
‘পারাপার’ নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসবে সোমবার (৯ অক্টোবর) এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ হবে নাটক পারাপার। এটি প্রযোজনা করেছে দেশ নাটক।
নির্দেশক নাট্যকার মাসুম রেজা নাটকের পটভূমি সম্পর্কে বলেন, মৃত্যু ছাড়া মানুষ আর কোনো নিশ্চিত গন্তব্য জানেনা। জীবনের অলি গলিও অচেনা তার। জানেনা নিজের ভেতরে সে কতটা নিষ্ঠুরতা বয়ে বেড়ায় অথবা কতটা কোমলতা। মানুষ বেঁচে থাকার জন্যে যে জীবিকা করে বা মনের টানে যে ভালোবাসা তার হৃদয়ের দুকূল ভাসিয়ে দেয় তা সরাসরি প্রভাব ফেলে তার সহজাত স্বভাবের উপর। মানুষ বদলে যায়। পারাপার নাটকের পরতে পরতে চলেছে এই বদলে যাওয়া মানুষের সুলুক সন্ধান। প্রেম মানুষের মনে এক তাড়না তৈরি হয়, এমন কী জীবনের মূল্য চুকিয়ে তার প্রেমের নিরাপদ আশ্রয় নির্মাণ করতে চায় সে। যেমন পারাপার নাটকে চিনু গায়েন ভালোবেসেছিলো মাঞ্জেলাকে। সে ভালোবাসার এমন গভীরতা যে অদেখার দিনে চিনু কল্পনায় যে মাঞ্জেলাকে দেখে, সে যেনো শরীরী মাঞ্জেলার চেয়েও জীবন্ত। আর মাঞ্জেলা চিনুর জন্যে যে পথ চেয়ে থাকে সে পথে প্রতিদিন চিনু ফেরে, না ফেরার প্রাত্যহিকতায়। তাদের চার বছরের বিরহকাতর প্রেম বেঁচে থাকে অলৌকিক অভিসারে। চিনু গায়েন তার জীবন বাস্তবতায় জীবিকার নিরীখে যে জীবন যাপন করে সে জীবন চিনুর বিপরীতে আরেক চিনু। যে চিনুকে চিনু নিজেও চেনেনা কিন্তু বয়ে বেড়ায়, ধারণকরে। শিল্পের আড়ালে সে তার অন্তরজাত শকুন লুকায়। শিল্প ভাঙ্গিয়ে সে বাণিজ্য করে। সে বাণিজ্যের পণ্য নারী। বিবাহের আবরণে সীমান্তের এপার ওপার। পারাপার নাটকে চিনুর লক্ষ্যে পরিণত হয় এক গ্রাম্য বালিকা জোসনা। চিনুর কণ্ঠের সুর ও সহজাত আকর্ষণ জোসনাকে আকৃষ্ট করে।
তিনি বলেন, জোসনার মন নিমেষেই আত্মসমর্পন করে চিনুকে। তাদের বিবাহ হয়। চিনুর কাছে সে বিবাহের আরেকনাম পেশাগত সাফল্য আর জোসনার কাছে তা অভাবিত প্রাপ্তি। সীমান্ত পেরিয়ে কলকাতায় এক আশ্চর্য সুন্দর জীবনের কল্পনা নিয়ে জোসনা চিনুর সাথে চলে বেনাপোলের উদ্দেশ্যে। সীমান্তের চোরাই পথ বন্ধ হয় বিবিধ কারণে। তখন রশীদ কোম্পানির পান্থশালায় চলে চোরাই পথের দ্বার উন্মোচনের অপেক্ষা। এই অপেক্ষার ভেতরে হঠাৎই চিনুর বাণিজ্য চিন্তা পাশ ফিরে শোয়। যখন সে দেখে তার প্রকৃত প্রেম মাঞ্জেলাও চুড়ি বুড়ির হাত ধরে পাচার হয়ে যাচ্ছে সীমান্তের ওপারে। তখন জীবিকা ও প্রেমিকার অবশ্যম্ভাবি দ্বন্দ্ব পারাপার নাটকের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। চিনুর সামনে তখন জোসনাকেও পারে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টা প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে যায়। জোসনা তার জীবিকা, মাঞ্জেলা তার মানসী। জোসনাকে সে ওপারে নিয়ে বাণিজ্য করবে আর মাঞ্জেলাকে সে যেতে দেবে না।
