদের তৎপরতার সামাজিক গণ্ডি খুব বিস্তৃত ছিল না।
তখন দেশে যে ধরনের চলচ্চিত্র নির্মিত হতো তাতে সামান্য হলেও সমাজ ও মানুষের দৃশ্যগত রাজনৈতিক উপস্থিতি ছিল, সে সব চলচ্চিত্রে ছিল দেশজ মানুষের স্বর ও ধ্বনি। সেসব চলচ্চিত্র কারিগরি ও চলচ্চিত্রের ভাষাগত বিচারে খুব উৎকৃষ্ট ‘চলচ্চিত্র’ না হলেও তার মাঝে সরলতার প্রাণবান উপস্থিতি ছিল। এ সরলতা শিল্পের বিচারে মূল্যবান। কেননা এ ধরনের সরল প্রয়াসের মাঝে সত্য ও সততার সরব স্বাক্ষর অমোচনীয়ভাবে দৃশ্যমান থাকে। চলচ্চিত্র ‘কলা’ অর্থে নিখুঁত হওয়ার যে দাবি রাখে সে বিচারে ষাটের দশকে এ দেশের চলচ্চিত্রে ‘নিখুঁত হওয়ার প্রচেষ্টা’র স্বাক্ষর তখনকার চলচ্চিত্রকারদের সৃষ্টিতে উপস্থিত দেখতে পাই।
ফলে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নিজের চলচ্চিত্র নির্মাণযাত্রার সূচনাবিন্দু রিক্তহস্তে শুরু করেনি। তখন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র-সংস্কৃতিতে দেশ ও ভাষা প্রেমের সঞ্চয় এবং তারুণ্যের কিছু সাহস ছিল। এই পুঁজি নিয়ে বাংলাদেশ পাড়ি দিয়েছে ৫০ বছর। আজ ২০২২ সালে বসে আমরা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কেমন চিত্র দেখতে পাই?
আজ ২০২২ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র-সংস্কৃতির এমন সক্ষমতার অবস্থায় পৌঁছেছে যে তাকে দেশের সিনেমাহলে বাঁচিয়ে রাখতে এক হাজার কোটি টাকার ‘ইনসেনটিভ’ দিতে হচ্ছে (দৈনিক প্রথম আলো, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১)।
বাংলাদেশে বর্তমানে সক্রিয় সিনেমাহল রয়েছে মাত্র ৭০টি (ডেইলি স্টার, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০)। সারা দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে প্রায় ২০টি জেলায় এখন আর কোনো সিনেমাহল নেই (দৈনিক প্রথম আলো, ২৯ জুন ২০১৭)।
দেশে আজও রাষ্ট্রায়ত্ত চলচ্চিত্র নির্মাণ স্টুডিও এফডিসি আছে। সেখানকার বর্তমান অবস্থা এমন যে, এফডিসির নিজস্ব আয়ে তা আর চলতে পারছে না। এফডিসিকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকার বহু বছর ধরেই ভর্তুকি দিচ্ছে। এফডিসিকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র নির্মাণ-বিতরণ-প্রদর্শন আজ আর কোনো সরল চলচ্চিত্র বিপণন কাঠামো নয়। এটি বহু বছর ধরেই একটি সিন্ডিকেটবাজিতে পরিণত হয়েছে।
এফডিসিতে এখন আর প্রতিভাবান কোনো ‘তারকা’ অবশিষ্ট নেই। যে দুই একজন ‘নায়ক’ বা ‘নায়িকা’ রয়েছেন তাদের গ্রহণযোগ্যতা দেশের সব শ্রেণির মানুষের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। এ কারণে তাদেরকে আর ‘তারকা’ বলার মতো পরিস্থিতি কার্যত নেই। এফডিসিকে কেন্দ্র করে চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কুশলীদের যে উপস্থিতি এখন দেখা যায় তাকে আর ‘প্রাণবান’ বলার সুযোগ নেই। এফডিসি আজ এমন একটি কারখানা যেখানে আর ‘উৎপাদন’ হয় না। আর যা বা যতটুকু ‘পণ্য’ সেখানে উৎপাদিত হয় তা দেশের মানুষের কাছে কোনো আবেদন তৈরি করতে সক্ষম নয়।
এটি একটি ‘বাতিল’ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান ও এর সংশ্লিষ্ট মানুষজন আজ ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেক’ বা বিদায়ী ভাতার জন্য অপেক্ষমাণ। আর সে কারণেই হয়তো এখনো তারা তাদের পুরনো এই প্রতিষ্ঠানে মাঝে মাঝে সমবেত হয়ে কখনো পিকনিকের ব্যবস্থা করেন অথবা কখনো সভা করে নিজেদের অসুবিধা দূর করণের জন্য বিভিন্ন দাবি-দাওয়া জানান।
অথচ ২০ বছর আগেও বাংলাদেশে চলচ্চিত্রিক তৎপরতার কেন্দ্রস্থ শক্তি ছিল এফডিসি। এই শক্তির যতটা না ইন্ডাস্ট্রির প্রভাব বা সক্ষমতার জন্য ছিল তারচেয়ে বেশি ছিল প্রযুক্তিগত কারণে। সারাবিশ্বেই চলচ্চিত্র শুরু থেকে সেলুলয়েডে ফর্ম্যাটে নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশেও তাই। আর এই সেলুলয়েড নির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণ-প্রসেসিং ব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও কারিগরি দিক থেকে একটি জটিল অবকাঠামোগত বিষয়।
এর জন্য যে সকল কারিগরি অবকাঠামোর প্রয়োজন তা ব্যক্তির সীমাবদ্ধ পুঁজির মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠান একটি জরুরি ও অত্যাবশক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কেন্দ্রীয়ভাবে সক্রিয় ছিল। ঢাকার কারওয়ান বাজারে অবস্থিত এফডিসি ছাড়া দেশে সেলুলয়েড ফর্ম্যাটে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রসেসিং অসম্ভব ছিল।
আর এ কারণেই এফডিসিকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র সিন্ডিকেট নিজস্ব মনোপলির প্রতিযোগিতাহীন বাজার ও প্রভাব তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু এই পরিস্থিতি ২০০০ সালের পর থেকে পরিবর্তিত হতে শুরু করে। চলচ্চিত্র নির্মাণে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার ও ডিজিটাল প্রযুক্তির সহজলভ্যতা চলচ্চিত্র মাধ্যমটিকে গণতান্ত্রিক করে তোলে।
ফলে মাধ্যমগতভাবে এর ‘মুক্তি’ ঘটে। আজ মোটামুটি মানের একটি কম্পিউটারে চলচ্চিত্র সম্পাদনার সফটওয়্যার ব্যবহার করে একটি চলচ্চিত্র সম্পাদনা করে ফেলা খুব সহজ একটি ব্যাপার। প্রযুক্তিগতভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণের
