Logo
×

Follow Us

বিনোদন

মিজোগুচি: বিপন্ন মানবতার ব্যথিত কথক

Icon

আশিক মাহামুদ

প্রকাশ: ২০ মে ২০২৪, ১৭:৩৭

মিজোগুচি: বিপন্ন মানবতার ব্যথিত কথক

কাইলি মিজোগুচি। ছবি: সংগৃহীত

চলচ্চিত্র-সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে জাপানের একটি আলাদা পরিচিতি গড়ে উঠেছে পৃথিবীর চলচ্চিত্র অনুরাগীদের কাছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে জাপানি সিনেমার জয়-জয়কার তাদের দীর্ঘ চলচ্চিত্র যাত্রা এবং সুদৃঢ় পরম্পরার কথাই মনে করিয়ে দেয়। তবে জাপানি চলচ্চিত্রের আজকের এই মর্যাদার আসন তৈরির পেছনে রয়েছে তাদের অজস্র গুণী চলচ্চিত্র নির্মাতার অবদান। একজন মেধাবী নির্মাতার শূন্যস্থানে দ্রুত এসে দাঁড়িয়ে গেছেন আরেক মেধাবী নির্মাতা। এই মেধাবী উত্তরাধিকার বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাদের প্রতিষ্ঠিত করেছে।

তবে এদের মধ্যে তিনজন কালজয়ী নির্মাতার নাম শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত হয়ে থাকে আলাদাভাবে- মিজোগুচি, ওযু এবং কুরোশাওয়া। জাপানি চলচ্চিত্রকে যদি একটি মানবদেহের ধড়- কাঠামোর সঙ্গে তুলনা করা হয় তাহলে মিজোগুচি, ওযু এবং কুরোশাওয়া হলেন সেই দেহ কাঠামোর অন্তর্গত চালিকা শক্তি বা পরমাত্মা।

কাইলি মিজোগুচি আলোচ্য তিন নির্মাতার মধ্যে প্রবীণতম। তার জন্ম ১৬ মে, ১৮৯৮ সালে। ৫৮ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে মিজোগুচি নির্মিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা নব্বইটির মতো, যার মধ্যে আছে বেশ কিছু নির্বাক চলচ্চিত্র। এই সংখ্যাই বলে দেয় মিজোগুচির কাজের জগৎ কত ব্যাপক এবং বিস্তৃত। তবে ওযু বা কুরোশাওয়া বিশ্ব চলচ্চিত্রের দরবারে নিজেদের যেভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন, মিজোগুচির ক্ষেত্রে পথটা মোটেও এতটা মসৃণ ছিল না। জীবদ্দশায় এই মেধাবী শিল্পীর প্রকৃত মূল্যায়ন হয়নি, এমনকি জাপানও এই অমূল্য রতনকে চিনেছে অনেক দেরিতে।