তিনি বলেন, দ্বিখণ্ডিত চিনু গায়েনের চেহারায় তখন শিল্পী ও শকুনের সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়। শিল্পের ফড়িয়া রশীদ কোম্পানির মুখোশও খসে পড়ে। তার ভেতরের শকুনও প্রকাশিত হয়। জোসনা, মাঞ্জেলা, চিনু গায়েন ও রশীদ কোম্পানি। চতুর্ভূজ সংকটে দোল খায় চারজনের জীবন। পারাপার নাটকে এই চতুর্ভূজ সংকট তৈরি করে আমি জীবনের কিছু মৌলিক প্রশ্নকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি, উত্তর দিইনি। পারাপারে বাস করা মানুষগুলোর যাপিত জীবন থেকেই সব প্রশ্নেরউত্তর মিলবে বলে আমার বিশ্বাস।
পারাপার নির্দেশনা দিচ্ছেন ফাহিম মালেক ইভান। তিনি বলেন, এক জীবনে নিজেকে নানা রঙে প্রকাশ করে মানুষ। একের মধ্যে রূপ আর অরূপের সন্ধান মেলে। জীবনের হাজার বাঁকে অসংখ্য ঘটনার প্রেক্ষিতে ঘটে এই রূপান্তর। সবকিছু রঙিন করে দেখা ভাবোখালী গ্রামের সরল মানুষগুলোও এই রূপান্তরের বাইরে নয়। জীবন ও জীবিকার তাগিদে তারাও খোলস পাল্টায়। সবকিছু নিয়েই পারাপার নাটকের ভাবোখালী নানা বর্ণে বর্ণিত রঙিন এক গ্রাম। নাট্যকার মাসুম রেজার লেখনীতে এই চিত্র যেন আরো রঙিন হয়ে ফুটে উঠেছে। পারাপারে লোক সমাজের কথাই যেন ব্যক্ত হয়েছে তাই লোক ঐতিহ্যের নানাদিক তুলে ধরা হয়েছে। ভাবোখালীর নানা রঙ দৃশ্যকাব্য হয়ে পাদ প্রদীপের নীচে উদ্ভাসিত হবে এই প্রত্যাশায় নাট্যকার মাসুম রেজা তার এই সৃষ্টি পরম মমতায় যেন আমার হাতে অর্পণ করেছেন। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা। দেশ নাটকের সাথে প্রায় দুই যুগ ধরে সম্পৃক্ত থাকলেও নির্দেশনার পথে এটি প্রথম যাত্রা। আমার প্রতি আস্থা রাখার জন্য দেশ নাটকের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
দেশ নাটক বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় নাট্যদল। ১৯৮৭ সালের ১ জুলাই থেকে দেশ নাটকের যাত্রা শুরু। গত ৩৫ বছরে দেশ নাটক মঞ্চে এনেছে ২৪টি প্রযোজনা ৫০০ এর বেশি মঞ্চায়ন বাংলাদেশসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রদর্শিত হয়েছে। তিন দশকের অধিক সময় ধরে বাংলাদেশের থিয়েটার আন্দোলন ও মঞ্চ নাটকচর্চায় দেশ নাটক একটি সুপরিচিত মূলধারার নাট্য সংগঠন এবং বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এর সক্রিয় সদস্য। এ ছাড়াও দেশ নাটক বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রুপ থিয়েটারে নাট্য নির্দেশনা, থিয়েটার ও অভিনয় বিষয়ক কর্মশালা পরিচালনা, উৎসব আয়োজন এবং সাংস্কৃতিক কর্মসূচি সমন্বয়ে উল্লেখযোগ্য অবদানের দাবিদার। বর্তমান সময়ে জাতীয় পর্যায়ে মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র ক্ষেত্রে সফল অভিনেতা-অভিনেত্রী, স্বীকৃত নাট্যকার ও নাট্য নির্দেশক ও সংগঠক তৈরি এবংবাংলাদেশে সুস্থধারার সংস্কৃতি চর্চার প্লাটফর্ম তৈরিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ দেশ নাটকের তিন দশক ব্যাপী নাট্যচর্চার একটি উল্লেযোগ্য অর্জন।