দৃশ্যধারণ-সম্পাদনা ও প্রদর্শন এখন পুরোপুরি ডিজিটাল হয়ে গেছে। আজ ছোট একটি ক্যামেরায় বড় চলচ্চিত্র নির্মিত হতে পারে। এ বাস্তবতায় বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণের কেন্দ্রস্থ ধারণা আর অস্তিত্বশীল নেই। এখন দেশের যে কোনো প্রান্তে বসে যে কোনো তরুণ বা যে কোনো বয়সের মানুষ চলচ্চিত্রবিদ্যায় দক্ষ হলে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারেন। আর চলচ্চিত্র প্রদর্শন ও বিতরণও এখন তেমন জটিল কিছু নয়।
অনলাইনভিত্তিক দুনিয়ায় হাজারো অনলাইন প্ল্যাটফর্ম রয়েছে, রয়েছে শত শত স্ট্রিমিং সাইট। আর এ সব বিষয়ে তরুণদের উৎসাহ ও উদ্দীপনাও প্রচুর। এ কারণে এফডিসিকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র সিন্ডিকেট আজ নিজেদের মনোপলি হারাতে বসেছে। তাদের জন্য পরিহাস হলো, তাদের মনোপলি গড়ে উঠেছিল চলচ্চিত্রের প্রযুক্তিগত কারিগরি ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ বা মালিকানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে; আর আজ সেই প্রযুক্তিগত কারিগরি মাধ্যমের গণতন্ত্রায়নের ফলে তাদের সিন্ডিকেটবাজি বা মনোপলি সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রযুক্তির দুরূহতা ও ব্যয়বহুলতা তাদের ‘শক্তিশালী’ করেছিল। আজ চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রযুক্তির সহজলভ্যতা তাদের ‘শক্তি’ কেড়ে নিয়েছে।
এফডিসি বা এফডিসিকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রের নির্মাণ-বিতরণ-প্রদর্শনের এই যখন পরিস্থিতি তখন বাংলাদেশে আজ চারটি পাবলিক ও ৯টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘চলচ্চিত্র অধ্যয়ন’ করানো হচ্ছে। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ‘চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট’। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ফিল্ম আর্কাইভ এবং বহু বছর পরে হলেও ফিল্ম আর্কাইভ নিজস্ব বিশাল ভবন ও অবকাঠামো গড়ে তুলতে পেরেছে। এখন দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য ক্যাটাগরিতে ১০টির অধিক চলচ্চিত্রে অনুদান প্রদান করা হচ্ছে।
দেশের বহু তরুণ গত পঞ্চাশ বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলচ্চিত্র বিষয়ে অধ্যয়ন ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এবং করছেন। দেশে প্রতিবছর চলচ্চিত্রে ‘জাতীয় পুরস্কার’ প্রদান করা হয় এবং চলচ্চিত্রগুণীজনদের চলচ্চিত্র সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য দেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদকে সম্মানিত করা হয়।
এসব রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা-পুরস্কারের পাশাপাশি বাংলাদেশ গত পঞ্চাশ বছরে চলচ্চিত্র বিষয়ক এমন সব দমনমূলক আইন ও বিধি তৈরি করেছে যা চলচ্চিত্রের সৃজনশীলতার কণ্ঠরোধ করে দিয়েছে। এ যেন গাছের শিকড় কেটে পাতায় জল ঢালার মতো বিষয়। রাষ্ট্র ও সরকার একদিকে চলচ্চিত্রের মান উন্নয়নে বরাদ্দ, পুরস্কার ও প্রণোদনার বিভিন্ন প্যাকেজ উপহার দিয়ে চলচ্চিত্রকে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলছেন, পাশাপাশি এই রাষ্ট্রই চলচ্চিত্র সংস্কৃতির দমনে ঔপনিবেশিক আমলের আইনের আদলে নতুন নতুন দমনমূলক আইন প্রণয়ন করে কণ্ঠরোধ করছেন।
বিগত সময়ের এসব আইন ও বিধির ক্ষমতায় চলচ্চিত্রে রাষ্ট্রীয় পুলিশি প্রতিষ্ঠান ‘ফিল্ম সেন্সর বোর্ড’ দেশের চলচ্চিত্রকে যাচাই-বাছাইয়ের নামে দেশে নির্মিত চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ক্রমাগত হয়রানি করে চলেছে। কার্যত ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের এই ‘পুলিশি’ তৎপরতার ভয়ে বহু চলচ্চিত্রকার প্রতিনিয়ত নিজেই নিজেকে ‘সেল্ফ সেন্সরড’ হয়ে নিজেদের চলচ্চিত্রিক সক্ষমতাকে হত্যা করছেন। এই হত্যাযজ্ঞ মানুষের মননে সংঘটিত হয় বলে তা দৃশ্য ও শ্রুতিতে দেখা বা শোনা যায় না। আর এ ক্ষতির কারণে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত পঞ্চাশ বছরেরও ‘সাবালকত্ব’ অর্জন করেনি।
বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশে প্রায় ২৩০০টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র নির্মিত হলেও আমরা আজ ২৩টি বিশেষ চলচ্চিত্রের নাম উল্লেখ করতে পারব না যা কলানৈপুণ্যে ও কারিগরি দক্ষতার প্রশ্নে নিখুঁত নির্মাণ হয়েছে। শুধু তাই-ই নয়, গত পঞ্চাশ বছরেও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিশ্ব চলচ্চিত্রের বিচারে বিশ্বে কোনো উল্লেখ করার মতো শৈল্পিক অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেনি। আজ পুরো বিশ্ব নয় কেবলমাত্র এশিয়ার চলচ্চিত্রের সর্বকালের ২৫০টি সেরা চলচ্চিত্রের তালিকা যখন হয় তখন সেখানে বাংলাদেশের একটি চলচ্চিত্রও স্থান করে নিতে সক্ষম হয় না।
এ পরিস্থিতির মাঝে আরও হতাশার চিত্র হলো, দেশে আজ চলচ্চিত্র চর্চার সে অর্থে শক্তিশালী কোনো সামাজিক তৎপরতা দেখা যায় না। দেশে আজও গুটিকয় চলচ্চিত্র সংসদ বা ফিল্ম সোসাইটি সক্রিয় রয়েছে কিন্তু তাদের তৎপরতার গণ্ডি ও সক্ষমতার বিস্তৃতি খুব সীমাবদ্ধ। কারণ এসব চলচ্চিত্র সংসদ নিজস্ব প্রয়াসে প্রতিকূলে সাঁতার কাটার চেষ্টায় রত। দেশে চলচ্চিত্র সংসদকে দমনের উদ্দেশ্যে প্রণীত ‘চলচ্চিত্র সংসদ নিয়ন্ত্রণ ও নিবন্ধন আইন ১৯৮০’ সংশোধন করে ‘চলচ্চিত্র সংসদ নিবন্ধন আইন ২০১১’ নামে পুনর্বহাল করা হয়েছে।