বস্তুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই পাশ্চাত্যের দর্শক-বোদ্ধারা পরিচিত হতে থাকেন জাপানি চলচ্চিত্রের অভূতপূর্ব সৌন্দর্যের সঙ্গে। এই সময়ে কুরোশাওয়া তার ‘রশোমন’ এবং ‘সেভেনথ সামুরাই’ দিয়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন পাশ্চাত্যের দর্শকদের কাছে। যদিও বহুদিন পর্যন্ত মিজোগুচি রয়ে গিয়েছিলেন আড়ালে, নিভৃতে। অবশ্য ততদিনে ‘উগেতসু’ (১৯৫৩) এবং ‘সানশো দ্যা বেইলিফ’ (১৯৫৪)-এর মতো কালজয়ী চলচ্চিত্রদ্বয় সৃষ্টি হয়ে গেছে তার  শৈল্পিক হাতের ছোঁয়ায়। ইউরোপে তার এই কাজগুলো সমাদৃত হলেও নিজ দেশ জাপানে দর্শক এবং সমালোচকদের কাছে তখনো তেমন একটা গ্রহণযোগ্যতা পেতে ব্যর্থ হন মিজোগুচি। মিজোগুচিকে নতুন করে আবিষ্কার করার কৃতিত্ব দেওয়া যেতে পারে-নুভেলবার্গ সিনেমা মুভমেন্টের অন্যতম প্রাণপুরুষ চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক আন্দ্রে বাঁজার ‘কাইয়ে দ্য’ সিনেমাকে। আন্দ্রে বাঁজা চলচ্চিত্রের ভাষা, নন্দনতত্ত্ব ইত্যাদি নানা বিষয়ে প্রায় ২৯০টি প্রবন্ধ রচনা করেন, যার সংকলিত রূপ হলো ‘কাইয়ে দু সিনেমা’ বা ‘কাকে বলে সিনেমা’। এখানে আন্দ্রে বাঁজা, মিজোগুচির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন তার শান্ত-সৌম্য-মিজোসীন নির্ভর নির্মাণ কুশলতার জন্য। বাঁজার সিনেমা দর্শনের অন্যতম বিষয় ছিল ‘মিজোসীন উইথ পারফেক্ট ব্লকিং’। আর এই দর্শনের প্রতিফলন পেয়েছিলেন তিনি মিজোগুচির নির্মাণ শৈলীতে। 

মিজোগুচির শিল্প দর্শনের মূল পাটাতন ছিল মানবিক বোধের উন্মেষ। একজন মানবিক শিল্পী হিসেবে তিনি তার সকল শিল্প কর্মেই আঁকতে চেয়েছেন মানুষের চিরন্তন দুঃখ-কষ্ট-হতাশা-বিচ্ছেদ কিংবা মিলনের গল্প। আর এই সব গল্প তিনি খুঁজে নিতেন জাপানের প্রচলিত লোকজ সাহিত্য বা পুরাণের ভাণ্ডার থেকে। তার চরিত্ররা কখনো উদ্বাস্তু, কখনো ছিন্নমূল, কখনোবা জীবন থেকে সব কিছু হারিয়ে ফেলা নিঃস্ব- অসহায় মানুষ। অস্তিত্বের লড়াইয়ে যারা প্রায়ই হেরে যায়, ঝরে পড়ে সবার অজান্তে ক্ষয়িষ্ণু নক্ষত্রের মতো দূর আকাশতলে।

জাপানের সামন্তীয় সমাজকে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি মিজোগুচির ক্যানভাসে, বিশেষ করে সামন্তীয় সমাজের নারীরা-যারা নানা ধরনের নিপীড়ন এবং অত্যাচারের শিকার হয়ে হারিয়ে গেছে নিভৃতে; কীভাবে তাদের নীরব ত্যাগের ফলে রক্ষা পেয়েছে একটি পরিবার বা তার সদস্যরা সেই ব্যথিত করুণ গল্পগুলোর মর্মস্পর্শী চিত্রায়ণ আমরা দেখতে পাই মিজোগুচির ক্যানভাসে।

মিজোগুচির ক্যামেরা সব সময় শান্ত- সৌম্য এক অভূতপূর্ব কাব্যময়তায় বলে যায় অপঠিত জীবনের আখ্যানগুলোকে। তার লং টেকের ব্যবহার-যেন অবধারিতভাবে স্থির করে দেয় সময়ের গতি প্রবাহকে, বিপন্ন মানুষের অস্তিত্ব সংকটের বোবা কান্নাকে চিত্রিত করে পরম মমতায়। সিনেমার ফ্রেমে ফ্রেমে জেগে ওঠে তার নিজস্ব ধ্রুপদ স্পর্শ, যা বহুমাত্রিক ও সর্বজনীন।

জাপানি নব তরঙ্গের অন্যতম প্রাণপুরুষ কেনজি মিজোগুচির ১২৬তম জন্মবার্ষিকীতে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি জাপানি সিনেমার এই দিকপালকে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