ফাহিম মালেক ইভান সম্পর্কে নির্দেশক নাট্যকার মাসুম রেজা বলেন, তার নির্দেশনার কাজ আমি মাঝে মাঝেই মহড়াতে উপস্থিত থেকে নিবিড়ভাবে দেখেছি।পারাপারে যে প্রশ্নগুলো আমি উত্থাপন করেছি ইভান তার চরিত্রাভিনেতাদের কাছ থেকে সে প্রশ্ন সমূহেরউত্তর বের করে নিয়েছেন নিপুন কৌশলে। পারাপারের অভিনয় শিল্পীরা তাঁদের মেধা ও পরিশ্রমের সবটুকু ঢেলে দিয়েছেন বলে পারাপার হয়ে উঠেছে অভিনয় সমৃদ্ধ একটি নাটক। এ নাটকের অনেক শিল্পীই প্রথমবারের মতো মঞ্চে উঠছেন বা বড় চরিত্র চিত্রন করছেন মঞ্চে। এ কৃতিত্বও ইভানের। ইভান অতি সুচারু রূপে সাজিয়েছেন পারাপারের প্রতিটা দৃশ্য। আমি তার ভেতরে এক ক্যারিসমেটিক নির্দেশককে দেখতে পেয়েছি। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি ইউসুফ হাসান অর্ককে যিনি এ নাটকের বেশ ক’টি গানে সুরারোপ করেছেন। যাঁরা সেট, লাইট, সংগীত, প্রপস, পোশাক ও পোস্টার পরিকল্পনা করেছেন তাঁদেরকে সবিশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। আমার দল দেশ নাটক-এর প্রতি আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি পারাপার নাটকটি মঞ্চে আনার সকল আয়োজন সম্পন্ন করার জন্য।
নাটকের অন্যান্য চরিত্রে যারা আছেন- মঞ্চে: ইব্রাহীম হোসাইন, কুদ্দুস মাখন, গোলাম মাহমুদ, আরিফ হক, অসীম কুমার নট্ট, কামাল আহমেদ, লেতুনজেরা, ইসমেত জেরিন বিনতে নিজাম, মাঈন হাসান, মায়াবী, কাজী লায়লা বিলকিস, সজীব বিশ্বাস, কাজী রাজু, নাজমুল আলম (লিমন), মাসুদ রানা সবুজ, সালাম শামীম, ব্রততি বিথু, দিনা চৌধুরী, মো: নাঈম হাসান, মো: সাজ্জাদ হোসাইন, মো: শুভ খান, শাহেদ নাজির হেডিস, ফাহিম মালেক ইভান।
নেপথ্যে
রচনা : মাসুম রেজা
নির্দেশনা :ফাহিম মালেক ইভান
নির্দেশনা সহকারী :আশরাফুল আশীষ
মঞ্চ :কাজী কোয়েল
পোশাক :সাজিয়া আফরিন
পোশাক সহযোগী :দিনা চৌধুরী
আলো :ফারুক খান টিটু
সুর : ইউসুফ হাসান অর্ক (নাড়াই ধরেছে ঘুড়ি, এই বানাকিরাস্তাদিয়া)
ফাহিম মালেক ইভান (কি চমৎকার দেখা গেল, তুমি জলে নিলে বাস, মানুষ ভাসে, চক্ষে কত জলরে বন্ধু)
অসীম কুমার নট্ট (মানুষ ভাসে), ইমামুর রশিদ (ঝলমল ঝলমল), কাজী নজরুল ইসলাম (ভুলি কেমনে)
পবন দাস বাউল (চঞ্চল মন)
সঙ্গীত :অসীম কুমার নট্ট, , ইমামুর রশিদ, ফাহিম মালেক ইভান
সঙ্গীত সহযোগী :অয়ন চৌধুরী, শাহেদ নাজির হেডিস, সজীব বিশ্বাস, কাজী রাজু, মায়াবী, সঞ্জয় বণকি
কোরিওগ্রাফি : ফেরদৌস হাসান, মৃন্ময়ী, পূজা
প্রপ্স :রাকিবুল ইসলাম রাসেল
প্রপস সহযোগী :তাওহীদা ইসলাম তানহা, গোলাম রাসুল নাবিদ
রূপসজ্জা :শুভাশিস তন্ময়
প্রমোশনাল ভিডিও :ক্লাসিক সরকার, ইসমত জেরীন, এহসান শুভ
পোস্টার ডিজাইন :চারু পিন্টু
অর্থ ব্যবস্থাপনা: নাজনীন হাসান চুমকি
প্রযোজনা অধিকর্তা :কাজী লায়লা বিলকিস
মিলনায়তন ব্যবস্থাপনা :সেলিনা শেলী,নাজনীন হাসান চুমকি, মেহনাজ পারভিন বনী, এহসানুল আজিজ বাবু, মামুন চৌধুরী রিপন, , আনিসুর রহমান বিপ্লব, হোসাইন নিরব, রোশেন শরিফ, ফিরোজ আলম।