আইন করে চলচ্চিত্র চর্চার তৎপরতাকে দমন করা হচ্ছে ঠিকই; কিন্তু চলচ্চিত্র চর্চাকে সামাজিকভাবে শক্তিশালী করার জন্য রাষ্ট্র-সরকার বা সমাজ আজও কোনো ‘ইনসেনটিভ’ প্রদান করেনি। চলচ্চিত্র চর্চায় দেশের কোনো জাতীয় প্রতিষ্ঠানও নেই। চলচ্চিত্র সংসদগুলো বহুদিন ধরে দাবি জানাচ্ছে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য; কিন্তু এই দাবির দিকে সরকারের কোনো নজর বা গুরুত্ব দেখা যায়নি।
ফলে চলচ্চিত্র চর্চাহীন একটি বিপুল জনগোষ্ঠীর দেশে ‘চলচ্চিত্র-সংস্কৃতি’র শক্তিশালী হওয়ার কোনো কার্যকর কারণ থাকতে পারে না। এটি অলৌকিকভাবে ঘটার বিষয় নয়। সমাজে বা রাষ্ট্রে সংস্কৃতির শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে হলে এ নিয়ে বিশেষ মনোযোগ দিতে হয়। আর এ মনোযোগ দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত রাখতে হয়।
গত পঞ্চাশ বছরে চলচ্চিত্র সংস্কৃতির বিকাশে যে মনোযোগ দেয়া হয়নি তা আজ হঠাৎ করে যদি দেয়া হয় তাহলেও পরিস্থিতির খুব চটজলদি উন্নতি হবে-এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। সংস্কৃতি-শিল্পচর্চায় রাতারাতি কোনো ‘ফল’ অর্জন করা যায় না। সংস্কৃতি হলো এমন বনস্পতি যা বহু সময়ে কয়েক প্রজন্মের নিরবধি চর্চায় বিকশিত হয়। এ বস্তু বা ফল হাইব্রিড ধান বা বেগুন নয়। এ বস্তু বা ফল দেশের মাটিতে জন্মানো নিজস্বতার গুণে ঐশ্বর্যময়। তাই এই ফল পেতে সাধনা লাগে। আর এ সাধনা আমরা বাংলাদেশ নামের এই রাষ্ট্রে, সমাজে আজও দেখছি না।
আজও এই দেশে চলচ্চিত্রে যা বা যতটুকু অর্জন আছে তার সবই ব্যক্তিগত সাফল্য ও সংগ্রামের গল্প। অল্প কয়েকজন মানুষের এই ব্যক্তিগত সাফল্যের ফসলকে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ সামগ্রিক অর্জন দাবি করলে তা হবে এক নিষ্ঠুর প্রবঞ্চনা। নিজেদের শরীর থেকে অপবাদের দোষ স্খলনের জন্য এ হবে অপরের ব্যক্তিগত অর্জন ‘হাইজ্যাক’ করার মতো অপরাধ।
আমরা তা নিশ্চয়ই করতে চাই না। কারণ এ ধরনের কার্যে আপাতত আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের ‘ইমেজ’ বা ভাবমূর্তির লজ্জা আপাতত নিবারণ হলেও তাতে নিজেদের সঞ্চয় বাড়বে না। যে শূন্য কলস মাথায় নিয়ে আমরা হাঁটছি তা অমৃতে পূর্ণ হবে না। এই শূন্যতার স্থলে পূর্ণতা পেতে হলে আমাদেরকে চলচ্চিত্র সংস্কৃতির বিষয়ে যত্নবান হয়ে বহু কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আর তা যদি হয় তবে হয়তো আমরা সামনের দিনে এ শূন্যতার অবসান দেখতে পাব।
যেমনটি বলছিলাম, আমাদের সামষ্টিক অর্জনের কলস শূন্য হলেও আমাদের কিছু ব্যক্তিগত অর্জন রয়েছে। চলচ্চিত্রে বিগত পঞ্চাশ বছরে আমাদের যা গৌরব তা এই ব্যক্তিগত সাফল্যে। এখন সেই অর্জনগুলো নিয়ে আলাপে যেতে চাই।
তিন
গত পঞ্চাশ বছরে চলচ্চিত্রে ‘ইন্ডাস্ট্রি’ হিসেবে আমাদের একটি উত্থান হয়েছিল। এই দেশে একসময় ১২৩০টি সিনেমাহল ছিল বলে উল্লেখ করেছেন চলচ্চিত্র বিপণনকারীগণ (ঝুমা, ২০১৪; ৪৪)। বাংলাদেশে একটা সময়ে নিয়মিত শতাধিক কাহিনিচিত্র নির্মিত হয়েছে এবং প্রতি সপ্তাহে সিনেমাহলে তিন বা চারটি করেও নতুন চলচ্চিত্র ‘মুক্তি’ পেত। আজ সে সময়টি গত হয়েছে। এখন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ‘ইন্ডাস্ট্রি’ বাংলাদেশের সরকারের কাছে পাটশিল্পের মতো একটি ভর্তুকি খাত মাত্র।
কিন্তু কেন এক সময়ের ‘সোনালি আঁশ’ আজ এই সংকটে পতিত তার রাজনৈতিক-সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিচার না করে এই খাতটিকে দোষারোপ করে কোনো ফায়দা হবে না। দুনিয়ায় পাটজাত পণ্যের কদর বাড়লেও কমছে আমাদের দেশে। কেন? এ কি কেবল মানুষের ইচ্ছাকৃত কোনো স্বভাবের ফল নাকি এ একটি পরিকল্পিত জাতীয় সর্বনাশ? ভাবতে হবে। ভাবা দরকার।
তেমনি আজ সারাবিশ্বে যখন ৭৭০ কোটি মানুষের অন্তরে সবচেয়ে বিস্তৃত ও শক্তিশালী সাংস্কৃতিক মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র রাজত্ব করছে। তখন বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের এই দশা কেন? বাংলাদেশে কেন কতকগুলো শিল্পবোধহীন অর্বাচীনের নিয়ন্ত্রণে এ দেশের চলচ্চিত্রের
নির্মাণ-বিতরণ-প্রদর্শনের সামগ্রিক কাঠামো? এ কি কেবল কিছু স্বার্থান্বেষী পুঁজিপতির পেশির দাপট? নাকি এও একটি দেশের জাতীয় স্বার্থের পরিকল্পিত সর্বনাশ? ভাবা দরকার। যদি এই সংকটের ভেতর হতে বের হতে হয় তবে এ নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে হবে। চলচ্চিত্রের রাজনৈতিক গুরুত্ব ও এর সাংস্কৃতিক মূল্য বিচার ছাড়া এই ভাবনা হবে অসম্পূর্ণ ও অসফল। ভাবতে হবে চলচ্চিত্রের রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়েও।
অনেকের মতো আমারও বিশ্বাস বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের তিনটি দুঃখময় দীর্ঘশ্বাস হলেন জহির রায়হান, আলমগীর কবির ও তারেক মাসুদ। তাদের অসময়ে অস্বাভাবিকভাবে নিহত হওয়া বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার মতো নেতৃত্ব ও অভিভাবকত্ব আজ নেই। হয়তো এ কারণেই আজ দেশের চলচ্চিত্রের দশা অনেকটা-দশচক্রে ভগবান ভূত!
