
বাউল। ছবি- সংগৃহীত
শিরোনাম মোতাবেক বলতে গেলে বাউল মকদ্দস আলম উদাসী (১৩৫৪-১৪৩০ বঙ্গাব্দ) ভাইয়ের কথা দিয়ে লেখাটা শুরু করতে হয়। আমাকে দেওয়া শেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, বাউল সাধনা হলো গুরুমুখী বিদ্যা। এই লাইনে গুরুই সব। দীক্ষাগুরুর হাত ধরে আল্লাহর দর্শন লাভ করা যায়। কারণ এক ঘরেই তিনজনের বসত : আল্লাহ, রসুল আর গুরু। আলিফ, দাল, মিম অক্ষরে তার ভিতরে খেলা করে। আলিফ, দাল, মিমে আদম। মুর্শিদ বা গুরু আছেন আদম ছুরতে। উনাকে ভজলেই আমরা স্রোষ্টার দর্শন পাব।
বলতে বলতে উদাসী
ভাই একটু একটু মাথা নাড়িয়ে গাইতে শুরু করেছিলেন, ‘নামের লিঙ্গ, প্রেমের যোনি/সঙ্গমেতে হয় যে
শুনি,/গায়েবে ইলমে লে যোনি...’ মুর্শিদের মুখটা হলো নামের লিঙ্গ, শিষ্যের কর্ণ হলো যোনি। মুর্শিদের কথাটা যখন
শিষ্য কর্ণ দিয়ে শুনবে তখন তারা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের জগতে ভ্রমণ করবে। সুনামগঞ্জে
বাউল গানের আগে ছিল ‘হালতি গান’। বাড়ি থেকে একটু দূরে গাছগাছড়ার আড়ালে থাকত সেই
বিশেষ ঘরটা। যেখানে প্রতি বিষ্যুদবারে আল্লাহ-রসুল বিষয়ে গান, হালকা জিকির হতো। আশপাশের বাড়িগুলো থেকে
নারী-পুরুষরা
ওজুসহ মুর্শিদের ধ্যানে বসতো। গানের সুরে সুরে দেহ-মনের পাপ ক্ষয়ের জন্য তারা অঝোর
ধারায় বুক ভাসাত। উদাসী ভাই বলেছেন, সেই হালতি গান থেকেই বাউল গানের উদ্ভব ।
সুনামগঞ্জে,
হাওরের পরতে পরতে,
ধোঁয়া ধোঁয়া
গ্রামগুলোতে যে বাউলদের বসত। তাদের অধিকাংশই সংসারি। বাউল চেতনা ও সাধনার মাধ্যমে
তাঁরা মুর্শিদের সন্ধান করেন; কিন্তু চলন-বলন,
পোশাক-আশাকে, জীবন সংগ্রামে তারা আর দশজন গরিব
কৃষক-কামলা,
জেলে-মাঝি-মেস্তরি কিংবা
বউ-বাচ্চা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য হাওরপাড়ের একজন বাউল উপরের সবকয়টা কাজ পারে এবং
করে। ‘দিন আনে, দিন খায়’
হাওরপাড়ের বাউলদের চৌদ্দ আনা। সিদ্ধিটা তাদের চিন্তা ও ধর্ম-কর্মের অনুষঙ্গ। তারা
সিদ্ধিকে বলেন, ‘তামাক’। যাদের
সঙ্গে সারাদিন কাজ করেছেন সন্ধ্যায় তারা গোসল করে একটু চা-পানি খেয়ে একসঙ্গে
মিলবেন। তাদের বাপ-মায়ের মুর্শিদ ছিল, তারাও মুর্শিদের হাতে ধরে ভাবের পথে এসেছেন। কঠোর পরিশ্রমের পর সন্ধ্যাটা
কাটান নিজের কিংবা পির ভাইয়ের ঘরের বারান্দায়। ২/৩ জনেই ভাব জমে ওঠে। কথা খুব কম
হয়। যা ২/৪টা হবে তার উনিশ আনাই গভীর চিন্তার। এই যেমন আছিমপুরের সাবুল শাহ বলেন,
গরিবির মতো গরিবি যদি
করতা পারো, তাইলে ফকিরি
হাসিল হইব। পাশে বসা শফিক আলী মস্তান মোটা হাড়ের খাঁচাটা একটু নড়েচড়ে, কালো পাথর টাইপ চোখে-মুখে অদ্ভুত এক ঔজ্জ্বল্য
নিয়ে হয়তো বলবেন, খালি ফকির হইলে
হয় না, লোভ-কাম, বীর্য শাসন...। তারপরেই তিনি হয়তো দাড়ি-গোঁফের
আড়াল থেকে খুব স্বাভাবিক গলায় স্ত্রী-সঙ্গ বিষয়ে বলবেন : ‘মাসে এক, বছরে বারো, যে যত কমাইতে পার।’ তাই পরিবার পরিকল্পনা ছাড়াই
অধিকাংশ বাউলের পরিবার ছোট। তাদের কামনা-বাসনাও খুব সামান্য। অল্পে তুষ্ট এই
মানুষগুলোর সংসার জীবনে হা-হুতাশ খুব কম। তাদের আছে প্রকৃতির মতো অদৃশ্য শৃঙ্খলা ও
সাধনালব্ধ কঠিন বিশ্বাস।
হাওরপাড়ের বাউলের ঈদ আর দশজন বাঙালির ঈদ থেকে কিছুটা হলেও ভিন্ন। শান্তি ও সঙ্গপ্রিয় এই ভাবুকরা ঈদের দিন বিকালেই মিলিত হবেন আশপাশের কোনো নির্জন মাজারে কিংবা জাত-ভাইয়ের বাড়িতে। তারা সবাই কম-বেশি গাইতে পারেন এবং সব ধরনের যন্ত্র বাজাতে পারেন। তাই ঈদের দিন রাতে বাউল গানের আসর জমে উঠতে খুব বেশি দেরি হয় না।