Logo
×

Follow Us

বিনোদন

হলিউডের লেখক-শিল্পীরা কেন ধর্মঘটে

Icon

অনিন্দ্য আরিফ

প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২৩, ১৫:৪৩

হলিউডের লেখক-শিল্পীরা কেন ধর্মঘটে

ছবি: সংগৃহীত

রোবট বা যন্ত্রের দখলে চলে যাওয়া ভবিষ্যৎ কাল্পনিক পৃথিবী নিয়ে অনেক বছর ধরেই গল্প লিখে আসছেন হলিউডের চিত্রনাট্যকাররা। এবার তারাই যন্ত্রের কাছে নিজেদের চাকরি হারানোর শঙ্কায় পড়েছেন। প্রতিবাদে শুরু করেছেন ধর্মঘটও। সংকটটা তীব্র হয়েছে করোনা ভাইরাসের সময়ে। এই সময়ে ব্রডকাস্ট টেলিভিশনের বদলে ওটিটি স্ট্রিমিংয়ের জনপ্রিয়তা হু-হু করে বাড়তে থাকে।

দ্রুত বেড়ে ওঠা স্ট্রিমিং সার্ভিসের জন্য ন্যায্য পারিশ্রমিক পাচ্ছে না চিত্রনাট্যকাররা। এমনকি শিল্পী থেকে শুরু করে অন্য কলাকুশলীরাও পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। 

হলিউডে চিত্রনাট্যকারদের আয়কে ‘রেসিডুয়ালস’ বলা হয়ে থাকে। এই বিষয়টি কী? আগে টিভি শোর চিত্রনাট্য লিখে সম্মানীর সঙ্গে ‘উপরি’ জুটত। ডিভিডি রাইটস থেকে শুরু করে শোর পুনঃপ্রচারের আয়ে ভাগ পেতেন লেখকরা। এটাই রেসিডুয়ালস আয়। কিন্তু এখন নেটফ্লিক্স, ডিজনি প্লাস, হটস্টারের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো তাদের ভিউয়ের সংখ্যা প্রকাশ করে না। ফলে লেখকরা একটি নির্দিষ্ট পারিশ্রমিক পান, বাড়তি কিছু পান না।

এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের সিনেমা ও ফিল্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চিত্রনাট্যকার এবং অন্য কলাকুশলীদের কাজের বিষয়টি অনিয়মিত, চুক্তিভিত্তিক এবং নিম্ন মজুরির। দ্য স্ক্রিন অ্যাক্টর গিল্ডের (সেগ-এফটিআরএ) অন্তর্ভুক্ত অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বছরে স্বাস্থ্য-বীমার জন্য প্রয়োজনীয় ২৬ হাজার ডলারই আয় করতে পারেন না। তার ওপর এখন চলমান অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে এই ‘রেসিডুয়ালস’ আয়ের পথ বন্ধ হওয়ায় তারা চরম আয় সংকটে পড়েছেন। পাশাপাশি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এআইয়ের উত্থান তাদের আয়ে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো প্রভাব ফেলেছে। তারা মনে করছেন এই এআইয়ের কারণে তাদের চাকরিচ্যুতি ঘটতে পারে। 

তারা কেমন শঙ্কায় আছেন, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ‘এনসিআইএস : লস অ্যাঞ্জেলেস’, ‘দ্য টার্মিনাল লিস্ট’-এ ছোট চরিত্র করা ৪৮ বছর বয়সী শন ল্যাংয়ের মন্তব্যে, রেসিডুয়ালই দুই প্রজেক্টের মাঝের সময়টা আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। একের পর এক প্রজেক্ট করছেন- আমাদের মতো অনেকেই এমন সৌভাগ্যবান নন। রেসিডুয়ালসই তাদের খাবার জোগায়, সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে সাহায্য করে। ফলে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

চলচ্চিত্রের কাহিনি রচয়িতারাও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের বিষয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। চিত্রনাট্যকার ওয়ারেন লেইট মনে করেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফলে সামনের দিনে প্রথম খসড়ার বদলে দ্বিতীয় খসড়া তৈরির জন্য চিত্রনাট্যকারদের ভাড়া করবে প্রযোজনা সংস্থা। যে কারণে তাদের কম অর্থ দেওয়া হবে। এ রকম উদ্বিগ্নতা থেকে গত মে মাস থেকে টানা ১১ সপ্তাহ ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছে ফিল্ম ও টেলিভিশন লেখকদের সংঘ দ্য রাইটার্স গিল্ড অব আমেরিকা (ডব্লিউজিএ)। এর আগে সর্বশেষ হলিউডে ধর্মঘট হয়েছিল ২০০৭ সালে। বেতন ও অন্যান্য ইস্যু নিয়ে ১০০ দিন পর্যন্ত চলা সেই ধর্মঘটের ফলে ক্যালিফোর্নিয়ার অর্থনীতিতে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষতি হয়েছিল। এর ১৫ বছর পর আবারও ধর্মঘটের মুখে পড়েছে হলিউড। এবারে হলিউডের ১১ হাজারের বেশি টিভি ও চলচ্চিত্র লেখকের সমর্থনে এই ধর্মঘট চলমান রয়েছে। 