চার
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইন্ডাস্ট্রির বাতাবরণের ভেতরে কিছু মানুষের শিল্পগুণসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রয়াস আমাদের কিছু অর্জন প্রদান করেছে। এর বাইরে চলচ্চিত্রে আমাদের অর্জন ইন্ডাস্ট্রির বাতাবরণের বাইরের কিছু মানুষের দলগত ও ব্যক্তিক প্রয়াসে।
সবাই জানেন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে গত নব্বই দশক থেকে দুটি ধারায় ভাগ করা হয়। মেইনস্ট্রিম বা মূলধারা আর বিকল্পধারা। মেইনস্ট্রিম বা মূলধারা বলতে বোঝানো হয় ইন্ডাস্ট্রির চলচ্চিত্রকে। আর বিকল্পধারা হলো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন থেকে বিকশিত কিছু মানুষের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গীকারের চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রয়াস। কার্যত সচেতনভাবে বাংলাদেশে আশির দশকের চলচ্চিত্র নির্মাণের এই আন্দোলনটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এটি বাংলাদেশে শিল্পগুণসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রথম আন্দোলন।
বাংলাদেশের মেইনস্ট্রিম ইন্ডাস্ট্রির বাইরে বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলনের নির্মাতাদের কাজে বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও বাস্তবতার প্রকৃত উপস্থিতি দেখা যায়। সে তুলনায় মেইনস্ট্রিম ইন্ডাস্ট্রি একটি বাজারসর্বস্ব বায়বীয় ‘বিনোদনের বাতাসা’ সরবরাহকারী তৎপরতা ছাড়া আর কিছু নয়।
বাংলাদেশের মেইনস্ট্রিম চলচ্চিত্রের এই ‘বিনোদনের বাতাসা’য় গত পঞ্চাশ বছরে মানুষের সংগ্রাম, রাজনৈতিক বাস্তবতার সৃজনশীল উপস্থিতি, সমাজের বিভিন্ন বর্গ ও শ্রেণির মানুষের ব্যক্তিক ও সামষ্টিক আনন্দ বা বঞ্চনার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিফলন নেই। মেইনস্ট্রিম চলচ্চিত্র সর্বদাই উদ্ভট নাচ-গান আর কাল্পনিক মারপিটের ফর্মুলা চলচ্চিত্রে আস্থা রেখেছে। মেইনস্ট্রিম চলচ্চিত্র দর্শকের সামনে সর্বদাই একটি কাল্পনিক সমাজের চিত্রায়ণ করেছে।
যে সমাজের সঙ্গে এই পৃথিবীর কোনো সমাজের সংযোগ নেই। সে কাল্পনিক জগতের চিত্রায়ণের যে অতিনাটুকে উপস্থাপনা তাতে দর্শকের আবেগীয় পরিস্থিতির ক্যাথারসিস সম্পন্ন হয়। এই আবেগীয় ‘রিলিফ’ দর্শককে তার সমাজের বাস্তবতা থেকে তাকে বিচ্যুত করে। সে কিছুক্ষণের জন্য হলেও নিজের জীবনের বঞ্চনা, দুঃখ, অবমাননা ভুলে যায়। আর তাকে ভোলানোর জন্যই এই কাল্পনিক মায়ার ‘ফাঁদ’ পাতা হয়।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে গত পঞ্চাশ বছর ধরে এই ‘বিনোদনের বাতাসা’র ফাঁদ রাষ্ট্র ও সমাজ নিয়ন্ত্রণকারী পুঁজির মালিকরা সচেতনভাবে বহাল রেখেছে। পাশাপাশি এই ইন্ডাস্ট্রি ও রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের পরিচালনকারী বিভিন্ন সরকার রাজনৈতিকভাবে সচেতন শিল্পগুণসম্পন্ন চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে লড়াই করে গেছে।
যখনই কোনো রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও শিল্পগুণসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে তখনই সেই চলচ্চিত্রকে ‘ফিল্ম সেন্সর বোর্ডে’ হয়রানি করা হয়েছে, চলচ্চিত্রটিকে সিনেমাহলে প্রদর্শনে অসহযোগিতা করা হয়েছে এবং চলচ্চিত্রটির নির্মাতা ও কলাকুশলীদের পরিকল্পিতভাবে কর্মহীন করা হয়েছে। যাতে পরবর্তীকালে সেই নির্মাতা আর কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণের সুযোগ না পায়। এসব ঘটেছে গত পঞ্চাশ বছরে। এসব ঘটনার সামগ্রিক ফল হলো চলচ্চিত্রে গত পঞ্চাশ বছরে আমাদের অর্জনের কলস ‘প্রায়’ শূন্য।
পাঁচ
গত শতাব্দীর ষাটের দশকের সবচেয়ে উজ্জ্বল চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি যখন তিনি খুন হন তখন তার বয়স মাত্র ৩৬ বছর। ভাবতে অবাক লাগে নিজের আয়ুষ্কালের এত সংক্ষিপ্ত সময়ে জহির রায়হান কত কীর্তিই না গড়েছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জহির রায়হান যুক্ত হয়েছিলেন ক্যামেরা হাতে। তিনি ক্যামেরাকে করে তুলেছিলেন রাইফেল। আর সে কারণেই বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রটির নির্মাতা জহির রায়হান। চলচ্চিত্রটির নাম ‘স্টপ জেনোসাইড’ (১৯৭১)। এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি আজ বাংলাদেশের ঐতিহাসিক দলিল।
জহির রায়হান স্বাধীন দেশে চলচ্চিত্র সংস্কৃতিকে কীভাবে গড়ে তুলতে চাইতেন বা পারতেন সে আলাপ আজ আমরা আফসোসের সঙ্গে করি। একটি দেশের জন্মযুদ্ধের যোদ্ধা হিসেবে জহির রায়হানের যে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও এক্তিয়ার তৈরি হয়েছিল তা তিনি কাজে প্রয়োগ করার আগেই খুন হয়েছিলেন। তাঁর খুন হওয়াটা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে একটি গভীর ষড়যন্ত্র।
জহির রায়হানকে হারিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যখন ১৯৭২ সাল হতে হাঁটতে শুরু করে তখন আমাদের দেশ কার্যত চলচ্চিত্রে তার গণমুখী চরিত্র হারিয়ে ফেলে। আর ঢুকে পড়ে ‘বিনোদনের বাতাসা’ উৎপাদনের ফাঁদে। সে ফাঁদের গর্তে বসেই আজও ইন্ডাস্ট্রি তার ‘পণ্য’ উৎপাদনে সক্রিয় আছে। যদিও আজ ইন্ডাস্ট্রির সে জোর আর ততখানি অবশিষ্ট নেই। তবুও তারা এখনো সক্রিয়।
কিন্তু এই ইন্ডাস্ট্রির ‘বিনোদনের বাতাসা’ উৎপাদন মেশিনের ভেতরেও কয়েকজন নিয়মিত এমন চলচ্চিত্র নির্মাণ করে গেছেন যাদের কাজে একটা সুস্থিত চেহারা তৈরির চেষ্টা ছিল। তাদের মধ্যে ছিলেন খান আতাউর রহমান, সুভাষ দত্ত, আমজাদ হোসেন, চাষী নজরুল ইসলাম ও নারায়ণ ঘোষ মিতা।
এই কয়েকজনের চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে বেশকিছু চলচ্চিত্রে সমকাল অথবা দেশ ও জনপদের ভগ্নাংশের উপস্থিতি দেখতে পাই। এর বাইরে ইন্ডাস্ট্রিতে ছিলেন কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির ‘বাতাসা’ তৈরির কোনো কিছুতে অংশ না নিয়ে বরং ইন্ডাস্ট্রির ‘বাতাসা’ প্রকল্পের বিপরীত চিন্তার শিল্পগুণসম্পন্ন দায়বদ্ধ চলচ্চিত্র নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন আলমগীর কবির।
আলমগীর কবির ছাড়াও এই লড়াইয়ের পথে ছিলেন হারুনর রশীদ, শেখ নিয়ামত আলী, মসিহউদ্দিন শাকের, বাদল রহমান ও সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী। কিন্তু সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী একদিকে যেমন ‘ঘুড্ডি’ (১৯৮০) নির্মাণ করে চমকে দিয়েছিলেন ঠিক তেমনি তাঁর নির্মিত ‘আয়না বিবির পালা’ (১৯৯১) ও ‘লাল বেনারসি’ (১৯৯০) হতাশ করেছিল। বরং এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে তাঁর ‘আয়না বিবির পালা’ ও ‘লাল বেনারসি’ ইন্ডাস্ট্রির সে সময়কার ‘বিনোদনমূলক’ চলচ্চিত্রের ক্যাটাগরির বাইরের কিছু ছিল না।
অন্যদিকে চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির প্রায় একাই পুরো সত্তর ও আশির দশক জুড়ে লড়ে গেছেন বাজারি চলচ্চিত্রের প্রকরণ ও বিস্তারের বিরুদ্ধে। আলমগীর কবিরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’ (১৯৭৩), ‘সূর্য কন্যা’ (১৯৭৬), ‘সীমানা পেরিয়ে’ (১৯৭৭) এবং ‘রূপালি সৈকতে’ (১৯৭৯) বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধনির্ভর চলচ্চিত্রগুলোর মাঝে অন্যতম সেরা নির্মাণ হারুনুর রশীদের ‘মেঘের অনেক রঙ’ (১৯৭৬)। উপরন্তু ‘মেঘের অনেক রঙ’ চলচ্চিত্রটিই আজ অবধি বাংলাদেশের একমাত্র চলচ্চিত্র যেখানে চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র হিসেবে দেশের ক্ষুদ্র
নৃ-গোষ্ঠীর একজন মানুষ অভিনয় করেছেন। গত পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশের মেইনস্ট্রিম চলচ্চিত্রের আর কোনো পর্যায়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের অংশগ্রহণ ও উপস্থিতি আর দেখা যায়নি।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে চলচ্চিত্রকার শেখ নিয়ামত আলীর তিনটি চলচ্চিত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। শেখ নিয়ামত আলী ও মসিহউদ্দিন শাকের নির্মিত ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ (১৯৭৯) বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে সম্মানিত। এর পাশাপাশি শেখ নিয়ামত আলীর ‘দহন’ (১৯৮৬) ও ‘অন্য জীবন’ (১৯৯৬) ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র।
বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ (১৯৮০)। ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ নির্মাণের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রকার বাদল রহমান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করেছেন। ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ নির্মাণের আগে পর্যন্ত বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ‘বিনোদন’ হিসেবেই দেখা হতো। দেশের চলচ্চিত্রে যে শিশুদের অংশগ্রহণ ও শিশুদের উপযোগী চলচ্চিত্র নির্মাণ গুরুত্বপূর্ণ এ ভাবনার সূত্রপাত হয় ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ নির্মাণের মধ্য দিয়ে।
দুটি কারণে বাংলাদেশের দুটি চলচ্চিত্র কালজয়ী চলচ্চিত্রের মর্যাদা পায়। একটি হলো ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’, অন্যটি ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’। এ দুটি চলচ্চিত্র বাংলাদেশের প্রথম সরকারি অনুদানের চলচ্চিত্র এবং এ দুটি চলচ্চিত্র শিল্পগুণের বিচারে, নির্মাণকুশলতায় ও বিষয়ের প্রতি নির্মাতাদের সৎ দৃষ্টির জন্য চলচ্চিত্র ইতিহাসে ছবি দুটি মাইলফলক হয়ে আছে।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইন্ডাস্ট্রির ভেতরে থেকে ইন্ডাস্ট্রির ফর্মুলার বাইরের চলচ্চিত্র নির্মাণের যে কঠিন লড়াই সে লড়াইয়ে অনাগ্রহী হয়ে এবং চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের পরামর্শে কয়েকজন তরুণ বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলনের সূত্রপাত করেন।
এই তরুণদের মাঝে তানভীর মোকাম্মেল, তারেক মাসুদ ও মোরশেদুল ইসলাম পরবর্তী এক দশকে এমন কিছু চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে কেবল দেশীয় পর্যায়ে সমৃদ্ধ ও পরিচিত করে তোলেনি, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের চলচ্চিত্র সম্মান এবং পুরস্কারও বয়ে আনতে সক্ষম হয়। তাদের এ অর্জন অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে এসেছিল। তাদের এই সম্মান ও স্বীকৃতি অর্জন তাদের সমকালে ও পরবর্তী সময়ে বহু তরুণকে প্রথাগত ফর্মুলা চলচ্চিত্রের বাইরে এসে চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহিত করেছে।
এ কারণে আজ এই ২০২২ সালে বাংলাদেশের তরুণ যে কোনো চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাজ ও কাজের সম্ভাবনা নিয়ে আমরা আলাপ তুলি না কেন, দেখা যাবে তাদের অধিকাংশই দেশীয় পরিসরে উৎসাহিত হয়েছেন তারেক মাসুদ, তানভীর মোকাম্মেল ও মোরশেদুল ইসলামদের চলচ্চিত্রিক তৎপরতায়।
তারেক মাসুদ, তানভীর মোকাম্মেল ও মোরশেদুল ইসলামের কিছু চলচ্চিত্রকে আমি সময়ের বিচারে সেরা নির্মাণ ভেবে থাকি। আমার বিবেচনায় তারেক মাসুদের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘আদম সুরত’ (১৯৮৯), ‘মুক্তির গান’ (১৯৯৫) বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে স্থায়ী সম্পদ। এর বাইরে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদের কাহিনিচিত্র ‘মাটির ময়না’ (২০০২), ‘অন্তর্যাত্রা’ (২০০৬) ও ‘রানওয়ে’ (২০০৯) বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে আলোচিত শিল্পগুণসম্পন্ন নির্মাণের নজির হয়ে আছে।