লেখকদের পর হলিউডের শিল্পীরাও ধর্মঘটে যোগ দিতে যাচ্ছেন। লেখকদের চলমান ধর্মঘটের মধ্যে পারিশ্রমিক বাড়ানোসহ বেশ কিছু দাবি নিয়ে নেটফ্লিক্স, ডিজনিসহ হলিউডের শীর্ষ স্টুডিওগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসেছিল হলিউডের শিল্পীদের সংগঠন সেগ-এফটিআরএ। কিন্তু আলোচনা তেমন ফলপ্রসূ না হওয়ায় এখন তারাও আগামী ১০ আগস্ট থেকে ধর্মঘটে শামিল হতে যাচ্ছে। 

লেখকদের সঙ্গে শিল্পীরা ধর্মঘটে নামলে ৬৩ বছর পর লেখক ও শিল্পীদের ধর্মঘটের মুখে পড়বে হলিউড। এটা হলে রিয়েলিটি শো, অ্যানিমেশন ও টক শো হয়তো চালানো যাবে; কিন্তু এমি অ্যাওয়ার্ডসের মতো বড় অনুষ্ঠান ঝুঁকিতে পড়বে। মুক্তির অপেক্ষায় থাকা জনপ্রিয় সিরিজ সিক্যুয়েল বা বহুল প্রতীক্ষিত সিনেমা মুক্তিও বাতিল হতে পারে। আর তাতে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতিতে পড়বে হলিউড। লেখকরা ১১ সপ্তাহ ধরে তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে ধর্মঘট করে আসছেন, অভিনয়শিল্পীরা চাইছেন বেশি পারিশ্রমিক, যাতে তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের নিশ্চয়তা থাকে। ইতোমধ্যে শতাধিক বড় তারকা খোলা চিঠিতে জানিয়েছেন, গ্রহণযোগ্য সমাধান না হলে তারা ধর্মঘটে যেতে প্রস্তুত। এই তারকাদের মধ্যে আছেন মেরিল স্ট্রিপ, জেনিফার লরেন্সের মতো অস্কারজয়ী তারকারা। ভবিষ্যতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সম্ভাব্য ব্যবহারের ফলে যেন ক্ষতির মুখোমুখি না হয়, সে বিষয়েও নিশ্চয়তা চান তারা।

যুক্তরাষ্ট্রের কর্মজীবী অনেক মানুষের কাছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন আশঙ্কা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন বলছে, এলএলএমএসের ভবিষ্যৎ গতিপথ খতিয়ে দেখা হয়েছে। এক দশক আগেই আধুনিক এআই সিস্টেমের ঢেউ শুরু হয়েছিল। ওই সময় ছবি শনাক্ত বা বার্তা অনুবাদ করতে পারত এটি। এখন এআই আরও উন্নত হয়েছে। একে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। অনলাইনের বিশাল তথ্যভাণ্ডার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আরও উন্নত হয়ে উঠতে পারে এই সিস্টেম। গত বছরের নভেম্বরে চ্যাটজিপিটি উন্মুক্ত হওয়ার পর থেকে এর সক্ষমতা সম্পর্কে ইতোমধ্যে মানুষের ধারণা জন্মেছে। চ্যাটজিপিটি উন্মুক্ত হওয়ার পর এক সপ্তাহের মধ্যেই ১০ লাখের বেশি মানুষ এটি ব্যবহার করেন। দুই মাসে ১০ কোটি ব্যবহারকারী এটি ব্যবহার করেন। তবে সিনেমার লেখক শিল্পীদের মতো অনেকেই এর ব্যবহারে নিজেদের জীবিকা হারানোর ভয়ে উদ্বিগ্নও রয়েছেন। 

অন্যান্য সেক্টরের মতো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হলিউডের চলচ্চিত্রেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বেড়েই চলেছে। প্রবীণ শিল্পীদের মুখের বলিরেখা মুছে দিতে সহায়তা করছে এআই। অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রকে বাস্তবের মতো করে তুলে ধরছে, এমনকি চিত্রনাট্য তৈরিতেও এআইয়ের পরীক্ষামূলক ব্যবহার চলছে।

তাই এখন চিত্রনাট্যকারদের ইউনিয়ন দাবি তুলেছে, চ্যাটজিপিটির মতো কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি করে দেওয়া রচনাকে ‘সাহিত্য উপকরণ’ বা মূল উপকরণ হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করা যাবে না। অর্থাৎ এ ধরনের লেখা যদি চিত্রনাট্যকারকে দেওয়া হয়, এজন্য তার মজুরি কমানো যাবে না। সেই সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে দক্ষ করে তোলার কাজে মানুষের রচিত বিদ্যমান চিত্রনাট্য ব্যবহার না করারও দাবি তুলেছেন তারা। 

একসময় মেশিনের ব্যবহার কীভাবে শ্রমজীবী মানুষের যন্ত্রণার কারণ হয়ে উঠেছিল, তার মর্মভেদী বর্ণনা আমরা শুনছিলাম আমেরিকান লোকগাথার কিংবদন্তি জন হেনরিকে নিয়ে গাওয়া হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গণসংগীতে। আজ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার আবারও কর্মজীবী মানুষকে একই হৃদয়বিদারক পরিণতি নেওয়ার শঙ্কা তৈরি করছে। যে শঙ্কা থেকে মুক্ত হতে পারছেন না হলিউডের চিত্রনাট্যকার ও শিল্পীরাও। তাই আজ তারা অন্য শ্রমজীবী এবং কর্মজীবীদের মতো ধর্মঘটে শামিল হয়ে নিজেদের জীবিকা বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