তানভীর মোকাম্মেলের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘হুলিয়া’ (১৯৮৫), কাহিনিচিত্র ‘চিত্রা নদীর পারে’ (১৯৯৮) ও ‘লালন’ (২০০৪) বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এর বাইরে তানভীর মোকাম্মেল নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘তাজউদ্দীন : নিঃসঙ্গ সারথি’ (২০০৭), ‘সীমান্তরেখা’ (২০১৭) ও ‘১৯৭১’ (২০১১) বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে স্থায়ী সম্পদ ও দলিল হয়ে
থাকবে। চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলামের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আগামী’ (১৯৮৪), কাহিনিচিত্র ‘চাকা’ (১৯৯৩) এবং শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘দীপু নাম্বার টু’ (১৯৯৬) ও ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ (২০১১) বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
ইন্ডাস্ট্রির বাইরে থেকে আরও যারা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তাদের মাঝে চলচ্চিত্রকার আবু সাইয়ীদের ‘শঙ্খনাদ’ (২০০৪) বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এছাড়া কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’ (১৯৯৪), কহিনুর আক্তার সূচন্দার ‘হাজার বছর ধরে’ (২০০৫), তৌকীর আহমেদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কাহিনিচিত্র ‘জয়যাত্রা’ (২০০৪), গোলাম রাব্বানী বিপ্লবের কাহিনিচিত্র ‘স্বপ্নডানায়’ (২০০৭) এবং নাসির উদ্দীন ইউসুফ নির্মিত চলচ্চিত্র ‘আলফা’ (২০১৮) উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র চিরকাল অবহেলিত হয়ে এসেছে। চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির কাহিনিচিত্রের বিনোদনের বাতাসার মোহ ও মায়ায় চলচ্চিত্রের এই শক্তিশালী ধরনটি জনপ্রিয় হতে পারেনি। তথাপি বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র কিন্তু একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। যার নাম ‘স্টপ জেনোসাইড’।
সামগ্রিকভাবে প্রামাণ্যচিত্র জনপ্রিয় না হলেও তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘মুক্তির গান’-এর দেশব্যাপী প্রদর্শনী ও জনপ্রিয়তায় নির্মাতাদের মাঝে বাংলাদেশে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের আগ্রহ ও উৎসাহ সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে চলচ্চিত্রকার মানজারে হাসীন মুরাদ, নির্মাতা ইয়াসমিন কবির, সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল, ফৌজিয়া খান, শাহীন দিল রিয়াজ ও মোল্লা সাগর নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
ইয়াসমিন কবির নির্মিত ‘স্বাধীনতা’ (২০০৩) ও ‘পরবাসী মন আমার’ (২০০১) বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আলোচিত নির্মাণ। এছাড়া সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল নির্মিত ‘ঝলমলিয়া’ (২০১৬) এবং মোল্লা সাগর নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘দুধ কয়লা’ (২০০৬) ও ‘সাইরেন’ (২০০৮) গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাজের মধ্যে আশাজাগানিয়া কাজ করেছেন কামার আহমদ সায়মন, আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ। কামার আহমদ সায়মনের ‘শুনতে কি পাও’ (২০১২) এবং আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ (২০১৬) ও ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ (২০২১) এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র।
এছাড়া এই সময়ে বাংলাদেশের অনেক তরুণ নির্মাতা চলচ্চিত্র নির্মাণে তৎপর রয়েছেন। আশা করা যায় চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং চলচ্চিত্র বিপণনে অনলাইনভিত্তিক গতিশীলতা এই তৎপরতাকে আরও শক্তিশালী করবে।
দেশের চলচ্চিত্র নির্মাণ তৎপরতা আজ আর ঢাকার কারওয়ান বাজারকেন্দ্রিক নয়। আজ বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণের তৎপরতা ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে চলছে। এই তৎপরতা আশাবাদী করে তোলে। কিন্তু এই আশার আবাদ তখনই সফল হবে যখন আমরা এই বিপুল তরুণের চলচ্চিত্রযাত্রাকে সহজ ও অবাধ করতে সক্ষম হব। আগামীর চলচ্চিত্রযাত্রাকে সহনীয় ও অবাধ করতে হলে আমাদের আলাপ তুলতে হবে কী কী বিষয় আমাদের যাত্রাকে কঠিন ও জটিল করে তোলে। কী কী প্রতিবন্ধকতা আমাদের যাত্রাকে সীমাবদ্ধ ও সংকুচিত করে দেয়। আর এ আলাপ দিয়েই আজকের আলোচনার সমাপ্তিতে পৌঁছাব।
ছয়
গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রধান সংকট ছিল দুটি। একটি হলো চলচ্চিত্র শিক্ষার ব্যবস্থা না করে বিএফডিসি নামক রাষ্ট্রায়ত্ত চলচ্চিত্র নির্মাণ কারখানা চালু করা। অন্যটি হলো চলচ্চিত্রচর্চায় দেশব্যাপী কোনো প্রকার প্রণোদনার ব্যবস্থা না করে চলচ্চিত্র দমনে তৎপর হওয়া। ফলে আজও বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের কোনো প্রকার সামাজিকায়ন সম্ভব হয়নি।
চলচ্চিত্র শিক্ষা ছাড়া চলচ্চিত্র নির্মাণ-বিতরণ ও প্রদর্শন অন্ধের হস্তীদর্শনের মতো সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি করে। অন্যদিকে চলচ্চিত্রের সামাজিকায়ন না হওয়ার কারণে ‘চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট কোনো পেশা’ আমাদের সমাজে না পেয়েছে আদর আর না পেয়েছে সমাদর। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট কাজকে যদি কোনো সমাজ সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয় তবে সে সমাজে চলচ্চিত্রের বিকাশ কীভাবে সম্ভব?
কথা হলো এ দুটি কাজে রাতারাতি উন্নতি করার সম্ভাবনাও নেই। চলচ্চিত্র শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে প্রধান সংকট হলো বাংলাদেশে গুণী চলচ্চিত্র শিক্ষক প্রায় নেই বললেই চলে। একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিক্ষক হিসেবে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের চলচ্চিত্র শিক্ষা বিষয়ক তৎপরতার সম্মুখভাগে ছিলেন চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির, চলচ্চিত্রকার বাদল রহমান, চলচ্চিত্রকার সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী, আলোকচিত্রশিল্পী ও সিনেমাটোগ্রাফার আনোয়ার হোসেন, চলচ্চিত্র সম্পাদক সাইদুল আনাম টুটুল, শিল্প-নির্দেশক মহিউদ্দিন ফারুকের মতো গুণী মানুষজন। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মে এমন গুণী চলচ্চিত্র শিক্ষক আজ কোথায়?
স্বাধীনতার ৫০ বছর পর চাইলে আজ বাংলাদেশ সরকার চলচ্চিত্র শিক্ষায় ও চলচ্চিত্র সংস্কৃতির সামাজিকায়নে মনোযোগ দিতেই পারে। দেয়া উচিতও। কিন্তু চলচ্চিত্র শিক্ষায় আজ মনোযোগ দিলেই আগামীকাল তার ফল লাভ হবে না। গুণী চলচ্চিত্র শিক্ষকের অভাবে চলচ্চিত্রের শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ অসফল এবং অসম্পূর্ণ থেকে যেতে বাধ্য।
এই সংকট মোকাবিলায় আমাদের যেমন দেশ ও বিদেশের গুণী শিক্ষকদের বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে, তেমনি গুরুত্ব দিতে হবে চলচ্চিত্র শিক্ষার পরিবেশ ও বিস্তৃতিকে।
চলচ্চিত্র শিক্ষাকে যদি দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া যায় তবে দেশের আনাচ-কানাচ হতে প্রতিভাবান তরুণদের উত্থান খুব সহজেই হতে পারবে। আর এই কাজটি আরও সহজ ও অবাধ তখনই হবে যখন চলচ্চিত্র সংস্কৃতির সামাজিকায়ন সম্ভব করে তোলা যাবে। চলচ্চিত্রের সামাজিকায়নের জন্য চলচ্চিত্রচর্চা, চলচ্চিত্র উৎসব, চলচ্চিত্র বিষয়ক সিরিয়াস পত্র-পত্রিকার বিস্তার অবাধ করতে হবে।
আর এ কাজে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ও সামাজিকভাবে ‘প্রণোদনা’ প্রদান করতে হবে। চলচ্চিত্র কেবলমাত্র বছরে একবার ৭/৮ দিনের ‘উৎসবভিত্তিক’ তৎপরতা নয়। এটি একটি শিল্প এবং এই শিল্পের চর্চা প্রাত্যহিক হওয়া জরুরি। চলচ্চিত্রের সংগঠিত চর্চা ও তৎপরতা ছাড়া চলচ্চিত্রের সামাজিকায়ন অসম্ভব। আর এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্র তথা সরকারের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
চলচ্চিত্র শিক্ষার আধুনিক ও উপযুক্ত ব্যবস্থা দেশব্যাপী করা গেলে এবং চলচ্চিত্রচর্চায় নিয়োজিত চলচ্চিত্র সংসদসমূহকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতা যদি দেয়া সম্ভব হয়তবেই চলচ্চিত্র সংস্কৃতির প্রাথমিক সংকট দূরীভূত হবে।
প্রাথমিক সংকট দূর হওয়ার পর বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে চলচ্চিত্রের জন্য প্রণীত অনেকগুলো দমনমূলক আইন সম্পূর্ণ বিলোপ করতে হবে। ১৯১৮ সালের ‘সিনেমাটোগ্রাফ আইন’ নামের ব্রিটিশ আইনটি যেমন বিলুপ্ত করতে হবে তেমনি বিলুপ্ত করতে হবে পাকিস্তান আমলে প্রণীত ১৯৬৩ সালের ‘সেন্সরশিপ অব ফিল্মস অ্যাক্ট’-এর বর্ধিত ভার্সন ‘দ্য সেন্সরশিপ অব ফিল্মস (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট, ২০০৬’। বাতিল করতে হবে ‘চলচ্চিত্র সংসদ নিবন্ধন আইন ২০১১’।
এছাড়া বাংলাদেশে বিগত ৫০ বছরে যতগুলো চলচ্চিত্র বিষয়ক আইন প্রণীত হয়েছে তার সবগুলো আইনেরই প্রেরণার উৎস ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি দুটি আইন, যথা-‘সিনেমাটোগ্রাফ আইন’ এবং ‘সেন্সরশিপ অব ফিল্মস অ্যাক্ট’। ফলে বাংলাদেশ আমলে প্রণীত চলচ্চিত্র বিষয়ক সব আইনও বিলুপ্ত করতে হবে। এর স্থানে চলচ্চিত্রকে ‘কলা’ অর্থে শিল্প ও ‘পণ্য’ অর্থে ইন্ডাস্ট্রি বিবেচনায় নতুন একটি আইন প্রণয়ন করতে হবে।
যেখানে চলচ্চিত্রকার ও চলচ্চিত্রশিল্পী-কলাকুশলীদের সৃজনশীল স্বাধীনতাকে নিরঙ্কুশ করা হবে। বাংলাদেশে আইন দ্বারা আজ চলচ্চিত্রকর্মীরা বন্দি হয়ে আছেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র-সংস্কৃতিকে মুক্ত ও অবাধ করতে হলে আইন দিয়েই একে ‘মুক্ত ও স্বাধীন’ ঘোষণা করতে হবে। এ যদি না হয় তবে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আইন ও পাকিস্তানি আইনের ঘেরাটোপে বন্দি চলচ্চিত্র বাংলাদেশে আজও ‘মুক্ত’ নয়, আগামীকালও থাকবে না।
চলচ্চিত্র-সংস্কৃতিকে আইনগতভাবে ‘মুক্ত ও স্বাধীন’ না করে যতই চলচ্চিত্র শিক্ষার ব্যবস্থা হোক তাতে সৃজনশীল চলচ্চিত্র নির্মাণ অসম্ভবই রয়ে যাবে। আমার বিবেচনায় আজ বাংলাদেশের সব চলচ্চিত্রকর্মীকে নিজেদের চলচ্চিত্রের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে হবে। এ হবে চলচ্চিত্রের ‘মুক্তির যুদ্ধ’। একটি জনযুদ্ধে জয়ী দেশের মানুষ কখনো এসব ঔপনিবেশিক আইনের শৃঙ্খলে বন্দি থাকতে পারে না। অথচ গত পঞ্চাশ বছর ধরে এই বন্দিত্ব চলছে। আজও এর কোনো মীমাংসা হয়নি।
আশার কথা হলো, বাংলাদেশের তরুণ চলচ্চিত্রকর্মীরা একসময় নিজেদের সৃজনশীল স্বাধীনতার জন্য ‘বিকল্প’ পথের ঘোষণা দিয়েছিলেন। আজ এই নতুন শতকে এসে বাংলাদেশের তরুণরা চলচ্চিত্রে ‘স্বাধীনতা’র ডাক দিয়েছেন। একসময় ‘বিকল্পধারার চলচ্চিত্র’ আন্দোলন হয়েছে বাংলাদেশে। আজ বাংলাদেশে ‘স্বাধীন চলচ্চিত্র আন্দোলন’ শুরু হয়েছে।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসে এই ‘স্বাধীন চলচ্চিত্র’ আন্দোলনের আহ্বান করে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সাবালকত্বের পথে হাঁটার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করা যায়। কেননা মানুষ তখনই সাবালক হয় যখন সে নিজের মতে আস্থাশীল হয়ে নিজের পথে হাঁটতে শুরু করে। বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলনকে আমি বাংলার অভিমানী কিশোরদের নিজেদের পৃথক হয়ে পথচলার আন্দোলন হিসেবে দেখি। একটি জাতির কৈশোরে প্রবল প্রতাপশালী চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি আর স্বৈরশাসনের কবলে থাকা দেশের শাসনযন্ত্রের বিরুদ্ধে তখন ‘বিকল্প’ হওয়ার চেষ্টাই ছিল জরুরি ও সঠিক পথ।
এখন সময় অনেকটা পার হয়েছে। চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির পূর্বেকার প্রবল প্রতাপ আর অবশিষ্ট নেই। দেশের শাসনযন্ত্র যদিও আজ পুরোপুরি গণমানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই। তবু আজ বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত সুবিধা দেশের মানুষকে নিজেদের সাংস্কৃতিক মুক্তির প্রশ্নে সক্রিয় হতে সাহস ও শক্তি প্রদান করছে।
এ কারণেই আজ ‘স্বাধীন চলচ্চিত্র আন্দোলন’কে আমি নিজের দেশের মাটি, মানুষ ও প্রকৃতির মাঝে ‘স্বাধীন’ভাবে বিরাজমান হওয়ার আকাক্সক্ষা হিসেবে দেখছি। আর এই কারণেই এই আন্দোলনকে আমি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সাবালকত্বের পথে হাঁটার সঙ্গে চিহ্নিত করছি।
৫০ বছর আগে একটি দেশ জনযুদ্ধ করে নিজেদের মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। সেই দেশটি আজও আমাদের প্রাণে ‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরি, স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’। আমরা আমাদের স্মৃতির অতল জলে ডুব দিয়ে খুঁজে আনি আমাদের যা কিছু স্মরণীয়। এই স্মৃতি আমাদের সম্পদ ও শক্তি। স্মৃতির এই সম্পদ দিয়ে আমরা আমাদের শক্তিতে ‘আগামী’ নির্মাণে প্রবৃত্ত হব। যদিও আগামী আমাদের সামনে এখনো ‘স্বপ্ন’ হয়েই বিরাজ করছে।
সাত
আজ হতে আরও ২৫ বছর পরে বাংলাদেশ যখন ৭৫তম জয়ন্তী উদযাপন করবে। তখন আমরা কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই?
নিশ্চয়ই আমরা বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিকশিত হতে চাই। উন্নয়ন চাই। কিন্তু এ উন্নয়ন যদি কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয় তবে তা আবর্জনা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের মন ও মননে আমাদের বিকাশ প্রয়োজন। সংস্কৃতি সেই মন ও মননে বিকাশের একমাত্র পথ। সংস্কৃতির অপরাপর মাধ্যমের মতো যদি আমরা চলচ্চিত্র সংস্কৃতির বিকাশও চাই তবে আমাদের অতীতের সামষ্টিক ব্যর্থতা আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যক্তিক সাফল্যের স্মৃতি হতে শিক্ষা নিয়ে আমাদের আগামীর ‘মুক্ত ও স্বাধীন’ চলচ্চিত্র সংস্কৃতির স্বপ্ন বাস্তবায়নে শপথ নেয়া জরুরি।
গত পঞ্চাশ বছর ধরেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংস্কৃতি আইনগতভাবে ও সামাজিকভাবে ‘বন্দি’ হয়ে আছে। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছরের এই ক্ষণে আমাদের এই ‘বন্দিত্ব’কে বিসর্জন দেয়া ছাড়া বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংস্কৃতির ‘স্বাধীনতা’ অর্জন অসম্ভব। দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরের এই আনন্দঘন মুহূর্তে তাই চলচ্চিত্র সংস্কৃতির স্বাধীনতার ডাক দেয়াই যথার্থ ও একমাত্র জরুরি চলচ্চিত্রিক তৎপরতা হোক।
লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও সংগঠক